গাঙ্গের ডাক

গাঙ্গের ডাক
– ও নন্তু আইজ তরে কেউ চিঠি দেয়নাই?
– না রাধা বু। কেন জিগাইলা এই কথা? তুমি না প্রতিদিন চিঠি লইয়া রাগ করো আর মোরে থাপ্পর দেও।(নন্তু)
– হ দেই তো আইজ দিতে পারতাছি না। তাই তো তরে জিগাইলাম।
– উমম… কত্তো সখ মোরে থাপ্পর দেওয়ার।
– কি রে রাধা পিরিতে পরলি নাহি।(কলি)
– না রে কলি। পিরিত করার কি কেউ আছে। মুই তো হিঁদুর বেটি। এই গায়ে মোর জাতের কেউ নাই রে।
– হ দেহিস সামলাইয়া চলিস। আবার মুসুলমান কাউরে চাইয়া বসিস না। এমনেই তো তগো এ গায়ে কেউ ভালা চোখে দেহে না।
– ঐ কলি ঐ…! তরে না কইছি এই হিঁদুয়ানির সাথে কথা কইবি না। (কলির বাবা)
(গ্রামটার নাম বীরপুর। পদ্মা নদীর পারে ছোট একটি গ্রাম। এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। হিন্দু পরিবার বলতে একটা পরিবারই আছে। সেটাই হলো রাধার পরিবার। রাধার বাবা আজ থেকে প্রায় সাত আট বছর আগে শহরে গিয়েছিল কাজের উদ্দেশ্যে। আজ পর্যন্ত সে ফেরেনি। কেউ বলে, সে নাকি মারা গিয়েছে। আবার কেউ বলে, শহরে গিয়ে সে নাকি আরেকটা নতুন সংসার পেতেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাধার মা একদম নিশ্চিত তার স্বামী নতুন আরেকটা সংসার পাততেই পারে না। অশিক্ষিত মানুষে ঘেরা এই গ্রামে রাধাদের অবস্থা একদম একঘরে ধরনের। তাদের সাথে না কেউ ভালোভাবে কথা বলে। না কেউ ভালো চোখে তাদের দেখে। কারণ একটাই তারা হিন্দু। পরিবারে রাধা আর তার মা ছাড়া কেউ নেই। ওর বাবা যখন গ্রাম ছেড়ে যায়, তখন ওর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। এখন ওর বয়স বিয়ের উপযুক্ত। দেখতেও সুন্দর। ওর মতো সুন্দরী গ্রামে নেই বললেই চলে। তাই গ্রামের মুসলিম বুড়ো থেকে শুরু করে যুবক পর্যন্ত তার দিকে কুদৃষ্টি দিতে পিছপা হয় না। কিন্তু রাধার মনে ঘোরাফেরা করে অন্য কেউ।)
– জানতাম রহিম ভাই তোমারে এই গাঙ্গের পাড়েই পামু। আইজ যে চিঠি দিলা না।
– আইজ দুই বছর হইলো তরে মুই চিঠি দেই। তুই তো জানস যেদিন তরে চান্দের আলোতে দেখবার ইছছা হয় সেইদিন মুই চিঠি দেই না।
– হ বুঝবার পারছি। হের লাইগাই তো আইলাম। হুনো আইজ তাড়াতাড়ি যাইতে হইবো। মা কইছে হে আইজ সালাম পাইকারের বাড়ি থেইকা তাড়াতাড়ি আইয়া পরবো।
– আইতে না আইতেই যাওনের খবর। যা অহনি। তর সাথে কথা নাই।
– আরে রাগ করতাছ কেন। আহো না এট্টু তোমার কান্ধে মাথাডা রাখি। (রহিমের হাত ধরে)
(রহিম সালাম পাইকারের ভাতিজা। সে মুসলিম। ও জানে রাধার সাথে তার সম্পর্কটা কেউ মেনে নেবে না। তবুও মনের কোন এক কোণায় রাধাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখে। পলকহীন দৃষ্টিতে রাধা তাকিয়ে আছে রহিমের দিকে। রাধাকে এই জ্যোৎস্নার আলোয় দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।)
– রাধা এমুন কইরা কি দেখতাছোস।
– চুপ রহিম ভাই। মোরে দেখবার দাও। কেন জানি আইজ তোমারে পরান ভইরা দেখবার মন চাইতাছে।
(দুজনেই নিরব। নৌকার উপর বসে রহিমের কাঁধে মাথা রেখেছে রাধা। নদীর পানি দেখছে দুজনেই।)
– জানো রহিম ভাই এই গাঙ্গের পানি না মোরে খুব ডাহে। মনে হয় মোর কত্তো আপন এই গাঙ্গ।
– কি কইতাছোস এইগুলা। খেপা হইছোস নাহি।
(রহিমের কথা শুনে রাধা হি হি করে হেসে উঠে। চারিদিকে তার হাসির শব্দের যেন প্রতিফলন হচ্ছে। অনেক কষ্টে হাসি থামায় সে। রহিম তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।)
– হ রহিম ভাই মুই খেপাই হইছি। তোমারে তো পামু না তাই নাহয় গাঙ্গেই নিজেরে ভাসাইয়া দিমু। (রাধার এই কথাটা বলার সাথে সাথেই তার মুখ চেপে ধরে রহিম।)
– খবরদার যদি এমুন কতা আর একবার কইছোস তয় তর আগে মুই গাঙ্গে ঝাপ দিমু।
– ছি ছি…! এমুন কতা কেউ কয়?(রহিমের মুখ চেপে ধরে বলে রাধা)
(দুজনের এভাবেই কাটে বেশ অনেকটা সময়। দুজনেই জানে সমাজে তাদের ভালোবাসার কোন গ্রহনযোগ্যতা নেই। তবুও একে অপরকে ভালোবাসে। সেই ভালোবাসায় নেই কোন ছলনা।)
– অনেক রাইত হইলো রাধা তুই অহন যা।
– আইজ কেন জানি তোমারে ছাইড়া যাইবার মন চাইতাছে না।
– চল আমি তরে বাড়ি দিয়া আহি।
– না রহিম ভাই। কেউ দেখলে মোরে এই গায়ে আর থুব না। মুই একাই যাইবার পামু। এতো রাইত হইলো মা এহনো আসে না ক্যা। মুই কি একবার যামু সালাম পাইকারের বাড়ি। একবার যাইয়ায় দেহি। (মনে মনে কথা গুলো বলতে বলতে সালাম পাইকারের বাড়ির দিকে এগুচ্ছিল রাধা)
– কাকি ও কাকি..! মায়ের কাম কি শ্যাষ হয়নাই।
– আ… মোর জ্বালা! কই, তর মায়ে কি যুবতী মাইয়া যে এই রাইতে আইছোস খুঁজবার। কাম হইলে এমনেই যাইবো। (ছালামের বউ)
– কে আইছে বউ? অহ…! রাধা সুন্দরী। বয় বয়, তর মায়ের কাম শ্যাষ হোক লইয়া যাইস।(খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ছালাম) (ছালাম পাইকার এই গ্রামের একজন মুরুব্বী। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও স্বভাবটা তার লুচুদের মতো। মেয়ে মানুষ দেখলেও কামুক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে।)
– মা সালাম পাইকারের বাড়ি কাম না করলে কি হয় না?
– হোন মাইয়ার কতা। তাইলে প্যাট চলবো কেমনে? তর ইস্কুলের বেতন দিমু কেমন কইরা?
– মুই পড়ুম না। তাও তুমি ওর বাড়িত কামে যাইবা না।
– তর বাপে যেইদিন আইবো হেইদিন থেইকা আর যামু না কামে।
– হাছা কইতাছো মা।
– হ হাছা।
– হে ভগবান, আব্বারে তাড়াতাড়ি গায়ে পাঠাইয়া দাও। (পরদিন সকালে রাধার মা গলা ছেড়ে দিয়ে কান্না শুরু করলো তার স্বামীর জন্য)
– হায় ভগবান। মোর স্বামী কি আর ফিইরা আইবো না। কই আছে কেমুন আছে কিছুই জানি না। তারে পাঠাইয়া দাও।
– মা ও মা কাইন্দো না তো। লও পেয়ারা খাও। (মায়ের হাতে পেয়ারা গুজে দিয়ে)
– মুই খামু না। তর বাপের জন্য মনডা কেমুন করতাছে।
– মা, তুমি এমনে কানলে কেমনে হইবো কও দেহি। আব্বায় খুব তাড়াতাড়ি আইবো মুই জানি।
– তুই হাছা কইতাছোস মা?
– হ গো হাছা। তোমার জন্যি নতুন শাড়িও আনবো। আর হে আইয়া যদি দ্যাহে তুমি এমুন কাইন্দা কাইন্দা চেহেরা খারাপ করছো হ্যার ভালা লাগবো, কও।
– না ভালা লাগবো না।
– তাইলে আর কাইন্দো না বুছছো।
– আইচ্ছা।
(কথাগুলো বলে রাধা ছুট দেয় স্কুলের দিকে এবার সে নবম শ্রেনীর ছাত্রী। রোজ রাস্তায় যাবার সময় তার পথ আটকায় সালাম পাইকার।)
– ঐ ছুড়ি ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা কই যাস?(ছালাম) (রাধা থমকে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায়। কোন উত্তর দেওয়ার সাহস পায় না।)
– ওস্তাদ, কাইল গাঙ্গের পাড়ে রহিমের সাথে পিরিত করবার গেছিল। (ছালামের কানে তার চ্যালা ফিসফিস করে বলল কথাটা)
– কস কি মোর ভাতিজা এই মাইয়ারে…! ছি… ছি…. ছি…! মোর মান ইজ্জত সব গেল।
– হোন ভাতিজা, তরে মেট্রিক পাশ করাইছি নিজের টেহা দিয়া। কাম ধান্দা না কইরা বইয়া বইয়া খাইলে চলবো? আইজ তুই শহরে যাবি। মোর শহরে যে দোকান আছে হেইডার কিছু কাম আছে। হেইগুলা দেখশোন করবি।
– ঠিক আছে চাচা। তয় কাইল গেলে হয় না?
– না আইজি যাইতে হইবো।
(রহিম আর কোন কথা বলার সাহস পায় না। সেখান থেকে নিজের বাড়িতে গিতে চিঠি লেখে রাধাকে) চিঠি রাধা, মুই শহরে যাইতাছি। চাচার দোকানের কামের জন্যি। তুমি ভালো কইরা থাকবা। এইবার শহরে নিজের একটা চাকরি খুঁজুম। আর চাকরি পাইলেই আইয়া তোমারে সাথে কইরা লইয়া যামু। আমগো সুখের সংসার হইবো।
ইতি
রহিম। (চিঠিটা রহিম নন্তুর মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় রাধার কাছে। রাধার সাথে আর কোন কথা বলতে পারে না সে। রওনা হয় শহরের উদ্দেশ্যে।) (এদিকে আস্তে আস্তে দিন, সপ্তাহ, মাস কেটে যায় কিন্তু রহিম ফেরে না। রাধার চালচলন মন্থর হয়। সে আর আগের মতো হাসে না। ছালাম পাইকার যেন দিন দিন রাধার প্রতি হিংস্র হয়ে উঠেছে। সে রাধাকে কাছে পেতে চায়। এমন সময় একদিন রাধার বাবা আসে গ্রামে।)
– রাধা ও রাধা, দেখ তর আব্বায় আইছে। (রাধার মা)
– আব্বা আইছে..! দ্যাখছো মা কইছিলাম না আব্বায় আইবো খুব তাড়াতাড়ি। মোর কতা হাছা হইলো তো।
– হ রে মা। মুই আইছি। কেমুন আছিস রে মা?(রাধার বাবা)
– মুই ভালাই আছি। তুমি কেমুন আছো আব্বা?
– মুইও জবরদস্ত আছি। তর আর তর মায়ের জন্যি নতুন শাড়ি আনছি। আয় দ্যাখ। (রাধার বাবা রাধার জন্য লাল টুকটুকে একটা শাড়ি এনেছে। রাধা শাড়িটা পেয়ে খুব খুশি হয়।)
– আসলে এট্টু টেহা হাওলাত।(রাধার বাবা)
– বুছছি রাধার বাপ। তুমি টেহা হাওলাত লইবার আইছ। বহ। কেমুন আছো?(ছালাম)
– জে, ভালা নাই খুব একটা।
– ভালা নাই? হুনলাম তুমি নাহি শহরে আরেকটা বিয়া করছো। কতাডা কি হাছা? চিন্তা কইরো না মুই কাউরে কমু না। হাছা কতা কও।
– হ করছি। কিন্তু কেউ জানে না। শহরে ব্যবসা খুলছি হেইডার এইবার বিরাট লোকসান হইছে। হেই জন্যি টেহা লাগবো।
– বুঝবার পারছি। মুই তো তোমারে টেহা দিবার চাই। হাওলাত লয় একবারেই দিবার চাই তয় তার বদলে…!
– তার বদলে কি দিতে হইবো? মোর তো কিছুই নাই।
– বেশি কিছু না। তোমার মাইয়া রাধারে এক রাইতের জন্যি যদি…!
– কি কইতাছেন এইসব।
– আরে মিয়া। মুই ভুল কি কইলাম। টেহা না নিবার চাও লইয়ো না। তোমার ব্যবসায়ের লোকসানের কতা হুনলাম তাই ভাবলাম। (একটু ভেবে রাধার বাবা রাজি হয়ে গেল।)
– হোন মিয়া কাউরে এই কতা কইবা না। বুঝবারি তো পারো গায়ে মোর মান ইজ্জত….।
– আপনে হেই চিন্তা কইরেন না। কেউ জানবো না।
– তুমি আইজ তোমার বউরে লইয়া কুনহানে বেড়াইবার যাও। রাইতে মুই মোর কাম করমু।
– ঠিক আছে। টেহা ডা…!
– হ এই লও।
(রাধার বাবা তার মাকে নিয়ে বেড়াতে গেল আর এদিকে সালাম পাইকার তার চাহিদা মিটিয়েই নিল টাকার বিনিময়ে। কামুক চাহিদার কাছে হয়তো আর বর্ণভেদ থাকে না।)
– ও রাধার বাপ। রাধারে খুঁইজা পাইতাছি না। হে কই?
– খোঁজ লইয়া দেহ আছেই কুনোহানে।
(রাধার খোঁজ আর পাওয়া যায় না। রাধা নেই। নদীতে পাওয়া যায় রাধার লাল টুকটুকে শাড়ির ছেঁড়া অংশ। এর দুদিন পরেই রহিম আসে। নতুন চাকরি পেয়েছে সে। রাধাকে এবার তার সাথে নিয়ে যাওয়ার পালা।)
– রহিম ভাই রাধা বু হারায়ে গেছে। (নন্তু)
– কি কস নন্তু তুই এইসব।
– হ ঠিকি কইতাছি। এই লও তোমার চিঠি।
(রাধা রহিমকে চিঠি লিখে গেছে।) চিঠি রহিম ভাই, তোমারে কইছিলাম না এই গাঙ্গ মোরে ডাহে। আইজ মুই গাঙ্গেরে আপন কইরা লইলাম। মোর বাপ মোরে বেইচা দিছিল ছালাম পাইকারের কাছে। নিজেরে দেইখা রাখপার পারলাম না। তাই আইজ নিজেরে গাঙ্গের জলে ভাসাইয়া দিতাছি। তুমি ভালা থাইকো।
ইতি
রাধা।
(রহিম চিঠিটা পড়ার পর নৌকা নিয়ে যায় মাঝ নদীতে। তাকেও আর কেউ কোনদিন দেখে নি।)
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত