বাবা

বাবা
আশ্চর্যজনক ভাবে বাবা আমার কোনো বান্ধবীর বিয়েতে আমাকে যেতে দেন না। এমনকি আমার আত্নীয়দের মাঝে সমবয়সী বা সামান্য বড় তাদের বিয়েতেও তেমন একটা যাই না বাবার বারণে। আগে একটু বিরক্তি লাগলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে বিষয়টা।
তবে আগামী সপ্তাহে তুশার বিয়ে। আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। না গেলে একদম ই চলবে না আগে থেকে বলে রেখেছে। এমনকি বাসায় এসে মা’কে ও বলে গেছে যেতে ই হবে। মা হাসিমুখে ওকে বলেছেন আমি যাব। কিন্তু ভয় তো বাবাকে নিয়ে। উনি আমার সব কথা রাখেন তবে এই একটা বিষয়ে কেন যে এত বাধা বুঝিনা। মা যদি বাবাকে বলেন তাও হবে না আমি নিশ্চিত। আমাকে ই বলতে হবে। রাতে খাবারের সময় বাবাকে বললাম, আগামী পরসু তুশার বিয়ে ওই যে আমাদের বাসায় আসে প্রায় ই। একটা পরিক্ষায়ও আমাদের সাথে গিয়েছিল তুমি ওকে সাথে নিয়েছিলে সেই তুশা। বাবা কিছু না বলে চুপচাপ খাচ্ছেন। বুঝলাম নিরবতা ই অসম্মতির লক্ষণ।
সবার ক্ষেত্রে নিরবতা সম্মতির লক্ষণ হলেও বাবার ক্ষেত্রে উল্টো। মানে আর কথায় কাজ হবে না। কিন্তু অন্যদিকে তুশা বার বার ফোন দিয়ে ই যাচ্ছে আমি আসছি না কেন এই জন্যে। শেষমেষ বলে ই দিলাম ওকে বাবার অসম্মতির কথা। আর কোনো কথা না বলে তুশা ফোন কেটে দিল। পাশের রুমে ই বাবা বসে ছিলেন। একটু পর ই উনার ফোন বেজে উঠল। একটু খেয়াল করতে ই বুঝতে পারলাম আর কেউ না তুশা ই ফোন দিয়েছে। মাঝে মাঝে যখন আমার ফোনে টাকা থাকত না তখন বাবার নাম্বার দিয়ে ওকে ফোন দিতাম। হয়ত সেখান থেকে খুজে ফোন দিয়েছে। বেশ কয়েক মিনিট কথা বলার পর মনে হল বাবার মত পাল্টেছে। আমার রুমে এসে ই বললেন, কাল সকালে ই যেন রওয়না হয়ে যাই তুশার বাড়িতে। খুব খুশি লাগছিল শুনে অবশেষে যেতে পারব ভেবে। তুশাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আসছি। বার বার কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিলাম বিয়েতে কি পড়ব না পড়বো ভেবে।
আলমারী খুলে মায়ের হাতেগুনা কয়েকটা শাড়ির মধ্যে আমার ভালো লাগে সবচেয়ে পছন্দের শাড়িটা বের করলাম। সাথে হালকা জুয়েলারি নিলাম এগুলো আমার নিজের কেনা বেশি ভারী কিছু আমার পছন্দ না। ছোট্ট কানের দুল, কাঁচের চুড়ি, আর চেইন ছোট লকেট লাগানো ব্যাস এগুলো ই। আলমারি বন্ধ করতে ই কিছু একটার আওয়াজ পেলাম রান্নাঘরে। গিয়ে দেখি বিড়াল। বিড়াল তাড়িয়ে রুমে আসতে ই শুনলাম মা বলছেন, এতকিছুর কি দরকার। বিয়ের দাওয়াত যেকোনো একটা কিছু দিলে ই হয় এমন নয় তো যে আমরা বড় কুটুম বড় কিছু দিতে হবে। তখন ই বাবা বললেন, তাই বলে আমার মেয়ে বান্ধবীর বিয়েতে যাবে ওর মন যাতে ছোট না হয় সেটা আমি দেখব না। তুমি তো জানো সব..! তারপর মা আবার ধমক দিয়ে বললেন, তাই বলে তোমার অর্ডার করা চশমা আনার টাকা দিয়ে উপহার আনবে। তোমার চোখের কি হবে!
আরে, চশমা আমি ঠিক আগামী মাসে বানিয়ে আনব। এ মাস চলে যাবে। বাবা মায়ের কথাগুলো শুনে কেমন জানি খারাপ লাগা শুরু হল। মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা বাড়তি কাজ মানে হিসেবে টানা পুরন। এখন যদি বাবাকে গিয়ে না বলি তাহলে আর শুনবে না আমি সেটাও জানি কারণ তুশা কথার বরখেলাপ হবে বাবার কাছে। বাবা কথা দিয়েছেন আমি যাব। পরদিন সকালে সবকিছু ঠিকঠাক করে চলে গেলাম তুশাদের ওখানে। যাওয়ার আগে বাবা ঠিক আরো কিছু টাকা আমার হাতে গুঁজে দিলেন। দরকারে খরচ করতে। আমি জানি না এই মধ্যবিত্ত বাবারা এত কিছু কিভাবে পারে..! কিছু না বলে টাকাটা নিয়ে চলে এলাম। কারণ আমি জানি এই টাকাটা আমার খরচ করা হবে না ঠিক ই এসে আবার ফেরত দিব মায়ের কাছে। তুশাদের বাড়িতে এলাহি কান্ড! আর হবে না ই বা কেন প্রথম বড় মেয়ের বিয়ে। কোনো কিছুর কমতি রাখেন নি। সবকিছু যেন একদম কানায় কানায় পূর্ণ।
সামনে ই তুশা রেডি হচ্ছে কনে সাঁজে। ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। সাথে ওর কাজিনরাও তৈরি হচ্ছে। খুব সকালে যাওয়ায় ড্রেস পড়ে ই গিয়ে ছিলাম। তবে এখন রেডি হতে হচ্ছে। তুশা বার বার এটা ওটা পড়িয়ে দিতে চাইছে আরো ভালো করে সাঁজার জন্য বলছে। কিন্তু কেন জানি আমার তেমন ভালো লাগছে না। আমার যেমন আছে তাতে ই ভালো। তবে তাদের সবার মাঝখানে আমাকে নিতান্ত সাধারণ লাগল। তাতেও আমার এত মাথা ব্যথা নেই। বেশ আড়ম্বরের মধ্য দিয়ে ই শেষ হল বিয়ে। তবে বাইরের কয়েকজন প্রতিবেশিনীদের খেয়াল করলাম ঠিক ই আমাকে নিয়ে কেমন জানি একটা চোখ চাওয়াচাওয়ি করছেন।। আমি সবার মধ্য থেকে সরে গেলাম। কোনো রকম তুশাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। বাড়িতে এসেও যেন মনটা ভারী ভারী লাগছিল। বাবা কি একটূ বলতে এসেও বলতে পারলেন না। চলে গেলেন।
একদিন হুট করে এসে ই ছেলেপক্ষ আমাকে পছন্দ করে গেল..! যত তাড়াতারি সম্ভব বিয়ে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে বিয়ের সব আয়োজন আমার পরিবারের পক্ষে সহজ নয় তা আমি ভালো করে জানি। তবুও বাবা রাজি হয়ে গেলেন। আমি কিছু বলতে পারলাম না কারণ আমার পরে আরো ভাই বোন আছে তাদের কথাও ভাবতে হবে। একটু একটু করে দিন ঘনিয়ে আসছিল। বাবা হঠাৎ বিকেলে বললেন, চল মার্কেটে যাব। আমি অনেকটা অবাক হয়ে বললাম এখন! হ্যা, এখন। তোর যা যা দরকার সব কিনে নিবি। বিয়ের জন্য মেয়েদের অনেক কিছু কেনা লাগে কসমেটিকস থেকে শাড়ি ড্রেস। আমার অল্প কিছু আছে বেশি নেই। মা বললেন বাবার সাথে চলে যেতে।
বাবা গাড়ি থেকে নেমে ই বড় মার্কেটের দিকে রওনা হলেন। আমি বললাম বাবা ওখানে না এদিকে চলো। আমাদের মার্কেটে। আমার যা কিছু কেনার এখান থেকে ই কিনব। দোকানে ঢুকে ই আমি কিছু বলার আগে ই একটা মেয়ের কনে সাঁজতে যা যা লাগে বাবা সবকিছু একটা একটা করে কিনে দিতে লাগলেন। নিজের পছন্দ মত। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম। আমার এই বাবা ই কি না আমাকে অন্য মেয়েদের বিয়েতে যেতে বাধা দিতেন আজ তিনি নিজ হাতে নিজের মেয়ের কনের সাঁজ কিনছেন। হুট করে বলে উঠলাম, বাবা একেবারে পর করে দিবে নাকি?? একদিনে ই সবকিছু শেষ! আমি ঠিক বুঝলাম বাবা ওপাশ টায় ফিরে চোখের জল মুছলেন তারপরও চোখ দুটো লাল হয়ে আছে..!
আমি চোখ নামিয়ে কান্না করছিলাম। বাবা বললেন, মেয়ে ধন কে যদি সারা জীবন বুকে আগলে রাখা যেত তাহলে কখনো এসব জিনিষে হাত দিতাম। দোকান থেকে রাস্তায় দাড়িয়ে বাবা বললেন, জানিস মা তোকে কোনো মেয়ের বিয়েতে যেতে দেই না কেন! তুই তখন খুব ছোট খুব শখ করে সব জায়গায় নিয়ে যেতাম তোকে। অফিসের স্যারের মেয়ের বিয়েতে গেলাম তোকে নিয়ে। তুই অবাক হয়ে কনে দেখছিলি। আর আমায় বলছিলি, বাবা আমায় ওই কনে যা যা পড়েছে আমাকে কিনে দিবে এই ইদে! ওই যে কপালে পড়েছে, নাকে পড়েছে, হাতে দেখো কত্ত চুড়ি…! আমি পড়ব আমার খুব ভালো লেগেছে। তখন খুব ছোট্ট তুই মা।
আমার হয়তো এত সামর্থ্য নেই ওই বড়লোকের কনের মত সাঁজাবার তবুও তোর কথায় হ্যা হ্যা বলছিলাম।
ঠিক এর ওপর পাশটায় আমার উপরের পদের কর্মকর্তা আমাকে দেখে তাচ্ছিল্য করছিল। শেষ পর্যন্ত বলে দিল তোকে এগুলা সবাই পায় না সবাই কিনতে পারে না। তুই ঠিক তখন আমার আঙুল ধরে বলেছিলি, ” আমার বাবা কিনে দিবে। ” আমি তখন আড়ালে চোখ মুছে তোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এরপর থেকে আমি কখনো তোকে আর কোথায় বিয়েতে যেতে দেইনি। কি জানি তোর যদি আর কোনো শখ থেকে থাকে মনে আমি যদি পূরণ করতে না পারি। জানিস তো মা, তোর এই বাবা টার এত সামর্থ্য নেই। তোকে ওই বড় বাড়ির মেয়ের মত সাঁজিয়ে দেবার..! তবে খুব ইচ্ছে ছিল নিজ হাতে তোকে ওই জিনিষ গুলো কিনে দিব। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে ফেললাম। আমার ওই বড় ঘরের মেয়েদের মত সাঁজার ইচ্ছা নেই বাবা। শুধু তোমার মত একটা বাবা থাকলে ই চলবে আমার। খুব করে কান্না করেছি সেদিন।
নিজের অজান্তে ই ছোট্ট বেলায় বাবাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আমি যদি এসব কেনার কথা না বলতাম তাহলে হয়ত বাবা এতটা অপমানিত হতেন না। যে কোনো বাবা ই চান উনার সর্বস্ব দিয়ে মেয়ে কে খুশি রাখতে মেয়ের সুখ খুঁজে দিতে। তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে সবটুকু বিলিয়ে দিয়েও মেয়ের স্বপ্ন পূরণে পিছপা হোন না। শুধু বাইরে থেকে দেখা মানুষগুলো ই বুঝে না কোথায় আঘাত করে তারা। বাবা’রা শুধু দিয়ে ই যায়..! শেষ পর্যন্ত নিজের সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকেও অন্যঘরে দিয়ে দেয়। তারপরও কিছু উচ্চ মান সম্পন্ন লোক জিজ্ঞেস করে,, মেয়ের বাবা কি দিল..! বিয়ের ২য় দিন। খুব সকালে উঠে ই বাবাকে ফোন দিলাম। কি রে মা কিছু হয়েছে? কিছু দরকার??
— হ্যা, খুব দরকার। এখানেও আমার বাবাকে দরকার …! থাকতে পারব না আমার ওই বাবাকে ছাড়া অপর পাশটায় চাপা কান্নার আওয়াজ পেলাম। এই প্রথম। কারণ বাবারা কখনো কাঁদেনা…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত