অবশেষে নীল আকাশ

অবশেষে নীল আকাশ
নিয়াশার বাড়ির সামনে এসে হটাৎ থেমে গেল সাদ।একটু অস্বস্তিতে পড়ে আছে। একবার ভাবছে যাওয়া কি ঠিক হবে। দ্বিধাবোধটা কিছুতেই কাটাতে পারছে না।সাদের এমন হটাৎ দাঁড়িয়ে থাকা দেখে রহমান সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। তিনি সাদকে বললেন, “কি হলো সাদ বাবা! থামলে কেন?”রহমান সাহেবের এই কথার প্রত্যুত্তরে কি বলা উচিত তা সাদ ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু বড় ধরনের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। রহমান সাহেব আবার বললেন, “লজ্জা পাচ্ছো?আরে লজ্জার কি আছে? কয়দিন পর তো মাঝে মাঝে আসবা।নিজের বাড়ি মনে করবা ছেলে।“রহমান সাহেবের এই কথায় সাদ একটু লজ্জা পেল।সে একটু বিব্রত করে বললো, “না তেমন কিছু না। চলেন।“রহমান সাহেব সাদের কথায় মুচকি হাসলেন। বললেন, “তোমাকে দেখে কিন্তু নিয়াশা বেশ খুশি হবে।“ সাদ রহমান সাহেবের এই কথায় কিছু বললো না।চুপ করে তার সাথে যেতে লাগলো।আর মনে মনে বলছে, “আপনার মেয়ে তো আমাকে দেখতেই পারে না।বাসায় গেলে নাকি ঝাটা দিয়ে দৌড়ানি দেয় নাকি আবার, কে জানে?”
সাদকে দেখে রহমান সাহেবের স্ত্রী আমেনা বেগম খুশি হলেন। একটু অবাকও হয়েছেন বটে।এই ভরদুপুরে হটাৎ তাদের বাড়ির হবু জামাই তাদের বাড়িতে আসবে সেটা একটু অবাকের বিষয়। রহমান সাহেব তার স্ত্রী আমেনাকে বললেন, “বাজার থেকে আসার সময় তোমার জামাইকে রাস্তায় দেখলাম। বললো, এদিকে বলে কি কাজে এসেছিল।আর যেই কাজ থাকুক না কেন নিয়াশাকে যে একবার দেখতে এসেছিল তা আমি নিশ্চিত।তাই ধরে নিয়ে আসলাম। আমার মেয়েকে দেখতে এসে ,না দেখে চলে যাবে এত সহজ নয়।“রহমান সাহেবের এই কথায় সাদ একটু বেশি অস্বস্তিতে পড়ে গেল।কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। রহমান সাহেব যে ব্যাপারটা এত সহজে বুঝে ফেলবেন তা সাদ বুঝতে পারেনি।
ব্যাপারটা সত্যি।সাদ মূলত এখানে এসেছিল নিয়াশাকে এক নজর দেখতে।সাদ থাকে তার বড় আপু আলো আপুর বাসায়। পড়াশোনা কমপ্লিট করে বেশ কিছুদিন তার বড় আপুর বাসায় থাকতে এসেছে।আলো আপুর বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীতে।সাদ এখানে প্রায় দেড় মাসের মতো হলো থাকছে।এতে কারো অসুবিধা নেই।সাদের দুলাভাই একজন আর্মি অফিসার। এখন ট্রেনিং এ আছে।তাই বাসায় কোনো মানুষ নেই বলে সাদের আলো আপু তাকে বেশকিছু দিন থাকতে বলেছে।একা একা সারাদিন বসে থাকা ভালো লাগে না।আর বেশ কিছুদিন ধরে নিয়াশার সাথে তার দেখা হচ্ছে না।এই নিয়ে সাদ বেশ বিচলিত। মনের মানুষকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করছিল সাদের। মন অজানা বিদ্রোহ শুরু করে।নিয়াশার ফোন নাম্বার টা থাকলেও তাকে ফোন দেওয়ার সাহসটা হয়নি কখনো।হবে কেমন করে?
মেয়েটা তো আর অন্যান্য মেয়েদের মতো না।যদি বলে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।তাহলে সে বলবে আমার সময় নেই।নিয়াশার সময় ঠিকই আছে।কিন্তু তবুও সে বলবে।এতে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নেই। এজন্যই সাদ বলতে পারেনি, “এই মেয়ে তুমি বুঝো না তোমাকে দেখার জন্য এই হৃদয়ের অনূভুতিগুলো যে বিদ্রোহ করে।কতটা ক্লান্ত তারা।“ সাদ বলতে পারেনি।পারেনিও না দেখে থাকতে।তাই চুপটি করে এসেছিল একবার দেখার আশায়।ভেবেছিল বাসায় যাবে কিন্তু সেটাও পারেনি। বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি তে যাওয়া ব্যাপারটা সাদের কাছে কদাচিৎ মনে হয়েছে।তাই সে নিয়াশার বাসার বেলকানিতে বেশ কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থেকে যখন তাকে দেখতে পেলনা তখন সে ব্যার্থ মন নিয়ে নিরবে চলে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে নিয়াশার বাবা রহমান সাহেব দেখে ফেলেন।আর তাই তাকে ধরে বাসায় নিয়ে আসেন। এখন না পারছে পালাতে,না পারছে কিছু বলতে। মনে হচ্ছে লোভ করে দেখার করা ভাবনাটা ভুল ছিল।অতি লোভে তাঁতি নষ্ট এমনিতেই তো কেউ বলে না।
সাদকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে নিয়াশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল।সাদ যে হটাৎ এই সময়ে তাদের বাসায় আসবে এটা হয়তো সে ভাবতে পারেনি।নিয়াশা ড্রয়িং রুমে এসে ওয়ার্ড ড্রপের কাছে ঘেষে দাঁড়াল। ঘরে সাদ একা বসে আছে।নিয়াশাকে দেখে সাদ কিছু বললো না। শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকল।নিয়াশাও সাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুজন দুজনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিছুতেই যেন এই দৃষ্টি কেউ সরাতে পারছে না।এক মাদকতাময় দৃষ্টি। দু’জনের দৃষ্টির মাঝে এক অনূভুতি নাড়া দিচ্ছে।সাদ গভীররভাবে সেই দৃষ্টির অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেদিনের মতো। যেদিন সাদা প্রথম নিয়াশার প্রেমে পড়েছিল।গভীর প্রেমে।এক গভীর এক মায়াজালে। যার থেকে কোনো মুক্তি নেই শুধু আছে গভীরত্বের ছোঁয়া।
সেদিন নিয়াশা স্কুল ছুটির বেশ কিছুক্ষণ পর বাসায় যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে বের হয়।নিয়াশা এখানে একটি প্রাইভেট স্কুলে প্রায় ছয় মাসের মতো শিক্ষকতা করে। সেদিন স্কুল ছুটির পর বাসায় যাওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিল। হটাৎ নিয়াশা দেখতে পেল টুম্পাকে। টুম্পা নিয়াশাদের স্কুলে পড়ে।নিয়াশার খুব আদরের একজন ছাত্রী।ক্লাস টু’তে পড়ে।নিয়াশা দেখে একটা লম্বা উঁচা ছেলে টুম্পাকে চকলেট দিচ্ছে।আর টুম্পা তা হাসি মনে নিচ্ছে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ছেলেটার মুখভরা দাঁড়ি।কালো শার্ট। গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা বর্ণের।যতটুকু দেখে নিয়াশা বুঝতে পারল লোকটাকে আগে কখনো দেখিনি। টুম্পার মা-বাবাকে নিয়াশা ভালো করে চিনে। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কোনো কিডন্যাপার।
নিয়াশা কি জানি ভেবে ছুটে গেল টুম্পার কাছে।গিয়েই চকলেটটা টান দিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল আর টুম্পাকে নিজের কাছে ঝাপটে ধরে ছেলেটাকে বললো, “এই ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েকে আপনি এসব দিয়ে ভুলিয়ে বালিয়ে কিডন্যাপ করতে এসেছেন?তাও আবার এই ভরদুপুরে! দাঁড়ান এখনি আমি লোকজন জড় করছি। আপনাকে পুলিশে দিব!” নিয়াশার এই কথা শুনে টুম্পা হাসতে থাকে।বেশ জোরে হাসতে থাকে।ছেলেটা তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিয়াশার দিকে।নিয়াশা টুম্পার এমন অকারণে হাসি দেখে ঘাবড়ে যায়।মেয়েটা ভয় না পেয়ে দাঁত বের করে হাসছে।মেয়েটার মনে কি ভয়ডর নেই?নিয়াশা টুম্পাকে জিগ্যেস করলো, “কি হয়েছে? তুমি হাসছো কেন?”টুম্পা তখনো হাসতে হাসতে বলে, “আরে ম্যাডাম এনি আমার মামা হন।আমার সাদ মামা।আজ মা আসেনি।তাই তিনি নিতে এসেছেন।“ টুম্পার এমন কথায় নিয়াশা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। একটু লজ্জা পেল।
কি বলবে আর।যার মুখভরা দাঁড়ি।গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা।দেখেই তো জঙ্গি জঙ্গি মনে হয়।নিয়াশার কি দোষ।নিয়াশা দেখে ছেলেটা তার দিকে সেই কখন থেকে তাকিয়ে আছে।ফেরাবার নাম গন্ধ নেই। নিয়াশার রাগ হচ্ছিল।এমনিতেই ছেলেটাকে দেখতে জঙ্গি মনে হচ্ছে।তার উপর ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছিলো চোখ দুটো তুলে নিয়ে মারবল খেলতে।নিয়াশা কিছু বললো না।চুপ করে থাকলো। তারপর টুম্পাকে ‘আসি’ বলে চলে আসে সেখান থেকে।আর এদিকে সাদ তখনো নিয়াশার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে।শ্যামলা বর্ণের একটা মেয়ে।দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও মুখের একটা মায়া আছে।আর এই্ মায়ার জালে সে আটকে যায়।সাদের মনে গেঁথে যায় এই মায়াময় মুখে লজ্জা পাওয়ার পর টোল পড়াটা দৃশ্যটা। খুব ইচ্ছে করছিল তার গাল দুটো টেনে দিতে। কিন্তু সেটা যে নিছক পাগলামি আর অপরাধ তা পরে বুঝতে পেরে নিজের মনে দমিয়ে রাখল।
– কেমন আছেন?
হটাৎ নিয়াশা সাদকে কথাটা বললো।সাদ একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। কারণ তখনো সে নিয়াশার দিকে তাকিয়ে ছিল।সাদ জড়তা নিয়ে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?
– হুম ভালো আছি।
নিয়াশা তার বাবা রহমান সাহেবকে আসতে দেখে আর কিছু বলতে পারলেন না। চুপ করে তার বেডরুমে চলে আসল।এসে বেলকানিতে দাঁড়াল।এই বেলকানি থেকে রাস্তা দেখা যায়।এই রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে কত মানুষ কত রিকশা।নিয়াশার মনেও ভাবনা হতে লাগল জীবনটা এক রাস্তার মতো।কত মানুষ আর কত কিছু এই রাস্তা নামক জিনিস দিয়ে চলে যায়।নিয়াশা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।আর মনে পড়ে সেই ধূসর উদাস স্মৃতি গুলো।আর মনে করিয়ে দেয় সেই একজনকে।যাকে ভালবাসতো একসময়। কিন্তু আজ সে নেই।এই রাস্তায় দেখলে মনে পড়ে যায় আরিফের কথা।যে এক সময় এই রাস্তায় তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত তাকে একটিবার দেখার আশায়।অথচ আজ সে মানুষটি তাকে কত না সহজ ভাবে ছেড়ে চলে গেছে।ভার্সিটি থাকা কালে আরিফের সাথে সম্পর্ক হয় নিয়াশার।এই সেই সম্পর্ক নয় খুব ভালো সম্পর্ক। সেখানে ছিল কিছু ভালো অনূভুতি, কিছু ভালো মূহুর্ত, কিছু ভালোবাসা। খুব ভালো ছিল নিয়াশা।
স্বপ্ন ছিল একটা ছোট মেঘের সংসার। যেখানে কিছু না থাকলেও ভালোবাসা আকাশে শরতের মেঘ উড়বে।আর সেই স্বপ্নমেঘে দুজনে ভালোবাসায় হারিয়ে যাবে।নিয়াশার ভেতরে এই ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো যখন আরিফকে বলতো তখন আরিফ তা শুনে হাসত।এই হাসি দ্বারা আরিফ কি বুঝাতো নিয়াশা তখন বুঝতে না পারলেও একসময় বুঝতে পারে যখন তাদের সম্পর্কের দু’বছর হওয়ার পর আরিফ তাকে ছেড়ে চলে যায়।কেন চলে যায়?এটা প্রথমে জানতে না পারলেও পরে দেখে আরিফ এক সাদা চামড়ার সুন্দরী বড়লোক মেয়ের সাথে নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছে।নিয়াশা আরিফের ছেড়ে যাওয়ায় কি বুঝেছিল তা জানে না শুধু এটুকু বুঝেছিল তার ভিতরের আরিফ কখনো তার প্রতি পাগলামি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেত না।আর তাই সে তার থেকে সুন্দরী সাদা চামড়ার মেয়ের দিকে চলে গেছে।তার শ্যামলা বর্ণের রূপ হয়তো তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি।যে ভালোবাসায় মনের রূপ না খুঁজে বাহ্যিক রূপ খুঁজে সেই ভালোবাসা আর যাইহোক কখনো পূর্ণতা পায় না।আর তাই পড়ালেখা শেষ হওয়ার এত বছর পরেও সে তার জীবনে নতুন কাউকে ভাবতে পারেনি। স্বপ্ন গুলো দেখার মিথ্যা আশায় আর থাকতে চাইনা সে।
– আকাশ ভালো লাগে? নিয়াশা পাশে হটাৎ সাদ ঔএসে এই কথাটি বললো।নিয়াশা অবাক হলো না।সাদের দিকে না তাকিয়ে বললো,
– না।
– তবে কি ভালো লাগে?
– জানি না।
– আমারও কিন্তু এখন আকাশ ভালো লাগে না!
– ওহ, ভালো।
– কারণ জানতে চাইবেন না?
– বলুন?
– কারণ এখন আমার আপনাকে ভালো লাগে। যেখানে আমি দেখতে পাই আকাশ। দেখতে পাই সাদা মেঘ। দেখতে পাই মেঘলা আকাশ।দেখতে আমার ভালোবাসার সাত রঙা রংধনু। নিয়াশা সাদের কথায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। শুধু তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আর ভাবছে এই আকাশকে কাছে পাওয়ার গল্প।
সেদিন নিয়াশা চলে যাওয়ার পর টুম্পার কাছ থেকে সাদ জানতে পারে তার নাম নিয়াশা। তাদের গণিত ক্লাস নেয়। খুব আদর করে টুম্পাকে। এরপর থেকে সাদ টুম্পাকে স্কুলে নিয়ে আসা-যাওয়ার বাহানায় প্রায় স্কুলে আসত।স্কুলে এসে কখনো লুকিয়ে কখনো আড়চোখে নিয়াশাকে দেখতে।কেন দেখতো এটা সাদ নিজেও বুঝতো না। বারবার নিজেকে বুঝাতো এগুলো অপরাধ। কিন্তু তবুও সে নিয়াশাকে দেখার জন্য চলে আসত।নিয়াশাকে দেখা মাত্র বলতো, “আমাকে চিনতে পারছেন?ওই যে সেদিন আমার ভাগ্নীকে কিডন্যাপ করতে এলাম আপনি দেখে ফেললেন। আপনার জন্যই সেদিন নিজের ভাগ্নীকে কিডন্যাপ করতে পারলাম না।“আরেকদিন বলতো, “আজ কি আমাকে দেখতে কিডন্যাপার মনে হচ্ছে? দেখুন আজ কিন্তু আমার মুখে দাড়ি নেই।আজ কিডন্যাপ করলে কেউ বুঝতে পারবে না নিশ্চয়ই?
নিয়াশা সাদের এইসব কথায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যেত। কিছু বলতে পারত না। স্কুলে সবার সামনে একজন অপরিচিত ছেলের সাথে কথা বলা যে শোভা পায় না তা সে বুঝতো।তাই কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে চলে আসত। কিন্তু তবুও সাদ প্রায় আসত নিয়াশার সাথে কিছু কথা বলে মনকে শান্তনা দিতে।নিয়াশাকে যে সে খুব ভালোবেসে ফেলছে। তাকে নিয়ে যে অগুছালো কাব্য তার মনে জমা হয়েছে তা নিয়াশাকে প্রকাশ করার জন্য যে কতটা বিদ্রোহ করতো এটা শুধু সাদ বুঝতো।আর তাই প্রতিদিন বেহায়ার মতো সে নিয়াশার সামনে যেত। প্রায় একমাস পর একদিন টুম্পা নিয়াশাকে টুম্পার জন্মদিনের জন্য তাদের বাসায় যেতে বলে।টুম্পা অনেক অনুরোধ করে আসার জন্য।একটা ফুটফুটে মেয়ের মুখে এমন বাচ্চাসুলভ আবদার ফেলার মতো ক্ষমতা হয়তো কারোর নেই।নিয়াশাও পারেনি।তাই সে রাজি হয়ে যায়।কিন্তু নিয়াশা টুম্পার জন্মদিনের দিন যায়নি।কারণ টুম্পা নিয়াশাকে ইনবেটশন দেওয়ার পর সাদের কাছে গিয়ে বলে, “মামা, মামীকে জন্মদিনের দিন আসতে বলেছি। মামী বলেছে আসবে।
এখন আমার আইসক্রিম কিনে দাও।“এই কথা নিয়াশা তাদের আড়ালে শুনে ফেলে।আর এজন্যই সেদিন যায়নি।কিন্তু এরপরের দিন আরো অবাক হয় যখন দেখে সাদের পরিবারের সবাই নিয়াশাদের বাসায় আসে সাদের সাথে বিয়ের সমন্ধ করতে।সাদের এবার ইন্জিনিয়ার পাস করেছে। খুব শিঘ্রই চাকরি পেয়ে যাবে। পরিবারের একমাত্র ছেলে।আর পরিবারের অবস্থান খুবই ভালো।নিয়াশার বাবা-মা প্রথমে রাজী না হলেও প্রত্যেকের অনুরোধে তারা মেনে নেয়।কথা হয় চাকরি পাওয়ার পর নিয়াশাকে তাদের ঘরের বউ করে নিয়ে যাবে।এতে কার কোনো আপত্তি নেই।কারণ সাদ একজন ইঞ্জিনিয়ার পাস করা ছেলে। বেশিদিন হয়তো বেকার থাকতে হবে না।আর এছাড়া তার বাবার ব্যবসা আছে। কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নিয়াশা তখনো চুপ করে ছিল। কিছু বলেনি।নিয়াশার পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি করার ক্ষেত্রে বাবা-মা কিছু বলেনি। কিন্তু এই বিয়ের বিষয়ে সবার মতামতের উপর না করা সাহস আর ইচ্ছেটা হয়নি।কিন্তু নিয়াশা যে সাদকে মেনে নিতে পারছে না এটা সাদ বেশ বুঝতে পারে।
– একটা কথা বলবেন?
– বলুন।
– আমাকে পছন্দ করার কারণ টা জানতে পারি?
– হটাৎ এই কথা?
– আহ্! বলুন না?
– যদি বলি কোনো কারণ নেই।
– আশ্চর্য!কারণ ছাড়া কেউ কাউকে পছন্দ করে?
– পছন্দ করতে কারণ লাগে।আমি আপনাকে নিজের করে চেয়েছি। ভালোবেসেছি।আর এই ভালোবাসতে কোন কারণ লাগে না।কারণ দিয়ে কখনো ভালোবাসা হয়না।যেই ভালোবাসায় কারণ লাগে সেই ভালোবাসা স্বার্থপর হয়।হারিয়ে যায়।সেটা কখনো পূর্ণতা পায় না।
– আমি কি আপনার ভালোবাসার যোগ্যতা রাখি?আমি তো দেখতে সুন্দরী না।
– আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন। যখন এই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায় তখন আকাশটাকে দেখতে খারাপ লাগে। কিন্তু আবার এই আকাশে সাদা মেঘ উড়ে বেড়ায় তখন কিন্তু এই আকাশটা রঙিন লাগে। ভীষণ প্রিয় মনে হয় এই আকাশকে। তখন কিন্তু কালো আকাশের কথা মনে পড়ে না।কারণ এই নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো তা ভুলিয়ে দেয়। রঙিন করে তুলে। আপনার মনে কোন আকাশ খেলে যায় আমি জানি না কিন্তু আমার আকাশে সবসময় আপনি নীল আকাশের সাদা মেঘ হয়ে উড়ে বেড়ান।যা আমাকে কখনো অন্ধকার মেঘলা আকাশকে অনুধাবন করায় না।করায় আপনিময় এক নীল আকাশ।আর আমি আপনার মাঝে সেই আকাশ দেখতে পাই।আপন করে নিতে চাই এই আকাশকে। সাদের এই কথায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। অনুধাবন করতে থাকে মনের ভেতরের সেই সাদা মেঘের নীল আকাশকে। ভালোলাগা ছুঁয়ে যায় মনে।কি বলবে ভেবে পায় না। শুধু তাকিয়ে থাকে সাদের দিকে। মনে হচ্ছে এতদিনের জমানো মেঘলা আকাশ আজ কারো সুপ্ত অনুভূতিতে হারিয়ে যাচ্ছে। অনুধাবন করছে সেই রঙিন নীল আকাশকে।নিয়াশা বললো,
– জানেন আমার একটা বদ অভ্যাস আছে?
– কি রকম?
– আমি অল্পতেই কারো প্রতি অভিমান পুষে রাখি।এক প্রচন্ড অভিমান। কেন যেন সহজে ভাঙতে চায় না।
– তাই!আমার যে অভিমানী মেয়ে খুব পছন্দ।
– কেন?
– অভিমানী মেয়েদের গাল দুটো টেনে দিতে খুব ইচ্ছে করে।
– কি! কয়টা মেয়ের গাল ধরে টেনেছেন?
– কেন? আপনার রাগ হচ্ছে?
– উঁহু!আপনি বলবেন কিনা?
– যদি বলি আপাতত কারোর না।তবে একজন দিতে চাইলে টেনে দিতে পারি।
– সে যদি না দেয়?
– তবে আর কি মনে মনে টানব।কারণ মনের টানা ভরা টানা।
– আচ্ছা আপনার কি করতে ভালো লাগে?
– একটা কথা বলতে?
– কি কথা?
– ভালোবাসি।
নিয়াশা সাদের কথায় লজ্জা পায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মনে মনে ভাবছে,”এই ছেলেটার কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই,এভাবে কেউ ভালোবাসি কথা বলে। “আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে নিয়াশা।আজ এই আকাশকে বড় আপন মনে হচ্ছে। আকাশকে আজ খুব ভালো লাগছে।চোখ বন্ধ করে তা অনুধাবন করছে।সাদ আড়চোখে বারবার নিয়াশার দিকে তাকাচ্ছে।নিয়াশার মুচকি হাসিটা সাদের হৃদয়ে একরাশ ছন্নছাড়া অনূভুতিতে পরিণত করছে।নিয়াশার কাছ থেকে ভালোবাসি প্রত্যুত্তর শোনার জন্য সাদ উদগ্রীব হয়ে আছে। কিন্তু নিয়াশা বলছে না।কেন জানি সাদের নিয়াশাকে বলতে ইচ্ছে করছে, “এই মেয়ে তুমি কি আমার ভালোবাসা বুঝো না।যদি বুঝো তবুও কেন স্বীকার করোনা। উত্তর দাও।“ বলতে পারে না।না বলায় থেকে যায় মনের মাঝে।ওই যে এক কথা আছে না সব কথা বলে না হৃদয় কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।মন ভাঙে সাদের।নিয়াশার কাছ থেকে একটা কাঙ্খিত উত্তরের আশায় সাদ মনমরা হয়ে যায়। খুব করে শুনতে ইচ্ছে করে, “আমার মনের মাঝে আপনি একরাশ ভালোবাসার মুগ্ধতা হবেন?”
সাদ আর রহমান সাহেব খেতে বসেছেন। খাবার বেড়ে দিচ্ছে আমেনা বেগম। খুব যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন তিনি।তার এক ছেলে এক মেয়ে।ছেলেটা তিনবছর ধরে আমেরিকায় সেটেল হয়ে আছে। সাদের মাঝে তিনি যেন তার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছেন।কারণ সাদের খাওয়ার সিস্টেম আর ছেলের সাথে তিনি মিল খুঁজে পাচ্ছেন।আর সাদের মুখে ‘মা’ ডাকটা যেন সাদের প্রতি আরো মায়া বাড়িয়ে দিচ্ছে আমেনা বেগমের।নিয়াশা একটু পর পর রান্নাঘরে আসছে আর কিছু না বলেই হটাৎ করে চলে যাচ্ছে।সাদ তা খেয়াল করছে।কারণ সাদ দেখতে পাচ্ছে নিয়াশা একটি শাড়ি পড়েছে।নীল শাড়ি।আগে পড়া ছিল না। হয়তো একটু আগে পড়েছে।কিন্তু কেন পড়লো? সাদকে দেখানোর জন্য নয়তো।সাদ তা ভেবে পায়না। আমেনা বেগম নিয়াশাকে এই অবস্থায় দেখে বললো, “কি রে? হটাৎ নীল শাড়ি পড়লি যে তোর তো নীল রঙের শাড়ি পছন্দ নয়।
তোর খালা তোকে দেওয়ার পর তো একদিন ও পড়ে দেখলি না।“ নিয়াশা মায়ের কথায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল।কি করে বুঝাবে যে আজ তার নীল রঙ খুব ভালো লাগছে।আর ভালো লাগছে নীল রঙ প্রিয় সেই মানুষটিকে।তাই আজ পড়তে ইচ্ছে করছে।নিয়াশা কিছু না বলে তার রুমে চলে গেল।নিয়াশার মা হাসতে হাসতে বললো, “পাগলি একটা!” সাদ ও মনে মনে হাসলো।তাহলে নিয়াশার মনেও সাদের জন্য অনূভুতি নাড়া দিয়েছে।যার জন্য সে তার কাছে স্পেশালে হতে চাইছে।নিয়াশা তার রুমে আয়নার সামনে বসে আছে। বারবার আয়নায় নিজের চেহারা দেখছে।আর সাদের সেই কথাগুলো ভাবছে।আর আনমনে হেসে উঠছে।নিয়াশার মনে উথাল পাতাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।কেন যেনো সাদকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, “আপনি কি আমার আয়না হবেন?যেই আয়নায় আমি শুধু আপনার ভালোবাসা দেখতে পাব।“এই সব ভাবান্তর নিয়াশার মনে সাদের প্রতি অন্যরকম এক অনূভুতি জন্ম দিচ্ছে। খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে নিয়াশার।
সাদ চলে যাচ্ছে।তার আলো আপু বাসা থেকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে। চলে যাবে সাদ।নিয়াশা তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।তার বাবা-মা সাদকে বিদায় জানাচ্ছে।নিয়াশা কি জানি ভেবে দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেল। বিছানায় মন খারাপ করে শুয়ে পড়লো। এতদিন সাদকে কাছে পেয়েও যে অস্বস্তি লাগত তা এখন তার দূরে যাওয়ার ফলে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সাদের সাথে কাটানো মূহুর্তে গুলো মনে করছে।কেন যেন খুব মিস করছে তাকে। হটাৎ ফোনে একটা মেসেজ চলে আসলো।নিয়াশা দেখলো সাদের মেসেজ। সেখানে লেখা, “যদি তোমার সাথে আমি মেঘলা দিনে বৃষ্টির কথা বলতে চাই।শীতের দিনে কুয়াশর কথা বলতে চাই। জোৎস্না রাতে চাঁদের কথা বলতে চাই। তবে তুমি কি আমায় হাত ধরে বসে সে কথাগুলো শুনার বিনিময়ে ভালোবাসি বলবে?” নিয়াশা মেসেজ দেখে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে।
দৌড়ে যায় বেলকানির কাছে।দেখে দাঁড়িয়ে আছে এক নীল পরিহিত এক শ্যামলা বর্ণের ছেলে।ঠিক যেখানে আরিফ দাঁড়িয়ে থাকত।আজ নিয়াশার আরিফের কথা মনে নেই।মনে নেই তার মলিন স্মৃতি।তার সব ভালোবাসা এখন এই মানুষটিকে নিয়ে।যে তার কালো মেঘে ঢাকা আকাশ মুছে দিয়েছে। তাকে নিজের করে নিয়েছে।নীল আকাশ হতে চেয়েছে তার জীবনে।নিয়াশা তাকিয়ে আছে সাদের দিকে।বেলকানির এই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখছে সে ছেলেকে।মনে ভালোবাসার জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।আর মনে মনে সে গানটা গাইছে,, “একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে বন পাহাড়ি ঝর্ণা খুঁজে,, বৃষ্টি জলে একলা ভিজে সে ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত