গাপ্পুই প্রথম গন্ধটা পায় নাকে। দমবন্ধ হওয়া কটু একটা গন্ধ! আগে কখনও টের পায়নি। অথচ ইদানীং গন্ধটা এসে বারবার ঝটকা দিয়ে যাচ্ছে নাকে।
গাপ্পু হিল্লিকে বিষয়টা জানায়। সে অন্যপাড়ায় থাকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর নিজের মহল্লায় আর খাবার মিলছে না। সবার কপাট বন্ধ। রাস্তায় মানুষের চলাচল নেই। সূর্যের প্রথম আলোর মতো রাস্তাঘাট একেবারে ঝকঝকে, তকতকে, গাছেদের নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত কান পাতলে শোনা যায়। যেখানে সেখানে মানুষের নাকঝাড়া কিংবা থুতু-কফ ফেলাও বন্ধ হয়ে গেছে! এমনকি চুলকানি হলেও এখন আর কেউ চুলকাতে চায় না। পাছে অদৃশ্য ভাইরাসটা সুযোগ পেয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে যায়; সেই ভয়ে। সেখানে হিল্লির খাবারের কথা কে ভাববে?
তাই গায়ে পড়ে গাপ্পুর সঙ্গে সে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। গাপ্পুর একে মেজাজ খারাপ, তার উপর বয়স্ক; জেল্লা বলতে কিছু নেই। দেহের নানা জায়গায় দাদ আর খোস-পাঁচড়া। প্রায়ই গাছের তলায় বসে ঝিমোয়।
গাপ্পুর মহল্লায় ওর এক বাধা বৃদ্ধা মহিলা রয়েছেন। পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। স্বামী নামজাদা বস্ত্র ব্যবসায়ী। ছয়তলা বিল্ডিংটাই ওদের। একটাই ছেলে, থাকে বিদেশে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বছরে একবার এসে মা-বাবাকে দেখে যায়। ওরাও সেখানে বেড়াতে যান মাঝেমধ্যে। করোনার প্রকোপ শুরু হবার পর স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকছেন। বাজার-সদাই সব করে দেয় কেয়ারটেকার। শুধু মহিলা নিয়ম করে সারাদিনে দুবার নিচে নামেন। তখনই তিনি লোলো মেমসাহেবের সঙ্গে ওকেও পাঁউরুটি-বিস্কিট খেতে দেন। সেখান থেকে হিল্লিও কিছু পায়। তাতে ওর প্রাণটা অন্তত বাঁচে। সেজন্য নিজের মহল্লা ছেড়ে দিয়ে বেশ কদিন থেকে ওর সঙ্গেই লিভ-ইন করছে হিল্লি। নইলে যে ছুটতে পারে না, ‘বাঘা’ নামের ওর আগের জীবনের ক্ষত হারামিটাকে মুখ ভেংচে, ভয় দেখিয়ে দূরে সরাতে জানে না- তার সঙ্গে আবার থাকাথাকি কী? শুধু খাওয়ার নিশ্চয়তার জন্যই গাপ্পুকে সঙ্গ দেওয়া- নইলে কিসের কী, পান্তাভাতে গাওয়া ঘি!
গাপ্পুর প্রশ্নটা ওকে বেশ ভাবায়। কিন্তু নিজে কখনও গন্ধটা পায়নি। এসব ব্যাপারে ওর মাথা বেশি কাজ করে না। সে নিজেকে সবসময় লতার মতো ভেবে সুখ পায়। কারও উপর নির্ভরশীল থাকতেই ভালোবাসে সে। অথচ গাপ্পুর বয়স বেড়ে যাওয়ায় সারাক্ষণ পরামর্শ দিতে পছন্দ করে সে এখন। পাশাপাশি নিজের ভেতরকার উদ্ভাবনী শক্তিটুকুও আগের মতো আর নেই। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে যেমন কিছু করতে ভয় পায়, কাউকে কিছু বলতেও প্রচণ্ড তার কুণ্ঠাবোধ। দ্বিধান্বিত চরণ ফেলে চলছে সবসময়। নইলে হিল্লির পরামর্শ নেয় এসব গুরুগম্ভীর ব্যাপারে? কার নাকের ছেঁদা দিয়ে কিসব গন্ধ ঢুকছে তা নিয়ে হিল্লি কী করবে? সে কি গন্ধ গবেষক?
সহসা হিল্লির বাঘার কথা মনে হলো এসময়। ওকে সে ঘৃণা করে মনে মনে। কিন্তু প্রথম ভালোবাসা তো! মনেও পড়ে খুব। কোনো সমস্যা হলে এখনও কেন যেন বাঘাটার উপর নির্ভর করতে ইচ্ছা করে খুব। ওর প্রতি হিল্লির একটা গভীর বিশ্বাস উল্কিকাটার মতো রয়ে গেছে মনের ভেতর। কিন্তু যে-রকম পজেসিভ আচরণ আর এলানো স্বভাব ওর, তাতে কাছে ঘেঁষলে সে নিশ্চিত, আবারও সে বিরক্ত হতে শুরু করবে, নয়তো আগের মতো ক্ষোভ জন্ম হবে কথায় কথায়।
হিল্লি জিজ্ঞাসা করল, ‘গাপ্পু ভাইয়ের নাকে একটা গন্ধ আহে? এই নিয়া তুমি কইতে পারবা কিছু? তোমার নাকেও কি গন্ধটা আহে?’
‘এ জন্য ডাকছস?’ বলে রাগী চোখে গাপ্পুর দিকে তাকায় বাঘা। গাপ্পু কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে। বাঘার মেজাজ খুবই চড়া; সারাক্ষণ দলবল নিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে। সক্রিয় রাজনীতিও করে নিজেদের ভেতর। অন্যদিকে, গাপ্পু চিন্তাশীল এক জীব; কৈশোর থেকেই তার ভেতর রয়েছে এক কবি ও দার্শনিক মন। এখন বয়স হয়েছে। নড়চড়া বেশি করতে পারে না। তার উপর ওর সঙ্গে রয়েছে হিল্লি-বাঘার দীর্ঘদিনের পুরনো গার্লফ্রেন্ড। এই সূত্র ধরে ক্রুদ্ধ বাঘা যদি ওকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে, তাহলে এ বয়সে সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে? বাঘা মুখ থেকে টু শব্দটি বের করলেই হলো; ওমনি ওর দলবল ছুটে এসে আঁচড়ে-কামড়ে ওকে মহল্লা ছাড়া করবে। সে এসব ভালোই বোঝে। কেন যে হিল্লি ডেকে এনেছে ওকে? পুরনো প্রেম যেন উথলে উঠেছে মাগীর! মনে মনে রেগে যায় ওর উপর।
হিল্লি উত্তর দিলো, ‘এ জন্য না। তোরে বহুদিন দেখি না। মনডা আঁইঢাই করতাছিল। না ডাকলে তো আসিস না।’ বলে একটা ম্যারি বিস্কুট ওকে খেতে দেয় সে।
‘নতুন ভাতার জুটাইছিস। খাওয়া-খাদ্যের তো অভাব নাই দেখতেছি। খাওনের অভাবে কতজন মরতে বইছে- খবর রাখোস! ছুল্লুরে চিনতি না? রাইতের কালে রাস্তার মাইঝখাইন দিয়া গদাইলস্করি চালে হাঁটতে গিয়া একটা ট্রাক উল্টাইয়া মানুষ মাইরা ফেলছিল। হেই ছুল্লু, তিলপাপাড়ায় একটা মিষ্টির দোকানের সামনে থাকত, হে মারা গেছে কাইল। না খাইতে পাইয়া কদিন বাঁচবে- ক? হেরে লইয়া ব্যস্ত আছলাম। এমন সময় তুই ডাইকা উঠলি।’ বিস্কুটটা খেতে খেতে বেশ প্রফুল্ল মনে কথা বলতে থাকে বাঘা।
গাপ্পু এ সুযোগটাই নেয়। ভয়ে চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না বাঘার। পা ঠকঠক করে। একবার খাওয়ার লোভে পড়ে ওদের এলাকায় না বুঝে ঢুকে পড়েছিল। কী যে ঠ্যাঙানি দিয়েছিল ওর চ্যালা-চামুণ্ডারা- এখনও মনে পড়লে শরীর শিরশির করে ভয়ে।
হিল্লির দিকে চোখ রেখে নরম করে গাপ্পু বলে, ‘ভাইজান, সময়ডা ভালো ঠেকতেছে না। এমন উৎকট গন্ধ কোনদিন শুঁকিনি। ভয় হইতেছে!’
বাঘা গাপ্পুকে দেখে ফিক করে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘আরে কাকা, আমি আপনের ছেলের হমান। আমারে ক্যান ভাইজান ডাইকা লইজ্জা দেন? আমি তো গন্ধবণিক না যে গন্ধ শুঁইকা সব কইতে পারুম?’
‘তোমার তো অনেক অভিজ্ঞতা। তাই কইলাম। হিল্লিও দেখতে চাইল তুমারে।’ বিনয় ও কাকুতি একসঙ্গে জোট বাধে কণ্ঠে।
বাঘার মন নরম হয়ে যায় মুরুব্বী গাপ্পুর কথায়। কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে কী যেন ভাবল সে। তারপর বলে উঠল, ‘আপনের সামনের বাসায় একজন মেমসাহেব থাকে না? চিনেন?’
‘চিনি। তয় কতাবার্তা তো নাই।’ গাপ্পু উত্তর দেয়।
পাশ থেকে হিল্লি খনখনিয়ে বলে ওঠে, ‘খুব দেমাগ। কতাই কইতে চায় না। চোহের সামনে গাড়ি দিয়া আয়ে আর যায়। হের লগে কতা কমু কেমনে?’
‘বাসার ভিতরে ঢুইকা জিগাইয়ো। মহিলা কিন্তু খুব ভালো। নাম জানো? লোলো।’
‘তর লগে ভাব অইছে, না? তোর মতন লুচ্চা আমি বাপের জন্মেও দেহি নাই।’ ঘোঁত ঘোঁত করে ওঠে হিল্লি।
বাঘার মুড ভালো। সে মিটিমিটি হেসে ঘাড় দুলিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয়। অন্যসময় হলে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত সে। পাল্টা হিসাবে হিল্লির চরিত্র নিয়ে কথা বলতেও কসুর করত না। এখন সময়টা খারাপ। অভাব বেঁধে ফেলতে চাইছে সবাইকে। খুব শঙ্কার ভেতর জীবন এগোচ্ছে। রাতে খেলে সকালে কী খাবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় সময় কাটছে বাঘার। তাই সে এড়িয়ে গেল এসব প্রসঙ্গ।
গাপ্পু আর দেরি করে না। বাঘা বিদায় নেবার পর দুই লাফে লোলোদের বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়ল সে। গ্যারেজের ভেতর এক কোণে মেমসাহেবের আবাস। সেখান থেকে সুখাদ্যের একটা ঘ্রাণ আসছে নাকে। মাঝে মাঝে মহল্লায় বিয়ে-শাদি হলে এসব দামি খাবারেব স্বাদ পায় ওদের জিহ্বা। এখন মানুষগুলোই মুখোশ পরে ভয়ে ভয়ে রাস্তায় চলাচল করছে। চেনাশোনা কাউকে আর আগের মতো চেনা যায় না। মুখে মুখোশ, চোখে ইয়া বড় গগলস, মাথায়-হাতে আবরণী দিয়ে বের হচ্ছে। কে যে কোন জন- গাপ্পু ওর দুর্বল দৃষ্টিশক্তি দিয়ে ঠাহর করতে পারে না। প্রায়ই ভুল হয়।
সে এগিয়ে যায় তার ডেরার দিকে। পিছু পিছু চলে হিল্লি। এসব বাড়িতে ওদের ঢোকা নিষেধ। ঢুকলেই অনাহুত দূর-দূর শুনতে হয়; নয়তো বেতের বাড়ি খেতে হয় কেয়ারটেকারের। খুবই নিদারূণ সব অভিজ্ঞতা। এখন কেয়ারটেকার যেখানে থাকার সেখানে নেই। হয়তো কোথাও গেছে। এই ফাঁকে ওরা দুজন চলে এসেছে একেবারে লোলো মেমসাহেবের কাছে।
মেমসাহেব কখনও ঝিমুচ্ছেন। কখনও বা ঘুম ভেঙে একটু-আধটু খাবার মুখে তুলছেন আলতো করে। মিটিমিটি সুখী চোখ দিয়ে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন এদিক-ওদিক। সমস্ত শরীর কম্বলের মতো সাদা-কালো পশমে ঢাকা। এর ভেতর দুটো চোখ ছুলানো বেতফল হয়ে পিটপিট করছে।
গাপ্পু এসেই বিলম্ব না করে বলে ওঠে, ‘ম্যাডাম, প্লিজ চিৎকার করবেন না। আমরা এ মহল্লার স্থানীয় বাসিন্দা। কদিন ধরেই একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে আসছে আমার। এক্কেরে দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা! আমাদের এক বন্ধু বাঘা বলল আপনের কতা। আপনি নাকি ডাক্তার আমাদের সমাজের? খুব নামডাক ছিল নাকি বিদেশে? এ বিষয়ে কিছু কি বলতে পারেন আমাকে?’ এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁফাতে থাকে সে। বুকের ভেতরটা পাতলা লাগে জমানো কথাগুলো বমির মতন উগড়ে দেয়ায়।
প্রথমে ওদের দেখে যেরকম বিস্মিত হয়েছিলেন, বাঘার কথা বলতেই তার চেহারা নিমিষে আর্দ্র হয়ে এল। একমুখ রহস্যময় হাসি হেসে বলে উঠলেন, ‘বাঘা আসেনি?’ পিটপিটে চোখ দুটোয় যেন একধরনের ব্যাকুলতা প্রকাশ পায়।
পিছন থেকে অনুচ্চ গলায় হিল্লি বলে ওঠে, ‘মাগীর কামড় দেহ, বাঘারে না দেকলে তাইর জান বাঁচে না! আমরা কেউ না। নডি কুনহানের!’ অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে গালি মিশে থাকে।
গাপ্পু বলল, ‘না ম্যাডাম।’
মেমসাহেব চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। চোখ বুঁজে কী যেন ভাবেন। অনেক্ষণ পর গাপ্পুর দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা, কখন গন্ধটা পান মনে করতে পারেন?’
‘এ বাড়ির ম্যাডাম যহন আমাদের বিস্কুট-পাঁউরুটি খাওয়ান তহন।’ গাপ্পু বলে।
সঙ্গে সঙ্গে লোলো কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। আনমনা-উদাসীন দৃষ্টি তার।
হিল্লি ওকে পিছন থেকে চিমটি কাটে নখ দিয়ে। গাপ্পু টের পেলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ মেমসাহেব আর সে একেবারে মুখোমুখি। চোখের পাতা ফেলবার জো নেই।
সহসা লোলো মেমসাহেব বলে উঠলেন, ‘অনেক তো বেলা হলো। তোমাদের নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। নাও, একটা মাংসের হাড় নাও। দুজন মিলেঝুলে খেয়ে নাও।’ বলে ঘরের ক্ষুদে দরজার শিকের ফাঁক গলিয়ে একটা হাড় ওদের দিকে ঠেলে দেয় লোলো।
পেটে ওদের অসম্ভব ক্ষুধা। তাই দ্বিরুক্তি না করে আয়েস করে খাওয়া শুরু করে গাপ্পু আর হিল্লি। চাপা গলায় হিল্লি মন্তব্য করে, ‘যত বজ্জাত ভাবছিলাম, বিদেশী মাগী তত খারাপ না। মনটা জবর ভালা।’
খাওয়া শেষ করার পর লোলো গাপ্পুর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘শোনো, এ গন্ধটা সবাই পায় না। আমাদের ভেতর যাদের ডায়াগনোস্টিক নোজ আছে, তারাই কেবল পায়। তোমার সেটা আছে। জানো, লন্ডনে থাকতে আমি এই গুণের জন্য একটা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে কাজ করেছি। কোনটা পারকিনসন আর কোনটা ক্যানসার সহজেই বলতে পারতাম শুঁকে শুঁকে। এটা একটা রেয়ার গুণ। তোমার সেটা আছে।’ বলে থামেন একটু।
এ কথায় গাপ্পুর বুক গর্বে ভরে ওঠে। হিল্লির দিকে তেরছা করে তাকিয়ে মুচকি হাসে সে।
গাপ্পু প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু লোলো ম্যাডাম, আমার প্রশ্নের তো উত্তর পেলাম না?’ চোখে অপার কৌতূহল।
উত্তরে লোলো কিছু বলতে যাবেন ওমনি কোত্থেকে যেন কেয়ারটেকার ছুটে আসে এদিকে। সহসা ওদের দেখে দূর দূর করে গ্যারেজ থেকে বের করে দেয়। তাড়া খেয়ে অসহায়ের মতো ওরা গেটের বাইরে চলে যায়।
কেয়ারটেকার লোকটি এবার গেটের বাইরে গলা বাড়িয়ে ওদের দুজনকে রূঢ় ভাষায় ধমকে ওঠে, ‘তোরা আইজ কোনো খাওন পাইবি না। ইদিকে ঘুরঘুর করতে দেখলে ঠ্যাং ভাইঙ্গা ফেলামু। ম্যাডামের লাই পাইয়া ঘাড়ে চাইপ্পা বইছে। পারলে ঘরের ভিতরে হাইন্ধা পড়ে। যা ভাগ!’
বকা খেয়ে গাপ্পু আর হিল্লির মন খারাপ হয়ে গেল। পিছপা হয়ে কয়েক কদম হেঁটে গলির মুখে একটা গাছের নিচে বসে ঝিমুতে থাকে। চোখের সামনে থোক থোক অন্ধকার। ক্ষুধার জ্বালা যে কী ভয়ঙ্কর বলার অপেক্ষা রাখে না। গাপ্পুর চেয়ে হিল্লি আরও মুষড়ে পড়ে। সে ক্ষুধার জ্বালা একদম সহ্য করতে পারে না। এসময় ছুল্লুর কথা মনে পড়ে গেল। এমন সাহসী বীর যদি না খেতে পেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে তো ওর কী হবে?
খুব বিষণ্ন বোধ করে হিল্লি। কোনো কথা সরে না মুখে।
ঠিক এসময় হর্ন বাজাতে বাজাতে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে লোলো মেমসাহেবের বাড়িটার সামনে। বিশ-পঁচিশ মিনিট দাঁড়ায় সেখানে। তারপর আতঙ্ক ছড়ানো সাইরেনের শব্দে চারপাশ বিদীর্ণ করতে করতে অ্যাম্বুলেন্সটি ফের ওদেরই দিকে এগিয়ে আসে।
গাপ্পু আর হিল্লি ভয়ে খোলা ড্রেনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘূর্ণায়মান লাল সাইরেনের শব্দে বারবার পিলে চমকে উঠছে ওদের। হঠাৎ গাড়িটা ওদের সামনে এসে গতি কমালো এবং ওদের চমকে দিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে একটি আস্ত পাঁউরুটি উড়ে এসে পড়ল ওদেরই সামনে। গাপ্পু স্পষ্ট দেখল, সেই চেনা ম্যাডাম একটা স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। তার আলুথালু সাদা চুল স্ট্রেচারের দুইপাশে ছড়ানো; মুখে অক্সিজেনের মাস্ক। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে এসে ওকে নিস্তব্ধ করে ফেলল। কোনোকিছু স্পষ্ট করে বোঝার আগেই গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে গেল ওদের চোখের সামনে থেকে।
একটু বাদে গাপ্পু রুটিটা আগলে ধরে হিল্লিকে বিষণ্ন সুরে বলে উঠল, ‘বুঝতে পারতেছি রে এখন। লোলোদের বাড়ির যে ম্যাডাম আমাদের দুইবেলা খাইতে দিত, তার কাছ থেইকাই গন্ধটা আমি সবসময় পাইতাম। ম্যাডাম বোধ হয় আর বাঁচব না রে! তবু যাওনের আগে রুটিটা দিয়া গেল আমাদের খাওয়ার লাইগা! এইসময় এমনও মানুষ আছে দুনিয়ায়!’
হিল্লির অনুচ্চস্বরে মন্তব্য করে, ‘গন্ধ পাইয়াও তো সাবধান করতে পারলি না ম্যাডামরে! কী লাভ তাইলে- ক?’
‘আমাদের কথা তো উনারা বোঝে না রে হিল্লি । বুঝলে কি পৃথিবীর চেহারা এমন কুৎসিত অইতো?’ বলেই গাপ্পু মৃদুস্বরে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।
হিল্লি চোখের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শ্রীহীন, মায়া-মমতাহীন ছায়া দেখতে পায়।