তখন জিপিএ ফাইভ ছিলো না। ডিভিশন ছিলো এবং রেজাল্ট নিয়ে ভীষণ টেনশন ছিলো। থাকার কারণ, আমি ছিলাম যারপরনাই বেকুব কিসিমের ছাত্র! এতই বেকুব যে, বাংলা স্যার ক্লাস এইটে আমার নাম পর্যন্ত দিয়েছিলেন— শামৃ, অর্থাৎ শাখামৃগ।
আনন্দের ব্যাপার, ম্যাট্রিকে এই প্রশ্নটা আসলো— শাখামৃগ মানে কী? আরো আনন্দের ব্যাপার আমি অত্যন্ত খুশি হয়ে উত্তর লিখলাম— শাখামৃগ মানে মিজানুর।
বলাবাহুল্য, মিজানুর আমার নাম। মিজানুর হাসান মিজু ওরফে শামৃ।
পরীক্ষা শেষে সবাই নিয়ম করে প্রশ্ন মেলাতে বসে। আমিও বসলাম। আর যাই হোক, একটা প্রশ্ন আমার কমন পড়েছে। আমার তাতেই বিমলানন্দ! কিন্তু বিমলানন্দ বিমল দুঃখে পরিণত হতে বেশিক্ষণ সময় নিলো না। ওরা বলল, শাখামৃগ মানে বানর! মানে বান্দর!
ধড়াস করে উঠল বুকটা! আমি যে অন্য একটা মানে লিখে এসেছি সেটা চেপে গেলাম সাথে সাথে। মুখে সবজান্তা হাসি ছড়িয়ে বললাম, আমিও লিখছি এইটা! আমিও লিখছি!
কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাংলা স্যারের ওপর ম্যালা রাগ হলো। এই লোক এতদিন ধরে আমাকে বান্দর বলে আসছে দুঃখ নাই; কিন্তু একবার যদি ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলতো, তাহলে এক নম্বর তো নিশ্চিত হতো। ওরা যে যে উত্তর বলছে তার তো কিছুই মিলছে না!
আমি খুবই ভয় পেলাম। বাংলাতেই না ফেল করে দিই! তবে বাংলা আমাকে হতাশ করল না। বাংলায় পাস করলাম। কিন্তু ইংরেজি, সাধারণ বিজ্ঞান ও গণিত আমার সাথে বিস্তর প্রতারণা করল। তিন সাবজেক্টে ফেল করে আমি স্কুলের বারান্দায় ঘাস চিবাতে থাকলাম। চিবাতে চিবাতেই মনে হলো আমি শুধু যে বেকুব তা না, গরুও। পরক্ষণেই সে সম্ভাবনা বাদ দিলাম— আর সব বাদ দিলেও গরু দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ভবিষ্যতের ঘুঁটে দেয়! আমি আর কী দিই!
তিন সাবজেক্টের ফেলের পর যে পরিমাণ মন খারাপ হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল আমি বোধহয় নড়তে পারব না। কিন্তু কে জানত, তার চাইতেও বড় শোক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল! খবর পেলাম— রঞ্জু সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে!
আর থাকতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আমার বাড়ি আর রঞ্জুর বাড়ির মধ্যে মাত্র একটা গলি। রঞ্জুকে যখন পেটায় তখন আমি তা স্পষ্ট শুনতে পাই। আমাকে পেটালেও রঞ্জু! আজ আমার বাড়ি থেকে যে চিৎকার যাবে তা শুনেশুনে ওই বদটা খুব হাসবে! মিষ্টিও পাঠাবে নিশ্চয় বাড়িতে। রঞ্জুর সেকেন্ড ডিভিশনের রসগোল্লা খাইতে খাইতে আমার পিঠের চামড়া লাল করে ফেলবে বাপ-চাচারা!
আমার মুখের থুতু শুকিয়ে আসলো। রঞ্জুও যদি ফেল করত একটা চান্স ছিল… এখন আর কোনো উপায় থাকল না! বাপ-চাচা পেটাবে; আর মা-চাচিরা ফিট হয়ে যাবে! কিছুটা আমার ফেলের দুঃখে আর অনেকটা আমার মাইর খাওয়ার শোকে!
ফলে বাড়ি আর ফিরলাম না! না না। পালিয়ে যাচ্ছি এই রকম আবার ভাইবেন না! পালানোর জন্য যে মানসিক শক্তি দরকার তা আমার নাই। বেকুব কিসিমের মানুষদের তা থাকেও না। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম বরফ মিলের সামনে। রোজা ছাড়া এই বরফ মিলে আর কখনো আসি না। হাজার হাজার বরফ তৈরি হয় এখানে। রোজার সময় বরফ কিনে পলিথিনে করে নিয়ে যাওয়া হয়। শরবতে দেওয়ার জন্য। আজও বরফ নিতে আসলাম, কিন্তু কারণটা ভিন্ন।
: কয় কেজি বরফ লাগব?
: এই তিন কেজি… না না… পাঁচ কেজি!
: এত বরফ কী করবা?
: আছে। কাজ আছে।
: এই তুমি না এইবার ম্যাট্রিক দিছিলা… পাস করো নাই না?
: বরফ দেন তাড়াতাড়ি।
: বাড়িতে কেউ ফিটের রোগী আছে নাকি?
: কত টাকা?
: টাকা লাগবে না যাও। আহারে! কোন মুখে এই খবর দিবা কও…! ফিটের রোগী তো শুনামাত্র শেষ! তুমার জন্য মানুষ মইরা যাইব! মুর্দার জইন্য কি আর টাকা নেওন যায়!
: এইসব কী বলেন?
: ফিট লাগার সাথে সাথেই মাথায় বরফ দিবা… এক্কেবারে চাইপা ধরবা। ভালো কইরা প্যাকেট কইরা দিছি… ইশশশ! এইসব পরীক্ষা ক্যান যে আসে দুনিয়ায়!
মিল-মালিকের শেষ কথায় চোখে পানি চলে আসল। হাতে বরফ থাকায় পানিটা মুছতে পারলাম না। টপ করে পানিটা পড়ল বরফের ওপর।
: কাইন্দো না কাইন্দো না। শুনো। বাড়ি থেইকা তাড়ায়ে দিলে এইখানে আইসো। আমার মিলে আরো ম্যাট্রিক ফেল পোলাপান কাজ করে। তুমারেও কাজ দিমুনে!
২.
বাড়ির গেটে দাঁড়িয়েই শুনলাম ভেতরে মহাগ্যাঞ্জাম চলছে। একবার বাবার কণ্ঠ তো একবার চাচার… মাঝে মাঝে চাচির! মায়ের কণ্ঠ পাচ্ছি না… এরই মধ্যে ফিট লেগে গেল কিনা কে জানে! লাগলে, এক্ষুনি বরফ থেরাপি দেয়া লাগবে।
ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। উঠানে মহাগ্যাঞ্জাম। মহাগ্যাঞ্জাম মানে এমন যে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ওদিকে ছুটে যাচ্ছে তো ও ওদিকে! কিন্তু সবার মুখেই ভীষণ খুশির ছটা! মানে কী! মানেটা কী! ভালো করে খেয়াল করলাম যে আমাকে এর মধ্যে কেউ ভালো করে খেয়ালই করছে না। দুই তিন জনের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। এ ওকে, ও তাকে… মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে!
আরও পড়ুন: বুক রিভিউ : সেই রাতে পূর্ণিমা ছিল
মানে? আমার ফেল করার বেদনায় বাড়ির সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আগে থেকে কিনে রাখা মিষ্টি খেয়ে ফেলছে?
না। এমন হবার কথা না। বাড়ির মানুষদের ফিটের দোষ থাকলেও ছিটের দোষ তো কোনোকালে ছিল না!
আমি চাচাত বোনকে বিড়বিড় করে বললাম, কী হইছে রে?
বোন বলল, ওরে! তুই জানিস না এখনো?
: কী?
: মিঠু ভাই আছে না… মিঠু ভাই…! ওর তো ছেলে-মেয়ে হয়েছে!
: ছেলে-মেয়ে মানে?
: আরে মিঠু ভাই… ওই যে রাজশাহীতে থাকে… কতদিন হয়ে গেল না… বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিল না… ভাইয়ের ছেলেও হয়েছে…মেয়েও হয়েছে…যমজ! কী খুশির খবর, না?
আমি মাথা নাড়ালাম। চাচি এসে মুখে মিষ্টি ঠুসে দিলো— খা খা! আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে!
আমি মাথা নাড়ালাম। চাচাও দেখছি মহাখুশি। বাবা তো লাফাচ্ছে বলতে গেলে। এতদিনে বংশের দুর্নাম ঘুঁচল। আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, আমি আরেকটা দুর্নাম করে আসছি…। সবাই থমকে তাকালো আমার দিকে। বাড়ির উৎসব হঠাৎই যেন হারিয়ে গেল।
বোন বলল, কী? কী করেছিস? মেয়ে ভাগিয়ে এনেছিস? কোথাকার মেয়ে? দেখতে কেমন? কই রে?
আমি বললাম, আরে কী বলো এইগুলা! মেয়ে কেন ভাগাবো?
বাবা বলল, তাহলে? কী হয়েছে? কী করেছিস? দেখ মিজু, এমন একটা ভালো দিনে কোনো খারাপ খবর শোনাবি না!
চাচা বলল, খারাপ কিছু শুনালে থাবরায়া দাঁত ফেলে দিবো হারামজাদা!
আমি একটা ঢোক গিললাম। তারপর বললাম, আজ তো ম্যাট্রিকের রেজাল্ট ছিল…
মা বলল, হ্যাঁ। কী হয়েছে তাতে? লেটার পাইস নাই একটাও?
আমি করুণ চোখে তাকিয়ে থাকলাম। এরা আমার কাছ থেকে লেটারের আশা করে আর আমি এদের জন্য কী উপহার নিয়া আসছি!
চাচা বলল, কী হলো? ধর্মের লেটার পাইস নাই রে?
আমি কুঁইকুঁই করে বললাম, লেটার না… আমি পাস করতে পারি নাই!
সবাই থমকে গেল আবারও। তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তারপর চাচা হো হো করে হেসে উঠল। আমার দিকে এগিয়ে আমার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, সাবাস! বংশের ধারা ধইরা রাখছোস দেখছি… তোর বাপ, আমি… আমরা কেউই প্রথমবারে ম্যাট্রিক পাস করি নাই! পাস ফেইল নিয়া চিন্তা করবি না একদমই! মিষ্টি খা…
আমি বাবার দিকে তাকালাম। আর তারপরই কী হলো কে জানে… মাথাটা আমার ঘুরে উঠল। পরে শুনেছিলাম, আমার নিয়ে আসা বরফ খুব কাজে লেগেছিল!