কখনো কোনো অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি সে, টিভিতে দেখেনি কোনো দৌড়ের দৃশ্যও। তবু এখন সে যে দৌঁড়টা দিলো, তাঁর পায়ের সঙ্গে প্রাণের আকুতি দেখলে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নও হিংসা করত।
দৌঁড়টা দেয়ার আগে রহমত অবশ্য স্থিরই ছিল, এক জায়গায় তাদেরকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। শেষরাতে বাড়ি ঘেরাও দিয়ে তাঁদের কয়েকজনকে অস্ত্রধারীরা ধরে এনেছিল। একটা হেলিকপ্টারে টেনে তুলেছিল। বিশাল লোহার পোকাটার পেটে ঢুকতে ঢুকতে নিজেকেই প্রশ্ন করেছিল রহমত, ‘এইডা কেমুন যন্ত্র বানাইছে, এত জোরে পাংখা ঘুরতাছে, কিন্তু আওয়াজ নাই মুডে।’ হেলিকপ্টারের আওয়াজে তো ঘুমই ভেঙে যাবার কথা, অথচ তাঁরা টেরও পায়নি।
রহমতদের হাত বাঁধা হয়ে গিয়েছিল আগেই, এবার চোখ বেঁধে কপ্টারের মেঝেতে উপুড় করে শুইয়ে দেয়া হলো। অনেকক্ষণ উড়ে চলার পর হেলিকপ্টার কোথাও নামল। চোখ-বাঁধা অবস্থাতেই ওদের নিচে নামানো হলো। কতক্ষণ কেটেছে সে জানে না, শুধু জানে লম্বা, লম্বা একটা অন্ধ অপেক্ষা। এর মধ্যে চারপাশে ঘূর্ণি শুরু হলো। শব্দ না পেলেও রহমতের মনে হলো হেলিকপ্টারটি উড়ে যাচ্ছে। এরপর আবার নীরবতা। শুধু মাঝে মাঝে ফিসফাস শব্দ, জুতার আওয়াজ, কিছু পান করার ঢকঢক আওয়াজ, আর অন্ধকার, নিকষ কালো অন্ধকার।
আরও অনেকক্ষণ কেটে গেলে কেউ একজন এসে ওদের চোখের বাঁধন খুলে দিলো, খুলে দিলো হাতের বাঁধনও। রহমত দেখল তাঁরা একটা ফুটবল মাঠের মত ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে। চারপাশে ঘন বন, সামনে একটা পোড়োবাড়ি, তার দেয়াল ঘেঁষে দুটো চেয়ারে দুজন অস্ত্রধারী বসে। কাঠের পোড়-খাওয়া টেবিলের দুপ্রান্তে দুটি রাইফেল অলস ঝিমুচ্ছে, ওদের মাঝখানে একটা লাল টিনের ক্যান। মদ, না অন্যকিছু, রহমত ভেবে পেলো না।
‘বাঁচতে চাও তো দৌড়াও। আমরা পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে গুলি শুরু করব, এর মধ্যে কেউ বনে ঢুকে যেতে পারলে বেঁচে যাবে।’
রহমতরা কিছু বুঝতে পারল না। দাঁড়িয়ে থাকল।
একজন অস্ত্রধারী ওদের দিকে রাইফেল তাক করল।
‘কুইক, ওয়ান, টু, থ্রি…।’
আর কিছু বলতে হলো না। রহমত জানে জুতা দৌড়ের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সে উবু হয়ে জুতা খুলে নিল, তারপর দৌড়। দৌড় দিলো ধরে আনা বাকি পাঁচজনও। চারজন তার বয়সী, অন্যজন এলাকার মাতবর আওয়াল খাঁ। আওয়াল খাঁর বয়স হয়েছে, ভুড়িও আছে, তিনিও ছুটলেন, যদিও ওটাকে দৌড় না বলে অনেক ওজন হয়ে যাওয়া হাঁসের শরীরটাকে হেলিয়ে-দুলিয়ে পুকুরে যাওয়া বলাই ভালো। তিনি থাকলেন সবার পিছনে, তার চিৎকারটাই প্রথম শোনা গেল। রহমত পিছনে ফিরলো না, তাঁর সামনে এখন কেবল বনের ধার, জগতে আর কিছু নেই, বোধকরি কখনও কিছু ছিলও না।
রহমত দৌড়াচ্ছে। মাঠের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে, এমন সময় তার হাতে রক্তের ছিটে লাগল। চোখের কোণে ধরা পড়ল তার থেকে হাতখানেক পিছনের জনের মাথার খুলি উড়ে গেছে। ‘হায় খোদা! বাঁচাও!’ সে আরও জোরে দৌড় দিল। এইতো আর দু’পা গেলেই বন, মাঠের থেকে বনের ভূমি বেশ একটু নিচু, একবার গিয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যাবে সে।
এক পা মাঠে আর এক পা বনের সীমানায় শূন্যে ভেসে, এমন সময় তাঁর শরীরটা বেঁকে গেল। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি খেল সে। ঝাঁকি খেল হাতের জুতোজোড়াও। হাত থেকে ছুটে গিয়ে, সিনেমায় দেখা স্লোমোশনের মতো তারা শূন্যে ঘুরতে লাগল, তারপর কোথায় পড়বে ঠিক করতে না পেরে সরাসরি নিচে নেমে এল।
মাঠের এ প্রান্তে একজন অস্ত্রধারী সাইলেন্সারযুক্ত রাইফেলটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে পার্শ্ববর্তীর দিকে ফিরল। ক্যানটাকে দেখিয়ে সে বলল, ‘সবচেয়ে দূরেরটাকে তুমিই শুট করেছো। পানীয়টা তোমারই পাওনা।’