ইচ্ছেমৃত্যু

ইচ্ছেমৃত্যু
নভেম্বরের ১৩ তারিখ,বৃহস্পতিবার বিকেলে ছাত্র ছাত্রীদের অংক করাচ্ছিলাম; পিয়ন ছগির আমাকে চা দেয়ার সময় বললো “স্যার,খবর শুনেছেন গতকালের লঞ্চডুবিতে এ গ্রামেরই একজন মহিলা মারা গেছেন;কিছুক্ষণ আগে নাকি তার লাশ এম্বুলেন্স এ করে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে,সন্ধ্যা নাগাদ জানাজা” কথাগুলো বলেই ছগির চলে গেলো। সামনের বেঞ্চির একদম কোনায় বসা ছিলো রাসেল,আমার ছাত্র; ও হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললো,স্যার যিনি মারা গেছেন ওনাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির সাথেই,হালিম কাকার বৌ,নাম ভানু;ওনার মেয়ের কাছে যাচ্ছিলেন। ‘ভানু’ নামটা শুনতেই সামান্য চমকে উঠলাম।
কারণ,একসময় আমিও এক ভানুকে চিনতাম; আজ থেকে ২১ বছর আগে,সে আমার প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলো। আমি তখন সবে এ স্কুলে জয়েন করেছি,বয়স বড়জোর সাতাশ কি আটাশ; স্কুলের সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক,আশপাশের দু এলাকার মধ্যে একমাত্র ডিগ্রি পাশ। তাই সবার কাছে আমার জায়গাটা ছিলো বেশ উঁচুতে। ভানু তখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। বেশ ভালো ছাত্রী আর অংকেও তুখোড় মেধাবী; প্রায় সময়েই ব্লাকবোর্ডে ওকে দিয়েই অংক করাতাম। মাঝে মধ্যে আসতো,’স্যার এ অংকটা বুঝিনি,একটু দেখিয়ে দিলে ভালো হয়’ আমিও দেখিয়ে দিতাম,ওর জানার আগ্রহ বরাবরই আমায় মুগ্ধ করতো। অন্যান্য শিক্ষকদের থেকে আমার বয়স কম বলে ছাত্রছাত্রীদের সাথে আমি ভালোভাবে মিশতে পারতাম। একবার হঠাৎ করেই,ভানু দরজায় নক করলো, ‘স্যার আসতে পারি..?’
-হ্যাঁ এসো
-আমার দিকে লাজুক চোখে তাকিয়ে বললো
‘হ্যাপি বার্থডে স্যার’ সাথে একটা হলুদ খামে মুড়ে পেন্সিল দিয়ে আঁকা আমার একটা ছবি,ডান দিকের এক কোনায় নীল কালিতে দুটো তারা,আর তার নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘If you fall,I’ll be there’ হ্যাঁ,এভাবেই ভানু আমার সবথেকে প্রিয় ছাত্রী হয়ে ওঠে। এর মাঝে একবার আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম,টাইফয়েড হয়েছিল। পনেরো দিনের মতো স্কুলে যেতে পারিনি। এই পনেরো দিনের মধ্যে ভানু ওর বান্ধবীদের নিয়ে দুবার এসে আমাকে দেখে গেছে। এর কয়েকমাস পরের ঘটনা,ভানু তখন ক্লাস টেন এ।
ও আগে মাঝে মাঝে আমার কাছে আলাদাভাবে অংক দেখাতে আসলেও ইদানীং রোজ ২-৩বার করে আসছে। না ব্যাপারটা আমার কাছে একটুও অস্বাভাবিক লাগেনি,আমি সরল মনে ওর গানিতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করে দিতাম। কিন্তু আড়ালে আড়ালে খবর ছড়িয়ে গেছে আমার আর ভানুর মধ্যে নাকি চুটিয়ে প্রেম চলছে, আমি অবশ্য তখনও এগুলো টের পাইনি। একটা সময় পর আমার কলিগরাও আমার দিকে একটু কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে।ক্লাসে ছাত্র ছাত্রীরা আমাকে দেখলে হাসছে; সবকিছু আমার কাছে সামান্য অস্বাভাবিক লাগা শুরু করে। এরই মধ্যে একদিন টিফিনে ভানু আমার কাছে অংক দেখাতে এলো,ও চলে যাওয়ার একটু পরেই আমার স্কুলের হেডমাস্টার আসলেন আমার ডেস্ক এ। উনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন,’জাকির সাহেব,আপনি এখনো বিয়ে করছেন না কেনো…? স্যারের হঠাৎ এমন প্রশ্নে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। বললাম স্যার,এখনো বিয়ে নিয়ে খুব একটা ভাবিনি।
–এমন কথা বললে হবে,লোকে তো চারদিক থেকে নানান কথা বলছে। আমি তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে, স্যার আসলে কি বুঝাতে চাইছেন। ওইদিন বাড়িতে যাওয়ার পরে রাতে মা বললেন, “আজ দুপুরে তোর ছাত্রী ভানুর বাবা আর তোর স্কুলের সভাপতি এসেছিলেন বাড়িতে” আমি রিতীমত আশ্চর্য হয়ে গেলাম,
–কেনো ?
–তুই নাকি দু বছর ধরে তার মেয়ের সাথে কি সব করে বেড়াচ্ছিস,এলাকার লোকজন ছি ছি করছে।
সভাপতি বলে গেছে,তুই যেন সামনের মাসেই ওকে বিয়ে করে ফেলো। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হ্যাঁ,ভানুর প্রতি আমার যেটা ছিলো,সেটা হতে পারে ভালোলাগা,তাও সামান্যতম কিন্তু আমার এ হুঁশটুকু ছিলো যে ও আমার ছাত্রী আর সেজন্যই আমি সেটাকে কোনোদিনও ভালোবাসায় রূপ দেইনি। পরদিন ওকে ডাকলাম,জিজ্ঞেস করলাম,তুমি এসব কি ছড়িয়েছো মানুষের কাছে।
ভানু চুপ করে রইলো, একটা কথাও বললো না। ওর চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়াচ্ছিল। দুমাস বাদে ওর এসএসসি পরীক্ষা; এই দু-মাসে ওর সাথে আমি আর একটা কথাও বলিনি। চারদিকে অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ছিল যে, আমি যদি আর একটু ওকে প্রশ্রয় দিতাম তাহলে হয়তো আমার চাকরি বাঁচানোই দায় হয়ে যেতো। আমার জন্মদিনে ওর দেয়া হলুদ খামটা আবারও খুললাম,কাগজটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই চোখে পড়লো এক কোনে লেখা I love you sir…লেখাটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলেছে কিন্তু দাগগুলো ভীষণ স্পষ্ট। এরপরে ওদের ফেয়ারওয়েল এর দিন এলো,ভানুর স্কুল জীবনের শেষ দিন। প্রায় দু’মাস পরে ওইদিন দুপুর দুটোর দিকে ভানু আবারও আমার দরজায় নক করলো, আমায় ডেকেছিলেন স্যার..? বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললাম ‘না’ ভানু আবার জিজ্ঞেস করলো “আমায় ডেকছিলেন,
-‘না’
ব্যাস এটাই ছিলো আমাদের শেষ কথা। এরপর আর কোনোদিনও ওর দেখা পাইনি। বহুদিন পর একবার মনে হয়েছিলো,ও যদি আমার ছাত্রী না হতো তাহলে হয়তো গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো। পাঠক এতক্ষণ যেই ভানুর কথা শুনলেন; এই সেই ভানু,আমার ছাত্রী;যে গতকাল লঞ্চ ডুবিতে মারা গেছে। ইচ্ছে ছিলো জানাজায় অংশ নেয়ার কিন্তু পারিনি। সপ্তাহখানেক পরে,বিকেলবেলা হাঁটতে হাঁটতে ওদের বাড়িতে পৌঁছাই। ওর বড় ছেলে আমাকে ওর কবরটা দেখিয়ে দিলো পুকুরের উত্তরপারে একটা উঁচু ঢিবির মতো, চারপাশে কাঁচা বাঁশের বেড়া,বিকেলের সূর্য সেই বেড়া ছুঁয়ে ওর কবরের ওপর পড়ছে। আমি ওর কবরের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম।
আমার চোখে তখনও ভাসছিল ষোল বছরের একটা কিশোরী মেয়ের ছবি আর তার সাথে জড়ানো হাজারো স্মৃতি। এরপর পকেট থেকে একটা কলম আর এক টুকরো কাগজ বের করে তাতে লিখলাম, ‘Here sleeps Bhanu,My Student’ ফিরে আসার সময়ে কাগজটাকে একটা শুকনো মাটির দলা দিয়ে ঢেকে রেখে এলাম ওর কবরের ওপরে। এতগুলো বছর পর কেনো জানি আবারও খুব জানতে ইচ্ছে করছিল,শেষদিন ও আসলে আমায় কি বলতে চেয়েছিলো; আমার অবহেলা সেদিন ভানুকে তার শেষ কথাগুলো বলার ন্যূনতম সুযোগটুকুও দেয়নি। থাকুকনা কিছু ইচ্ছে স্তিমিত, কিছু গল্পের শেষ লাইন দিতে নেই,অপূর্ণতায় ই ভালো মানায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত