বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা বরাবরই সাপে – নেউলে। ছোট বেলা থেকেই আমি কেন জানি বাবাকে সহ্য করতে পারতাম না। এটা নয় যে উনি আমার আপন বাবা নন,নিজের আপন বাবা হওয়া সত্ত্বেও আমি তাকে খুব অপছন্দ করতাম। আমার অপছন্দের তালিকায় যতো লোক ছিল তার মধ্যে বাবা অন্যতম। মা এ নিয়ে আমাকে অনেক কথা বলেছিল আমি পাত্তা দিতাম না। আমি যখন ক্লাশ ২ এ পড়ি তখন মা খুব অসুস্থ হয়ে পরে ,যদিও কারণটা আমি ছিলাম। আমি সেদিন ভুল করে ঘরে রাখা ইঁদুর মারা ওষুধ খাবারের মধ্যে কোনভাবে মিশিয়ে দেই ,যার কারণে মা অসুস্থ হয়ে যায়। এর এক বছর পর আমার আর একটা ভুলের কারণে মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে বাবা আমাকে সহ্য করতে পারত না।
আমি বাবা ,মায়ের একমাত্র ছেলে। যদিও মা মারা যাবার পর বাবা একাই আমায় মানুষ করেছে ,২য় বার বিয়ের কথা ভাবে নি। মা যে বছর মারা গেল সে বছর আমরা খুব আর্থিক সমস্যায় পরে যাই। আমি বাবার কাছে একটা সাইকেল চাই ,কিন্তু বাবা দেয়নি। সেদিনের পর থেকে আমি বাবাকে বাবা বলে ডাকতাম না। সবসময় আপনি বলেই ডাকতাম। কোন কিছুর দরকার ছাড়া বাবার সাথে ২য় কেন কথা আমি বলতাম না। আমাদের মাঝের এই দূরত্বটা দিন দিন বেড়েই চলছিল আর সেদিকে আমার কোন ভ্রুক্ষেপেই ছিল না।
আজ আমি ভাল সরকারি চাকরি পেয়েছি। পড়াশোনার সুবাদে বাবার থেকে অনেক আগেই সরে এসেছি,তবে এ নিয়ে আমি খুব খুশি ,ওই মানুষটার মুখ অন্তত দেখতে হতো না। আমার প্রয়েজনীয়,টাকা মাসের শুরুতেই বাবা পাঠিয়ে দিত ,কখনো কখনো প্রয়েজন থেকে বেশিও দিত। আমি কখনো জানার চেষ্টা করিনি টাকাগুলো কোথা থেকে দিত। আমার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। এটা ওনার দায়িত্ব যেটা উনি পালন করতে বাধ্য।
চাকরি পাওয়ার ১ মাস পর আমি বিয়ে করে নিলাম,আমার নিজের পছন্দের মেয়েকে। বাসায় জানানের প্রয়োজন মনে করিনি,এমনকি বাবার থেকে অনুমতিও নেই নি। ওই লোকটার ছায়াআমার নতুন জীবনে পরুক আমি তা চাই নি। বিয়ে করার সপ্তাহ খানিক বাদে গ্রাম থেকে আমার ফোনে কল এলো। রহিম চাচা ফোন করে বলল বাবা খুব অসুস্থ ,আমাকে একবার দেখতে চায়। আমি যাই নি ,কাকাকে বলে দিয়েছি ,” আমি চাকরির জন্য আসতে পারব না,টাকা পাঠাচ্ছি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান ,আমি এসে কি করব আমি তো আর ডাক্তার নই।” বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
২য় দিন পর গ্রাম থেকে ফোন এলো বাবা মারা গেছে,কবরটা যেন দিয়ে আসি। এবার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গ্রামে গেলাম। গিয়ে দেখলাম বাড়ি ভর্তি লোকজন,প্রায় প্রত্যেকে কান্নাকাটি করছে। আমার চোখ দিয়ে একফোঁটা জলও বের হলো না। বাবার দাফনের কাজ শেষ করে ভাবলাম সেদিন এই রওনা,দেব। কিন্তু গ্রামের সবার অনুরোধে রাতটা থাকলাম। রাতে ঘরের মধ্যে পুরোনো জিনিসগুলো ঘাটিয়ে দেখছিলাম। মা,বাবার ঘরে গিয়ে টেবিলের ড্রোয়ারটা খুলতেই একটা ডায়েরি চোখে পরল। যেহেতু আমার সময়ও কাটছিল না তাই আমি ডায়েরিটা নিয়ে পড়তে লাগলাম।
” ৭-৮-১৯৯৩
আজ আমার ঘর আলো করে আমার খোকা এসেছে। আজ আমি সব থেকে বেশি খুশি। বাবা হওয়ার আনন্দ যে এতোটা আমি তা এর আগে কখনো বুঝতে পারি নি। আমার খোকাকে আমি আদরে রাখব সারাজীবন ,আমার যতোই দুংখ,কষ্ট আসুক আমি সেটা খোকাকে বুঝতে দেব না। ” আজ আমার খোকা বাবা ডেকেছে ,বাবা ডাকটায় এতোটা মধু মেশানো থাকে আমি জানতাম না ,আমার আয়ু আমার খোকা যেন পায়। ” ডায়েরির ২য় পাতায় লেখা।
আমি একে একে সব পাতাগুলো পড়তে লাগলাম জানিস খোকা তোর মাকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম ,আজ তোর একটা ভুলের কারণে আমি আমার জীবনের অর্ধাঙ্গীনিকে হারালাম ,খুব কষ্ট হচ্ছে জানিস খোকা ? তাই তোকে একটু বকেছি আর সেটা নিয়ে তুই আমার সাথে রাগ করে কথা বলিস না প্রায় ৭ দিন হয়ে গেল। আমি তোর মুখ থেকে বাবা ডাকটা কি শুনতে পাব না? তোর জন্য একটা সাইকেল কিনব বলে টাকা জোগাড় করেছিলাম ,কিন্তু দেখ তোর করিম চাচার মেয়ের অসুখে সে টাকাটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। তুই রাগ করিস নি তো খোকা ?
৫- ২- ২০১২
খোকা তুই আজ কতোদিন হয়ে গেল আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছিস ,তোর মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে না পেলেও তোর মুখটা তো দেখতে পেতাম তাই না বল? আমি এমন অভাগা বাবা যে কিনা তোকে কিছুই দিতে পারিনি ,তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে খোকা ,আসবি একটি বার ? জানিস খোকা তোর কথা ভেবেই আমি ২য় বিয়ে করিনি। আমি চেয়েছি তুই যেন সুখে থাকিস। খোকা তুই যখন চাকরি পাবি আমি তোর জন্য টুকটুকে একটা লাল বউ এনে দেব ,সে অধিকারটুকু আমায় দিস আমি কিন্তু তোর “না” শুনব না এবার।
২-১-২০১৫
খোকা তোর পড়াশোনার খরচ দিতে একে একে সব বিক্রি করে দিয়েছি শুধু এই ভিটেটুকু ছাড়া। তুই হয়তো জানিস না তোর মায়ের মৃত্যুর ১ বছর পরই আমার চাকরিটা চলে যায়,তারপর তোকে যে কি করে মানুষ করেছি সেটা আমি নিজেই জানি। আমার শরীরটা ইদানিং ভাল নেই। ডাক্তার বলল কি যেন অপরাশেন করতে হবে,অনেক টাকা লাগবে। এতো টাকা পাব কই বল? আমি জানি আমার খোকা চাকরি পেলে ঠিক আমায় সুস্থ করে তুলবে।
১৬-৩-২০১৮
শরীরটা আজ খুব খারাপ লাগছে তোর রহিম চাচাকে দিয়ে ফোন করে তোকে আসতে বললাম,আমি ফোন করলে তো তুই ধরিস না। তুই একবার আসিস খোকা আসবি তো ?
১৮-৩-২০১৮
রহিম বলল তোর নাকি ছুটি নেই ,তুই আসতে পারবি না। আমার না তোকে দেখার খুব শখ খোকা,মৃত্যুর আগে শেষবার তোর মুখটা দেখা বুঝি আর হলো না। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমার বুঝি আর তোর বউকে দেখা হলো না,শেষ বয়সে তোর ছেলেমেয়েদের সাথে হামাগুঁড়ি খেলা হলো না ঠিক যেমন তোর,সাথে করতাম। আমাকে ঘোড়া বানিয়ে তোর ছেলেমেয়ে খেলা,করত ঠিক তোর মতো। সে শখ আর মিটল না। আলমারিতে একটা শাড়ি রাখা আছে তোর বউকে দিস। আমি মনে হয়,তোর যোগ্য বাবা হতে পারলাম না, তোকে কোন সুখেই দিতে পারিনি।। তোর এই অভাগা বাপটাকে ক্ষমা করিস পারলে। তুই ঘুমিয়ে পড়লে আমি রোজ তোর বিছানার পাশে বসে থাকতাম ,তুই কখনো বুঝতেই পারিস নি ! সম্ভব হলে আমার কবরটা মাঝে মাঝে এসে দেখে যাস ! তোকে খুব ভালবাসি খোকা !
“তোর অপরাধী বাবা। “
ডায়রীর শেষ পাতায় আর কিছু লেখা নেই। শুধু ডায়েরির মাঝে আমার একটা ছবি ছাড়া। আমি বুঝতে পারলাম আমি কাঁদছি। ডায়েরিটা টেবিলে রেখে এক দৌড়ে বাবার কবরের কাছে গিয়ে বাবার কবরে উপড়ে পরে কাঁদতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম ,” বাবা ,আমায় মাফ করে দেও,আমি তোমাকে কখনোই বুঝিনি ,আমি খুব বড় পাপি বাবা ,আমায় তুমি মাফ করে দেও। ” আমার কান্নার শব্দে নিঝুম রাতটাও যেন আরও চুপসে গেল। এ জীবনে হয়তো আমার পাপের ক্ষমা নেই আজ প্রকৃতিও তারই সাক্ষী দিচ্ছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প