বিজয়িনী

বিজয়িনী

তমার খুব ইচ্ছে করলো রাইসুল ভাইয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে, উনার জ্বর হয়েছে কি-না। কিন্তু তমা জানে এটা সম্ভব না। রাইসুল তার স্বামী আসিফের খুবই কাছের বন্ধু। মনে রাখতে হবে আসিফের কাছের বন্ধু, তমার নয়। তাই মনের কৌতুহল চেপে তমা জিজ্ঞেস করলো,
–“আপনার শরীর-মন ভালো আছে তো রাইসুল ভাই?”
রাইসুল ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো।
–“জি ভাবী। কেন বলুন তো?”
তমা বিব্রতস্বরে উত্তর দিলো,
–“আপনি স্বপ্নে দেখেছেন আসিফ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। সেজন্যে এখন আমাকে আসিফের কাছ থেকে সাবধান থাকতে বলছেন ? মানে এটা কী আদৌ কোনো কথা হলো?”
রাইসুল লজ্জ্বিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে রইল। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে কফি শেষ করে অবশেষে বলল,
–“আচ্ছা ভাবী আজ তবে আসি।”
বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না রাইসুল। তড়িঘড়ি করে সে বের হয়ে গেল। তমা দরজা বন্ধ করতে করতে আসিফকে ফোন দিল। চারবার রিং দেওয়ার পর আসিফ ফোন ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–“এই সময় যে আমি কতটা ব্যস্ত থাকি, তা কী তুমি জানো?”
–“জানি।”
–“জানার পরও যখন বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করো, তখন কী করতে ইচ্ছে হয় জানো?”
–“জানি তো! আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে, তাইনা?
–“কি!”
কথাটা বলেই তমা ফিক হেসে দিল।

ঠোঁটে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করল রাইসুল। গতরাতে আসিফের সাথে ঝগড়া করে তমা তার বাবার বাসায় চলে গিয়েছিল। আসিফ ওকে ফিরিয়ে আনেনি। উল্টো সে রাইসুলকে ফোন দিয়ে বলল রাতে এসে ওর সাথে থাকতে। বেচারার মা-বাবা নেই। একাই থাকে। দুবছর হলো প্রেমের বিয়ে। সে যাইহোক, রাইসুল ব্যাচেলর এবং একই সাথে বেকার মানুষ। সুতরাং বিনাবাক্য ব্যায়ে সে থাকতে চলে এল। পরেরদিন অর্থাৎ আজ সকাল বেলা আসিফ একটু তাড়াতাড়িই অফিসে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই তখন বেকার রাইসুলের ইচ্ছে করল কবিতা লিখতে। কলমের সন্ধানে টেবিলের ড্রয়ার খুলে কলম খুঁজতে খুঁজতে সে আসিফের বহু পুরোনো ডায়েরি খুঁজে পেল। খুশিতে রাইসুলের সবকটি দাত বেরিয়ে পড়ল। অন্যের ডায়েরি, বিশেষ করে প্রিয়বন্ধুর ব্যাক্তিগত ডায়েরি পড়ার মত আনন্দ পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। রাইসুল লক্ষ্য করল, ডায়েরিতে সর্বশেষ লেখাটি লেখা হয়েছে গতরাতে। এবং এর আগের সব লেখা কমপক্ষে একবছর আগের। আগের মত আর ডায়েরি লিখেনা সেটা বোঝা যাচ্ছে। ইদানীং ও যেভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাতে ডায়েরি ছুয়ে দেখার সময়ও তার হয় কি-না সন্দেহ। কিন্তু গতরাতের লেখাগুলো তার কাছে খুব একটা সুবিধার ঠেকছিল না। ভাল করে পড়ার আগেই কলিংবেল বেজে উঠেছিল। রাইসুল তাড়াহুড়ো করে মোবাইলে লেখাটির ছবি তুলে ফেলল এবং দরজা খুলতেই সে তমাকে আবিষ্কার করল। তমা এমনভাবে বাসায় ঢুকলো যেন কিছুই হয়নি। বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। তমা আর আসিফ এমনই। এর আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। হুট করে ঝগড়া করে আবার হুট করেই সমাধান হয়ে গিয়েছে।
যাইহোক, লেখাগুলো রাইসুলকে বেশ ভাবাচ্ছে। দুই প্যারায় লেখা হয়েছে। মাঝখানে ছোট্ট গ্যাপ। তমাকে দরজা খুলে দিয়ে সোফায় বসে সে দুইবার পড়েছিল। এখন আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে তৃতীয়বারের মত সে পড়া শুরু করল।

প্রথম প্যারাঃ- “আজকের দিনে আমার সাথে ঝগড়া করার কী খুব প্রয়োজন ছিল? কেন সে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে? আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি। সে জানে এটা। আমি জানি, সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। অন্য কাউকে ভালোবেসে, অন্য কাউকে আপন করে, আমাকে পর করে দেবে। অথচ সে বলেছিল, যতদিন বেচে থাকবে ততদিন তার প্রার্থনায় আমৃত্যু আমাকে চাইবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সে! সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার প্রার্থনায় এখন অন্য কেউ!
আজকাল আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। ভীষণ কষ্ট পাই। বুকের ভেতর অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়। ঘেন্না হয় নিজেকে। তারচেয়েও বেশি ঘেন্না হয় তাকে! সে কী জানে আমাকে কষ্ট দেওয়া তার একদমই উচিত হয়নি! এর মূল্য দেওয়ার জন্য সে প্রস্তুত তো?

দ্বিতীয় প্যারাঃ-“একসময় সে বায়না করত আমার হাতের আদা দিয়ে দুধ চা খাবে বলে। আমি বানিয়ে দিতাম। ব্যস্ততার দরুন এখন আর সেই সুযোগ হয়না। আমি চা পছন্দ করি না। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে এটা দারুণ বানাতে পারি। আমি ঠিক করেছি খুব শীঘ্রই আমার প্রিয় মানুষটিকে আমি আদা দিয়ে দুধ চা খাওয়াবো। আমার প্রিয়তমার জীবনের শেষ খাবারটি হবে আমার হাতে তৈরী। তার স্বামীর তৈরী। একটি মেয়ের ভাগ্য এরচেয়ে ভাল আর কিভাবে হতে পারে?”–

টানা হাতের লেখাগুলো যে আসিফেরই, সেটা বুঝতে রাইসুলের খুব একটা অসুবিধে হয়নি। আসিফ তমাকে সন্দেহ করছে। কিংবা হয়তো সত্যিই তমার সাথে কারো সম্পর্ক আছে। রাইসুলের মনে পড়ে গেল শামসে’র কথা। আসিফের অন্যতম দুশমন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সে তমার জন্য পাগলপ্রায় ছিল। আত্মবিশ্বাসের স্বরে সেদিন বলেছিল, তমাকে সে নিজের করেই ছাড়বে যেভাবেই হোক। তাহলে কী ছেলেটা শামস হতে পারে! রাইসুল কপাল চেপে ধরল। হঠাৎ করেই মাথা ধরেছে। সে মিথ্যা বলেনা খুব একটা। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে তমাকে স্বপ্নের কথাটা সে মিথ্যে বলেছে। কেন জানি লেখাগুলো তমাকে দেখানো চায়নি। সে চেয়েছে অন্যকোন উপায়ে মেয়েটিকে সাবধান করে দিতে। তাই ঐ মুহুর্তে যা মাথায় এসেছে তা’ই বলেছে। কিন্তু তাই বলে স্বপ্নের বাহানা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। বোকামি হয়েছে। তমার কাছে সে এখন হাসির পাত্র হয়ে গেছে। রাইসুলের সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। আসিফ ওর বন্ধু। তার উচিত এ ব্যাপারে আগে আসিফের সাথেই কথা বলা। হতে পারে তমার ওপর প্রচন্ড অভিমান করে জেদের বশে সে মনের কথা গুলো ডায়েরিতে লিখে ফেলেছে। সুতরাং যাই ঘটুক না কেন, আগে আসিফের সাথে কথা বলে নেওয়া দরকার। পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে রাইসুল রওয়ানা দিল আসিফের অফিসে।

ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে কপাল কুঁচকে তমার দিকে তাকাল আসিফ।
–“তরকারীতে লবণ দাওনি?”
–‘দিয়েছি তো। কম হয়েছে বোধহয়।”
–“একেবারেই হয়নি।”
তমা কিছু বলল না। প্লেটে লবণ নিতে নিতে আসিফ বলল,
–“রাইসুল কখন গিয়েছিল?”
–“আমি আসার একটু পরই।”
–“আমার অফিসে এসেছিল। উদ্ভট সব প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো কিছু বলতে চায়। হয়তো বলেও ফেলতো, কিন্তু তার আগেই আমার মিটিং পড়ে গেল।”
তমা আসিফের প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছিলো। আসিফ খাওয়া বন্ধ রেখে তমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
–“রাইসুলকে তোমার কেমন লাগে?”
–“ভালোই।”
–“আমার থেকে বেশি ভালো?”
–“এটা কেমন প্রশ্ন?”
–“যেমনই হোক। তুমি উত্তর দাও।”
তমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
–“এতদিন সুস্থই মনে হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে উনি কিছুটা অসুস্থ। খুব শীঘ্রই পাগল হতে চলেছেন।”
–“তাই নাকি!”
–“হুঁ। আজ এসে কি বললেন জানো?”
–“কি?”
–“গতরাতে উনি স্বপ্নে দেখেছেন, তুমি নাকি আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছ। তাই আমাকে তোমার থেকে সাবধান থাকতে বলছেন।”
কথা শেষ করেই তমা খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। আসিফ মুচকি হেসে বলল,
–“প্রথম প্রথম প্রেমে পড়লে মানুষ এমন উদ্ভট কথাবার্তাই বলে।”
–“রাইসুল ভাই প্রেমে পড়েছেন নাকি? কার?”
তমা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল। আসিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খেতে শুরু করল। কোনো উত্তর দিল না। রাত অনেক হয়েছে। কাল ভোরে আবার চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরতে হবে।

রাইসুল পুরোটা রাত জেগেই কাটিয়ে দিল। আজ আসিফের সাথে যখন কথা বলছিল, তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি সে অসুখী, কোনো ধরণের সমস্যায় আছে এটাও মনে হয়নি। হাসিখুশি সংসারী একজন মানুষই মনে হয়েছে। ছেলেটি কী প্রকৃতপক্ষেই সুখী? নাকি সবটাই অভিনয়, রাইসুল ঠিক বুঝতে পারেনি। তারপরও ঠিক করেছিল লেখাটি একবার আসিফকে দেখাবে। দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে এসব লেখার মানে কি! কিন্তু সেটি করার আগেই আসিফের জরুরি মিটিং পড়ে গেল। রাইসুল প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করে শেষে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর আসিফ নিজেই কল দিয়ে বলল, আগামীকাল দুইদিনের জন্য তার চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে। রাইসুল একবার জিজ্ঞেস করল,
–“ভাবীকে সাথে নিয়ে যাবি?”
আসিফ হেসে ফেলল। এখানে হাসির কি আছে রাইসুল বুঝতে পারল না। হাসতে হাসতে আসিফ বলল, ফিরে এসে তোর সাথে দেখা করব। কিছু জরুরি কথা আছে। রাইসুলের কেবলই মনে হতে থাকলো, দু’দিন পর সব এমনই থাকবে তো?

দু’দিন পর। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল চাপলো রাইসুল। নিজের এই কাঁপাকাঁপিতে রাইসুল নিজেই বিরক্ত। অযথা সে এমন করছে কেন! ওপাশ থেকে দরজা খুলেই চওড়া হাসলো তমা,
–“এখনও বেচে আছি রাইসুল ভাই। এইযে দেখুন আপনার সামনে জ্বলজ্যান্ত একদম।”
রাইসুল লজ্জ্বিত স্বরে বলল,
–“ভেতরে আসব ভাবী?”
–“জি জি অবশ্যই, আসুন।”
রাইসুল ভেতরে গেল। দরজা বন্ধ করে সোফায় বসতে বসতে বসতে তমা বলল,
–“একটা কথা বলব?”
–“জি ভাবী।”
–“আসিফ যখন ঘরে থাকেনা আপনি ঠিক তখনই বাসায় আসেন। কেন বলুন তো?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে রাইসুল ঘাবড়ে গেল। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল, গলা শুকিয়ে এল। পানি আনার জন্য তমা যখন রান্নাঘরে গেল তখন রাইসুল আড়চোখে তমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বসার ঘর থেকে রান্নাঘরের বেশকিছু অংশ চোখে পড়ে। মেয়েটির চোখে-মুখে রাগ এবং বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। এরই মধ্যে তার একটি কান্ড রাইসুলকে বেশ অবাক করল। পানি নিয়ে আসার পথে তমা তার হাতের দামী মোবাইলটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিল। দৃশ্যটি দেখে রাইসুল আৎকে উঠলো। এ কেমন মেয়ে! এই মেয়ের রাগ এত মূল্যবান! রাইসুল চোখ ফিরিয়ে নিল। তমা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“শান্ত হোন। এত নার্ভাস হওয়ার মতো কিছু বলিনি।”
রাইসুল ক্ষীণ স্বরে বলল,
–“আপনি যেমনটা ভাবছেন আসলে ব্যাপারটা তেমন না।”
–“আমি জানি। কিন্তু আসিফ তেমনটাই ভাবছে। তার ধারণা আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। শুধু আপনি না। আমিও আপনার প্রেমে পড়েছি। দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।”
রাইসুল হতভম্ব চোখে তমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আসিফের সাথে রাইসুলের দেখা হলো পাঁচদিন পর। আসিফের ছাদেই বসেছিল। সূর্য তখন মাত্র অস্ত গেছে। রাইসুলের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। সেদিন তমার কাছে সন্দেহ বিষয়ক কথাবার্তা শুনার পর থেকেই আসিফের সাথে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা কি অভিমান নাকি লজ্জ্বা থেকে করছে সে জানে না।
রাইসুল কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আসিফ কী বলতে পারে সে বিষয়ে তার মোটামুটি ধারণা আছে। দোষটা তার নিজেরই। বন্ধুর অনুপস্থিতিতে বারবার ওর বাসায় আসা আসলেই ঠিক হয়নি। ওর সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আজ সে আসিফের মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করে দেবে। রাইসুল কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আসিফ বলে উঠল,
–“তুই তমাকে বিয়ে করবি?”
রাইসুল যারপরনাই অবাক হয়ে বলল,
–“তোর মাথা ঠিক আছে?”
–পুরোপুরোই ঠিক আছে। একদম সুস্থ মস্তিষ্কে কথাটা তোকে বললাম।”
রাইসুল লম্বা দম নিয়ে বলল,
–“দেখ আসিফ, আমি জানি আমাকে আর ভাবীকে নিয়ে তোর মনে একটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা তোর সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যি বলছি। বিশ্বাস কর।”
আসিফ বেশ কিছুক্ষন রাইসুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
–“কিন্তু তারপরও যদি বলি, তুই তমাকে বিয়ে করবি?”
–“কেন বিয়ে করব?”
–“কারণ আমি বর্ণাকে ভালোবাসি।”
–“বর্ণা কে?”
–“আমার অফিসের কলিগ।”
রাইসুলের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা আসিফ এই কথা বলছে। রাইসুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসিফ বলতে থাকলো,
–“তমা ভাল মেয়ে। খুব খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু তবু কেন জানি ওকে আমি আর ভালবাসতে পারছিনা। আমি বর্ণাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু এদিকে তমাকে এভাবে রেখে ছেড়ে যেতেও পারছিনা। একমাত্র তুই যদি ওকে গ্রহণ করিস তাহলে আমি শান্তি পাব। বর্ণাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারব। এছাড়া…..”

কথা শেষ করার আগেই আসিফের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল রাইসুল। ঘটনার আকস্মিকতায় আসিফ বাকশূন্য হয়ে পড়ল। কি বলবে ভেবে পেল না। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছাদের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে নিজেলে সামলালো রাইসুল। তারপর শান্ত হয়ে বসে বলল,
–“তুই যেটাকে ভালবাসা বলছিস সেটা ভালবাসা না। একধরনের ভ্রম, ক্ষনিকের ভালোলাগা। নেশার মত। যা কিছুদিন পর কেটে যেতে বাধ্য। তখন তুই কি করবি?”
আসিফ চুপচাপ বসে রইল। একটি কথাও বলল না। অনেকক্ষণ পর রাইসুল বলল,
–“এতঘর থাকতে রান্নাঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলি কেন? তোর কী ধারণা ছিল আমি রান্নাঘরে ঢুকে ভাবীর সাথে প্রেম করি?”
আসিফ বলল,
–“কিছুদিন আগে তমার দামী মোবাইল সেট রান্নাঘর থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। আরো কী কী জানি চুরি হয়েছে। সবই নাকি রান্নাঘর থেকে চুরি হয়। সেজন্যই লাগিয়েছিলাম। বুদ্ধিটা তমারই।”
রাইসুল গম্ভীরস্বরে বলল,
–“বাকিগুলোর খবর জানিনা। তবে মোবাইল চুরি হয়নি। ভাবী নিজেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। আমি দেখেছি।”
আসিফ অবাক হলোনা খুব একটা। শ্বান্তস্বরে বলল,
–“ওর মাথায় কখন কী ভর করে ঠিক নেই। একটু পাগলাটে। তবে এই পাগলী মেয়ের একটা বিশেষ গুণ আছে।”
–“কি সেটা?”
বিশেষ গুন কী সেটা বলার আগেই আসিফের মোবাইল বেজে উঠলো। ঘর থেকে তমা কল করে তাকে নিচে যেতে বলছে। রাইসুল চিন্তিত কন্ঠে বলল, আমি আছি এখানে। তুই দেখে আয়।”

বিশ মিনিট পর ফিরে এসে আসিফ বলল,
–“বলেছিলাম না একটু পাগলাটে? হঠাৎ করেই ওর ইচ্ছে হয়েছে আমার হাতে তৈরি আদা দিয়ে দুধ চা খাবে। তবে শর্ত একটা। চিনি হয়েছে কি-না সেটা চেখে দেখা যাবেনা। কি অদ্ভুত! কি আর করা! আন্দাজে বানিয়ে দিয়ে এলাম।”
রাইসুলর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
–“চা কি রান্নাঘরে তৈরী করেছিস?”
–“হ্যা, আর কোথায় করব?”
রাইসুল দ্রুত চিন্তা করে বলল,
–“ভাবী যেকোনো মানুষের হাতের লেখা নকল করতে পারে, এটাই কি তার বিশেষ গুণ?”
–“হ্যা, কিন্তু এটা তো আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমন কি ওর বাবা-মা ও না। তাহলে তুই কিভাবে জানলি?”
রাইসুল আর কথা না বাড়িয়ে আসিফকে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল।”

২১ ঘন্টা পরঃ

আসিফের বাসার সামনে এখন লোকজনের ভীড়। সেই ভীড় ঠেলে আসিফকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিশের জীপে। হাসপাতালে পৌছানোর আগেই তমা মারা গিয়েছিল। প্রাথমিক সন্দেহে আসিফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে, আসিফ নিজ হাতে চা বানিয়েছে এবং সেটা পান করে তমার মৃত্যু হয়েছে। চায়ের মধ্যে সায়ানাইডের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। চিনির মত দেখতে এই বিষটির তীব্র বিষক্রিয়ার ফলে মৃত্যু হয়েছে বলে ডাক্তার নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও আসিফের ব্যাক্তিগত একটি ডায়েরি এমন কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে এই হত্যার সাথে আসিফ সম্পূর্ণভাবে জড়িত।

তমার লাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রাইসুল। মেয়েটির ঠোঁটের কোনায় যেন এক রহস্যময়ী হাসি সে দেখতে পাচ্ছিল তখন। বিজয়িনীর হাসি! সেদিনের সেই দুইপ্যারায় লেখাটার অর্থ এখন তার কাছে স্পষ্ট। প্রথম প্যারায় ছিল তমার নিজের মনের কথা। একদম নিজের অনুভূতি। আর দ্বিতীয় প্যারাটি ছিল আসিফের মতো করে লেখা!

প্রিয় মানুষটি তাকে কষ্ট দিয়েছে ভীষণ। ভেতর থেকে সে কতটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলো সেটা হয়তো আসিফও বুঝতে পারেনি। বেঁচে থাকার সাধ অনেক আগেই মিটে গিয়েছিল মেয়েটির। তবে নতুন করে জন্ম নিয়েছিল ঘৃণা। প্রিয় মানুষটিকে তার অন্যায়ের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজের প্রতি কেউ এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারে! ভাবতেই শিউরে উঠে রাইসুল। এই পৃথিবীতে আসিফ ছাড়া একমাত্র সে’ই জানে এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা! পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে আসিফ একজন খুনী। কেউই তার এই বিপদের দিনে এগিয়ে আসবে না। রাইসুল পুলিশের জীপের দিকে একবার তাকালো। ড্রাইভারের পাশের সিটে আয়েশ করে বসে আছেন এই এলাকার নতুন ওসি মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম ওরফে শামস। কেসটি তিনিই হ্যান্ডেল করবেন। জীপে বসে থাকা স্তব্ধ, হতভম্ব আসিফের দিকে তাকিয়ে থেকে রাইসুল ভাবছে, সে কী পারবে তার এই বন্ধুটিকে বাচাতে……..?

~বিজয়িনী~

লিখাঃ- Tanya Zannat.(তনয়া জান্নাত)তমার খুব ইচ্ছে করলো রাইসুল ভাইয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে, উনার জ্বর হয়েছে কি-না। কিন্তু তমা জানে এটা সম্ভব না। রাইসুল তার স্বামী আসিফের খুবই কাছের বন্ধু। মনে রাখতে হবে আসিফের কাছের বন্ধু, তমার নয়। তাই মনের কৌতুহল চেপে তমা জিজ্ঞেস করলো,
–“আপনার শরীর-মন ভালো আছে তো রাইসুল ভাই?”
রাইসুল ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো।
–“জি ভাবী। কেন বলুন তো?”
তমা বিব্রতস্বরে উত্তর দিলো,
–“আপনি স্বপ্নে দেখেছেন আসিফ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। সেজন্যে এখন আমাকে আসিফের কাছ থেকে সাবধান থাকতে বলছেন ? মানে এটা কী আদৌ কোনো কথা হলো?”
রাইসুল লজ্জ্বিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে রইল। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে কফি শেষ করে অবশেষে বলল,
–“আচ্ছা ভাবী আজ তবে আসি।”
বলেই আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না রাইসুল। তড়িঘড়ি করে সে বের হয়ে গেল। তমা দরজা বন্ধ করতে করতে আসিফকে ফোন দিল। চারবার রিং দেওয়ার পর আসিফ ফোন ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–“এই সময় যে আমি কতটা ব্যস্ত থাকি, তা কী তুমি জানো?”
–“জানি।”
–“জানার পরও যখন বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করো, তখন কী করতে ইচ্ছে হয় জানো?”
–“জানি তো! আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে, তাইনা?
–“কি!”
কথাটা বলেই তমা ফিক হেসে দিল।

ঠোঁটে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করল রাইসুল। গতরাতে আসিফের সাথে ঝগড়া করে তমা তার বাবার বাসায় চলে গিয়েছিল। আসিফ ওকে ফিরিয়ে আনেনি। উল্টো সে রাইসুলকে ফোন দিয়ে বলল রাতে এসে ওর সাথে থাকতে। বেচারার মা-বাবা নেই। একাই থাকে। দুবছর হলো প্রেমের বিয়ে। সে যাইহোক, রাইসুল ব্যাচেলর এবং একই সাথে বেকার মানুষ। সুতরাং বিনাবাক্য ব্যায়ে সে থাকতে চলে এল। পরেরদিন অর্থাৎ আজ সকাল বেলা আসিফ একটু তাড়াতাড়িই অফিসে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই তখন বেকার রাইসুলের ইচ্ছে করল কবিতা লিখতে। কলমের সন্ধানে টেবিলের ড্রয়ার খুলে কলম খুঁজতে খুঁজতে সে আসিফের বহু পুরোনো ডায়েরি খুঁজে পেল। খুশিতে রাইসুলের সবকটি দাত বেরিয়ে পড়ল। অন্যের ডায়েরি, বিশেষ করে প্রিয়বন্ধুর ব্যাক্তিগত ডায়েরি পড়ার মত আনন্দ পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। রাইসুল লক্ষ্য করল, ডায়েরিতে সর্বশেষ লেখাটি লেখা হয়েছে গতরাতে। এবং এর আগের সব লেখা কমপক্ষে একবছর আগের। আগের মত আর ডায়েরি লিখেনা সেটা বোঝা যাচ্ছে। ইদানীং ও যেভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাতে ডায়েরি ছুয়ে দেখার সময়ও তার হয় কি-না সন্দেহ। কিন্তু গতরাতের লেখাগুলো তার কাছে খুব একটা সুবিধার ঠেকছিল না। ভাল করে পড়ার আগেই কলিংবেল বেজে উঠেছিল। রাইসুল তাড়াহুড়ো করে মোবাইলে লেখাটির ছবি তুলে ফেলল এবং দরজা খুলতেই সে তমাকে আবিষ্কার করল। তমা এমনভাবে বাসায় ঢুকলো যেন কিছুই হয়নি। বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। তমা আর আসিফ এমনই। এর আগেও অনেকবার এমন হয়েছে। হুট করে ঝগড়া করে আবার হুট করেই সমাধান হয়ে গিয়েছে।
যাইহোক, লেখাগুলো রাইসুলকে বেশ ভাবাচ্ছে। দুই প্যারায় লেখা হয়েছে। মাঝখানে ছোট্ট গ্যাপ। তমাকে দরজা খুলে দিয়ে সোফায় বসে সে দুইবার পড়েছিল। এখন আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে তৃতীয়বারের মত সে পড়া শুরু করল।

প্রথম প্যারাঃ- “আজকের দিনে আমার সাথে ঝগড়া করার কী খুব প্রয়োজন ছিল? কেন সে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে? আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি। সে জানে এটা। আমি জানি, সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। অন্য কাউকে ভালোবেসে, অন্য কাউকে আপন করে, আমাকে পর করে দেবে। অথচ সে বলেছিল, যতদিন বেচে থাকবে ততদিন তার প্রার্থনায় আমৃত্যু আমাকে চাইবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সে! সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার প্রার্থনায় এখন অন্য কেউ!
আজকাল আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। ভীষণ কষ্ট পাই। বুকের ভেতর অদ্ভুত যন্ত্রণা হয়। ঘেন্না হয় নিজেকে। তারচেয়েও বেশি ঘেন্না হয় তাকে! সে কী জানে আমাকে কষ্ট দেওয়া তার একদমই উচিত হয়নি! এর মূল্য দেওয়ার জন্য সে প্রস্তুত তো?

দ্বিতীয় প্যারাঃ-“একসময় সে বায়না করত আমার হাতের আদা দিয়ে দুধ চা খাবে বলে। আমি বানিয়ে দিতাম। ব্যস্ততার দরুন এখন আর সেই সুযোগ হয়না। আমি চা পছন্দ করি না। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে এটা দারুণ বানাতে পারি। আমি ঠিক করেছি খুব শীঘ্রই আমার প্রিয় মানুষটিকে আমি আদা দিয়ে দুধ চা খাওয়াবো। আমার প্রিয়তমার জীবনের শেষ খাবারটি হবে আমার হাতে তৈরী। তার স্বামীর তৈরী। একটি মেয়ের ভাগ্য এরচেয়ে ভাল আর কিভাবে হতে পারে?”–

টানা হাতের লেখাগুলো যে আসিফেরই, সেটা বুঝতে রাইসুলের খুব একটা অসুবিধে হয়নি। আসিফ তমাকে সন্দেহ করছে। কিংবা হয়তো সত্যিই তমার সাথে কারো সম্পর্ক আছে। রাইসুলের মনে পড়ে গেল শামসে’র কথা। আসিফের অন্যতম দুশমন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সে তমার জন্য পাগলপ্রায় ছিল। আত্মবিশ্বাসের স্বরে সেদিন বলেছিল, তমাকে সে নিজের করেই ছাড়বে যেভাবেই হোক। তাহলে কী ছেলেটা শামস হতে পারে! রাইসুল কপাল চেপে ধরল। হঠাৎ করেই মাথা ধরেছে। সে মিথ্যা বলেনা খুব একটা। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে তমাকে স্বপ্নের কথাটা সে মিথ্যে বলেছে। কেন জানি লেখাগুলো তমাকে দেখানো চায়নি। সে চেয়েছে অন্যকোন উপায়ে মেয়েটিকে সাবধান করে দিতে। তাই ঐ মুহুর্তে যা মাথায় এসেছে তা’ই বলেছে। কিন্তু তাই বলে স্বপ্নের বাহানা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। বোকামি হয়েছে। তমার কাছে সে এখন হাসির পাত্র হয়ে গেছে। রাইসুলের সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। আসিফ ওর বন্ধু। তার উচিত এ ব্যাপারে আগে আসিফের সাথেই কথা বলা। হতে পারে তমার ওপর প্রচন্ড অভিমান করে জেদের বশে সে মনের কথা গুলো ডায়েরিতে লিখে ফেলেছে। সুতরাং যাই ঘটুক না কেন, আগে আসিফের সাথে কথা বলে নেওয়া দরকার। পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তিত মুখে রাইসুল রওয়ানা দিল আসিফের অফিসে।

ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে কপাল কুঁচকে তমার দিকে তাকাল আসিফ।
–“তরকারীতে লবণ দাওনি?”
–‘দিয়েছি তো। কম হয়েছে বোধহয়।”
–“একেবারেই হয়নি।”
তমা কিছু বলল না। প্লেটে লবণ নিতে নিতে আসিফ বলল,
–“রাইসুল কখন গিয়েছিল?”
–“আমি আসার একটু পরই।”
–“আমার অফিসে এসেছিল। উদ্ভট সব প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো কিছু বলতে চায়। হয়তো বলেও ফেলতো, কিন্তু তার আগেই আমার মিটিং পড়ে গেল।”
তমা আসিফের প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছিলো। আসিফ খাওয়া বন্ধ রেখে তমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
–“রাইসুলকে তোমার কেমন লাগে?”
–“ভালোই।”
–“আমার থেকে বেশি ভালো?”
–“এটা কেমন প্রশ্ন?”
–“যেমনই হোক। তুমি উত্তর দাও।”
তমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
–“এতদিন সুস্থই মনে হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে উনি কিছুটা অসুস্থ। খুব শীঘ্রই পাগল হতে চলেছেন।”
–“তাই নাকি!”
–“হুঁ। আজ এসে কি বললেন জানো?”
–“কি?”
–“গতরাতে উনি স্বপ্নে দেখেছেন, তুমি নাকি আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছ। তাই আমাকে তোমার থেকে সাবধান থাকতে বলছেন।”
কথা শেষ করেই তমা খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। আসিফ মুচকি হেসে বলল,
–“প্রথম প্রথম প্রেমে পড়লে মানুষ এমন উদ্ভট কথাবার্তাই বলে।”
–“রাইসুল ভাই প্রেমে পড়েছেন নাকি? কার?”
তমা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল। আসিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খেতে শুরু করল। কোনো উত্তর দিল না। রাত অনেক হয়েছে। কাল ভোরে আবার চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরতে হবে।

রাইসুল পুরোটা রাত জেগেই কাটিয়ে দিল। আজ আসিফের সাথে যখন কথা বলছিল, তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি সে অসুখী, কোনো ধরণের সমস্যায় আছে এটাও মনে হয়নি। হাসিখুশি সংসারী একজন মানুষই মনে হয়েছে। ছেলেটি কী প্রকৃতপক্ষেই সুখী? নাকি সবটাই অভিনয়, রাইসুল ঠিক বুঝতে পারেনি। তারপরও ঠিক করেছিল লেখাটি একবার আসিফকে দেখাবে। দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে এসব লেখার মানে কি! কিন্তু সেটি করার আগেই আসিফের জরুরি মিটিং পড়ে গেল। রাইসুল প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করে শেষে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর আসিফ নিজেই কল দিয়ে বলল, আগামীকাল দুইদিনের জন্য তার চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে। রাইসুল একবার জিজ্ঞেস করল,
–“ভাবীকে সাথে নিয়ে যাবি?”
আসিফ হেসে ফেলল। এখানে হাসির কি আছে রাইসুল বুঝতে পারল না। হাসতে হাসতে আসিফ বলল, ফিরে এসে তোর সাথে দেখা করব। কিছু জরুরি কথা আছে। রাইসুলের কেবলই মনে হতে থাকলো, দু’দিন পর সব এমনই থাকবে তো?

দু’দিন পর। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল চাপলো রাইসুল। নিজের এই কাঁপাকাঁপিতে রাইসুল নিজেই বিরক্ত। অযথা সে এমন করছে কেন! ওপাশ থেকে দরজা খুলেই চওড়া হাসলো তমা,
–“এখনও বেচে আছি রাইসুল ভাই। এইযে দেখুন আপনার সামনে জ্বলজ্যান্ত একদম।”
রাইসুল লজ্জ্বিত স্বরে বলল,
–“ভেতরে আসব ভাবী?”
–“জি জি অবশ্যই, আসুন।”
রাইসুল ভেতরে গেল। দরজা বন্ধ করে সোফায় বসতে বসতে বসতে তমা বলল,
–“একটা কথা বলব?”
–“জি ভাবী।”
–“আসিফ যখন ঘরে থাকেনা আপনি ঠিক তখনই বাসায় আসেন। কেন বলুন তো?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নে রাইসুল ঘাবড়ে গেল। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল, গলা শুকিয়ে এল। পানি আনার জন্য তমা যখন রান্নাঘরে গেল তখন রাইসুল আড়চোখে তমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বসার ঘর থেকে রান্নাঘরের বেশকিছু অংশ চোখে পড়ে। মেয়েটির চোখে-মুখে রাগ এবং বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। এরই মধ্যে তার একটি কান্ড রাইসুলকে বেশ অবাক করল। পানি নিয়ে আসার পথে তমা তার হাতের দামী মোবাইলটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিল। দৃশ্যটি দেখে রাইসুল আৎকে উঠলো। এ কেমন মেয়ে! এই মেয়ের রাগ এত মূল্যবান! রাইসুল চোখ ফিরিয়ে নিল। তমা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“শান্ত হোন। এত নার্ভাস হওয়ার মতো কিছু বলিনি।”
রাইসুল ক্ষীণ স্বরে বলল,
–“আপনি যেমনটা ভাবছেন আসলে ব্যাপারটা তেমন না।”
–“আমি জানি। কিন্তু আসিফ তেমনটাই ভাবছে। তার ধারণা আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। শুধু আপনি না। আমিও আপনার প্রেমে পড়েছি। দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।”
রাইসুল হতভম্ব চোখে তমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আসিফের সাথে রাইসুলের দেখা হলো পাঁচদিন পর। আসিফের ছাদেই বসেছিল। সূর্য তখন মাত্র অস্ত গেছে। রাইসুলের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। সেদিন তমার কাছে সন্দেহ বিষয়ক কথাবার্তা শুনার পর থেকেই আসিফের সাথে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এটা কি অভিমান নাকি লজ্জ্বা থেকে করছে সে জানে না।

রাইসুল কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আসিফ কী বলতে পারে সে বিষয়ে তার মোটামুটি ধারণা আছে। দোষটা তার নিজেরই। বন্ধুর অনুপস্থিতিতে বারবার ওর বাসায় আসা আসলেই ঠিক হয়নি। ওর সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আজ সে আসিফের মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করে দেবে। রাইসুল কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আসিফ বলে উঠল,
–“তুই তমাকে বিয়ে করবি?”
রাইসুল যারপরনাই অবাক হয়ে বলল,
–“তোর মাথা ঠিক আছে?”
–পুরোপুরোই ঠিক আছে। একদম সুস্থ মস্তিষ্কে কথাটা তোকে বললাম।”
রাইসুল লম্বা দম নিয়ে বলল,
–“দেখ আসিফ, আমি জানি আমাকে আর ভাবীকে নিয়ে তোর মনে একটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এটা তোর সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যি বলছি। বিশ্বাস কর।”
আসিফ বেশ কিছুক্ষন রাইসুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
–“কিন্তু তারপরও যদি বলি, তুই তমাকে বিয়ে করবি?”
–“কেন বিয়ে করব?”
–“কারণ আমি বর্ণাকে ভালোবাসি।”
–“বর্ণা কে?”
–“আমার অফিসের কলিগ।”
রাইসুলের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল যেন। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা আসিফ এই কথা বলছে। রাইসুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসিফ বলতে থাকলো,
–“তমা ভাল মেয়ে। খুব খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু তবু কেন জানি ওকে আমি আর ভালবাসতে পারছিনা। আমি বর্ণাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু এদিকে তমাকে এভাবে রেখে ছেড়ে যেতেও পারছিনা। একমাত্র তুই যদি ওকে গ্রহণ করিস তাহলে আমি শান্তি পাব। বর্ণাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারব। এছাড়া…..”

কথা শেষ করার আগেই আসিফের গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল রাইসুল। ঘটনার আকস্মিকতায় আসিফ বাকশূন্য হয়ে পড়ল। কি বলবে ভেবে পেল না। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছাদের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে নিজেলে সামলালো রাইসুল। তারপর শান্ত হয়ে বসে বলল,
–“তুই যেটাকে ভালবাসা বলছিস সেটা ভালবাসা না। একধরনের ভ্রম, ক্ষনিকের ভালোলাগা। নেশার মত। যা কিছুদিন পর কেটে যেতে বাধ্য। তখন তুই কি করবি?”
আসিফ চুপচাপ বসে রইল। একটি কথাও বলল না। অনেকক্ষণ পর রাইসুল বলল,
–“এতঘর থাকতে রান্নাঘরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলি কেন? তোর কী ধারণা ছিল আমি রান্নাঘরে ঢুকে ভাবীর সাথে প্রেম করি?”
আসিফ বলল,
–“কিছুদিন আগে তমার দামী মোবাইল সেট রান্নাঘর থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। আরো কী কী জানি চুরি হয়েছে। সবই নাকি রান্নাঘর থেকে চুরি হয়। সেজন্যই লাগিয়েছিলাম। বুদ্ধিটা তমারই।”
রাইসুল গম্ভীরস্বরে বলল,
–“বাকিগুলোর খবর জানিনা। তবে মোবাইল চুরি হয়নি। ভাবী নিজেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। আমি দেখেছি।”
আসিফ অবাক হলোনা খুব একটা। শ্বান্তস্বরে বলল,
–“ওর মাথায় কখন কী ভর করে ঠিক নেই। একটু পাগলাটে। তবে এই পাগলী মেয়ের একটা বিশেষ গুণ আছে।”
–“কি সেটা?”
বিশেষ গুন কী সেটা বলার আগেই আসিফের মোবাইল বেজে উঠলো। ঘর থেকে তমা কল করে তাকে নিচে যেতে বলছে। রাইসুল চিন্তিত কন্ঠে বলল, আমি আছি এখানে। তুই দেখে আয়।”

বিশ মিনিট পর ফিরে এসে আসিফ বলল,
–“বলেছিলাম না একটু পাগলাটে? হঠাৎ করেই ওর ইচ্ছে হয়েছে আমার হাতে তৈরি আদা দিয়ে দুধ চা খাবে। তবে শর্ত একটা। চিনি হয়েছে কি-না সেটা চেখে দেখা যাবেনা। কি অদ্ভুত! কি আর করা! আন্দাজে বানিয়ে দিয়ে এলাম।”
রাইসুলর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
–“চা কি রান্নাঘরে তৈরী করেছিস?”
–“হ্যা, আর কোথায় করব?”
রাইসুল দ্রুত চিন্তা করে বলল,
–“ভাবী যেকোনো মানুষের হাতের লেখা নকল করতে পারে, এটাই কি তার বিশেষ গুণ?”
–“হ্যা, কিন্তু এটা তো আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা। এমন কি ওর বাবা-মা ও না। তাহলে তুই কিভাবে জানলি?”
রাইসুল আর কথা না বাড়িয়ে আসিফকে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল।”

২১ ঘন্টা পরঃ

আসিফের বাসার সামনে এখন লোকজনের ভীড়। সেই ভীড় ঠেলে আসিফকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিশের জীপে। হাসপাতালে পৌছানোর আগেই তমা মারা গিয়েছিল। প্রাথমিক সন্দেহে আসিফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে, আসিফ নিজ হাতে চা বানিয়েছে এবং সেটা পান করে তমার মৃত্যু হয়েছে। চায়ের মধ্যে সায়ানাইডের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। চিনির মত দেখতে এই বিষটির তীব্র বিষক্রিয়ার ফলে মৃত্যু হয়েছে বলে ডাক্তার নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও আসিফের ব্যাক্তিগত একটি ডায়েরি এমন কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে এই হত্যার সাথে আসিফ সম্পূর্ণভাবে জড়িত।

তমার লাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রাইসুল। মেয়েটির ঠোঁটের কোনায় যেন এক রহস্যময়ী হাসি সে দেখতে পাচ্ছিল তখন। বিজয়িনীর হাসি! সেদিনের সেই দুইপ্যারায় লেখাটার অর্থ এখন তার কাছে স্পষ্ট। প্রথম প্যারায় ছিল তমার নিজের মনের কথা। একদম নিজের অনুভূতি। আর দ্বিতীয় প্যারাটি ছিল আসিফের মতো করে লেখা!

প্রিয় মানুষটি তাকে কষ্ট দিয়েছে ভীষণ। ভেতর থেকে সে কতটা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলো সেটা হয়তো আসিফও বুঝতে পারেনি। বেঁচে থাকার সাধ অনেক আগেই মিটে গিয়েছিল মেয়েটির। তবে নতুন করে জন্ম নিয়েছিল ঘৃণা। প্রিয় মানুষটিকে তার অন্যায়ের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজের প্রতি কেউ এতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারে! ভাবতেই শিউরে উঠে রাইসুল। এই পৃথিবীতে আসিফ ছাড়া একমাত্র সে’ই জানে এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা! পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কাছে আসিফ একজন খুনী। কেউই তার এই বিপদের দিনে এগিয়ে আসবে না। রাইসুল পুলিশের জীপের দিকে একবার তাকালো। ড্রাইভারের পাশের সিটে আয়েশ করে বসে আছেন এই এলাকার নতুন ওসি মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম ওরফে শামস। কেসটি তিনিই হ্যান্ডেল করবেন। জীপে বসে থাকা স্তব্ধ, হতভম্ব আসিফের দিকে তাকিয়ে থেকে রাইসুল ভাবছে, সে কী পারবে তার এই বন্ধুটিকে বাচাতে……..?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত