কারবার

কারবার

রাত খুব একটা বেশি হয়নি। সাড়ে এগারোটা বাজে। গলির মোড়ে সিগারেটের দোকান খোলা পাবো না ভেবে মেইনরোডের পাশে একটা টং দোকানে গেলাম। আজ একটু শীত বেশি পড়েছে। দোকানে কেউ নাই। ফাঁকা বেঞ্চে কুয়াশার আস্তরণ পড়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। দোকানদারকে বললাম এক প্যাকেট সিগারেট দিতে। দোকানদার সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাই এক কাপ চা দেই। আইজকা কাস্টমার নাই। লিকার সব কেতলিতে পইরা আছে। চায়ের দাম তো উডবোই না। যেই গ্যাস খরচা হইলো হেই গ্যাসের দামও উঠবো না।’

মায়া লাগলো কথাটা শুনে। বললাম, ‘দেন এক কাপ খাই। লিকার কমাইয়্যা দুধ বাড়াই দিয়েন।’ দোকানদার সাথে সাথে উঠে এসে একটা ন্যাকড়া দিয়ে কাঠের বেঞ্চ মুছে দিলো। মুছে দিয়ে বলল, ‘শীতে মুইতা গেছে বেঞ্চিতে।’ রসিক দোকানদারের কথা শুনে হেসে দিলাম।

বেঞ্চে বসে সিগারেট ধরালাম। দোকানির কানটুপিটা অদ্ভুত। কমলা রঙের কানটুপির উপরে দুইটা গোলাপি রঙের খরগোশের মতোন কান উঁচু হয়ে আছে৷ এই টুপি বাচ্চারা পরে। জিগ্যেস করলাম, ‘এই টুপি কই পাইলেন মামা?’ দোকানদার একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আর কইয়েন না ভাই। আমার একটা আম্মাজান আছে। চাইর বতসর বয়েস। এইডা ওর টুপি। আইজকা বেয়ানকালের থেইকা শীত। আম্মাজান কইলো- আব্বা তুমার কষ্ট লাগবো তো ঠাণ্ডায়। এইডা পরো। দুনিয়ায় সবার কথা ফেলা যায় ভাই। দুইজন আম্মার কথা ফেলা যায় না। একটা হইলো নিজের আম্মা। আরেকটা হইলো নিজের কইন্যা আম্মা। সারাদিন এই টুপি পইরা আছি। লোকজন দেইখ্যা হাসাহাসি করে। কিন্তু এই টুপিতে আমার আম্মাজানের যেই ভালবাসা আছে। লোকের হাসাহাসির কাছে তা অতি তুচ্ছ ভাইজান।’
কথাটা শুনে নিজের কাছেই লজ্জা লাগলো। আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করিনি ঠিক। কিন্তু হাস্যকর তো লেগেছে আমার কাছেও। বাবারা তাদের সন্তানদের জন্য কত কিছুই না সহ্য করে। জিগ্যেস করলাম, ‘এই দোকান কবে দিলেন? আগে তো দেখি নাই। আমি মাঝেমাঝেই এইদিকে যাওয়া আসা করি।’ দোকানদার চা দিতে দিতে বলল, ‘আইজকাই দিছি ভাই। আইজকা সকালে চালু করছি।’ কিন্তু দোকানটা দেখে মনে হয় অনেক দিন হয়েছে। হয়তো অন্য কোনো পুরাতন দোকানের সবকিছু দিয়ে বানিয়েছে।

চায়ে চুমুক দিয়ে দেখি চমৎকার চা। এক ঢোকে একেবারে ভিতরে যতটুকু গেলো যেন জুড়িয়ে গেলো এই কনকনে শীতের রাতে। সাথে সাথে আরেক চুমুক দিয়ে বললাম, ‘চা তো অনেক ভালো বানান মামা। অনেক মজা হইছে।’ দোকানদার একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আপনাগো দোয়ায় চা ভালাই বানাই ভাই। সাথে কি দুইটা নুনতা বিস্কুট দিমু। আরো টেস্ট লাগবো।’ বললাম, ‘দেন দেখি কেমন লাগে।’
আসলেই বিস্কুট দিয়ে খেতে আরো মজা লাগছে। দোকারদার বলল, ‘বুঝলেন ভাইজান এই দুনিয়া এক আজব জায়গা। মাত্র দুই ইঞ্চি একটা জিব্বার জন্যি কত কত পদ দুনিয়াতে মানুষ বানাইছে।’ আমি বললাম, ‘কেমন?’ দোকানদার একটা সিগারেট ধরিয়ে টান দিয়ে বলল, ‘এই যেমুন ধরেন ভাইজান, আমাগো এই জিব্বা। মাত্র দুই ইঞ্চি। এই দুই ইঞ্চি জিব্বার রাস্তাডা পার করানোর লাইগ্যা মানুষ কত কত খাবার বানাইছে। অথচ দেহেন, গলায় চইল্লা গেলে খাবারের আর কোনো টেস্ট নাই। যত টেস্ট যতক্ষণ মুখে নিয়া চাবাইবেন। এই টেস্টের লাইগ্যা কি করে না মানুষ। কত কত খরচা করে।’ দোকানদারের এই উচ্চমার্গীয় কথায় একটু অবাকই হলাম। প্রতিদিনই খাওয়া দাওয়া করি আমরা। কিন্তু সামান্য এই চায়ের দোকানদারের মতো এভাবে ভাবতে পারে ক’জনা।

বললাম, ‘খুব সুন্দর কথা বলছেন তো মামা। এভাবে কখনো ভাবি নাই।’ দোকানদার বলল, ‘এইসব আমার কথা না ভাইজান। আমার পরিবারের কথা। আমার বিবি আপনাগো দোয়ায় অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ। হেয় আমারে এসব কইছে। এই যে চায়ের লগে নুনতা বিস্কুটের ব্যাপারটা এইডাও আমার বিবি আমারে শিখাই দিছে।’ জিগ্যেস করলাম, ‘কি বলেছেন উনি?’

দোকানদার নিজের জন্যও এক কাপ চা বানিয়ে বলল, ‘কাস্টমার তো নাই এর লাইগ্যা নিজেই খায়া লিকার একটু কমাতাছি। যাউগ্যা, আমার বিবি আমারে কইছে আমাগো জিব্বারে যে যত বোকা বানাইতে পারবো হেয় ততো খাওনের ব্যবসা করতে পারবো। আমাগো জিব্বা তো ধরেন গিয়া সব সময় কি চায়- টেস্ট চায়। জিব্বারে যত টেস্ট দিবেন। জিব্বা তত খুশি হইবো। আপনারে দিলাম দুধ চা। কিন্তু খাইতে দিলাম নুনতা বিস্কুট। কারণ হইলো গিয়া, চা খায়া মুখ মিডা হইয়্যা গ্যাছে আপনার। মিডা মুখে মিডা কিছু টেস্ট লাগে না। চায়ের লগে যায় এমন অন্যকিছু মুখে দিলে টেস্ট বাড়বো। নুনতা বিস্কুটের টেস্ট নুনতা নুনতা। নুনতার ও একটা টেস্ট আছে। এই টেস্ট পাইছেন কারণ মুখতো মিডা। আবার নুনতা বিস্কুট খায়া মুখ হইছে একটু নুনতা। পরে আবার চায়ে চুমুক দিলে নুনতা মুখে মিডার টেস্ট আরো বাইরা গেলো। জিব্বার কি চমৎকার কারসাজি বুঝলেননি ভাই।’

রীতিমতো অবাকই হচ্ছি দোকানদারের কথায়। বললাম, ‘আপনার দোকানে তাইলে রোজ আসা লাগবে। অনেক কিছু জানেন আপনি।’ দোকানদার বলল, ‘আমি তো কিছুই জানি না ভাইজান। এসব আমার বিবি জানে। হেয় আমারে কইছে। তয় এই দোকানে আইস্যা আর লাভ নাই ভাইজান।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘কেন লাভ নেই।’ দোকানদার আমার হাত থেকে কাপটা নিতে নিতে বলল, ‘কারণ কাইল আর চা বেচুম না। আমি দুই দিন একই কারবার করি না। আপনেই আমার চায়ের দোকানের লাস্ট কাস্টমার। আর কোনো কাস্টমার আইবো না।’

বললাম, ‘কোনো না কোনো কাস্টমার তো আইসতেই পারে। আর দুই দিন একই কারবার করেন না মানে?’ দোকানদার বলল, ‘আর আইবো না ভাইজান। আমি জানি। আমি গতকাল যেই কারবার করছি। আইজ তা করতাছি না। আগামীকালই বেয়ান বেলা থেইক্কা আরেক কারবার শুরু করুম।’
মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগলো হঠাৎই। সারা শরীর একবার ঝাকিও দিলো। হয়তো শীতের কারণে এমন হচ্ছে। প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালাম। জিগ্যেস করলাম, ‘আগামীকাল কিসের কারবার করবেন?’ দোকানদার বলল, ‘ঐ যে ভাইজান কইছি না। জিব্বারে বোকা বানানির কারবার। জিব্বারে যত বোকা বানানি যাইবো তত খাওনের ব্যবসা। আমার কারবারই হইলো মানুষের জিব্বারে বোকা বানানির। আগামীকাল শুরু করুম মগজ ভুনার কারবার। এদিকে আসেন দেইক্ষা যান।’

আমি উঠে গিয়ে তাকালাম উনার পাশে রাখা একটা বড় প্লাস্টিকের ড্রামে। প্রথমে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিছুই। পরে ভালো করে মাথা এগিয়ে নিতেই দেখি অনেক গুলো মানুষের কাটা মাথা। সারা শরীরে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মাথাটা ভনভন করে কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো। ছিটকে সরে এলাম। তখনই দেখলাম দোকানদারের পাশে একটা চার পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে। আর একটা অনেক সুন্দরী মহিলা। দোকানদার বলল, ‘ভাইজান এই আমার আম্মাজান। আর এই আমার বিবি। আমরা হইলাম পিচাশ পরিবার ভাইজান। আমার আম্মাজানের পছন্দের খাবার দিয়াই কাইলকা নয়া কারবার শুরু করুম। মাইনষ্যের মগজের ভুনা।’

আমার পা টলছে। কি হচ্ছে কিছু বোঝার মত অবস্থায় নেই। মাথা একদম ফাঁকা হয়ে আছে। সুন্দরী মহিলাটা বলল, ‘আপনেই আমাগো লাস্ট কাস্টমার। লাস্ট শিকারি। আপনার মগজও ভুনা করা হইবো। রাস্তার পাশে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া এই শহরের মানুষজন মানুষের মগজ চাবাইয়া চাবাইয়া খাইবো লুচি দিয়া।’

তখনই পাশের বাচ্চা মেয়েটা বলল, ‘আম্মা আমি কাবাব খামু। কাইলকা মগজ খাওয়াইলে পরের দিন কাবাব খাওয়াবা?’ দোকানদার বলল, ‘আম্মাজান আমি তো এক কারবার দুইদিন করি না। আর কাবাব করার জন্যি তো কোনো মাইনষ্যের শরীর রাখি নাই। খালি মাথা রাখছি। শরীর তো ফালাইয়া দিছি।’ বাচ্চা মেয়েটা বলল, ‘কারবার করবা না। আমারে খাওয়াইবা। এই আংকেলের শরীর তো আছে এখনো। কাবাব বানাইয়া দিবা। খালি আমি খামু।’

বাচ্চাটার কথা শুনে দোকানদার আর সুন্দরী মহিলা দু’জনেই হেসে উঠলো। আমি সম্মোহিতের মতো কেবল শুনছি। দোকানদার বলল, ‘আইচ্ছা আম্মাজান ঠিক আছে। তাইলে এই ভাইজানের মগজ ভুনা কইরা মাইনষ্যেরে খাওয়ামু। আর তোমারে খাওয়ামু শরীরের গোসত দিয়া কাবাব।’

সুন্দরী মহিলাটা একটা বড় ছুড়ি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি এক পাও নড়তে পারছি না। আমার চুলের মুঠো ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। এরপর আর কি হয়েছে জানি না। আমার চারদিকে শুধু অন্ধকার। অন্ধকারের পর অন্ধকার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত