কামাল হোসেন তার স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় শুতে লজ্জা পাচ্ছেন। বাসর রাতেও তিনি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি টা একটু ভিন্ন। তিনি টানা ২০ বছর পর প্রবাসে কাটিয়ে আজ সকালে দেশে ফিরেছেন। এই দীর্ঘ বিশ বছরে তার বউয়ের সাথে শুধু কয়েকবার ফোনেই আলাপ হয়েছে। আজ সকালে যখন গ্রামে আসেন তখন পায়ে সালাম করে শুধু বলেছিল, ‘ আপনি ভালো আছেন?’ ব্যস এটুকুই কথা হয়েছিল! তারপর থেকে সারাদিন রান্নাঘরে নানা কাজে ব্যস্ত ছিল, একবারও সামনে এসে পড়েনি ।
কামাল হোসেনের আসা উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি মেহমান। গ্রামের লোকদের একটু পর পর যাওয়াআসা চলছেই।
তার কলিজার টুকরা একমাত্র মেয়ে জাহানারা এখনো আসেনি। মেয়ে জাহানারার বয়স যখন দুই বছর তখন তিনি দূবাই চলে যান। সেই ছোট্ট মেয়ে টা এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লেখা করছে। এটা ভাবলেও শত দুঃখের মাঝেও মনে প্রশান্তি লাগে কামাল হোসেনের। জাহানারার ভার্সিটি তে কিসের যেন পরীক্ষা চলছে।তাই আসতে পারেনি।বলেছে দুই একদিন পর নাকি আসবে। কামাল হোসনের কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে।সেই কখন থেকে একা একা বসে আছেন।তার স্ত্রী এখনো রান্না ঘরে কিসব খুটখুট করছে! তিনি স্ত্রী কে নরম স্বরে ডাক দিলেন, ‘জুলেখা ?’
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর জুলেখা বেগম ঘোমটা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে বললো, ‘আপনে একটু বসেন, রান্নাঘরের কাজ একটু বাকি আছে শেষ করে আসতেছি।’ এই বলে জুলেখা বেগম আবার বের হয়ে যান। কামাল হোসেন চিন্তিত হয়ে এবার খাটে বসে রইলেন। তার মন দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে ভাবছে বউ টা কি এখনো অভিমান করে আছে নাকি এতদিন পর সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে!! ২০বছর তো অনেক সময়!মনে মনে ভাবলেন জুলেখার স্বাভাবিক হতে কিছু টা সময় লাগতেই পারে। কামাল হোসেনের মন চলে যায় অনেকগুলো বছর আগের অতীতে। জুলেখার বয়স তখন কতইবা হবে! বড় জোর ষোল সতেরো! তখন সে এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে।
বড়ই অভাব অনটনের সংসারে এসে লাজুক কিশোরীর অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানা দিন দিন মলিন হয়ে যেতে লাগে। বিয়ের বছর ঘুরতেই একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয় জুলেখা। বৃদ্ধা মা বলতে থাকে, ‘অভাগার সংসারে পুড়া কপালিটা মাইয়া জন্ম দিল? এই পুড়া কপালি যেদিন এই ঘরে বউ হইয়া আইছে সেদিন থেকেই এই সংসারে শনিরদশা লাগছে।’ কামাল হোসেন তার মায়ের কথা মুখ বুজে সহ্য করেন। অভাব অনটনে মায়ের মাথাটা গেছে। এই মহিলা টা তার বাবার সংসারে অনেক খেটেছেন। তিনি ছেলে হয়েও মা কে এখনো আরাম আয়েশ মনের প্রশান্তি দিতে পারছেন না, এরচেয়ে বড় কষ্ট কি আর হতে পারে? মেয়ে জাহানারার আকিকা টা পর্যন্ত শ্বশুর বাড়ির টাকায় দিতে হয়েছে। জুলেখা একদিন তাকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছিল,
-‘এভাবে আর কতদিন! নিজে কিছু করবেন না? চোখের সামনে দিয়া মাইয়া বড় হইতেছে, ওর কি কোন ভবিষ্যৎ নাই?’
-‘বউ আমার রক্ত বেচে হলেও ওরে আমি মানুষ করমু।তুমি চিন্তা কইরো না। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিছি,সময় হলে ঠিকি জানতে পারবা।’ সেদিন রাতেই ফজলুর সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে কামাল হোসেন। আদম ব্যবসায়ী ফজলুর সহায়তায় দূবাই যাওয়ার দিন আস্তে আস্তে কাছে ঘনিয়ে আসতে লাগল কামাল হোসেনের। কিন্তু জুলেখা কঠিন জেদ ধরে বসেছে বিদেশ যাওয়া চলবে না। একদিন জুলেখা কেঁদে কেঁদে বলছিল,
– ‘দোহাই আপনার বিদেশে যাইয়েন না।
আপনার দুইটা পায়ে পড়ি।আমার কিছুই লাগবো না।’ কিন্তু কামাল হোসেন মাথা নিচু করে বসে থাকে।জুলেখার কথার জবাব দেয় না। জুলেখা চোখের জল মুছতে মুছতে আবার বলে, আমার চোখের জলে আপনের যাত্রা অমঙ্গল হইতে পারে। নিয়ত যখন করেই ফেলছেন। আচ্ছা ঠিক আছে যান।’ যাওয়ার দিন কাঁদতে কাঁদতে তার মা তাকে বিদায় দেয়। সে নিজের মেয়ে টা রে পাগলের মত প্রাণ ভরে আদর করে । জুলেখা দরজায় খিল দিয়ে ঘরে শুয়ে ছিল, ডাকাডাকি করার পরও দরজা খুলেনি। কামাল হোসেন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় জুলেখার ঢেকুর পেড়ে কান্নার আওয়াজ বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছিল।
বাপ দাদারা গাধারখাটুনি করেও সারাজীবন টাকার মুখ দেখে নি। কিন্তু, কামাল হোসেন দূবাই এসে সেই টাকার মুখ দেখতে পান। কিন্তু গভীর একটা সমস্যায় পড়েন, সঠিক কাগজ পত্র ভিসা না থাকার কারণে দেশে আসতে পারছিলেন না। তার মা মারা যাওয়ার কঠিন সংবাদ টা ফোনের মাধ্যমে শুনতে হয়েছে। জুলেখা মাঝেমাঝে ফোনে কথা বলার সময় কেমন মনমরা হয়ে থাকে। ছোট্ট মেয়ে জাহানারা টাও কথা বলা শিখে গেছে। ফোনে আলাপ করতে চায় সারাক্ষণ। মেয়ে বড় হতে থাকে কথার ধরণও বদলে যেতে থাকে। আব্বু এটা আনবে,আব্বু ওটা আনবে এখন আর এসব বলে না। ঘুরে ফিরে বারবার শুধু প্রশ্ন করে, আব্বু কবে আসবে তুমি? মা মেয়ের কোন কিছুর কমতি রাখেনি সে। প্রয়োজনের চেয়ে সব কিছু বেশি বেশি পাঠিয়েছে।
তার লক্ষী মেয়েটা কথা রেখেছে, যে বংশের কেউ কেউ কলেজের দরজায় পা রাখতে পারেনি সেখানে তারই মেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। এরচেয়ে তৃপ্তি আর কিবা হতে পারে? একটা সময় বাংলাদেশি এর্ম্বাসির সহয়াতায় সঠিক ভিসা পাসপোর্ট হাতে আসে। সব ঝামেলা মিটমাট করেই দীর্ঘ ২০ বছরপর সকালে দেশের মাটিতে পা রাখেন। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, কামাল হোসেন এক সময় ঘুমিয়ে যান। ঘুম ভাঙে জুলেখার ডাকে। ঘরের ভিতর হারিকেন জ্বলছিল। তাকিয়ে দেখে জুলেখার চোখে পানি টলমল করছে। কামাল হোসেন জুলেখার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছ তুমি?
-‘হুঁ ভাল।’
-‘সারাদিন এমন লুকিয়ে লুকিয়ে ছিলে কেন?’
-‘কই না তো! বাড়িতে কত কাজ সব তো আমার একা একাই করতে হয়েছে।’
-‘তাহলে কাজের মহিলা রাখছো কেন?এত কাজ যখন তোমার একাই করতে হবে?’
-‘এগুলা কাজের বেটি না! একেক টা যেন নবাবজাদি। সন্ধার পরেই ওজুহাত দিয়ে যে যার বাড়িতে চলে গেছে।সব তো একাই সামাল দিতে হইছে আমার।’
জুলেখার কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে কামাল হোসেন। জুলেখা তার সাথে অনেকদিন পর এভাবে পটপট করে কথা বলছে এতেই তার অনেক ভাল লাগছে। কামাল হোসেন সুটকেস খুলে জুলেখার জন্য নানান জিনিসপত্র বের করতে লাগল। জুলেখা আর্দ্র কন্ঠে বললো, ‘এত টাকা পয়সা খরচ করে এসব আনার কি দরকার ছিল?’ কামাল হোসেন তখন দামি একটা শাড়ি বের করে বললো, ‘এটা বাংলাদেশি টাকায় দাম কত জানো? বিশ হাজার টাকা!’
জুলেখা কিছুটা অবাক হয়ে বললো, এত দাম!’ পরক্ষণেই মুখ একটু গুমরো করে, ‘বুড়ী বয়সে এত দামি শাড়ি দিয়ে কি হবে ?’ কামাল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘একটা কথা বললে রাখবে?’ জুলেখা লজ্জিত স্বরে জবাব দেয়, কি বলেন।’ ‘তুমি কি শুধু আজকের রাতের জন্য বিয়ের শাড়ি টা আবার পড়বে?’ স্বামীর মুখে অদ্ভুত আরজির কথা শুনে মুখ ‘থ’ হয়ে গেছে জুলেখার। কামাল হোসেন আবার বলল, ‘জুলেখা, আগের রঙিন সময় গুলো তো আর পাব না,এখন এই বয়সে এসে তা খুঁজে নিতে তো আর দোষের কিছু নাই!’ জুলেখা লজ্জায় লাল হয়ে আলমারি খুলতে লাগল।কেন জানি তার ভিতরে ভিতরে এতদিন পর আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে!
ভোরবেলা তে জাহানারা বাড়িতে এসে হাজির।কেউকে না জানিয়ে গত রাত দশটায় সে ট্রেনে উঠেছিল। ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর ট্রেন তার গন্তব্য স্টেশনে এসে থামে।একটু আলো ফুটতেই সে রিক্সা নিয়ে বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। ঘরের ভিতর দুটো মানব মানবী একসাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে! জাহানারার চিৎকার চেঁচামেচি তে তাদের ঘুম ভাঙে। তাড়াহুড়া করে বাইবে বের হয়ে জুলেখা বেগম দেখেন, তার মেয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। জাহানারা তার মায়ের পড়নে বিয়ের লাল শাড়ি দেখে দূর থেকে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে করে হাসতে থাকে! মেয়ের মুখে
এমন চোরা হাসি দেখে নিজের দিকে তাকিয়ে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায় জুলেখা। দ্রুত শাড়ি বদলাতে ঘরে ঢুকবার সময় দরজায় স্বামীর বুকে ধাক্কা খায়! তা দেখে জাহানারা ফিক করে হেসে দেয়। কামাল হোসেন তার মেয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটা দেখতে ওর মা’র মতই সুন্দর হয়েছে। কি সুন্দর করে মুখটিপে ওর মা’র মতই অবিকল হাসছে। তখনি জাহানারা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আনন্দে চোখে পানি এসে যায় কামাল হোসেনের।আজ যে তার বড়ই আনন্দের দিন।
গল্পের বিষয়:
গল্প