বৃষ্টি কথন

বৃষ্টি কথন
আঞ্জুমান বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত। এমন সময় রানু খালা দৌড়ে এসে বলল,
-খালাম্মা, বৃষ্টি পরতাছে।
-আমি তো তাকে টেবিলে পড়তেই বসিয়ে আসলাম।
-খালাম্মা,আইন্নের মাইয়া বৃষ্টি না,আকাশ থাইকা বৃষ্টি পরতাছে।
-বলো কি!ছাদে তো কাপড় শুকাতে দিয়েছিলাম।
তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।আর আসার সময় দেখবে বৃষ্টি কি করছে।
-আইচ্ছা,খালাম্মা। ছাদ থেকে কাপড় গুলো নিয়ে আসার পর রানু খালা আঞ্জুমান বেগমের কানের কাছে গিয়ে বলল,
-খালাম্মা বৃষ্টি তো পরতাছে না।
-তাহলে কাপড় নিয়ে আসলে কেন?
-আইন্নের মাইয়া বৃষ্টির কথা কইতাছি।আমি ছাদে যাইয়া দেহি বৃষ্টি আর রিফাত দুইজনে বৃষ্টিতে ভিজতাছে।
-এককাজ করো।মেয়েটার দুইগালে চড় বসিয়ে ছাদ থেকে নিয়ে আসো।
-আইচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর ভেজা কাপড় নিয়ে বৃষ্টি তার বাবা নাসিরুদ্দিন সাহেবের রুমে প্রবেশ করল।তিনি হুইলচেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন।দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন।
-ভেজা কাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকছিস কেন?
-বাবা, জানো মা আজ কি করেছে?
-না,জানি না।
-মা আজ রানু খালাকে দিয়ে আমার গায়ে হাত তুলিয়েছে।তাও আবার রিফাতের সামনে।আমার কি কোন মান সম্মান নেই।
– দাঁড়া তোর রানু খালাকে জিজ্ঞেস করছি। নাসিরুদ্দিন সাহেব রানু খালাকে ডেকে পাঠালেন।
-জ্বি,খালু।ডাকছিলেন আমারে?
-পারুলের মা, তুমি নাকি বৃষ্টির গায়ে হাত তুলেছ।
-হ,খালুজান।খালাম্মা দিতে কইছিল দুইডা কিন্তু আমি একটাই দিছি।
-তোমার খালা দিতে বলেছে তাই তুমি ওর গালে চড় বসিয়ে দিলে?এরপর আমার ছেলেমেয়েদের গায়ে কখনও হাত তুলবে না।এখন তোমার কাজে যাও। এরমধ্যেই আঞ্জুমান বেগম ঘরে ঢুকে বৃষ্টিকে বলল,
-কি হয়েছে এত চেঁচামেচি কীসের?আর তুই বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে গিয়েছিলি কেন?
-বৃষ্টিতে ভিজতে অনুমতি লাগে নাকি।আমি তিনটি অভিযোগ নিয়ে এখানে এসেছি।
১)তোমার যদি বৃষ্টি এতই অপছন্দ আমার নাম বৃষ্টি রাখলে কেন?
২)তুমি আমাকে শাসন করলে কিছু বলিনা।কিন্তু এখন তুমি রানু খালাকে দিয়ে আমার গায়ে হাত তুলাচ্ছ।এই বিষয়টা আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বৃষ্টির কথা শেষ না হতেই তার মা গালে এক চড় বসিয়ে বলল,
-তোকে পড়ার টেবিলে আমি বসিয়ে আসলাম।আর তুই তোর ছোট ভাইকে নিয়ে চলে গেলি বৃষ্টিতে ভিজতে।তোর না হয় ব্যাঙের শরীর, সারাদিন ভিজলেও কিছু হবে না।কিন্তু রিফাতের তো ঠিকই জ্বর এসে যাবে। বৃষ্টি কোন কথা না বলে রুম থেকে চলে গেল।
-কথায় কথায় মেয়েটার গায়ে হাত তুলা ঠিক না।মেয়ের এখন বয়স হয়েছে।বুঝিয়েও তো বলতে পারো।
-তুমি পাত্তা দিয়েই তো মাথায় তুলেছ।দেখলে না, কথায় কথায় কেমন চাপাবাজি করে।  সারাদিনের মধ্যে একবারও বই হাতে নিতে দেখি না।অথচ দুইমাস পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। আর ছোট টা তো এখন থেকেই তার বোনের ভক্ত। রিফাত ক্লাস টুতে পড়ে।আজকে সাময়িক পরীক্ষার খাতা দিয়েছে। আঞ্জুমান বেগম ছেলেকে নিয়ে বাসায় এসে ড্রয়িং খাতা তার স্বামী নাসিরুদ্দিনের হাতে দিয়ে বলল,
-দেখো,তোমার ছেলে কত পেয়েছে?
– শালিক পাখি আর আম দুইটায় তো খুব সুন্দর হয়েছে।কিন্তু মার্কস দেওয়া হয়নি কেন?
-পরীক্ষায় এসেছে দোয়েল পাখি আর কাঁঠাল। তোমার ছেলে এঁকেছে শালিক আর আম।তাহলে নম্বর কি করে দিবে।
নাসিরুদ্দিন সাহেব ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-এগুলো এঁকেছ কেন বাবা?
-আমার দোয়েলপাখি আর কাঁঠাল একটাও ভালো লাগে না।আর বৃষ্টি আপু বলেছে আমার যা ভালো লাগে তাই যেন আঁকি।
-তা তো আঁকবেই।কিন্তু পরীক্ষার সময় যা আসবে তাই তো আঁকতে হয়। রিফাত কে রুম থেকে বিদায় করে আঞ্জুমান বেগম তার স্বামীকে বলল,
-সব দোষ তোমার মেয়ের।নিজে তো পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে এখন ছোট ভাইটাকেও নষ্ট করে দিচ্ছে। বিকালবেলা আঞ্জুমান বেগম আর রানু খালা দুইজনে রান্নার কাজ করছে।এমন সময় বৃষ্টি রান্নাঘরে ঢুকে বলল,
-মা,তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল।
-বল,আমি শুনছি।
-তোমার তোলা শাড়ি গুলো থেকে আমাকে একটা শাড়ি দিতে হবে কালকে।
-তুই শাড়ি দিয়ে কি করবি?
-কালকে আমি আর তুমি শাড়ি পড়ে কয়েকটা ছবি তুলব।
-হঠাৎ এই আবদার?
-কালকে বিশ্ব মা দিবস।বন্ধু-বান্ধব সবাই তাদের মায়ের সাথে ছবি তুলে ফেইসবুকে দিবে।আমিও দিব।এখন কিন্তু না করতে পারবে না।
-একদিনের জন্য ভালোবাসার কোনো দরকার নেই আমার।আর আগে তো কোনো সময় এত ভালোবাসা দেখি নি।
-তোমার সাথে তো ভালোভাবে কথাই বলা যায় না।
-ঠিক আছে।আমি শাড়ি নামিয়ে রাখব।এর আগে আমি যে পড়া গুলো দিয়েছিলাম সব গুলো মুখস্থ বলতে হবে।
পরের দিন মা-মেয়ে দুইজনে শাড়ি পড়ে অনেক ছবি তুলল।রিফাতকেও নতুন কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরিবারের সবাই একসাথে ছবি তোলা হলো।রানু খালাকে দিয়ে অনেক কষ্টে কয়েকটা ভালো ছবি তোলা হয়েছে।
সন্ধ্যার দিকে খুব জোরে বৃষ্টি পরা শুরু হলো। বৃষ্টি তার মাকে বলল,
-চলো মা,বৃষ্টিতে ভিজি।আজকে সবাই একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছে করছে।
-তোর ইচ্ছে হলে তুই ভিজ,আজকে কিছু বলব না।আমার বৃষ্টিতে ভিজলে হাঁপানি,শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।কোমড়ের ব্যথাটাও বেড়ে যায়।
-আজ কোনো কথা শুনব না।তুমি অসুস্থ হলে আমি তোমার সেবা করব।তাও বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। এরপর বৃষ্টি তার মা আর রিফাতকে নিয়ে ছাদে গেল।বৃষ্টি উপভোগ করার কিছু ছবি তুলে রাখল। চারমাস পর আজ বৃষ্টির মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এদিকে তার মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। বেশ কদিন যাবত কোমড়ের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে।বৃষ্টি এখন মায়ের খেয়াল রাখছে নিয়মিত। একদিন বৃষ্টি মার কাছে গিয়ে বলল,
-মা,আমাকে এবার নতুন একটা ফোন কিনে দিতে হবে।
-আগের ফোনের কি হয়েছে?
-ওটা এখন আর চলে না।নতুন মোবাইল লাগবে।সামনে স্কুল থেকে সংবর্ধনা দিবে।তখন নতুন ফোন দিয়ে ছবি তুলব।আগে থেকেই বলে দিলাম। দিন দিন আঞ্জুমান বেগমের অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল।হাসপাতালেও একমাসের মতো রাখা হলো।কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হলো না।পরে বাসায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। ডাক্তার নাসিরুদ্দিন সাহেবকে বললেন,
-এভাবে বেশিদিন রাখা সম্ভব হবে না।দুটো কিডনিই প্রায় অচল হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর কিডনির ব্যথার সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আর বাঁচানো গেল না আঞ্জুমান বেগমকে।হাসপাতালে নেওয়ার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। বাসা এখন আগের মতো জমজমাট থাকে না।বৃষ্টিও এখন আর বৃষ্টিতে ভিজে না।বৃষ্টি হলে এখন সে জানালা দিয়ে মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিফাত এবার বার্ষিক পরীক্ষায় শাপলা ফুলের জায়গায় তার মায়ের ছবি এঁকে আবারও শূন্য পেয়েছে। নাসিরুদ্দিন সাহেব হুইলচেয়ারে বসে এক রুম থেকে আরেক রুমে দুই সন্তানের খেয়াল রাখেন। রানু খালা মনমরা হয়ে সারাদিন বাসার কাজকর্ম করে। একদিন নাসিরুদ্দিন সাহেব একটা ডায়েরি হাতে নিয়ে বৃষ্টির রুমে প্রবেশ করে বললেন,
-তোর মা এই ডায়েরিটা তোকে দিতে বলেছিল।
ডায়েরিটা বিছানায় রেখে তার বাবা হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাবা রুম থেকে যাওয়ার পর ডায়েরিটা হাতে নিল বৃষ্টি। এরপর পড়া শুরু করল, স্নেহের বৃষ্টি, ডয়েরিটা যখন হাতে নিবি তখন আমি তোদের মাঝে থাকব না।তোকে আর কোন দিন শাসন করব না,এখন বৃষ্টি হলেও কেউ তোকে ভিজতে বারণ করবে না। তুই অনেক বার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলি, আমি বৃষ্টি পছন্দ করি না কিন্তু তোর নাম বৃষ্টি কেন রাখলাম।আজ তার জবাব দিচ্ছি। ছোটবেলায় আমিও তোর মতো খুব বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করতাম।এই জন্য তোর নানার অনেক বকাও শুনেছি।ছোটবেলা থেকেই শ্বাসকষ্ট,হাঁপানি ছিল।আবার বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর-সর্দি লেগে যেত।তবুও ভিজতাম। যখন কলেজে পড়তাম,তখন তোর বাবার সাথে আমার পরিচয় হয়।বিয়ের আগে প্রায় দুইবছর আমাদের পরিচয় ছিল।তখন চিঠির মাধ্যমে কথাবার্তা হতো।
প্রথম যেদিন তোর বাবার সাথে আমার দেখা হলো সেদিন প্রচুর ঝড়বৃষ্টি হলো।তোর বাবা আমার জন্য একটা গোলাপ ফুল এনেছিল।কিন্তু এত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ফুলটা আমার হাতে আসতে আসতে মাত্র একটা পাঁপড়ি অবশিষ্ট ছিল।তখন আমি ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলাম, যেই ছেলে সামান্য বৃষ্টিতে একটা ফুলের যত্ন নিতে পারে না সে কীভাবে একটা মেয়ের যত্ন নিবে। এর কিছুদিন পর যখন আবার বৃষ্টি হলো তখন তোর বাবা বন্ধুদের কাছে ধার করে একটা ছাতা কিনে আমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছিল।ছাতা তোর বাবা মাথায় না দিয়ে পাঁচটা ফুলকে ছাতার নিচে রেখেছিল। বৃষ্টি ভেজা শরীরে আমার হাতে পাঁচটা ফুল দিয়ে বলল, যেই ফুলটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সেইটা নিতে। আমি পাঁচটা ফুলই হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম।
দুইবছর পর আমাদের এই সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছে গেল।বিয়ের পর শ্বাসকষ্ট,হাঁপানির সাথে কিডনির সমস্যা দেখা দিল।এরপর থেকে আর বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি।তোর যখন জন্ম হলো তখন তোর মুখের দিকে তাকিয়েই তোর নাম বৃষ্টি রেখে দিলাম। এরপরের কাহিনি তো তোর জানাই।রিফাতের জন্ম হলো।তোর বাবা দুর্ঘটনায় পা হারালেন সাথে চাকরিও। তবে বাসা ভাড়া দিয়েই সংসারের খরচ ভালোভাবে চলে যেত।এছাড়াও প্রত্যেক মাসে কিছু টাকা জমানো থাকত তোদের ভবিষ্যতের জন্য। এখন তোর বাবা আর রিফাতের দায়িত্ব তোকেই নিতে হবে।রিফাতকে কখনও আমার অভাব বুঝতে দিবি না।আর বৃষ্টি হলেই আমার কাছে চলে আসবি।আমি একা আর কত ভিজবো। তুই সাথে থাকলে খুব ভালো লাগবে।দুইজনে একসাথে ভিজবো।
ইতি
তোর মা বাইরে যেমন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে তেমনি বৃষ্টির চোখেও। বৃষ্টি এখন রানু খালার কাছ থেকে রান্না করা শিখে নিয়েছে।বাবার ওষুধ-পত্রেরও খেয়াল রাখছে।রিফাতকেও স্কুল থেকে আনা-নেওয়া করছে।আবার নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছে। আজ আঞ্জুমান বেগমের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। কাকতালীয় ভাবে সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি রিফাতকে বলল,
-চল,মায়ের সাথে দেখা করে আসি।আজকে দুজনে মায়ের সাথে বৃষ্টিতে ভিজব।
-তুমি যাও আপু।আমি মায়ের জন্য গিফট নিয়ে আসছি।
এরপর দুই ভাইবোন একসাথে মায়ের কাছে গেল।রিফাত মায়ের একটা রঙিন ছবি এঁকেছে। সাথে নিয়ে এসেছে একটা ছাতা।ছাতা দিয়ে ছবিটাকে খুব যত্ন করে মায়ের কাছে নিয়ে গেল। উপর থেকে নাসিরুদ্দিন সাহেব দুই সন্তান আর তাদের মায়ের বৃষ্টি উদযাপন দেখে চলেছেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত