শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয় আমায় বউয়ের সাজে দেখে আঁতকে উঠলেন।তারপর “ওমা তুমিতো সেই শিউলি তাই-না,যে দুবছর আগে চলন্ত বাসে গনধর্ষনের শিকার হয়েছিলা।তারপর ধর্ষকরা মরে গেছো মনে করে রাস্তায় ফেলে চলে গিয়েছিল।তুমি সেই শিউলি তাইনা?” বলে মহিলা আমার একদম কাছে চলে আসলেন।আমি অসস্তিবোধ করলাম।বিয়ে বাড়ির বাকি অতিথিরা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।যেন সৃষ্ট নব্য কোন অসহায় প্রাণী কে এই প্রথম দেখছে তারা।
জানো তোমার সেই রক্তাক্ত চেহেরাটা আমি এখনো ভুলতে পারেনি,অন্য কোথাও ধর্ষণের শিরোনাম দেখলে তোমার চেহেরাটা ভেসে ওঠে প্রথমে।সেই সময় পত্রিকা কিংবা টিভিগুলো তোমাকে নিয়ে এতোই রিপোর্ট করেছিল যে প্রায় দু’সপ্তাহের মতো হেডলাইন হয়েছিলা।তোমার ধর্ষকদের বিচার চেয়ে সাধারণ সমাজের লোক থেকে ছাত্র সংগঠন গুলো অনেক প্রতিবাদ মিছিল করেছিল।আমিও একবার গিয়েছিলাম শাহাবাগ মোড়ে।একটা প্ল্যা কার্ড হাতে,বিচার চেয়ে।জানো আমারও পিষাস গুলোর ওপর অনেক রাগ হয়েছিলো।মহিলাটা দ্বিতীয়বার কথাগুলো বলল। তখন আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলে তখন আমি নিচে পুঁতেই যেতাম। মহিলাটা যখন কথাগুলো বলছিলো চারপাশের মানুষজন আমাকে আবার নতুন আঙ্গিকে পড়তে শুরু করলো।আমায় নিয়ে আবার চাঙা হয়ে উঠলো বিয়ে বাড়ির পরিবেশ টা।শুধু শ্বাশুড়ি মা’ই আমাকে ভরসা দিলো।এসবে কান দিওনা মা বলে। কিন্তু কান না দিয়ে উপায় আছে কি করে বলেন? সবাই তো আমার চারপাশ ঘিরে কথাগুলো বলছে।আমি কথার বিষয়বস্তু, আমি সবার কথার মধ্যমণি।ছাড় দিচ্ছে না ছোট-বড় কেউ।
ধর্ষণ ব্যাপারটা একটা শিশু মন কেউ এতোটাই প্রভাবিত করেছে যে সাত না পেরোনো মেয়েটাও আমার দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে ভয়ংকর ভাবে তাকাচ্ছে। পাশের জনের কথা শুনে। ভেবেছিলাম,ধর্ষিত হওয়ার দুয়েক বছর পেরিয়ে যখন গেছে সবাই আমার ঘটনাটা ভুলে গেছে।নতুন করে অনেক মেয়েই ধর্ষিত হচ্ছে,অহরহ ঘটনার মধ্যে আমার টাও সাধারণ নিছকে পরিণত হয়েছে।কিন্ত আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে অনেক বারই।কখনো ক্যাম্পাসে,কখনো বা অফিসে।
ধর্ষণ হওয়ার বছর পরেই আমার পড়াশোনা শেষ হয়। চাকরি করব বলে ঠিক করলাম।প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েই ধরা খেয়ে বসলাম।ভাইবা বোর্ডে মাঝবয়সী দুই ভদ্রলোক বসা ছিলো।আমরা একসাথে গেলাম তিনজন।
যে দুজন ভদ্রলোক ভাইবা নেবে বলে বসেছে তাদের একজনের মনে হলো, আমাকে এর আগে উনি কোথায় যেন দেখেছেন। চেহেরাটা বেশ পরিচিত পরিচিত লাগছে। তখন উনার পাশে বসা অপর ভদ্রলোক উনাকে আমার ঘটনাটা মনে করিয়ে দিলেন।তারপর উনি ও হ্যা! তুমি সেই শিউলি বলে আমার ফাইল টা দেখার আগেই বলে ফেললেন, আমাদের অফিসে স্মার্ট এবং ভালো মেয়ের দরকার বুঝলে।অনেক নামীদামী কোম্পানির লোকজন আসে এখানে।
তারপর বাকিটা উনার বলার প্রয়োজন হয়নি। নিজ দায়িত্বে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম।তারপর অনেকদিন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায়নি, লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে।
কর্মক্ষেত্র ছাড়াও কখনো কখনো এরকম অপরিচিত মানুষের কাছে এরকম কোন পার্টি বা অনুষ্টানে।প্রতিবারই এরকম কারো দ্বারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি।সবাই পিঠ চাপড়িয়ে শান্তনা দিতে গিয়ে পাশের বাদবাকি লোকজনদেরো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।পরিচয় করে দিয়েছে যারা জানতোনা আমি ধর্ষিতা তাদের কাছেও। বলেছে,
ইশ রে! তোমার ঘটনাটি শুনার পর সত্যি খারাপ লেগেছিল।দেশে ধর্ষকদের বিচার হয় না বলে এমন টায় হয়। তবে বলে কি!বিচার যখন হয়না এসব ভুলে যাও।একটা জীবন পেয়েছো সেটা উপভোগ করো।
কিন্তু কোনদিন কাউকে বলতে পারলামনা, আপনারা আমার জীবন টাকে উপভোগ করতে দিচ্ছেন টা কয়?আমি ভুলতে চাইলেও আপনারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ধর্ষকেরা একবার ধর্ষণ করে তাদের ক্ষুধা মিটিয়েছে,আপনারাতো ভালো রাখতে পাশে এসে হাত ধরার বদলে ধর্ষণ হয়েছিলাম রোজ সেটা মনে করে দিয়ে আমায় আহত করছেন,ধর্ষক শারীরিক নির্যাতন করেছে আর আপনারা আমাকে রোজ মানসিক ধর্ষণ করছেন। যেদিকে যাচ্ছি সবাই ধরিয়ে দিচ্ছেন আমি ধর্ষিতা, আমার উপর কিছু নরপশু আক্রমণ করেছিলো একসময়।তখন আপনাদের আমার উপর দয়া হয়েছিল আর পশু গুলোর উপর রাগ হয়েছিল।আমার সাথে যা ঘটেছে তা খুব খারাপ ঘটেছে, আপনি তাতে মর্মাহত তা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন সমাজের হয়ে কেউ না কেউ।আপনারা যদি আমায় দেখে এসব কথা না বলে একটা সুস্থ সবল মেয়ের সাথে যেরকম আচরণ করেন সেরকম আচরণ করতেন তাহলে জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ্য না হলেও চলতে সহজ হতো।দুর্ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়ার অনেক লোক আছে,কিন্তু পাশে এসে হাত ধরে ভরসা দিয়ে দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার মতো লোক নেহাত কম এই সমাজে।
এসব লোকদের প্যাচাল থেকে বাঁচতে তাই বেশ কয়েক মাস ঘরবন্দী ছিলাম।যখন চারপাশের সবাই আমাকে অবহেলা করতে শুরু করে,আড়ালে আমায় নিয়ে অনেক খারাপ কথা বলতে শুরু করে।ধর্ষণ হওয়ার পিছনের কারণ হিসেবে কেউ কেউ যখন আমার পোশাক, সন্ধ্যার পর কাজ থেকে ফেরা কে দায়ী মনে করেছিলো।আর দোষীরা তাদের কাছে পেয়েছিল রক্ষা।তখন সমাজটার উপর ঘৃণা জমে গিয়েছিল।মানুষগুলোর উপর থেকে ভরসা হারিয়ে বসে ছিলাম। সেদিন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।ব্লেড দিয়ে হাত কাটার আগেই মনে হল,কাদের উপর রাগ করে চলে যাচ্ছি আমি? যারা খারাপ হয়েছে বলে চোখের সামনে দুই দিনের দয়া করে আড়ালে আমায় দোষারোপ করে।আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।তাদের সাথে অভিমান করে বোকার মতো কেন মরব? মরে গেলেও দুই চারদিন আফসোস করবে।ধর্ষনের আঘাত সহ্য করতে পারেনি বলে আত্মহত্যা করেছি বলে হয়তো কেউ কেউ ধর্ষকের বদলে আমাকেই ঘৃণা করবে।তারপর ভুলে যাবে সবাই।কারণ সমাজটা এরকমই।সব ভুলে যায়।
বুঝে গেলাম,এই সমাজে যাই ঘটে যাক, মানুষ তার বিচার করবে। আরেক জনের সমালোচনা ধরতে গেলে, দেখবে দিনের শেষে নিজেকেই অপদস্থ করছো। লোকের বিচার বিবেচনা করে নিজেকে পাল্টাতে গেলে দেখবে প্রতিনিয়ত ই পাল্টে ফেলছো।লোকের জন্য কেন নিজের ক্ষতি করে নিজেকে শেষ করবে? নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলে তো,প্রয়োজন পরে না লোকে কি ভাবল। তোমার জীবন, তুমিই বাঁচবে, তোমার সাথে সহমরণে কেউ সামিল হবে না। তাই বাঁচলে নিজের জন্য বাঁচো,আর কারো জন্য না।আর অন্যের সমালোচনা আর দয়াই ভর করে নিজেকে থামিয়ে রেখো না,তুমি তোমার মতো করে বেঁচে থেকো।সমাজের দয়ায় বাঁচতে গেলে তারা তোমার মৃত্যু না হওয়া অবধি তোমার অপরাধ মনে করিয়ে দেবে কখনো শুধরোবে না।”
তারপর মরণের কথা ভুলে আই ডোন্ট কেয়ার নিয়ে আবার বাইরে বেরোলাম।ধর্ষিতা হলেও ভালোভাবে বাঁচা যায় তা প্রমাণের লক্ষ্য নিয়ে। আবার চাকরির ভাইবা দিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলাম।তারপর একদিন একটা ব্যাংকে চাকরি হলো। বাবা মা বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেক পাত্রপক্ষ রিজেক্ট করেছিল ঘটনা টা জানার পর।সাজতে সাজতে আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাবা মাও তখন ভিষণ চিন্তিত। পাত্রপক্ষের আমার রূপ পছন্দ হলেও প্রায় সব কটা বিয়ে ভেঙেছে ঘটনা বলার পর।না আমি চেয়েছিলাম সংসারটা গড়ে ওঠার আগে ভরসার হাত টা ভারি হয়ে উঠুক।অবিশ্বাস আর সন্দেহ নামক ক্ষত যাতে সৃষ্টি না হয় বাবাকে বলতাম পাত্রপক্ষকে আমার অতীত টা বলতে।যাতে বিয়ের পর যদি কোথাও এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ি সবার সামনে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তা নিয়ে কানাঘুঁষা না করে,আমার পাশে এসে দাড়ায়।বিয়ের আগে বলেনি বলে দোষ না দেয়।
তাই বাবাও বলতো।আমিও বলতাম যখন পাত্রের সাথে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ হতো।কারণ আমি চাইছিলাম, বিয়ের পর আমার চরিত্র নিয়ে তার মধ্যে কোন সন্দেহ না হোক। কিন্তু ঘটনা শুনার পর প্রত্যেকে খুব খারাপ ভাবে ধর্ষণ হয়েছি বলে সু সেড,খুব খারাপ হয়েছে আপনার সাথে,এরকম উচিত হয়নি।বিচার পেয়েছেন? এসব কথা বলে দয়া দেখিয়ে কেটে পরতো।কোন কোন পাত্রের পছন্দ হলেও পরিবারের বাদবাকিদের পছন্দ হতোনা।তখন বুঝতাম,মানুষের মুখের কথা কখনো কখনো সত্যি নাও হতে পারে।মানুষ বলে,ধর্ষিতা হওয়ার পিছনে মেয়েটার দোষ ছিলোনা, কিন্ত তিতা সত্যি এটা যে,বিয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়ে মেয়েটা। উপদেশ দেওয়া এক কথা,দয়া করা আরেক কথা।আর হাত ধরে আমি আছি ভরসা দেওয়া আরেক কথা।
তারপরো ভেঙে পরেনি আর।বিশ্বাস ছিলো একদিন ঠিক এরকম একটা পরিবার কে আমি পাবো।যারা আমায় বুঝবে, আমার উপর ভরসা করবে।একটু দেরিতে হলেও আমি রিহান আর তার পরিবার টাকে পেয়েছি। যারা আমার সমস্ত ঘটনা শুনার পরে বলেছে,তোমার সাথে যা ঘটেছে বা ঘটছে সেখানে তোমার দোষ কোথায়,সব তো এই সমাজটায় বসবাস রত কিছু মানুষের। যারা অনেক ভালো গুণের মধ্যে থেকেও খারাপ টায় চোখ রাঙায়। পিড়াপিড়ি করতে ভালোবাসে।শ্বাশুড়ি মা মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ভয় করোনা মা, আমরা আছি সবসময় তোমার পাশে।
রিহান বলেছিল,”তোমার সাথে যা হয়েছে সত্যি খারাপ হয়েছে।তবে তোমার অতীতে কি ঘটেছে না ঘটেছে তা দিয়ে আমি কি করব বল?অতীতের সাথেতো আমি সংসার করবোনা।সংসার করবো তোমার সাথে।
আর শরীর দিয়ে কি ভালোবাসার পবিত্রতা মাফা যায় বল?বিপদে আপদে প্রিয় মানুষটার ওপর ভরসা রেখে,ওর পাশে থেকে মনের পবিত্রতা দিয়ে সংসার শুরু করলে সে সংসার ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে।আমি তোমার মধ্যে সে বিশ্বাস আর পবিত্রতা দেখছি।যদি তুমি আমাকে একটিবার সে সুযোগ দাও। সেদিন অজান্তে মানুষটার বুকে মুখ গুঁজে অনেক কেঁদেছিলাম।কি ভাববে তা মাথায় আসেনি।আমি আমার মনের মতোন একটা পরিবার কে পেয়েছি সেই আনন্দ হচ্ছিল ভীষণ। তারপর পরিবারের সম্মতিতে আজকের দিন টা এলো।আমি চুপচাপ বসে আছি।পাশে বসা রিহান শক্ত করে আমার ডানহাত টা শক্ত করে ধরে রাখে।
শ্বাশুড়ি মা ভরসা দেয়।তারপর আমি খেয়াল করলাম,প্রিয় মানুষটার হাতের স্পর্শে এই প্রথম মানুষের পিড়াপিড়িতে আমার খারাপ লাগাটা সেরে উঠছে।ভরসা পাচ্ছি আবার নতুনভাবে বাঁচার।নিজেকে অনেকদিন পর একটা মানুষ মানুষ মনে হলো।। দোষ ধরে দেওয়া হাজারের ভিড়ে এমন একজন যদি থাকে তাহলে তার জন্যই আমি ভালোভাবে বাঁচব। আমার হাজার দরকার নাই যদি এমন একজন যে আমার সমস্ত দোষ জেনেও তা মেনে নিয়ে এরকম অসময়ে হাত ধরে ভয় করোনা,ছেড়ে যাবো না আর পাশে আছি তার জানান দেয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প