আমি নুজাইরাহ। আজ আমার বিয়ে। বিয়ে পুরোপুরি ঠিক করার পর আব্বু আমার মতামত শুনতে চেয়েছিলো একবার। বড্ড হাসি পাচ্ছিলো! আমার “হ্যা, না” জবাব উনি তখনই শুনতে চেয়েছে যখন ‘না’ বলার দরজা বন্ধ প্রায়। বাবার কথার কোন উত্তর দেই নি। নীরবতাকে সম্মতির বহিঃপ্রকাশ মনে করে বাবা চলে গেছে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে মাকে বলেছিলাম, মা, লোকটার যে দাড়ি ছিলো না, টাখনুর উপর প্যান্টও নেই! দীন সম্পর্কে কি পরিপূর্ণ ধারনা আছে তার? আমাকে কি পরিপূর্ণ পর্দা করতে দিবে? মায়ের জবাবটা এমন ছিলো- “ছেলেটা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। দশ গ্রামে ছেলেটার ভালো নাম। এতো ভালো চাকরী করে। তোর পর্দা, তোর কাছে। ও তোকে বাধা করবে কেনো!”
আমি বরাবরের মতো আজও বাবা মায়ের একটু বেশিই বাধ্য সন্তান! তাই বিয়ের আয়োজন নির্বিঘ্নে এগিয়ে চললো…
এই পরিসরে আমি আমার সম্পর্কে একটু বলে বলে নেই, খুব ইসলামিক নয় সামাজিক একটা পরিবারে আমার জন্ম।এখানে কেউ দীন মেনে চললে, সবাই খুশি হয়,কিন্তু না মানলেও খুব একটা রাগ করে না। সেই সুবাদে আমার পর্দা করতে কোন সমস্যা হয় নি এখানে। গত দু বছর আগে,পর্দা সম্বন্ধে, ইসলাম সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতাম না! কিন্তু আমার এক দীনদার বান্ধবীর কাছে এসব সম্বন্ধে অনেকটাই জেনেছি। খুব ভালো লেগেছে আল্লাহর দেওয়া প্রতিটা বিধি নিষেধকে। তাই নিজেরই জীবনে সেগুলো বাস্তবায়নে আপ্রান চেষ্টা করেছি দুইটা বছর। অনাবিল এক শান্তি আছে,আল্লাহকে হুকুমদাতা মেনে নিতে পারায়। এটা খুব বুঝেছি এই দুই বছরে আমি এখন শশুড়বাড়িতে। সবাই বেশ ভালোই। এ বাসাটা একেবারে গ্রামে। বিশাল আঙিনা।
চাকরির সুবাদে শহরের যাওয়ার কথা উঠলেও বৃদ্ধ শশুড়-শাশুড়িকে রেখে যাওয়াটা ভালো লাগছিলো না।তাই এখানেই থাকা। বাসার সদর দরজাটা সব সময় খোলাই থাকে কে কখন বাসায় ঢুকে বলাই যায় না। পরিবেশটা খুব অস্বস্তিকর লাগে আমার কাছে। আমার দেবর -ভাসুরের সামনে গেলে উড়নার একপাশটায় মুখটা ঢেকে দেই।কিন্তু বিষয়টা কারও কাছেই ভালো লাগে না তেমন! সেদিন আমার উনি তো বলেই দিলো, এটা কি বেশি বেশি নয়।ওরা তো বাড়িরই লোক। আর মুখ খোলা রাখাটা কি জায়েজ নয়। তারপরও একতরফা সংগ্রাম টা করেই গেলাম কিছুদিন। কিন্তু লাভ হলো না। রান্না করতে, কাপড় মেলতে অথবা বাবার চা টা দিতে গিয়ে একবার না একবার গায়রে মাহরামদের সামনে পড়তেই হচ্ছে!! আজ দুপুরে গোসল সেরে ফ্যানের নীচে চুল শুকাচ্ছিলাম। অবশ্য এসময়ে ঘরের দরজাটা লাগিয়েই দিতাম। কিন্তু কাল মা বলল, দিনের বেলায়ও দরজা লাগানোর কি প্রয়োজন?
তাই আজ খোলাই ছিলো দরজাটা। আজ হঠাৎ আমার ছোট দেবর ঘরে ঢুকে পড়ল। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, ভাবী আজ তো তোমার চুলও দেখে ফেললাম! তারপরে আরও একতরফা হাসতে হাসতে বলল,ভাইয়ার নেইলকাটার টা নিতে এলাম, দাও তো। অগত্যা নেইল কাটার টা এগিয়ে দিয়ে ধপ করো বসে পড়লাম বিছানায়। কান্না এলো,খুব করে কান্না এলো।কিন্তু কাঁদারও বেশি সময় নেই যে। মা ডাকছে বাবাকে ভাত বেড়ে দিতে হবে। এভাবেই চলছে দিনগুলো হঠাৎ একদিন আমার দেবরের এক বন্ধু বাসায় এলো। আঙিনায় কাজ করছিলাম। বুঝতেই পারি নি পেছন থেকে কখন এসে পড়েছে। হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো! ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেললাম। তবে দেরী হয়ে গেলো! ছেলেটা আমার চেহারা ভালো করেই দেখেছে। কমেন্ট করতেও ভোলে নি!
“বাহ্! ভাবীর চেহারাটা তো বেশ্ মিষ্টি!” আমি তখন পুরো বোবা বনে! পর্দা করার পর থেকে কেউ আমাকে সুন্দর,কিউট, মিষ্টি বলার সুযোগটা ও পায় নি কোনদিন! ইশ্, আমি বুঝি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি! কই বুক ফেঁটে কান্নাটা তো আসছে না আর! তবে আজ সারাদিন ছেলেটার “মিষ্টি” কথাটা বুকের মধ্যে হাতুড়ির আঘাত করছে অবিরাম। কোন কাজেই শান্তি পাচ্ছি না। আমার বিয়ের দুবছর হলো।আমি নার্সিং হোমে আজ। কাল সিজার করে আমার এক ছেলে হয়েছে। আমি এখন পুরোই সয্যাশায়ী! নড়তে পারছি না।
আমার স্বামীই আমার দেখাশোনা করছে। আজ আমার ননদ আর ননদের স্বামী এসেছে আমাকে দেখতে! আমার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দেওয়া আছে! নড়তে না পারলেও বুঝতে পারছি, আমার পা দুটো টাখনু পর্যন্ত বাইরে বেড়িয়ে আছে। আমার ননদের স্বামী আমার পায়ের দিকের সোফায় গিয়ে বসল! আমি যখন তার দিকে তাকালাম তখন দেখি তার চোখদুটো আমার পায়ের দিকেই নিবন্ধ! এখন তো আমার শক্তি নেই আমার পা দুটোকে ঢেকে দেওয়ার!! আর ওকে(স্বামী) বলার মতো কোন ইচ্ছেই নেই এখন! এটা তার কাছে নিছকই ছেলে মানুষই মনে হবে! অতীত স্মৃতি গুলো কেনো জানি খুব মনে পড়ছে আজকে। যখন থেকে শুনেছি, এই পা দুটো ঢাকাও ফরয। তখন থেকে কতনা বিড়ম্বনার মধ্যে ও পা দুটোকে ঢেকে রেখেছি। মোজা না পড়ে কখনই বাড়ি থেকে বের হয় নি। আজ যে পারলাম না!
আজ আমার সিজারের পাঁচদিন হলো। এখনো একা-একা হাঁটতে পারি না। আমার হাজবেন্ড আমার বাহুটা ধরে, বাথরুমে নিয়ে যায়। আজও তাই হচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎই তার মোবাইল বেজে উঠল। তাই জরুরী ফোন কিনা!
তাই উনি আমার দেবরকে আমাকে ধরতে ইশারা করে, দ্রুতই বেলকোণিতে চলে গেলো!এবার আমার দেবর,আলতো করে ধরলো আমার বাহুটা!!! ইশ্ আজ যদি সুস্থ থাকতাম দৌড়ে পালিয়ে নিজেকে বাঁচাতাম। কিন্তু সে শক্তি যে নেই আমার শরীরে!হঠাৎই মনে হলো, আল্লাহ!নন মাহরামের হাতের স্পর্শ পাওয়ার আগেই, যদি ঐ অপারেশন টেবিলেই চলে যেতাম তোমার কাছে! ভালো হতো না কি! না, হতো না হয়তোবা!
তাই বেঁচে আছি। আলহামদুলিল্লাহ! আমি এখন বৃদ্ধাপ্রায়। ২৫ বছর কেটে গেলো বিয়ের। আমার ছেলের বয়স ২৩বছর। আমার আরও একটা মেয়েও হয়েছে। ওর বয়স ২০। আজ খাবার টেবিলে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম,বাবা, দাড়িটা আর কাটিস না,রেখে দে।একটা হাসি দিয়ে ছেলে আমাকে বলল, বাবার আগেই আমি দাঁড়ি রাখবো! তার এই কথাটার যুতসই কয়েকটা জবাব জানা ছিলো।কিন্তু না, বলা যাবে না!আমার উনিও তো এখনো দাড়ি রাখেনি!ছেলেকে বলতে গিয়ে, যদি ছেলের বাপ কষ্ট পেয়ে যায়! বেলকোণিতে দাড়িয়ে, ঐ বিশাল আকাশটা দেখছি। আজ ২৫বছর পর! তোমার কথাগুলো খুব মনে পড়ছে মা। তুমি না বলেছিলে সব ঠিক হয়ে যাবে! কই মা,কিছুই তো ঠিক হলো না! উল্টো তোমার মেয়েটাই এখন জীবন্ত লাশ! যৌবন বয়সটাও ঠিকঠাক পর্দা করা হলো না,তোমার মেয়ের!!
তবে জানো মা! একটা জিনিস ঠিকই ছিলো! তোমার মেয়েকে কোনদিন অভাবের ছিটে ফোটাও দেখতে হয় নি! তোমার জামাই তো আজও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে!! কিন্তু তারপরে ও বুকের ভিতরে একটা বিশাল শূণ্যতা। আমি তো শুধু কোন নামাজীকে বিয়ে করতে চাই নি! আমি একজন সাহাবাকে বিয়ে করতে চেয়ছি! যে নিজের জীবনের চেয়েও ভালোবাসবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে(সাঃ)।
জানো মা, আজও আমার মনে হয়, যদি চলে যেতে পারতাম, ২৫ বছর আগের দিনগুলোতে! ছোট্ট নুজাইরার, বোরকা নিকাবগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম! সেগুলোতে একটা শান্তির পরশ আছে মা!আল্লাহকে ভালোবাসার এবং তাঁর ভালোবাসা পাবার এক অনাবিল শান্তি!
গল্পের বিষয়:
গল্প