মা মারা যাওয়ার পর আমি ধরেই নিয়েছিলাম বাবা অনেক বদলে গেছে। গভীর রাত করে বাড়ি ফিরতেন। আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলতেন কি বলতেন না! আমি খেয়েছি কিনা, ঠিক মতো পড়াশোনা করছি কিনা, এসব নিয়ে উনার কখনো মাথাব্যাথা ছিলো বলে আমার মনে হয় নি।
বাসায় একজন কাজের মহিলা ছিলেন। তাকে আমি বুবু বলে ডাকতাম। বুবুই আমার খেয়াল রাখতেন। আমাকে জোর করে খাওইয়ে দিতেন। পড়াশোনার ফাঁকে এক গ্লাস দুধ এনে দিয়ে যেতেন। রাত জাগলে ঘুমিয়ে পড়তে বলতেন। বাবার চেয়ে তাকেই আমার বেশি আপন বলে মনে হতো। আশেপাশের মানুষজন নানা ধরনের কথা বলতো। বাবা পুনরায় বিয়ে করেননি। তার চরিত্রে দোষ আছে। সন্তানের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই। কর্তব্য নেই। বেখেয়ালি একজন মানুষ। তারা আমার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে তাঁকাতেন। বাবার চেয়ে তাদেরকেই আমার বেশি আপন বলে মনে হতো।
সময় গড়িয়ে গেলো। আমি বড় হলাম। অবহেলার কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের দুয়ারে আঘাত হানলাম। বাবা অতি ব্যস্ত হয়ে গেলো। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে। খুব বড় ঘরে আমার বিয়ে ঠিক হলো। ছেলে অন্য দেশের নাগরিক। ভালো চাকরি করে। বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারবো। আমি আপত্তি করি নি। কারণ এই গুমোট জীবন থেকে মুক্তি পাওয়াটাই ছিলো আমার মূল লক্ষ্য। বিয়ের আগের দিন রাতে বাবার ঘর থেকে চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসে। কৌতূহলী মন নিয়ে দরজার ফাঁকে চোখ রাখি। সাথে সাথেই বুক জুড়ে শুরু হয় চিনচিনে ব্যাথা। বাবার এক হাতে মায়ের ছবি অন্য হাতে আমার ছবি। পরম যত্নে ছবিগুলোয় তিনি হাত বুলাচ্ছেন আর কাঁদছেন।
সহ্য করতে পারিনি। নিজের ঘরে ফিরে আসি। নানা প্রশ্নের বেড়াজালে নিজেকে আবদ্ধ বলে মনে হতে থাকে।
বাবা কেনো কাঁদছেন? তার কোনো অনুভূতি আছে বলে তো কখনো মনে হয় নি! নাকি বাবার অনুভূতি ছিলো কিন্তু আমি সেটা কখনো টের পাই নি? এই দূরত্ব সৃষ্টির পেছনে কি শুধু বাবাই ছিলো? নাকি আমি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি?! মাকে হারিয়ে বাবা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন। আমি কি মেয়ে হয়ে তাকে স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছিলাম? নাকি অভিমানের ভীরে চাপা পরে, দূরে সরে এসে তাকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছি?
যখন বুবুর কাছে শুনতে পাই, আমার খেয়াল রাখার জন্য তার বেতন বাবা হাজার খানিক বাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রতি সকালে সূর্য আমায় স্পর্শ করার আগেই বাবা বিনা শব্দে আমার ঘরে প্রবেশ করে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে যেতেন তখন আর বুঝতে বাকি ছিলো না ভুলটা কার। বিদায়ের আগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম আর বলেছিলাম, “তোমার মেয়েটা একদিনেই খুব বড় হয়ে গিয়েছে, বাবা। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে। ক্ষমা করে দিও আমায়। বাবার চোখে সেদিন আমি আনন্দ অশ্রু দেখেছি। সেই অশ্রুর প্রতিটি ফোটার নির্বাক অনুভূতি আমি ঠিক টের পেয়েছি!
গল্পের বিষয়:
গল্প