ত্রিমাত্রিক

ত্রিমাত্রিক
কোচিংয়ের বিদায়ের দিনে আমার আর রোহানের কাছে এসে একটা মেয়ে লাজুক ভঙিতে বলেছিলো, “আমি তোমাদের দুজনকে খুব মিস করবো।” আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “আমাকে কেনো মিস করবে তুমি। আর তুমিকি এই কোচিং এ এতোদিন ছিলে?”
“হ্যাঁ, আমি এখানকারই। তবে তোমাদের সাথে কখনো পরিচয় হয়নি আমার। দূর থেকে আমি তোমাদের দেখতাম। খুবই ভালো লাগতো।” রোহান বরাবরই আমোদপ্রিয় ছিলো। সে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলেছিলো, “কি বললে। আমাদের দুজনকে ভালো লাগে? তা কোন দৃশ্যটা তোমার ভালোলাগার স্থান নিলো?” রোহানের পাগলাটে হাসিতে মেয়েটি হয়তো বিব্রতবোধ করেছিলো। আমি ব্যপারটা বুঝতে পেরে রোহানের পেটের ওপর কনুইয়ের গুতো মেরে চুপ করিয়েছিলাম।তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” তোমার নাম
কি? “
” মোহনী তন্দ্রা! “
” বাহ, খুব সুন্দর নাম তো। একটা কবি কবি ভাব আছে!”
মেয়েটা যেনো খুব লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে হাসিহাসি মুখে বললো, “আমি টুকটাক লিখি। খুব আশা আছে আমার বই হবে কোনো একবছরে।” তারপর টুকটাক কিছু কথা, অতঃপর সবার বিদায়। কিন্তু মজার ব্যাপার ছিলো ঘুরেফিরে ক’মাস পর আমাদের তিনজনের আবার একসাথে হওয়া, যা কখনো ভাবিইনি আমি। একই ভার্সিটিতে তিনজন চান্স পেয়েছিলাম।যখন হলে থাকার সুযোগ মিললো, তখন তন্দ্রাকে বানিয়ে নিলাম আমার রুমমেট। আগের অপরিচিত তন্দ্রা হয়ে উঠলো আমার ইউনিভার্সিটি লাইফের বেস্টফ্রেন্ড। ভালোবাসার মানুষ রোহান আর জানের বান্ধবী তন্দ্রা। আমার চেয়ে আর কে বেশি সুখী ছিলো! একদিন ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমি বললাম,
“আচ্ছা তন্দ্রা, তোর স্বপ্ন কি রে?”
“স্বপ্ন বলতে? কিরকম স্বপ্ন!”
“আই মিন শখের স্বপ্ন”
“অনেকই তো আছে। কোনটা শুনবে?”
একটু ভেবেচিন্তে উত্তর করেছিলাম, “তোর লিখালিখির ব্যাপারে বল!” “আচ্ছা। কোনো একবছরের বইমেলাতে আমার বই ছাপানো হবে। সেইবছর আমার পেটে বাবু থাকবে। সবাই দেখবে আমরা দুজন ব্যক্তি মেলাতে উপস্থিত। অথচ অগোচরে আসলে তিনজন। আমি, আমার স্বামী আর পেটের অনাগত দিগ্বিদিক জয়ী রাজকন্যা কিংবা রাজপুত্র।”
রোহান কখন আমার পেছনে এসে বসেছে আমি টের পাইনি। তন্দ্রা ও টের পায়নি। এমন স্বপ্নের কথা শুনে রোহান হঠাৎ করে অট্টহাসি দিয়ে বসলো। ভয়ে আমি আর তন্দ্রা আঁতকে উঠে পেছনে ফিরে দেখি রোহান। সেদিনও আমি রেগে গিয়ে রোহানের পেটে কনুই দিয়ে গুতো মেরেছিলাম। কিন্তু ওই প্রথম আমি একটা অদ্ভুত ব্যপার লক্ষ্য করেছিলাম।ভালোবাসার চক্ষুসীমায় আমি যেখানে আছি, সেখানে আমার চেয়ে আরেকজনের প্রাধান্য বেশি। একজন ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, আরেকজনের চোখ দিয়ে অপারগতার অসহায়ত্ব ঝরে। ব্যাপারটা আমি হজম করতে পারিনি। সেদিনই তন্দ্রার রুম থেকে আমি অন্যরুমে সব বেডপত্র নিয়ে শিফট হয়ে গেলাম। ক্লাসে যদি তন্দ্রা সামনের সারিতে থাকতো, তাহলে রোহানকে জোর করে আমার আড়ালে বসাতাম। যদি তন্দ্রা পিছনে বসতো, তাহলে রোহানকে বসাতাম সামনের সারিতে। এতোকিছু করেও আমার চেষ্টা ফুলফিল করতে পারিনি। দেখতাম কোনো নোটস কিংবা কবিতার বইয়ের বাহানা দিয়ে দুজন একসাথে গল্প করছে কিংবা হাসিতে মেতে আছে।
তন্দ্রা কি ভাবতো তা আমি জানিনা। কিন্তু রোহান আমার চার বছরের ভালোবাসা। ওর চোখ দেখে আমি হার্টের অবস্থা বুঝতে পারি। ওর কন্ঠ শুনে আমি ওর আকুলতা ধরতে পারি। আমি বুঝতাম আমার ভালোবাসা আমার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। তবও কৌশলে যতোটুকু সম্ভব চাইতাম আমার প্রেম আমারই থাকুক। শুধুমাত্র রোহানের দিকটা মাথায় রেখে আমি তন্দ্রার মতো এতোটা ভালো বান্ধবীর সাথে অযথাই একটা ইস্যু নিয়ে ঝামেলা বাধালাম। স্কুলজীবনে আমার সাথে অনেকের ঝামেলা হয়েছে এবং রোহান বরাবরই তাদেরকে এমন থ্রেট দিয়েছে, আর কখনো আমার সামনেই মাথা উঁচু করবার সাহস পেতোনা। অথচ তন্দ্রার সাথে ঝামেলা হবার পর আমাকে বারবার বলতেছিলো, “তন্দ্রার কোনো দোষ নেই। ওকে তুমি সরি বলো।”
এই একটা কথাই আমার জন্য যথেষ্ঠ ছিলো। বড্ড অভিমানী মেয়ে আমি। এমনভাবে মাকড়সার মতো অভিমানের জাল বিছালাম, যেটা পরবর্তী সময়ে তন্দ্রা কিংবা রোহান আর ভেদ করতে পারেনি। আসলেই কখনো ভেদ করতে চেয়েছিলো কিনা তাও সঠিক জানিনা আমি। ওই শহরের ধূলো আর পায়ে লাগেনি আমার। সত্য বলথে লাগাতে চাইনি। বাস্তবতার তালেমিলে আমিও একসময় রুপ বদলালাম। কলেজ ড্রেস রেখে শাড়ির বয়স হয়ে এলো আমার। বাবার বন্ধুর ছেলেরা আমার সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করে চলে যেতে বাধ্য হয়।আমি তখনো রোহানের স্মৃতিতে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছি। আমার বয়স বাড়ন্ত থাকলেও অনুভূতির সুতো সেই চার বছরের ভালোবাসার মধ্যেই ট্রাভেল করে যাচ্ছিলো। জীবনে আসার পথ দিইনি আর কাওকে।
ঢাকা থেকে একটা বুক মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের চিঠি এসেছে। প্রকাশক আংকেল আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ভদ্রলোকটা বাবার বন্ধু। বারবার ফোনও দিয়েছেন। সমাজ রক্ষার্থে আমি আবার দীর্ঘ ছুটি নিয়ে আসলাম সেই শহরে। যেখানে প্রথম আমি হাঁটতে শিখেছিলাম। পড়ে গিয়ে প্রথম যেই মাটির ওপর বসে কান্না করেছিলাম। তারপর..? তারপর? রোহান! রোহান! রোহান !রোহান তারপর? তারপরেও রোহান। সাথে আরেকজন নতুন যুক্ত তন্দ্রা! মাথাটা ধরে আসছিলো.. রোহান আর তন্দ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা এই শহরে আমার? মন ছোট্ট করে উত্তর দিচ্ছিলো, “অনেক কিছুই ছিলো, কিন্তু তুই শুধু এই দুজনকে নিয়েই স্মৃতি সাজিয়েছিস।”
ওই অনুষ্ঠানে আমার জন্য বিশেষ হিডেন সারপ্রাইজ ছিলো। একদম সামনের সাড়িতে বসে থাকা যুবতীটা।পেটটা হালকা ফোলা, খুব সম্ভব বাচ্চা হবে। পাশে তার স্বামী বসে আছে। মেয়েটার দিকে একটা পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছিলো। ছিপি খুলে। খুব সাবধানে সন্তর্পনে। মনেহচ্ছে বোতলটা ক্যাচ মারলেও যুবতীটা ব্যথা পাবে। তারপর যুবতীর ঠোঁটের ওপর লেগে থাকা পানিটুকু টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললো সে। উফফ আর সহ্য করতে পারছিলাম না। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। খুব দূর থেকে পানির বোতল ছুড়ে মারা, আর হেসে হেসে বলা, “ক্যাচ ধর মিষ্টি।” ঠোঁটের ওপর কিছু লাগলে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলা, “তোরে জোকার লাগতেছে। ধর মুছে ফেল।”
সবার সাথে ফর্মালিটি শেষে খুব সাবধানে এগিয়ে আসলাম হালকা আলোর দিকটায়। তারা স্বামী স্ত্রী দুজনে এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। হতে পারে কোনো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। তাই হালকা খুকখুক করে গলা পরিষ্কার করলাম। শব্দ শুনে দুজনেই পেছনে ফিরে তাকালো। আমি আলোর বিপরীতে মুখ করে আছি। আগের মতো সেই ড্রেসাপও এখন করিনা। তারা চিনতে পারেনি আমাকে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলাম, “বাচ্চার বয়স কমাস ?” রোহান আমাদের একা রেখে দূরে চলে গেছে। আমি জানি সে এখন সিগারেট ধরাবে।বছর গেছে যোগাযোগহীন, কিন্তু অভ্যেস-স্বভাবের ছক আমার মাথা থেকে একদমই বেরোয়নি।অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যে কিজন্য মাথা দখল করে রাখে! তন্দ্রা অপরাধী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি একদম রোহানকে বিয়ে করতে চাইনি।” আমি হেসে বললাম, “মনে আছে আমাদের প্রথমবার কথার দিন?”
“হ্যাঁ..!” “বলোতো তোমার স্বামীর সাথে আমার কোন দৃশ্যটা তোমার ভালো লেগেছিলো?” তন্দ্রা মুখ নিচের দিকে নিয়ে বললো, “সেইযে সেদিন বৃষ্টির মধ্যে রোহান তোমাকে তার ছাতার নিচে নিয়েছিলো। তার হাত ছিলো! “
” আহা! নিজের স্বামীর গভীর অতীত ঘাটাতে নেই। তাররপ থেকে বলো।”
” গোলাপীরঙা ঠোঁট রেখেও কপালের ভেজা চুল সড়িয়ে চোখ বন্ধ রেখে একটা গাঢ় চুমু!”
“এটাই ভালো লাগার দৃশ্য?”
তন্দ্রা কিছু বললোনা। চুপ করে রইলো। অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো অন্যায়ের দিকে যাচ্ছে ভাবনার জগতটা। আরেকটু এই সুখী জুটির দিকে তাকালে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবো। খুব দ্রুত বাসায় চলে যাওয়া দরকার। রোহান আশেপাশে নেই। হঠাৎ তন্দ্রার হাতে একটা আংটি দিয়ে বললাম, “আমার প্রাক্তন প্রেমিকের জনম জনম ধরে স্নিগ্ধ চুমুর সাক্ষী হয় যেনো তোমার সর্বাঙ্গ।” তন্দ্রাকে কিছু বলার সুযোগ দেইনি আর। এসব ভুলে ভরা অপ্রাপ্তির অতীত পেছনে রাখাই ভালো। আমার গন্তব্য অনেকদূর। বহুদূর চলতে হবে জানি। কিন্তু কোথায় কোনদিকে তা জানিনা। দিক নির্ণয়ের জন্য এবার বোধহয় কাওকে প্রয়োজন। রোহান-তন্দ্রা-আর মিষ্টি, ত্রিমাত্রিক একটা ধাঁধাময় সম্পর্ক থেকে মুক্তি মিলেছে আজ আমার।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত