রুপন্তী আমার টিশার্টের কলারটা চেপে ধরে পাগলের মত বিলাপ করছে। রাফাত চলো আমরা গ্রামে ফিরে যায়। দেখ তুমি এই ডাক্তারী পেশাটা ছেড়ে দাও। গ্রামে গিয়ে দরকার হলে একবেলা না খেয়ে থাকবো। তবু তুমি আর হাসপাতালে যাবেনা। আমি রুপন্তীর মাথাটা বুকের সাথে টেনে নিয়ে বলি, তুমি পাগল হয়ে গেছো রুপন্তি। এটা আমার পেশা।
আজ সারাদেশ দূর্ভিক্ষের মধ্যে। করোনা নামক ভাইরাসের ভয়ে আমি পিছু হটতে পারিনা। নিজের পেশাকে কলংকিত করতে পারিনা। আমি যদি রোগীদের সেবা না করি তাহলে এইসব রোগীরা কোথায় গিয়ে দাড়াবে।
রুপন্তী এসব কিছু বোঝেনা। কাপা কাপা স্বরে বলে,,রাফাত তোমাকে ছাড়া আমি বাচবোনা। এই রোগীদের সেবা করতে গিয়ে প্রতিদিন শত শত ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছে,মারা যাচ্ছে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি বাচবোনা। আমার ভেতর তোমার অনাগত সন্তান। তার কথা অন্তত ভাবো। আমি রুপন্তীকে বোঝায়। সে বোঝেনা। মায়ের বাসায় পাঠাতে চাইলাম কিন্তু যাবেনা।
সকাল সকাল রুপন্তীর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। রুপন্তী রাত থেকে এখন অব্দি কাদছে। কেদোনা তো। আরে বাবা আমি তো ফিরে আসবো আবার। দেখো কিচ্ছু হবেনা। গেইট পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই ও ঝড়ের বেগে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। আমি এবার কেদেই ফেললাম। আর পারছিনা নিজেকে ধরে রাখতে। আমার চোখে,মুখে,গালে, কপালে সব জায়গায় চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে। আমি ওকে বুকের ভেতর শক্ত করে ধরে রাখি অনেকক্ষন।
খুব কষ্টে হাসপাতালে এসে পৌছালাম। তারপর শুরু হলো যুদ্ধ। সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। সারাদিন রাত পিপিই পড়ে কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠি। স্বেচ্ছায় মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত খেলা করি।রুপন্তী মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কাঁদে। ভীষন কান্না। একবুক কান্না। আমাকে ছাড়া একটা রাতও ঘুমায়নি ও। আমার বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমায়। অভ্যাসটা বহুদিনের। রাফাত আমার রাতে ঘুম আসেনা।
তুমি কবে আসবে। আমি বললাম এই তো আর কয়দিন। ওর কান্না সহ্য করতে না পেরে ফোন রেখে দিই। বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কাঁদি অনেকক্ষন। বাসায় যায়না ৫ দিন হলো। আমার জন্য রুপন্তীর আর আমার বাচ্চার কিছু হোক আমি চাইনা। রুপন্তির সাথে মাঝরাতে দেখা করতে যায়। বউটা আমাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। রাস্তার পাশেই আমাদের বাসাটা। আমি রাস্তায় দাড়িয়ে থাকি আর ও দুতলার বেলকোনিতে। খুব ছুতে ইচ্ছে করে ওকে। কিন্তু পারিনা। রুপন্তী আমাকে ফোন দেয়,কিন্তু কথা বলতে পারেনা। শুধুই কান্না করে। আমি বেশিক্ষন থাকিনা। আবার হাসপাতালের কেবিনে চলে যায়। আজ দুইদিন শরীরটা ভালো লাগছেনা। খুব দূর্বল লাগছে। সাথে একটু জ্বর।করোনার উপসর্গ বলে মনে হচ্ছে। ভাবতেই বুকটা কেপে ওঠে। আজ খুব কান্না পাচ্ছে। আমার যদি কিছু হয়ে যায় রুপন্তীর কি হবে, আমার বাচ্চার কি হবে।
আজ আমার করোনা পরীক্ষা করা হবে। জানিনা ভাগ্যে কি আছে। হঠাৎ রুপন্তীর ফোন। রাফাত একটু আসবে। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।কেমন জানি আমার ভালো লাগছেনা। তুমি ঠিক আছো তো? আমি বলি, এখনই আসছি রুপন্তি। অপেক্ষা করো। আমি গিয়ে দেখি রুপন্তি বেলকোনিতে অপেক্ষারত। ওর চোখ ফোলা ফোলা। আমি এই প্রথম নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিনা। রুপন্তি আমাকে টেক্সট করেছে,জানো রাফাত বাবুটা আজ আমার পেটে দুইটা কিক দিয়েছে।
আমি টেক্সট দেখেই হাওমাও করে কেদে উঠি। ল্যাম্পপোস্ট ধরে কাদতে থাকি। আবার ওর টেক্সট, এই রাফাত কাদছো কেন,এই রাফাত। দেখ তোমার বাবুটা আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। তুমি তো খুব বলতে আমার পেটের উপর মাথা রেখে তুমি ওর সাথে কথা বলবে, যাতে আমাকে কিক না দেয়! এখন আসোনা কেন তুমি?
আমি কাদতে থাকি শুধুই। এর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি বলি, রুপন্তী আমি গেলাম। পরদিন আমার করোনার রেজাল্ট আসলো। ডা: রাফাত হাসান। করোনা পজেটিভ। আমার মাথায় যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়লো। রুপন্তীর কান্নারত মুখটা আমার সামনে ভেসে উঠছে। আমার অনাগত সন্তানের কি হবে। রুপন্তীকে আমি কি বলে সাত্বনা দেব। আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা। যথারিতী কেবিনে ভর্তি করা হলো আমাকে। রুপন্তী ফোন দেয় কিন্তু রিসিভ করিনা আমি। আমার কান্নার শব্দে ও ঠিক বুঝে যাবে। টেক্সট করেছে ও, রাফাত আজ একটু আসবে।
আমি নিশ্চুপ। ফোনটা বন্ধ করে রাখি। আমার সহকর্মী রাশেদের কাছে ফোন দেয় ও। সব বলে দিয়েছে ওকে। পাগলের মত বিলাপ করতে করতে হাসপাতালের ওপাশে ও। আমি দেখে আর শান্ত থাকতে পারিনা। কাচঘেরা এই রুমটা আমার কাছে বন্দীশালার থেকেও কঠিন কিছু মনে হচ্ছিল। দেওয়ালের ওপাশ থেকে কেবল কান্নার বিভৎস চিৎকার। কথা বলতে চাই শুনতে পারিনা কিছু। ফোন দিলাম,এই রুপন্তী কাদছো কেন,চুপ করো প্লিজ তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। আমি ঠিক হয়ে যাবো দেখে নিও তুমি। রুপন্তী কেবলই কাদে আর বলে,রাফাত আমি তোমার কাছে যাবো। তোমাকে ছুয়ে দেখবো একটু। এদেরকে বলো একটু তোমার কাছে যেতে দিতে। নাহ রুপন্তী তুমি পাগলামি করোনা। প্লিজ চলে যাও। আমি সুস্থ হয়ে ঠিক তোমার কাছে ফিরবো।রুপন্তী পাগলের মত বিলাপ করছে। রুপন্তী আমি যদি কখনও ফিরে না আসি তবে তুমি আমার বাবুটাকে আগলে রেখো। তুমি নিজেকে গুছিয়ে নিও। তোমাকে আমার খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। রুপন্তী আমার বাবুটাকে বলবা, তোমার বাবা দেশের জন্য মানুষের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।
রুপন্তী এইবার পাগলের মত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ওকে কয়েকজন উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কাচঘেরা রুমে ছটফট করতে থাকি। খুব ইচ্ছা ছিলো রুপন্তীর সাথে আজীবন থাকবো। আমি ওর মাকে কথাও দিয়েছিলাম। জানিনা ফিরতে পারবো কিনা।আমার বাচ্চাটার সাথে আমার দেখা হবে কিনা! আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকি মহাশুন্যের দিকে। আমার চোখে কেবল অপ্রাপ্তির কালো অশরীরী ছায়া।
গল্পের বিষয়:
গল্প