সালিম বললো,’আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাই মীম। আগামী কাল আমরা কোর্টে যাবো।’ কথাটা শোনে বেশ অবাক হলো মীম।সে তার বুকে হাত দিয়ে দেখলো ঢিপঢিপ করে কাঁপছে বুকটা। মীম ভয়ংকর রাগ করে বললো,’সব সময় আপনার মজা করার অভ্যাস।
মজা ছাড়া কোন কথায় বলতে পারেন না আপনি।তাই বলে ডিভোর্সের মতো একটা নিকৃষ্ট বিষয় নিয়ে কেউ মজা করে!এই দেখুন এখনও আমার বুকটা কীভাবে কাঁপছে!’ কথাগুলো বলতে বলতে মীমের চোখ জলে ভরে উঠলো।সে সালিমের হাতটা টেনে নিয়ে তার বুকের উপর রেখে দেখাতে চাইলো কতটুকু কেঁপে যাচ্ছে তার বুক। কিন্তু সালিম হাত টেনে নিতে দিলো না।সে মীমের থেকে খানিক সড়ে গিয়ে অন্য পাশে ফিরে শুয়ে রইল।এতে মীমের কী যে কষ্ট হলো!সে এবার গলা ছেড়ে সত্যি সত্যি কেঁদে উঠলো।তার কান্না শোনে দরজায় কড় কড় করে শব্দ করলো কেউ।মীম তড়িঘড়ি করে কান্নাটা গিলে ফেলে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দরজার ও পাশে ওর শাশুড়ি।সালিমের মা মনুয়ারা বেগম।মনুয়ারা বেগম নাক মুখ আগুন করে বললেন,’কানতেছিলো কেডা? তুমি?’
মীম ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বললো,’জ্বি আম্মা।’ ‘ক্যান কান্দো?বাপ মরছে?’ ‘না আম্মা।’ ‘মার অপারেশন?’ জ্বি না আম্মা। এমন কিছু না।’ ‘তাইলে ভর সন্ধ্যায় গলা ছাইড়া কানলা ক্যান?শখে কান্দো? এমনিতেই বালা মসিবতের অভাব নাই। তিন বছর পার হইয়া গেছে বিয়ার বাল বাচ্চার খবর নাই তাইনে গলা ছাইড়া কান্দে?ও মাইয়া লাজ করে না তোমার এমনে গলা ছাইড়া কান্দো যে!শইল তো মাশাল্লা খাইয়া কম বানাইছো না তয় পেট বানানো যায় না!’
কথাগুলো মুখের উপর বলে মুখটা খানিক বাঁকিয়ে ও ঘরের দিকে চলে যায় মনোয়ারা।মীম তার কাঁপা অধরে আঁচল গুঁজে ধরে ওর শাশুড়ির দপদপ পা ফেলে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।মুখ ভরে কান্না আসে তার।গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু কাঁদতে পারে না ভয়ে। এই সময় সালিম ডাকে ঘরের ভেতর থেকে।মীম চোখ মুখ মুছে খুব স্বাভাবিক হয়ে তার কাছে যায়।সালিম তখন আলতো করে ওর একটা হাত ধরে। টেনে কাছে নেয়। বুকের উপর ওর মুখটা নিয়ে ধরে। মীমের অধর তখন কাঁপছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সালিমের বুকের কালো কুচকুচে লোম গুলো।সালিম গলা নামিয়ে বলে,’মীম, আগামীকাল এই জন্যই তোমায় ডিভোর্স দিবো। তোমাকে আর অপমানিত হতে দিবো না আমি।’ মীম কান্না থামিয়ে বলে,’আমায় ডিভোর্স দিলেই বুঝি আমার অপমান শোধ হয়ে যাবে?’
‘হুম শোধ হয়ে যাবে। বরং আমার মায়ের উপর তোমার শক্ত একটা প্রতিশোধ নেয়াও হবে।’ ‘কীভাবে?’ ‘তুমি অন্য একটা বিয়ে করবে।ও ঘরে তোমার কোল আলো করে একটা বাচ্চা আসবে। সেই বাচ্চাই হবে আমার মায়ের জন্য অপামান এবং তোমার প্রতিশোধ নেয়া।’ মীমের গলা আবার ভিজে উঠে।সে বলে,’তা যদি হতো এখানেও তো হতে পারতো?’ ‘এখানে হবে না মীম। কারণ, সমস্যা টা তোমার নয়, আমার।’ বলে প্যান্টের পকেট থেকে রিপোর্টটা বের করে মীমের সামনে মেলে ধরে সালিম।মীম জানতেও পারেনি সেদিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওরা কী পরীক্ষা করিয়ে এসেছে। সালিম শুধু বলেছিলো এই ডাক্তারের কাছে গেলে আল্লাহর রহমত আমাদের বেবি হবে।
মীম রিপোর্টটা খুব ভালো করে দেখলো। তারপর এটা একটানে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে মেঝেতে ফেলে সালিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো,’আমি প্রতিশোধ চাই না। আমার কোল আলো করা বাচ্চাও চাই না। আমি চাই শুধু আপনাকে। আপনাকে ছাড়া আমি একটি দিনও কাটাতে পারবো না সালিম।মরে যাবো আমি। বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমি অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।সালিম, আমার আল্লাহই তো আপনার সাথে আমার জোড়া মিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি এটা জেনেই দিয়েছেন যে এই জোড়ার কোনদিন বাচ্চাকাচ্চা হবে না। আমি আমার আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিবো সালিম। আপনাকে আমি ছাড়তে পারবো না। কোনদিন ছাড়তে পারবো না।’ সালিমের চোখ হঠাৎ জলে ভিজে উঠলো। মানুষ বলে সৈনিকদের হৃদয় বড় কঠিন। ওদের চোখে সহজে জল আসে না। কিন্তু সালিমের চোখে জল আসলো।সে তার চোখের জল জামার কোন দিয়ে মুছে তার মাকে ডাকলো।মনোয়ারা বেগম এসে রাগত স্বরে বললেন,’তোর বউরে বকাঝকা করছি বইলা কী বিচার করবে নাকি আমার?নাকি জবাব লইবে আমার কাছ থিইকা?’
সালিম গলাটা খানিক বড় করেই বললো,’আম্মা, আপনি যদি আমার জন্মদাত্রী না হতেন তাহলে শক্ত অপমান করতাম আজ আপনাকে। কিন্তু আজ আপনাকে আমি অপমান না করলেও আপনি অপমানিত হবেন যখন শুনবেন আপনার সালিম গুণধর কোন ছেলে নয়,আর আপনার পুত্রবধূও বন্ধ্যা নয়। ডাক্তারের রিপোর্ট অনুযায়ী বলছি আম্মা,আমি সন্তান দানের অযোগ্য পুরুষ,আর মীম সন্তান দানে যোগ্য নারী। বুঝেছেন?’ মনোয়ারা বেগম অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে বলেন,’মায়ের সাথে তামাশা করস তুই?’
সালিম বললো,’তামাশা নয় আম্মা এটাই সত্যি। আপনার পুত্রবধূ যদি আমায় ছাড়া অন্য কোন পুরুষকে বিয়ে করে তবে সে অবশ্যই মা হতে পারবে। কিন্তু সে এতোটাই আমায় ভালোবাসে যে আমার জন্য তার মা হওয়ার স্বপ্নটা জলাঞ্জলি দিতে চাচ্ছে!’ মীম তখনও সালিমের বুকে কাঁপছে।মনোয়ারা বেগম ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেছেন তখন।মনের ভেতর অনুযোগও আসছে। তিনি ভাবছেন, এতো দিন এমন একটা লক্ষ্মী মেয়ের সাথে শুধু শুধু অত খারাপ ব্যবহার করে কত বড় পাপ তিনি নিজের জন্য জমিয়েছেন।
মনোয়ারা বেগম লজ্জিত মুখে কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে সালিম বললো,’শুনুন আম্মা। এই জন্য কাউকে গাল বকার আগে কিংবা কারোর উপর অভিযোগ তোলার আগে শতবার ভেবে নেয়া উচিৎ এই গাল কিংবা অভিযোগটা কী একদিন নিজের দিকেই ফিরে আসে কি না। সালিম আরো একটা শক্ত কথা বলতে চেয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে মীম ওর বুক থেকে বেরিয়ে এসে সালিমের মুখটা চেপে ধরে বললো,’মার সাথে নিচু স্বরে কথা বলতে হয়।’ মনোয়ারা বেগম কেন জানি কী ভেবে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।মীম তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে তার শাশুড়ির কান্না থামাতে গেল।
গল্পের বিষয়:
গল্প