২০০৯ এর দিকে ফিজিক্স কোচিংএ ভর্তি হলাম সেলিম স্যারের কাছে। ওখানে ছেলেমেয়ে একসাথে ব্যাচ। বিকেলে ৫টার ব্যাচ। আমি গার্লস স্কুল থেকে পাশ করা, কলেজও গার্লস। ছেলেদের সাথে পড়তে গিয়েই গা কাঁপুনি। মফস্বলের মেয়ে আমি, বোকাসোকা ছিলাম। ব্যাচের সবথেকে দাপুটে মেয়ে “তেহজীব” আমার বান্ধবী হয়ে গেলো। তবে একটাই সমস্যা ছেলেদের সামনে স্যারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে তোতলাই। ছেলেরা এই সুযোগটা ১০০% কাজে লাগায়। সবথেকে বেশি কাজে লাগায় তেহজীবের বয়ফ্রেন্ড! নাম আবিদ! ইস্পাহানিতে পড়তো।ওদের স্কুল থেকেই প্রেম।
খুবই শয়তান ছেলে, চুল খাড়া খাড়া, শার্টের বা গেঞ্জির কলার অলওয়েজ দাঁড় করানো, হাতে ব্রেসলেট, বুকের বোতাম খোলা, ঠোঁটে সবসময় হিন্দি গানের গুনগুনানি আর কড়া পারফিউম! পুরাই গুন্ডা। মুখে কিছুই আটকায় না! সবাইকে হামকি ধামকি করতো।একবার আমার পেছন থেকে তেহজীবকে এত জোড়ে ডাকলো, আমি ভয় পেয়ে বেঞ্চ থেকে ধুপ করে পরে গেলাম। অবিদের বাবা-মা ডাক্তার। গাড়ি করে আসতো, তেহজীবও গাড়ি করে আসতো। আমি এমনিতেই গুটসুটি মেরে থাকতাম। ভয় আর লজ্জাতে তেমন কথা হতো না সবার সাথে। তবে পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় সবার সুদৃষ্টি আস্তে আস্তে পরতে লাগলো। তেহজীবের সূত্র ধরেই আবিদ আমার সাথে টুকটাক কথা বলতো। তেহজীব দেখা করতে গেলে আমাকে ওর সাথে নিয়ে যেতো।কথার ধরন যেমন,
—তেলিবতী (চুলে অলওয়েজ তেল দেওয়ার কারণে তেহজীব ওর নামের সাথে মিলিয়ে আমার নাম তেলিবতী করে দিয়েছিলো) নি নি নিতুতুতুতু ভালো আছো?
—-জ্বী ভাইয়া, ভালো।
—তেলিবতী, ভাইয়া ডাকবা না। আবিদ ডাকবা। বুঝেছো?
—জ্বী ভাইয়া।
—তুমি ঘোড়ার এততততততততততততত বড় ডিডিডিমমম বুচ্ছ! আবার যেমন একবার উইকলি টেস্টে আবিদের পাশে বসতে হলো….
—তেলিবতী আমাকে সব দেখাবা আজকে।
—কেন?
—দেখাইতে বলছি দেখাবা।
–হবে না। আমি কষ্ট করে পড়ে আসছি।
—স্কেল দেখছো আমার? বাইরানি খাইলে বুঝবা।(বান্দর পুলা)
বাধ্য হয়ে সব দেখালাম। আমার অংকের রেজাল্ট ভুল হলো, আবিদ ঠিক করে দিলো। টেস্টের মার্কে দেখা গেলো গুন্ডা ২৪ পেয়েছে, আমি ১৬। কেঁদে কেটে আমি শেষ। তবে তেহজীব আবিদকে প্রায়ই বকতো এজন্য। আমার চুল লম্বা ছিলো, বিনুনি করা থাকতো। বিনুনি দেখিয়ে আবিদ তেহজীবকে প্রায়শই বলতো,
—তেহজীব, দেখছো নিতুর লেজটা এখন আরও লম্বা হইছে? এঁই নিতু তুমি কি মাথায় তেলের সাথে সারও দেও? কি সার?ট্রিপল সুপার ফসফেট? মনে মনে খুব বকতাম আবিদকে… এরকম ফাইজালামি মার্কা কথা বার্তা। তেহজীব বলতো আমায় ওকে ভাইয়া ডাকার জন্য। শত হোক বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড। মুখে কিছু বলতাম না এর মধ্যে আবিদের জন্মদিন চলে এলো। ব্যাচের সবাই ওর বাসায় দাওয়াত পেলো। সন্ধ্যার পর দেখে, আমার যাওয়া হলো না। আমি তেহজীবের হাত দিয়ে গিফট পাঠালাম, হুমায়ুন আহমেদ স্যারের বই, কুটু মিয়া। বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখে দিলাম, তেহজীবকে দেখিয়েই লিখলাম, “আবিদ ভাইয়া, আমার বিনুনিকে লেজ বলবানা। ইট’স নট মাই লেজ, ইটস মাই ইমেজ” শুভ জন্মদিন। ” পরেরদিন ক্লাসে…
—তেলিবতী, তুমি কই ছিলা কালকে?
—আমার জ্বর ছিলো।
—দাম দেখাও? দাম দেখাবা না। তোমার দাম ১০ টাকাও না আমার কাছে।
আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। আমি ওর বইয়ের ব্যাগ টেবিল থেকে ফেলে দিলাম। ও আমার সামনের বেঞ্চ ফেলে দিলো। সবাই ধমকাধমকী করে থামালো। রাগে আমার মনে হচ্ছিলো, ওর কলার ছিঁড়ে ফেলি। আবিদ সবাইকে ক্লাস শেষে থাকতে বললো। সবাই থাকলো। সে আমার দেওয়া বইটা সবাইকে দেখিয়ে বললো,
—গতকাল আমার জন্মদিনে এইটা এক মাথা খারাপ অহংকারী মেয়ে উপহার দিছে। তাঁর ধারণা আমি বইয়ের কাঙাল। সে গিফট দিয়ে আমাকে উদ্ধার করেছে! এই বইটা আমি এখন জ্বালিয়ে ফেলবো। সব ছেলেরা এতে যেনো ভীষণ মজা পেলো।
—কে দিছে কে দিছে বলে, বই টানা হেঁচরা করে ছিঁড়ে ফেললো।
আবিদ নাম ধাম কিছু বললো না। তেহজীব জানতো, ও আবিদকে থামাতে না পেরে আমাকে নিয়ে চলে আসতে চাইলো। আমি আসলাম না। সবার সামনে আবিদ বইটা পুড়িয়ে ফেললো। আমি স্তব্ধ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলাম।লজ্জায় আর রাগে আমি পাথর হয়ে গেলাম। আমার কান্না পাচ্ছিলো, গাঁ কাপছিলো। কোনোমতে বের হয়ে এলাম।
পরের দুই ক্লাসে গেলাম না। ব্যাচ বদলে ফেললাম। এক সপ্তাহ পর মনে হলো, আবিদ থেকে বাঁচা গেলো। কিন্তু না, সে আমার কেমিস্ট্রি ব্যাচে এসে ভর্তি হয়ে গেলো। তেহজীব নেই! সে পুরাই স্বাধীন। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। একদিন ক্লাস শেষে আমি রিক্সায় উঠামাত্র আবিদ আমার ব্যাগ ধরে টান দিলো। আমি রিক্সা থেকে পরে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেললাম। সবাই তাজ্জব বনে গেলো। ও সবাইকে বুঝালো ও এটা না দেখেই করেছে। সবার সামনে স্যরি টরি বললো। কেমিস্ট্রি ব্যচে সে আমার নাম তেলিবতী প্রচার করে ফেললো। রাগে একদিন সিঁড়িতে ওর গেঞ্জি ধরে টান দিলাম। ও পড়ে গেলো, উঠে এসে টেনে আমার স্কার্ফ খুলে ফেললো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চলে এলাম। সারারাত ঘুম হলো না। ওরা ওখানে স্থানীয় ধনী, প্রভাবশালী; আমরা ভাড়াটে। পরেরদিন আমি নিজ থেকে স্যরি বললাম।
—তোমার ২টাকার স্যরি আমার দরকার নেই। স্টুপিড মেয়ে।
—তুমি তো আমার পেছনে লাগতেই এখানে এসেছো! তেহজীব জানে?
—আমি কি কাউরে ডরাই?
—না ডরাইলে তেহজীবকে সাথে নিয়ে আসতে। কাপুরুষের কাপুরুষ!
—কামহিলার কামহিলা। আমি হেসে ফেললাম। ব্যস সেই থেকে লাগালাগি কমলো। একদিন আবিদ আমার সাথে রিক্সায় উঠে পড়লো। হুড তুলে দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আমি হাত সরিয়ে দিলাম।
—তেলিবতী, হাত সরালা ক্যান?
—প্লিজ আবিদ আমি তেহজীব না।
আবিদ রিক্সা থেকে নেমে গেলো। আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো কেন জানি। এর মাঝে বাবা বদলি হয়ে গেলেন। আমারও বোর্ড মইগ্রেশন করে চলে আসতে হলো। চলে আসার কথা কাউকে বললাম না। শুধু স্যারদের বললাম। আবিদ জেনে গেলো কিভাবে যেনো। আমার হাতে যাপিং পেপারে মুড়ানো একটা বই দিয়ে বললো,
—ভেতরে একটা মেয়েদের খারাপ ছবিঅলা বই দিছি।
—ছিঃ আবিদ।
—আরে বাঁচতে হলে, জানতে হবে।
—ওকে। আমি হেসে ফেললাম।
—তুমি অনেক খারাপ তেলিবতী!!
—সেইম টু ইউ আবিদ।
—তেলিবতী, বইটা পড়ো কিন্তু।
আমি বাসায় চলে আসলাম। আমার যেনো তর সইছিলো না। আমি বাসায় এসেই র্যাপিং পেপার খুলে দেখি, আমার দেয়া সেই বই! মানে কি? আবিদ কি তাহলে কুটু মিয়ার আরেকটা কপি পুড়িয়েছে? উৎসর্গ পৃষ্ঠা খুলে দেখি, সেই আমার লিখা। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। বইয়ের ভেতরে দেখি একটা ক্যালেন্ডারের উল্টো পাতায় লিখা চিঠি। পাগল ছেলে! চিঠি কেউ ক্যালেন্ডারের পিছনের পাতায় লিখে নাকি? নিতু, তুমি কেনো আসোনি আমার জন্মদিনে? এই ২২শে অাগষ্ট আমার সবথেকে খারাপ জন্মদিন ছিলো। তাই আগষ্টের পাতাটাই তোমায় দিয়ে দিলাম।
আমার খুব ইচ্ছা নিতু কোনো এক ঝুম বৃষ্টির দিনে আমি তোমায় নিয়ে রিক্সা চড়বো। তুমি না চাইলে জোর করে রিক্সায় তুলবো। স্কেল দিয়া বাইরাইয়া তুলবো। তারপর তোমার কোমড় জড়িয়ে ধরবো। রিক্সা ড্রাইভার দেখবে না। পলিথিন দেয়া থাকবে। মাঝে মাঝে তোমার আরও অন্য জায়গায়ও হাত দিবো। তুমি তো আমার কোনো কথা শুনো না। মাঝে মাঝে তোমাকে পানি দিয়ে টুপ করে গিলে ফেলতে মন চায়। যা করবা পেটে গিয়ে করো। কিন্তু তোমার লেজের জন্য গিলি না। চুল নাকি পেটে হজম হয়না! তুমি তো মনে মনে আমাকে “অসুর ” বলে গালিও দাও। আমি শুনতে পাই। অসুরকে তো দূর্গা শায়েস্তা করেছিলো। আচ্ছা তুমি কি আমার জীবনে দূর্গা হবা? ওকে বাই! আর একটা কথা, মাথায় কি তেল দাও? খালামণিদের মত গন্ধ বের হয়। বাই দ্য ওয়ে আমি লম্বা চুল একদম পছন্দ করি না। আমার ধারণা তোমার চুল আমার গায়ে লাগলে চুলকাবে। একবার কাছে পাই তোমায়, বেল করে দিবো মাথা। ক্যালেন্ডার দেখো।
আমি চিঠি পরে ‘থ’ হয়ে গেলাম। কি বাজে ছেলেরে বাবা! ক্যালেন্ডারে দেখি ২২তারিখটা কাটা, তাতে লিখা “ট্রিমেন্ডাসলি মিসড ইউ তেলিবতী।” এক মুহূর্তের জন্য আমার পৃথিবী থেমে গেলো। এত সারপ্রাইজ আমি নিতে পারলাম না যেনো। আবিদ আমায় ভালোবাসে! আর ভালোবাসার কি ছিড়ি দেখো। খালি মারামারি। তারপর আমার সিলেট চলে আসা। কারো সাথে যোগাযোগ রইলো না। সবাই হারিয়ে গেলো মন থেকে। শুধু আবিদ মনে রইলো। ওখান থেকে আসবার পর আমি প্রতি মুহূর্ত আবিদকে মিস করেছি। কিন্তু যোগাযোগের কোনো স্কোপ ছিলোনা।
তারপর অনেকদিন, আর সাহস করে খুঁজিওনি। কিন্তু মনে প্রাণে ওই বাজে ছেলেটাকে আমি সবসময় ভেবেছি। আমি এখন জানি আবিদ আর আমার মধ্যে যেটা ছিলো, সেটা রাগ না রাগের পেছনে অনুরাগ! এটাই ভালোবাসা।
সাহসের অভাবে খোঁজ নেয়া হলো না আবিদের। সেও চেষ্টা করেনি বোধহয়! বাজে ছেলে একটা। তারপর অনেক বছর।আমারও প্রেম হয়নি আর। অভিমানে চুল ছোট করে কেটে ফেললাম। পরিবারের পছন্দে বিয়ে হলো, সংসার হলো আমার। এখন আমি আমার ছেলেকে গেঞ্জি পরিয়ে কলার দাঁড় করিয়ে দিই। বুকের বোতাম খুলে রাখি। আমার মা বকা দেয়, একি অসভ্যতা নিতু? বাবুকে গুন্ডা বানাবি নাকি? আমি হেসে বলি, মা ওকে আমি বাজে ছেলে বানাবো! ওর জীবনে একটা মেয়ে এসে সব ঠিক করে দিবে।
মা রক্তচক্ষু করে আমার দিকে তাকায়! আমার ইচ্ছা করে চিৎকার করে বলি, মা আমার জীবনে একটা প্রচন্ড বাজে ছেলে ছিলো মা। সে আমার সব এলোমেলো করে দিয়ে হারিয়ে গেছে আবিদ, তুমি কেন আর আমাকে খোঁজ করোনি? এখন কেমন আছো তুমি? আমার এখনো ভীষণ কষ্ট হয় রাতে! অনেক রাগ করে আছি। সামনে আসো একবার মেরে শার্ট ছিঁড়ে ফেলবো তোমার…
গল্পের বিষয়:
গল্প