“আরে মিরা না? হোয়াট এ সারপ্রাইজ! চিনতে পারছিস আমাকে?” পার্লারের সরু বিছানায় শুয়ে ফেসিয়ালের ম্যাসাজ নিচ্ছিলাম। মেয়েটা এতো যত্ন নিয়ে ম্যাসাজ দিচ্ছে যে আমি মনেহয় ঘুমিয়ে গেছিলাম আরামে। হঠাৎ নিজের নাম শুনে আমি চমকে তাকালাম। সামনে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে তাকে চিনি বলে মনে হলো না। মসৃণ ত্বক, দীঘল কালো চুল, স্লিম ফিগারে ভীষণ রকম রুচিসম্মত একটা সালোয়ার কামিজ পরনে যা আনকমন ডিজাইনে বানানো, পায়ে স্লিপার। এসব কিছু ছাপিয়ে তার উজ্জীবিত চোখ দুটো নজরে এলো, আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে পরছে। আমি বোকা বোকা মুখ করে বললাম-“আপনি কে? আমি কি আপনাকে চিনি?” “মডেল স্কুলের মিরা না তুই? হুটহাট ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতি বলে সবাই তোকে মিরাকল মিরা বলতো। তোর বাবা মহিদুল ইসলাম।” “হুম। কিন্তু আপনি কে?” “আরে আমি কংকা, তোদের কংকাবতী। তোর সাথে স্কুলে পড়তাম, তারপর ক্লাস টেনে আচমকা স্কুল ছেড়েছিলাম। আরে পিদিমে দেখা হলো কয়েকবার, তোর চুল কেটে দিয়েছিলাম মনেপড়ে?”
আমি সাথে সাথে চিনলাম এবং অবাক হলাম। যে কোনো কাজে কংকাকে সবার আগে আগে পাওয়া যেতো বলে স্কুলে টিচাররা ওকে কংকাবতী বলে ডাকতো। পারিবারিক সমস্যায় পরে বাধ্য হয়ে স্কুল ছাড়ে ও। আমি কংকার খুব ক্লোজ ছিলাম না কখনোই। কারন দুটো, এক. ওরা আর্থিক ভাবে অসচ্ছল ছিলো। আমার আবার নাক উঁচু ভীষণ। নিজের সমপর্যায় না হলে কারো সাথে মিশতাম না। সুন্দরী আর টাকাপয়সাওয়ালা বাপের মেয়ে ছিলাম কিনা! দুই. ও ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলো টানা পাঁচ বছর। আমিও ছাত্রী হিসেবে ভালোই ছিলাম কিন্তু ওকে টপকাতে পারছিলাম না কিছুতেই। মনে মনে ওকে ভীষন হিংসে করতাম। তাই ওর স্কুল বাদ দেওয়ায় আমি বরং খুশি হলাম।
সে যাইহোক, বছর পাঁচেক আগে ওকে নামকরা সেলুন পিদিমে কাজ করতে দেখে নিজের ভাগ্যে আরো একবার হেসেছিলাম। ওকে ছোট করার কোনো সুযোগ আমি হাতছাড়া করিনি। পিদিমে গেলে ওকে দিয়েই আমার কাজগুলো করাতাম, ইচ্ছে করেই করাতাম। ওকে আমার কাজগুলো করতে দেখলে কেন যেন ভালো লাগতো। আবার কাজ শেষে ওর হাতে কিছু টিপস গুজে দিতাম জোর করে। তবে ওকে টিপস দিলে নিতে চাইতো না, ভীষণ লজ্জা পেতো। আজ সেই কংকাকে দেখে মনে মনে ভাবছি কি ছিলো আর কি হয়েছে। এতোটা পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব এই কয়বছরে! “আরে তুই! তোকে তো আমি পিদিমে অনেক খুঁজেছি। কোথায় হারিয়েছিলি বলতো?” আমি নিজের মনে তখন হিসাব কষতে ব্যস্ত। টাকার অভাবে পিদিমে কাজ করা ওর সাথে আজকের ওকে মেলাতে পারিনা কিছুতেই। ও আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো- “আচ্ছা, তুই ফেসিয়াল শেষ করে আয়। আমি আছি ওপাশে, তোর সাথে অনেক গল্প করবো। এই কি নাম তোমার? আমার ছোটবেলার বান্ধবী ও, ভালো মতো করবে ওর ফেসিয়াল, ঠিক আছে? “
মেয়েটা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে মাথা নাড়ে। আমি একটু বিরক্ত হলাম। এমন ভাব করছে যেন নিজের পার্লার। আমার বিষয়ে কারো অযাচিত হস্তক্ষেপ আমার বরাবরই বিরক্ত লাগে। তবুও কিছু বললাম না কংকাকে। আসলে বলতে পারলাম না। আগের কংকা হলে হয়তো বলে ফেললাম কিন্তু এখনকার কংকা কে বলতে পারলাম না কিছুতেই ওর ধারালো ব্যক্তিত্বের জন্য। সুসজ্জিত অফিস ঘরে যখন ঢুকলাম আমি আরো একবার হোঁচট খেলাম। এতো সুন্দর করে ডেকরেট করা যে তাকিয়ে থাকতে হয়। দেয়াল জুড়ে কংকার অসংখ্য ছবি কখনো পুরস্কার হাতে কখনো বিভিন্ন বিজনেস উদ্বোধনের। কংকা ডাকলো- “আয়, বোস এখানে।” আমি এখনো ধাতস্থ হতে পারিনি কংকার এই বেশ ভুষার সাথে। এতোক্ষণে আমার জানা হয়ে গেছে যে, এই নামকরা পার্লারটার মালিক কংকা। “কি রে অবাক হচ্ছিস?” “হবো না? কি করে সম্ভব হলো বলতো?”
আমি আমার বিস্ময়বোধ লুকাতে পারি না। কংকা প্রানখোলা হাসি দিলো- “আল্লাহর রহমত আর প্রচুর খাটুনি আমার সাফল্যের মুলমন্ত্র। পরিস্থিতির চাপে পড়ে কত কি করেছি তুই তো নিজেই দেখেছিস। মানুষের দিন ঘুরতে সময় লাগে নারে। অনেক খারাপ দিন পার করে এতোদূর এসেছি তাই নিজেকে সামলে রাখি সবসময়। মাটিতে পা ফেলেই হাঁটি এখনো। যদিও এখন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবার দিন আমার। আজকাল মনেহয় আমার কংকাবতী নামটা সার্থক, কি বলিস?” ওর কথা শুনে আমি কষ্ট করে ঠোঁট টেনে হাসি, মনখোলা হাসিটা আসলোনা কিছুতেই। ওর খারাপ দিনে ও কি কি করেছে আমি জানি না। তবে পিদিমে ওর সাথে যা করেছি তা নিশ্চয়ই ও ভোলেনি? মনে পড়লো, পার্লারে একদিন আমার হীরের আংটিটা হারিয়ে গেছিলো।
ওটা ছিলো আমার স্বামী মিহিরের মায়ের স্মৃতি। দিশেহারা আমি ওকেই চোর সাব্যস্ত করতে চাইছিলাম, বারবার ইনিয়েবিনিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম আংটির কথা। আমার মনোভাব বুঝেই অপমানে আর লজ্জায় মাথা নিচু করে ছিলো কংকা হয়তো চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়েছিলো। আমি ভ্রুক্ষেপ করিনি কোনো। পরে বাসায় এসে অনেক খুঁজে আমার ব্যবহৃত পার্সের ভেতরেই পেলাম আংটিটা। আবার যখন পিদিমে গিয়ে ওকে খুজলাম সরি বলতে তখন আর ওকে পাইনি ওখানে। ওর কি মনে আছে সে ঘটনা? অতীত ভাবতে ভাবতে বর্তমানে কংকার উপস্থিতি ভুলে গেছিলাম। কংকা আমায় ডাকলো- “শোন, এবছরের বেস্ট ওম্যান এন্টারপ্রিনিয়র এর এ্যাওয়ার্ডটা আমিই পাচ্ছি আমার হস্তশিল্পের পোশাকের শোরুম “কংকাবতী” র জন্য। কি রে অবাক হচ্ছিস? অনেকেই হয়। “কংকাবতী”র জন্যই আমার কপাল খুলেছে।
কংকাবতীর পোশাক যে সবার এতো পচ্ছন্দ হবে এটা আমিও বুঝিনি। এই যে তোর পরনের শাড়ীটা আমি নিজে ডিজাইন করেছি। তোকে কিন্তু বেশ মানিয়েছে শাড়ীটা। আজ মনেহচ্ছে ডিজাইনার হিসেবে আমি সার্থক। তোর মতো ব্রান্ডেড সুন্দরীর গায়ে আমার ডিজাইন করা পোশাক, ভাবা যায়!” কংকার কথায় আমি একবার নিজের দিকে তাকালাম। আমার পরনে “কংকাবতী”র শাড়ি। এটা গত ঈদে মিহির কিনে দিয়েছে। আমার আরো একবার ওকে হিংসে হলো ওর সফলতা দেখে। আর আমি! কেবল মিহিরের বউ হয়ে রইলাম। আমার কষ্টার্জিত সার্টিফিকেট পরে আছে আলমারির কোনো এক কোনে। ” ওহহ, তোকে তো বলতে ভুলে গেছি আমার বিয়ে আগামী তেইশ তারিখ। তুই কিন্তু অবশ্যই আসবি তোর বরকে নিয়ে।”
কংকা একটা কার্ড এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি নেড়েচেড়ে দেখছিলাম, কংকা নিজেই আবার বলতে শুরু করলো- “ও খুব ভালো জানিস। আমরা একে অপরকে চিনি পাঁচ বছর যাবত। আমার এতো অর্জনে ওর ভুমিকা অনেক। এই যে দেখ এনগেজমেন্ট রিং। হীরের আংটি, লন্ডনের বিখ্যাত ডি বিয়ারস ব্র্যান্ডের। সুন্দর না? এরকম আরো তিনটে আংটি আছে আমার। ও যখনই কোথাও যায় আমার জন্য এরকম ছোট খাটো কিছু গিফট নিয়ে আসে। আমি মানা করলেও শোনে না।” কংকার মুখে তৃপ্তির হাসি। আমাকে কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বলে ফেললো কংকা। ও দেখি কিছু ভোলেনি, হীরের আংটির জন্য যে ওকে চোর ঠাউরেছিলাম সেটার দুঃখ বুঝি আজো ওকে তাড়া করে ফেরে। আমি সরি বলতে চাইছিলাম, মুখ খোলার আগেই কংকা বললো- “তোর তো আজকাল মনেহয় নিজের খুব যত্ন নিতে হয়, রেগুলার সেলুনে আসতে হয় তাই না?” আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে।
“পত্রিকায় দেখেছিলাম তোর নিউজটা। ওই যে কোন মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছিলি, কি যেন দূর্নীতি করতে যেয়ে তোর বর যে ধরা খেলো?” কংকাও তবে জেনে গেছে এসব! আমার আর কংকার চোখে চোখ রেখে বসে গল্প করার সাহস হলো না। অপমান আর লজ্জায় অধোবদন হয়ে বেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে কংকার গলা পেলাম- “আমার পার্লার তোর জন্য সবসময় ওপেন মিরা। বিনাদ্বিধায় চলে আসবি যখন প্রয়োজন হবে। তোর মতো আমি সুযোগ নিয়ে তোকে বারবার অপমান করবো না।”
টলতে টলতে গাড়িতে এসে বসলাম। পাঁচ বছর আগে আংটি হারানোর ঘটনায় কংকার কেমন লেগেছিলো আজ বুঝলাম। সময় এভাবেই বদলা নেয়, সব শোধ দিয়ে দেয়। আমি যা করেছি সব দ্বিগুণ হয়ে ফেরত আসলো আমার কাছে। আমি বড়লোক বাবার সুন্দরী মেয়ে মিরা হয়ে গেলাম বড়লোক স্বামীর রোজগার বাড়ানোর উপায়। আমার সৌন্দর্য, টাকাপয়সার গর্ব হেলায় হারালো। আর কংকা, আমাদের কংকাবতী সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠলো, নিজের একটা পরিচয় তৈরী করলো ঠিক যেমন একটা শুয়ো পোকা থেকে ধীরে ধীরে প্রজাপতির জন্ম হয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প