টিচার্স কমনরুম একটাই ছিল। টিচারও কমন জেন্ডার। এখানে আবার নারী ও পুরুষের ভাগ কেন? নারীশিক্ষক পুরুষশিক্ষক এক জায়গায় বসবে, আড্ডা দেবে, চা-সিঙাড়া খাবে, পরীক্ষার খাতা দেখবে, ক্লাস নোটস রেডি করবে, সংসারের সুসংবাদ ও দুঃসংবাদগুলো শোনাবে, আনন্দ ও বেদনা ভাগাভাগি করে নেবে।
এখন যিনি ভাইস প্রিন্সিপাল এই মোস্তারী ম্যাডামই আন্দোলন শুরু করেন, খোলামেলাই বলেন, আমি বেশি ঘামি, ক্লাসে যাওয়ার আগে বগলতলায় অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট রোল ঘসে যেতে হয়। এটা কি ছেলেদের সামনে করব? অফ পিরিয়ডে আমার ঘুম পায়। চেয়ারে বসেই ঘুমাই। ঘুমালে আমার মুখ হা হয়ে থাকে? এতগুলো পুরুষমানুষ আসবে- যাবে আর আমার হা-করা মুখের দিকে তাকাবে। আরো সমস্যা আছে পুরুষ টিচাররা অনেকে ইউরিনাল ব্যবহার করে না, দাঁড়িয়ে কমোডে করে, কমোডের সিট নোংরা হয়ে থাকে ? বসতে ইচ্ছে করে না। বলেন, আপনি বসতে চাইবেন স্যার?
স্যার হচ্ছেন প্রিন্সিপাল। এমন করে বললে দাবি মানতে হয়। বলা যায় এমন আন্দোলনে মোস্তারী ম্যাডাম টিচার্স কমনরুমের উলটোদিকে অপেক্ষাকৃত ছোট অ্যাটাচড বাথসহ একটি রুম গায়ের জোরেই দখল করেন। অন্য মেয়েরাও চলে আসে। তিন মাসের মধ্যে চেয়ার-টেবিল এবং ডিশলাইনসহ একটি টেলিভিশনও সংযোজিত হয়। প্রিন্সিপালের রুমে নতুন সোফা লাগানো হলে পুরনো একসেট তিনি লেডি টিচার্স কমনরুমে নিয়ে আসেন। সোফাতে ম্যাডামই বসেন, ঘুমাতে সুবিধা। দশ মিনিট সময় পেলেই এক রাউন্ড নাকডাকা ঘুম দেন।
এই নতুন কমনরুমেই লামিয়া মহসিনের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল, আপা আপনি আপনার স্বামীকে বিশ্বাস করেন?
তারপর লামিয়া হা করে আপার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই আপা ফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আয়েশা আফসারি।
প্রশ্নটা অনেকটাই আক্রমণাত্মক। এ-ধরনের প্রশ্ন মনে এলেও এড়িয়ে যাওয়াই কি উত্তম নয়? লামিয়া হয়তো জানে, এ-প্রশ্নের উত্তর যাকে দিতে হবে তিনি বিব্রত হতে পারেন, ক্রুদ্ধ হতে পারেন, ফাজিল মেয়ে বলে গালাগাল দিতে পারেন, কিংবা প্রসঙ্গ পালটে প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে পারেন। তবু উত্তরটা তার জানতে হবে। আয়েশা আফসারি কম কথা বলেন, কদাচিৎ হাসেন। লামিয়ার প্রশ্ন শুনে তাকে অবাক করে দিয়ে তিনি খিলখিল করে হেসে উঠলেন। যার হাসির শব্দ শোনা দুর্লভ অভিজ্ঞতা, তিনি কেন এমন করে হাসছেন কেন? প্রশ্নটা কি হাস্যকর?
আয়েশা আফসারি বললেন, কী রে লামিয়া, এ-প্রশ্ন কেন? মহসিন কি কোনো ছাত্রীর প্রেমেট্রেমে পড়ে তার হাতে পরীক্ষার প্রশ্ন তুলে দিয়েছে নাকি? সত্যি করে বল তো, খুব ঝগড়াটগড়া হয়েছে নাকি? আলাদা বিছানায় ঘুমোতে শুরু করেছিস?
আয়েশা আফসারি এভাবে বলতেই পারেন। লামিয়া তার সরাসরি ছাত্রী; অল্পদিন হলেও মহসিনকে পড়িয়েছেন, দুজনের গায়ে হলুদে এবং দুপক্ষের বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। তিনি ফিসফিস করে লামিয়াকে বললেন, ছেলেগুলো একটু বদমাশই হয়ে থাকে। চোখে চোখ রাখা ভালো, বেশি টাইট দিলে আবার বিগড়ে যাবে।
বহু সজোর উচ্চারণও মোস্তারী ম্যাডামের কানে ঢুকে না, কিন্তু আয়েশা আফসারি ফিসফিসে কথা পুরোটাই শুনলেন এবং আড়মোড়া ভেঙে সোফা থেকে উঠে বললেন, আয়েশা কি কনসালট্যান্সি শুরু করেছ নাকি? লামিয়াকে আরো কটা ক্লাস বাড়িয়ে দিচ্ছি। চাপে পড়লে খেজুরে আলাপের সময় থাকবে না।
লামিয়া মোস্তারী ম্যাডামের সামনে কথা বলার দুঃসাহস রাখে না। তাকে ঘুমন্ত মনে করেই প্রশ্নটা করেছিল। এ-অবস্থায় পিছু হটলে বড় ধরনের হার হয়ে যাবে বিবেচনা করে লামিয়া মাথা নিচু করেই ম্যাডামকে বলল, আই অ্যাম সিরিয়াস ম্যাডাম। আপনি কি আপনার স্বামীকে বিশ্বাস করতেন?
মোস্তারী ম্যাডাম লক্ষ করলেন তার স্বামীর বেলায় অতীত কালের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে ? বিশ্বাস করেন, নয় করতেন। ঠিকই আছে। তিন বছরের দাম্পত্য জীবন, দুটো সন্তান, ঈদের ছুটিতে পটুয়াখালী যাওয়ার পথে বরিশালের কাছে লঞ্চডুবিতে বেসরকারি ব্যাংকের ইভিপি ? এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, যে মনোয়ার হোসেনের মৃত্যু হয়েছে তিনিই ম্যাডামের স্বামী। তারপর একুশ বছর দেখতে দেখতে কেটে গেছে। ম্যাডাম বললেন, অবশ্যই আমার স্বামীকে বিশ্বাস করতাম। যে যত বেশি বিশ্বাস করবে তার স্বামী ততো আগে মরবে। তোমরা যারা অবিশ্বাস করো, তোমাদের স্বামী শতায়ু হবেন। অবিশ্বাসের বোঝা তোমাদের বহন করতে হবে।
ম্যাডাম মোস্তারী হোসেন বিবাহিত জীবনের প্রথম তিন বছরে যথেষ্ট মুটিয়ে গিয়েছিলেন। ওজন আরো বেড়েছে, কিন্তু লাবণ্য হারানো শরীরে মুখটাই এখনো কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণীর। ম্যাডাম আর বিয়ে করেননি, ম্যাডামকে নিয়ে কোনো গসিপও শোনা যায়নি।
তিনি লামিয়াকে বললেন, এসব প্রশ্ন যখনই মাথায় আসবে ডাবল ডোজ ঘুমের বড়ি খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়বে। সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখবে এ-প্রশ্নটা আর মনেই আসছে না।
প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে যাচ্ছি বলে তিনি লেডিজ কমনরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আয়েশা আফসারি ও মোস্তারী হোসেনের কথার তোড়ে প্রশ্নটা ধামাচাপা পড়ে যাক, লামিয়া মোটেও চাচ্ছে না। তখনই ঢুকল কেমিস্ট্রির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর আবিদা সুলতানা। লামিয়া বিনীত কণ্ঠে তাকেই বলল, আপা একটা বাজে প্রশ্ন করছি, কিছু মনে করবেন না। আপা, আপনি কি আপনার স্বামীকে বিশ্বাস করেন?
প্রথমে প্রশ্নের আকস্মিকতায় একটু ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তোমার দুলাভাইকে অন্য কারো সঙ্গে হুড ওঠানো রিকশায় দেখেছ নাকি? দেখে থাকলে বলো। আমার একটা পয়েন্ট দরকার। ঝগড়ায় সুবিধা করতে পারছি না।
না, ঠিক তা নয়?
তাহলে কী? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? তোমার দুলাভাইই তো আমাকে বিশ্বাস করে না। তোমরা তো আমাকে কাছে থেকে দেখছ। অবিশ্বাস করার মতো কিছু চোখে পড়েছে? বলো, সত্যি কথা বলো, আমাকে দেখেছ ব্যাটাছেলেদের সঙ্গে লটরপটর করতে? ছাত্রীর মায়ের সঙ্গে গম্ভীর আবার বাবা এলে তার সঙ্গে কথা বলার সময় অাঁচল ছেড়ে দিতে দেখেছ কখনো?
উল্টো প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে লামিয়া নিজেও অস্বস্তিতে; তারপরও যাকে বলে শেষ চেষ্টা ? নিজের ভেতর থেকে শক্তি ঢেলে বের করে জোর দিয়ে বলল, তার মানে আপনি আপনার স্বামীকে বিশ্বাস করেন?
আবিদা সুলতানা বললেন, আমি তো সে-কথা কখনো বলিনি। আমিই বরং তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার জন্য দুনিয়ার সব সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি। স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি জীবনের ছেলে-বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছি। তাদের দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। তেরো বছর আগে জুলজির আফসার উদ্দিন আমার জন্মদিনে ফুলের ঝুড়ি নিয়ে কেন বাসায় হাজির হয়েছিল বছরে অন্তত দু-তিনবার আমাকে তার জবাবদিহি করতে হচ্ছে। একবার ভেবে দেখ? প্রেম করে কেমন মানুষকে বিয়ে করেছি! ম্যাথসের আইরিন পারভিন, লামিয়ার পরে কলেজে ঢুকেছে। লামিয়ার প্রশ্ন শোনার আগেই বলল, আপু দয়া করে এ-প্রশ্নটা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমাদের দাম্পত্যজীবন মাত্র সাড়ে সাত মাসের। হানিমুনের ঘোর কাটতেই নাকি দুবছর কেটে যায়। আমি ঘোরের মধ্যে আছি। এই ঘোর থেকে আমি বের হতে চাই না।
আবিদা সুলতানা হঠাৎ যেন লামিয়ার হয়েই বললেন, এই ঘোর থেকে বের হয়ো না। ভান করে হলেও ঘোরের ভেতর থেকে যাও। ঘোর কাটলেই চোখেমুখে অন্ধকার দেখবে।
ইংরেজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর কামরুন্নাহার দোজা বললেন, লামিয়া এ-অ্যাসাইনমেন্ট তোমাকে কে দিয়েছে? তোমার পিএইচ-ডির খবর কী? ওটার কাজ শুরু করে দাও। আর এখন তুমি যে গবেষণা শুরু করেছ এর কোনো কূলকিনারা করতে পারবে না। কনফিউশন বাড়বে, সাসপিশন বাড়বে, শেষ পর্যন্ত সাইকিক প্যাশেন্ট হয়ে উঠবে।
একটু দম নিয়ে তিনি বললেন, শোন লামিয়া, আমি আর আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ড একসঙ্গে সাতাশ বছর পার করেছি। আমার মেয়ে নিখাতের কনজুগাল লাইফও থ্রি ইয়ার্স প্লাস। স্বামী ইজ স্বামী। তাতে বিশ্বাসই কেন করতে হবে আবার অবিশ্বাসই বা কেন? আমি তো মেয়েকে খোলাখুলি বলে দিয়েছি, লাভ ম্যারেজই হোক কী সেট্যাল্ড ম্যারেজ এটা মনে হবেই যে, এই লোকটাকে বিয়ে করে নিজের সর্বনাশ করেছিস। প্রিন্স চার্মিং হলেও একই অবস্থা হতো। স্বামীর কাজ স্বামী করবে, স্ত্রীর কাজ স্ত্রী। এর মধ্যে কোনো ব্যাপারে সেন্টিমেন্টাল হলে সুখের সমাপ্তি। স্বামীর জ্যাকেটে লম্বা চুল পেলেই মনে করিস না যে, সে অন্য মহিলার সঙ্গে শুয়েছে। পুরুষ মানুষ জ্যাকেট খুলেই শোয়। আবার চুল না পেলে সন্দেহ করে বসিস না যে, সে এখন একটা টেকো মেয়ের সঙ্গে শুচ্ছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস এসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে মজে থাকলে একসময় দেখবি চুলে পাক ধরেছে, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থ্যারাপির পরও শরীর আর নরম হচ্ছে না। দেয়ারফোর, কাজে ব্যস্ত থাকবি, যা ভালো লাগবে তাই করবি। ভালো কেউ যদি এর মধ্যে জীবনে এসে যায়, তাকেও ধরে রাখবি। তবে সাবধান যত জোড়াতালিরই হোক সংসারটাই মুখ্য। সংসারটা ভাঙিস না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সারোয়ারী খান এক কথায় বলে দিলেন, আমার হাজব্যান্ড খুব কাওয়ার্ড টাইপের মানুষ। এর মধ্যে আবার পরকালের চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছে। তাকে অবিশ্বাস করে এনার্জি লস করতে চাই না। প্রায়ই তবলিগে চলে যায়, দ্বীনের দাওয়াত দেয়। তাদের কাফেলায় কোনো মেয়েমানুষ নেই। যদি কখনো মেয়েরা যোগও দেয়, তাদের সবাই কমবেশি বার্ধক্যপীড়িতই হবে অর্থাৎ আমার ইয়াকুব সাহেবের চেয়ে বেশি বয়সী। কাজেই দুশ্চিন্তা নেই।
ইতিহাসের শাহানা কোরাইশীকে লামিয়া প্রশ্নটা তখনো করেনি। করবে কি-না এ নিয়ে একটু দ্বিধান্বিত ছিল। কারণ শাহানা মহসিনের মায়ের মানে লামিয়ার শাশুড়ির ফুপোতো বোন। অনুষ্ঠানে-উৎসবে মহসিনের সঙ্গে তার চেয়েও কমবয়সী খালাটির দেখা-সাক্ষাৎ হয়। বোনের ছেলের স্বার্থে সে গোয়েন্দাগিরি করলেও করতে পারে।
কিন্তু শাহানা কোরাইশী এগিয়ে এসেই বলল, সারোয়ারী আপা, কাউওয়ার্ড হাজব্যান্ডগুলোই সবচেয়ে বেশি ডেঞ্জারাস। ভীরুতার বদমাস খন্ডাতে কখন কী করে ফেলে বিশ্বাস নেই। আমাদের এক ডিসন্ট্যান্ট রিলেটিভ বউয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় ভয়ে কেবলই তোতলাতে থাকত। মধ্যপ্রাচ্য, ফেরত স্ত্রীর এক কাজিন তাকে কেন ছোটখাট সোনার লকেট প্রেজেন্ট করেছে এর কোনো সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে আমাদের সেই জিন্নাহভাই তার চেয়ে সাড়ে চার ইঞ্চি বেশি লম্বা সুরাইয়া ভাবির গলা টিপে ধরে রাখে, যতক্ষণ না তার জিহবা বের হয়ে আসে। কতটা নির্মম চিন্তা করুন ? দমটা বেরিয়ে আসার পর সেই লকেটসহ একটা চেইন তার গলায় পরিয়ে দেয়। জিন্নাহভাই এখন জামিনে ? শুনলে অবাক হবেন এই খুনিটাকে বিয়ে করার জন্য সুরাইয়া ভাবির ছোট বোন মাহমুদা পাগল হয়ে আছে। মাহমুদা এমবিবিএসে ফিফথ স্ট্যান্ড করেছে, কোর্টে বোনের খুনি স্বামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিতে তৈরি হচ্ছে ? এবার বুঝুন।
আলোচনার মূলধারাটার লাগাম টানলেন সারোয়ারী আপা নিজেই। বললেন, লামিয়া জনে জনে জিজ্ঞেস করছে ? আপনি কি আপনার স্বামীকে বিশ্বাস করেন? গবেষণা, তাই না? এই লামিয়া তোমাকে ফান্ড কে দিচ্ছে ? উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন না জেন্ডার মেইনস্টিমিং ফাউন্ডেশন? ফালতু গবেষণায় টাকা দেওয়ার মতো আর কাউকে তো দেখছি না। বেশ আমিই না হয় জিজ্ঞেস করছি, এই মেয়ে তুমি তোমার স্বামীকে কতটা বিশ্বাস করো?
এক রত্তিও না।
তাহলে তার সঙ্গে ঘর করছ কেন?
বাহ্! সংসার করতে হবে না। আর তা করতে আমার কোরাইশীও যা কামরুন্নাহার ম্যাডামের দোজা সাহেবও তাই। একজন পুরুষ মানুষ হলেই হলো ? আয়-রোজগার যত বেশি ততো ভালো, সোশাল স্ট্যাটাস উঁচু হলে রোজগারে ছাড় দেওয়া যায়। যেমন কামরুন্নাহার ম্যাডামের দোজা সাহেব সরকারের এডিশনাল সেক্রেটারি। বেতন কম, তবু পুষিয়ে যায়। লুলু বিলকিস ম্যাডামের হাজব্যান্ড ইয়াসিন আলী বিশাল জুতো ফ্যাক্টরির মালিক, টাকা আর টাকা। আমার কোরাইশী লুলু ম্যাডামের সাহেবকে বলে মুচি, গার্মেন্টসের মালিককে বলে দর্জি। টাকাতে পুষিয়ে যায়। কোরাইশীর পদও নেই, টাকাও নেই ? মুখে আছে বড় বড় কথা। তারপরও একসঙ্গে আছি। বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে এক সময় নাকের জল চোখের জল একাকার করেছি। এখন এটা বিবেচনাযোগ্য কোনো বিষয়ই মনে হয় না।
বাকি রয়ে গেলেন অনেকেই। কাল-পরশু কি আবার জিজ্ঞেস করবে, না আজই শেষ করবে? লামিয়া নোটও নিচ্ছে না। কোনো ছকও পুরণ করছে না। তাহলে এ কিসের গবেষণা? কোন কারণে এই একঘেঁয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে চলেছে? সাহানা কোরাইশী যাওয়ার সময় লামিয়াকে জিজ্ঞেস করে, মাথাটাথা ঠিক আছে তো? গবেষণার আর বিষয় নেই? ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, ডাউরি, ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন, বাবার সম্পত্তিতে সমান অধিকার, স্ত্রীর রিপ্রোডাকটিভ রাইটস এসব নিয়ে কাজ করো ? এগুলোই পরে পিএইচ-ডিতে কাজে লাগাতে পারবে।
আয়শা আফসারি বললেন, অধিকাংশ স্বামীই স্ত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সঙ্গে ইন্টারকোর্স করে থাকে ? অ্যান্ড দ্যাট অ্যামাউন্টস টু রেপ ? ধর্ষণের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই, গবেষণা করলে এটা নিয়ে করো। হিসাব করে বের করো কত পার্সেন্ট স্ত্রী ব্যাপারটা এনজয় করে আর কত পার্সেন্ট এটা দাঁত কামড়ে সহ্য করে।
লামিয়া বলল, জি ম্যাডাম এটাও খুব ইম্পোরট্যান্ট। এটাও দেখা দরকার। আমরা একটা-দুটো লেবেনচুষের জন্য এমপাওয়ারমেন্ট এমপাওয়ারমেন্ট বলে চেঁচামেচি করি অথচ যেখানে প্রতিবাদী হওয়া দরকার, মুখ বুজে পড়ে থাকি। যাকগে ম্যাডাম।
বলতেই ঘণ্টা পড়ল। লামিয়ার পরপর দুটো ক্লাস ছিল ইন্টারমিডিয়েট ফার্স ইয়ারের দু সেকশনেই। সেকশন ?এ?তে পড়িয়েছে মার্জিনাল ইউটিলিটি মানে প্রান্তিক উপযোগিতা ? প্রথম গ্লাস ঠান্ডা কোক বিশ টাকায় খেতে আপত্তি করবে না তৃষ্ণার্ত ভোক্তা। একটু কম ? পনেরো টাকা হলে দ্বিতীয় গ্লাস খাবে ? দশ টাকায় তৃতীয় গ্লাস, পাঁচ টাকায় চর্তুথ গ্লাস খাবার পর ঠান্ডা কোকের উপযোগিতা তার কাছে এতই কমে আসবে যে, বিশ টাকার কোক দু?টাকায় দিলেও সে খেতে চাইবে না। লামিয়া গ্লাস এঁকে কীসব বুঝাল। পরের ক্লাসটিতে পড়াল চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বিন্দুতে কেমন করে দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। আর ক্লাস ছিল না। বাসায় চলে যেতে পারত; কিন্তু গেল না। একদিন দুটো ক্লাস সেরে বাসায় ফিরে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে।
হাতে লেগে থাকা চকের গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে ঢুকলেন বাংলার মেহের নিগার। মেহের আপা উপন্যাস লিখেন। দু-একটা বাজে ধরনের ঈদসংখ্যায় তা ছাপাও হয়। ছাপার ব্যবস্থা করেন তার স্বামী এস এম শওকত আলী। তিনি ইটভাটার মালিক। তার সাহিত্যরস নিশ্চয়ই আছে নতুবা মেহের আপার এক একটা কুড়ি ফর্মা উপন্যাস ইটের টাকায় বাংলাবাজার থেকে ছাপিয়ে নিয়ে আসেন। দু-তিনশো কপি নিজেই কিনে নেন। ইটভাটার কর্মচারী ও তাদের বন্ধুদের দেন। শেষ পাতায় মেহের আপার কলেজ জীবনের সাদা-কালো ছবি রিটাচ করে ছাপা ? লেখকের বয়স যতই হোক ছবিটিতে তো যৌবন থাকা চাই।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কলেজের সব শিক্ষক জানেন এস এম শওকত আলী যত ধনীই হোন না কেন, মেহের আপার কথায় ওঠেন এবং বসেন। আপার সাহিত্য-প্রতিভা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আপা স্বামীকেও ভেড়ায় পরিণত করেছেন। ভেড়া বানানোর একটি-দুটি টিপস আপা নিজেও দিয়েছেন সদ্যবিবাহিত লেকচারারদের।
এস এম শওকত আলী স্ত্রীর কোনো লেখাই হয়তো দুই প্যারাগ্রাফ টানা পড়ে দেখেননি। কিন্তু তার চারপাশের মানুষদের স্ত্রীর বই উপহার দিয়ে, চা-মিষ্টি খাইয়ে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছেন হয়তো মেহের আফরোজ দেশের এক নম্বর ঔপন্যাসিক নন, কিন্তু তাকে এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই ? দেশের প্রথম পাঁচজন কথাসাহিত্যিকের মধ্যে তাকে গুনতেই হয়।
তিনি অনেক টাকা খরচ করে মেহের নিগারের কথিত প্রকাশককে (ঔপন্যাসিকের স্বামী নিজেই প্রকাশক হিসেবে নিজের নাম বসিয়ে দিতে পারতেন, কেন যে দেন না!) দিয়ে প্রেসক্লাব লাউঞ্জে প্রকাশনা উৎসব করেন, একুশের বইমেলায় একটা সিঙ্গল স্টল নেন, মেহের নিগার দু-চার দিন সে-স্টলে বসেন, নেশার নিয়ম ভেঙে পঁচিশের বদলে পঞ্চাশ পার্সেন্ট কমিশনে বিক্রিতে উৎসাহিত করেন, এমনকি নিজে টাকা দিয়ে কাউকে কাউকে বই কিনতে পাঠান, তারা অটোগ্রাফসহ মেহের নিগারের বই চায়।
এস এম শওকত আলী বিগলিত হয়ে মনে মনে স্ত্রীর প্রশংসা করে বেড়ান। গাড়ির দরজা খুলে দেন। স্ত্রীর হাতে এমনকি চমশার খাপ থাকলে তাও নিজে বহন করেন। বাসায় আস্তে আস্তে কথা বলেন, যাতে স্ত্রীর অভিনিবেশ নষ্ট না হয়। এমন স্বামীকে ভেড়া না বলে আর কিই-বা বলা যায়।
স্বামী যে ভেড়া এটা মেহের আপা নিজেও বলে বেড়ান।
লামিয়া প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপা, হাজব্যান্ড ভেড়া হয়ে গেলে তাকে তো আর অবিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই আসে না, তাই না?
যদি সত্যিই ভেড়া হয়ে যায়, আপা জবাব দেন।
তাহলে এ-ধরনের স্বামীকে বিশ্বাস করা যায়? লামিয়া জিজ্ঞেস করে।
তিনি জবাব দেন, যায়। কিন্তু এ-ধরনের স্বামী তুমি পাচ্ছ কোথায়?
কেন? আপনি পেয়েছেন। আপনিই তো আমাকে বলেছেন। তোমার দুলাভাইকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছি।
তিনি এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বলেন, আমি তো তা-ই ভাবতাম। এখন দেখছি ভুল করেছি। তোমার দুলাভাই দীর্ঘদিন ধরে ভেড়ার অভিনয় করে যাচ্ছিল। এটাই তার ডিফেন্স ট্যাকটিস। এমন হাজব্যান্ডকে কে সন্দেহ করবে? আমিও করিনি। তোমার দুলাভাই আমার কাছে ভেড়ার অভিনয় করত, অন্য মহিলার কাছে সিংহের। এখন এস এম শওকত আলী একজন মডেলের স্বামী। টিভিতে আমার সতীনকে নিশ্চয়ই দেখেছ, আমার মেয়ে শান্তার চেয়েও ছোট এসএমএসএ সিরামিকের ইটের বিজ্ঞাপন দেখনি ঝড়ো হাওয়াতে ছাদের ওপর মেয়েটা নাচছে? ডিলাইট শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে পুকুরে সাঁতার কাটছে।
সে তো অহনা। শাকিলের সঙ্গে লিভিং টুগেদার সম্পর্ক ছিল। একটা টিভি চ্যানেলের মালিকের স্কিপ্টও নাকি ছিল।
ঠিকই চিনেছ, সে এখন এস এম শওকত আলীর বিবাহিত স্ত্রী।
মেহের আপা তারপর কাঁদতে শুরু করলেন।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, আমার উপন্যাসে কলমের জোর খাটিয়ে নায়িকাকে কাঁদাই। আমার ভেড়ামানব দেখো, আমাকে কেমন করে কাঁদায়।
অহনা-শওকত জুটি নেপাল থেকে হানিমুন সেরে কেবল ফিরেছে। একটি পত্রিকা হাওয়া থেকে পাওয়া কলমে বিয়ের খবরটি প্রকাশ করে, পরের সপ্তাহে তাদের যুগল ছবিও ছেপে দেয়। আমার মেয়ে বলেছে, থাক মা, তোমার দেখার দরকার নেই। ছবিতে বাবাকে অনেক ইয়াং দেখাচ্ছে। হবে না, বউ মেয়ের চেয়েও কমবয়সী।
লামিয়া বলল, স্যরি আপা।
তিনি বললেন, ভেবেছিলাম কাউকে বলব না। এখন তো সেলিব্রিটির হাজব্যান্ড হিসেবে দুদিন পরপর তার ছবিও ছাপা হবে। আমি গোপন রাখব কেমন করে? বুঝলে লামিয়া, স্বামী কখনো ভেড়া হয় না, ভেড়ার অভিনয় করে।
লামিয়া বলল, থাক আপা। আপনি লেখালেখি করেন। আপনার সম্মান অনেক বেশি। আপনি লেখাটাই চালিয়ে যান।
তিনি বললেন, ছাপবে কে? কিনবে কে? তোমরা কোনোদিন গাঁটের পয়সায় আমার একটা উপন্যাস কিনেছ? এতদিন ছাপা থেকে কেনা পর্যন্ত সবটাই করত আমার ভেড়াস্বামী। অন্তত এ-হেল্পটা করার জন্য হলেও তাকে আমার চাই। দাও না কোনোভাবে এনে। অহনার সঙ্গেই থাকুক। মাসে একবার এসে আমার পান্ডুলিপি নিয়ে যাক। লিখতে না পারলে, বই বের না হলে আমি পাগল হয়ে যাব। তুমি কী জিজ্ঞেস করছিলে ? স্বামীকে বিশ্বাস করি কি-না? অবশ্যই করি। কোনো না কোনোদিন আমার ভেড়া আমার কাছেই ফিরে আসবে। আসতেই হবে।
মেহের নিগার ম্যাডাম চোখ ধুয়ে ধাতস্ত হলেন। ব্যাগ থেকে দুটো একশত টাকার নোট বের করে রোকেয়াকে দিলেন, যাও সবার জন্য চা-সমুসা-সিঙাড়া নিয়ে এসো। তোমার জন্যও এনো।
লামিয়ার মনে হলো প্রশ্নটা তো রোকেয়াকেও করা যায়। রোকেয়া কলেজের শুরু থেকেই আয়া। তেরো বছর চাকরি করার পর আয়া পদে স্থায়ী নিয়োগ হয়েছে। বয়স বেড়ে যাওয়ায় মোস্তারী ম্যাডাম তাকে ক্লাসরুম ঝাঁট দেওয়ার কাজ থেকে তুলে এনে লেডি টিচার্স রুমের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। চা আনা থেকে শুরু করে মেঝে মোছা সবই তার কাজ। পরিসর ছোট হওয়ায় পরিশ্রম ততটা হয় না।
রোকেয়া বড় ফ্লাক্স নিয়ে যখন বের হচ্ছে, ইংরেজির ভিকি রুড্রিগস ? ভিক্টোরিয়া ওল্ডহ্যাম রড্রিগস ঢুকলেন। লামিয়ার মনে হলো আরেকজন রেসপন্ডেন্ট এসে ধরা দিয়েছেন। তিনি তো ছুটিতে ছিলেন। কেন এসেছিলেন ? লেডি টিচার্স কমনরুমের একটা চার্ম আছে, তাই?
লামিয়া এগিয়ে গিয়ে বলল, দিদি ভূমিকা ছাড়া একটা প্রশ্ন করছি, সরাসরি উত্তর দেবেন। আপনি কি আপনার স্বামীকে বিশ্বাস করেন?
ভিকি রড্রিগস বললেন, বিশ্বাস না করায় আমার মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। আমি সন্দেহ করতাম আমাদের এক ভাড়াটের ওয়াইফের সঙ্গে ও জড়িয়ে পড়ছে। কমাস ভাড়া না দেওয়ার পরও তাদের উঠিয়ে দিচ্ছে না, সন্দেহটা আরো ঘনীভূত হয়। আমি ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়া আমার ছেলে অলিভারকে বলি। আমার স্বামী র্যায়মন্ড রড্রিগসকে অলিভার চার্জ করে, যাচ্ছেতাই গাল দেয়। র্যায়মন্ড পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোক, তখন মেট্রোপলিটান ঢাকার এডিসি। কী করেছে জানো ? ছেলের মুখে এসব কথা শুনে খাপ থেকে রিভলবারটা খুলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করে দেয়। গুলির শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দেখি আমার ছেলের রক্তে ভেসে যাচ্ছে কার্পেট। রিভলবার হাতে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে র্যায়মন্ড। আমি চিৎকার করে বলি, চলো হাসপাতালে নিয়ে যাই।
র্যায়মন্ড বলল, লাভ নেই। হার্ট টার্গেট করে গুলি করেছি। আমার অবিশ্বাসের মূল্য আমার অলিভার জীবন দিয়ে শোধ করল। আমার এখনো মনে হয় ছেলেটাকে আমিই খুন করেছি। আমিই র্যায়মন্ডকে ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করে তার মাধ্যমে নিজের ছেলেকে হত্যা করেছি। থাক না র্যায়মন্ডের একশ একটা মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ? আমি কেন তা ছেলেকে বলতে গেলাম? দোষী তো আমিই, আমিই তার খুনি।
ভিকি রড্রিগস বলে গেলেন, সন্দেহ আর অবিশ্বাস শান্তি নষ্ট করে। যাদের নিয়ে স্বামীকে সন্দেহ করছ, তারাও তোমার-আমার মতো মেয়েমানুষ। তোমার-আমার যন্ত্রণার কথা তারা কি একবারও ভাবে না?
ভিকি রড্রিগসের কথা লামিয়ার সুশৃঙ্খল চিন্তাস্রোত তছনছ করে ফেলল। লামিয়ার মূল প্রশ্নটি বিবর্ণ হতে শুরু করে।
মোস্তারী ম্যাডাম ফিরে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, লামিয়ার গবেষণা কদ্দূর এগিয়েছে?
জনপ্রতি একটি সিঙাড়া ও একটা সমুসা এবং এক কাপ চা এগিয়ে দেয় রোকেয়া। আজকাল আর পানি দিতে হয় না। ম্যাডামদের প্রায় সবার ব্যাগেই পানির বোতল থাকে।
প্রশ্নটার একটা ?তাই তো? এফেক্ট আছে। মোস্তারী ম্যাডামও নিশ্চয়ই ভাবছেন। তিনি রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, স্বামীর মার কেমন খেয়েছ?
অনেক আপা। প্রত্যেকদিনই পিটাইছে। বাংলা মদ খাইয়া প্রথম কাজ বউ পেটানো। মদের ঘোর কাইটা গেলে তার মতো ভালো মানুষ আর কে আছে? কতদিন আমার পা চাইপা ধইরা মাফ চাইছে।
ম্যাডামই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে বিশ্বাস করতে?
যেদিন শুনলাম বস্তির একটা মাইয়া বিয়া করছে, সেদিনও বিশ্বাস করছি। ভাবছি আমার স্বামীর শত্রুর শেষ নেই। এইটা তারাই রটাইছে।
এখন বিশ্বাস ভেঙেছে?
জি না ম্যাডাম। মদের ঘোরের মতো এটাও একটা ঘোর, মাইয়া মানুষের ঘোর। ঘোর কাটলেই আবার ভালো মানুষ। তার ঘোরও কাটবে। আমার কাছে আবার ফিরা আইব।
এত বিশ্বাস? ম্যাডাম জিজ্ঞেস করেন।
জি ম্যাডাম, সাতটা বাচ্চা তো আর এমনি এমনি হয় নাই।
লামিয়া হিসাব মেলায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এটাই হওয়ার কথা। স্ত্রী সবই মেনে নেবে। যৌনদাসীও তো কিছু একটা মজুরি পায়। স্ত্রী কি পায়? লামিয়া উত্তেজিত বোধ করে। বাবা স্বামী ভাই পুরুষ সহকর্মী সকলকেই সমান অপরাধী মনে হয়।
ভিকি রড্রিগস জিজ্ঞেস করলেন, কী লামিয়া, ক?মাস চলছে?
ছ?মাস প্লাস দিদি। পেটটা একটু বেশি বড় দেখাচ্ছে তাই না?
ভিকি বললেন, ফার্স্ট প্রেগন্যান্সিতে কতরকম দেখায়? এরপর কখন কনসিভ করল আর কখন বাচ্চা হলো হিসাবই থাকবে না।
সনোলোজিস্ট ডাক্তার কানু বালা আলট্রাসনোগ্রাম মনিটরের স্ক্রিনে লাল তির্যক আলো ফেলে দেখিয়ে দিয়েছেন দুপায়ের মাঝখানে কালচে স্ক্রোটাম ? অন্ডকোষ। লামিয়া ছেলেই চেয়েছে। পরদিন লেডি টিচার্স কমনরুমের সবার জন্য সন্দেশ নিয়ে এসেছে। কারণটা বলেনি। বলেছে এমনিই, বাসায় খেয়েছি, ভাবলাম সবাইকে নিয়ে এখানেও খাই।
বাবা স্বামী ভাই পুরুষ সহকর্মী তারপর লামিয়ার গর্ভস্ত পুত্র সন্তান। সেও তো তাদেরই একজন হওয়ার কথা, তাই না। লামিয়া আর ভাবেনি। ছুটির ঘণ্টা বাজে।
দুই
অনেক বছর গড়িয়ে যায়। মোস্তারী ম্যাডামের লেডি টিচার্স কমনরুম এখানে নেই। নতুন ভবনে দোতলায় ? পুরনোটার প্রায় চারগুণ।
মোস্তারী ম্যাডাম রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার ঠিক আগের মাসে তার চেয়ে অনেক কম বয়সী কেমিস্ট্রির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ইলিয়াস হোসেনকে বিয়ে করে বেশ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ম্যাডামকে অনেকেই বলতে শুনেছে, ছেলেটি ভালো। সেই ভালো ছেলেটি এবং ম্যাডামের মেয়েটি, যার স্বামী আমেরিকা যাওয়ার পর তাকে নেয়ওনি। খোঁজও রাখেনি ? দুজনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক ম্যাডামকে যথেষ্ট কষ্ট দেয়। মেয়ে মাকে বলে, ছিঃ মা, তুমি এত মিন।
ইলিয়াস হোসেন তার স্ত্রীকে বলে, ছিঃ মোস্তারী, ব্যাপারটাকে তুমি সেক্সুয়াল অ্যাঙ্গেলে দেখছ কেন?
সপ্তাহ দু-একের মধ্যে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মোস্তারী হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের দেখানোর জন্য তার লাশ পুরনো লেডি টিচার্স কমনরুমের সামনে রাখা হয়েছিল।
আয়েশা আফসারী ডায়ভার্সিটি ভিসা পেয়েছিলেন। তারা সপরিবারে আমেরিকায়। বছর তিনেকের মধ্যে তিনিও মারা যান কলোন ক্যান্সারে। আফসারী সাহেবের আমেরিকা যাওয়া হয়নি। স্ত্রী ও সন্তানরা দেশ ছাড়ার এক সপ্তাহ আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত গোলাম মওলা আফসারী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্বামীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে আবিদা সুলতানা বোরকা ধরেছেন। দুজন একসঙ্গে ওমরাহ পালন করে এসেছেন।
আইরিন পারভিনের হানিমুন ঘোর কাটতে দুবছর লাগেনি। আইরিন ও বেলালের নিত্যকার গ্লাস ছোড়াছুড়ি, ঘরের ভেতর ভাঙচুর এবং দ্বিপক্ষীয় শারীরিক আক্রমণ প্রতিবেশীদের রসালাপের রসদ যোগাচ্ছে।
কামরুন্নাহার দোজা কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে উত্তরায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল খোলেন এবং সরকারি দলের সঙ্গে বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বাড়তি সম্পর্ক স্থাপন করে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী এ-ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ জানিয়েছেন।
সারোয়ারী খানের স্বামী তবলিগ দলের সঙ্গে রাঙামাটি গিয়েছিলেন, সেখান থেকে নিরুদ্দিষ্ট হন। ভীতু টাইপের সেই ইয়াকুব সাহেব বেঁচে আছেন এবং একদিন ফিরবেনই এ-আশায় সারোয়ারী খান দিন গুনছেন। লুলু বিলকিস ম্যাডামের স্বামী ইয়াসিন আলী দেশের সবচেয়ে বড় জুতো ও চামড়াজাত দ্রব্য রফতানিকারক। লুলু ম্যাডাম প্রথম স্ত্রী হিসেবে তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রীকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিদায় করেছেন। চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে তার বার্ধক্যে ঈষৎ পুলক সঞ্চার করে যাচ্ছে ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা নীনা ফারদিন লস্কর। জেরিয়াট্রিক কেয়ার বৃদ্ধসেবা কায়দা-কানুন নীনা ভালোই জানে।
মেহের নিগার লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন। এখন টেবিলেও বসেন না। ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে দুমাস কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মেয়ে দুটোই বিদেশে ? একটা ওমানে স্বামীর সঙ্গে, অন্যটা অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্র্যান্ট। ছোট মেয়েটা তিন-চার মাসে একবার ফোন করে, বড়টা প্রতি শুক্রবার জুম্মার সময়। তখন তার স্বামী থাকে মসজিদে, মায়ের সঙ্গে একটু দীর্ঘসময় কথা বলা যায়।
ভিকি ম্যাডামের স্বামী র্যায়মন্ড রড্রিগস সুইসাইড করেছেন। রিভলভারের নল নিজের মুখে ঢুকিয়ে মাথা বরাবর গুলি করেছেন। ভিকি রড্রিগসও নেই। এ-বছরই গোড়ার দিকে বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না দেখে কাজের মেয়ে হইচই শুরু করে। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী এসে বাথরুমের দরজা খুলতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাড়ির কেয়ারটেকার বাইরে থেকে চাবিওয়ালা এনে দরজা খুলে দেয়। ভিকি রড্রিগস তখনো কমোডে বসে। একটুখানি নিশ্বাসও নেই। মাথাটা সামনে ঝুঁকে আছে।
আয়া রোকেয়ার স্বামী অসুস্থ অবস্থায় তার কাছে ফিরে এসেছে। রোকেয়া জানত তাকে আসতেই হবে। তার সে-জানা যে সত্য হয়েছে তাতেই আপ্লুত হয়ে পেনশন ও গ্র্যাচুইটির টাকা ভেঙে তার চিকিৎসা করছে। বস্তির সে-মেয়েটির ঘরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। রোকেয়া যতটা পারে সাহায্য করে। তার স্বামীরই তো সন্তান। সাতটা বাচ্চা লালন-পালন যে-করেছে, দুটো তার জন্য কোনো বোঝাই নয়।
লামিয়া চাকরি বদলেছে। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ট্যাক্স ক্যাডার পেয়েছিল। মাত্র কদিন আগে জয়েন্ট কমিশনার হয়েছেন। তার ছেলে রিফাত মহসিন লন টেনিসে জুনিয়র গ্রুপে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গতবারের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন টুর্নামেন্টে না থাকায় রিফাতের চ্যাম্পিয়নশিপটা তেমন গুরুত্ব পায়নি। লামিয়ার চাকরি বদল মহসিন পছন্দ করেনি। লামিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। বিশেষ করে লামিয়ার বস কাদের খানকে নিয়ে তাকে অনেক কথাও শুনিয়েছে। লামিয়া জবাব দেয়নি, সে জানে এটা জেলাসি। কোনো বিরোধে যায়নি।
এর মধ্যে শাহানা কোরাইশীর স্বামী রবিন কোরাইশী শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলে পুলিশ যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মহসিনও তাদের একজন। রবিন কোরাইশীর সঙ্গে আশুলিয়া-বাইপল সড়কের একপাশে পড়েছিল। তার প্যান্টের পকেটে ছটি ইয়াবা অর্থাৎ যৌন উত্তেজক বারোটি ট্যাবলেট পাওয়া যায়।
তোমাকে কেন? লামিয়ার এ-প্রশ্নের জবাবে মহসিন বলেছে, আত্মীয়দের কাউকেই ছাড় দেয়নি, কমবেশি জেরা করেছে। আমাকেও করেছে।
করপোরেট কর অরোপের ওপর তিন সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ শেষে বার্মিংহাম থেকে ঢাকায় ফিরে লামিয়া জানতে পারে, বিয়ে করে থাকুক কিংবা বিয়েটা ঝুলিয়ে রাখুক মহসিন ও সাহানা একসঙ্গে থাকছে, এক বিছানায়।
ওরা দুজন পরস্পরকে বিশ্বাস করে?
কিছুক্ষণ কাঁদার প্রস্ত্ততি নিয়ে লামিয়া বাথরুমে ঢোকে। যখন বের হয় বাইরে দাঁড়িয়ে রোকেয়ার ছোট মেয়ে। মা পাঠিয়েছে। বাবার দাফনের জন্য কিছু সাহায্য লাগবে। লামিয়ার ব্যাগে হাজার টাকার একটি বিবর্ণ নোট এবং পাঁচশো টাকার বেশ কটি চকচকে নোট।
লামিয়া সিদ্ধান্ত নিতে বড্ড দেরি করছে। চকচকে পাঁচশো টাকার একটা নোট দেবে না বিবর্ণ হাজার টাকার নোট?
আর সব স্ত্রীর মতো লামিয়াও মহসিনকে সন্দেহ করেছে। সে-ই একবার দুটো ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে দেখে মহসিন ও সামিয়া প্রায় গায়ে গায়ে লেগে বসে আছে, অনুচ্চস্বরে কথাও বলছে। সামিয়া লামিয়ার চার বছরের বড়, মহসিনের বয়সী। স্বাধীনচেতা সামিয়া প্রথম স্বামীর ইম্পোরট্যান্ট পরিচিতি জনে জনে বলে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তারপর তাকে তালাক দিয়েছে। দ্বিতীয় স্বামী মাসুদুল্লাহ খান জাল টাকা বানানোর সময় মেশিনসহ ধরা পড়ে তখনো জেলে। বিপদাপন্ন স্ত্রীর বড় বোনের পাশে দাঁড়াতে দিয়েই মহসিনের এই সখ্য।
লামিয়া তাদেরও বিব্রত করতে চায়নি। চুপচাপ আবার বেরিয়ে আসে। অস্থিরচিত্তে ক?ঘণ্টা ঘোরাঘুরি ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে বিকেলে যখন বাসায় ফেরে, সামিয়াকে আর দেখেনি।
অবিশ্বাসের শুরুটা ওমান থেকেই, কিন্তু তা সামিয়াকে নিয়ে। শাহানা কোরাইশীকে নিয়ে কখনো নয়।
রোকেয়ার মেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, যদি দিতে চান দেন, বেহুদা আটকে রাখছেন কেন?