মূল ঘর থেকে কিছুটা দূরত্বে আরো একটি ছোট্ট ঘর। সেই ঘরের নাম আঁতুর ঘর। ঘরের মেঝেতে শীতলপাটি বিছানো। পাশে রাখা মালসা ভরা গরম পানি, পরিস্কার কিছু তেনাকাপড় আর একটা ধারালো ব্লেড। ইতিমধ্যে বেশ বিলম্ব হয়ে গেছে অতএব যা হবার তা হয়ে গেলে ভাল হতো। ধাত্রীর নাম ইয়াসিনের মা। তার হাতে তখন মা এবং সন্তানের জীবন-মরণ অবস্থা। শেষ পর্যন্ত সে কি সামাল দিতে পারবে!
বিলম্ব কিছুটা হয়েছিল বটে, তবুও বহু কাংক্ষিত চিৎকার শুনিয়ে একটি শিশু এলো দুনিয়ার আলো-বাতাসের মাঝে। জন্ম-নাড়ি কেটে তাকে শীতল পাটির উপর রাখা হল। ইয়াসিনের মার সচেতন চোখ নবজাতকের শরীর খুঁজে আবিস্কার করেছিল এক অবাক জিনিস। সেই জিনিসটার উপর ভরসা করে ইয়াসিনের মা বাইরের দিকে মুখ বের করে বললো -ছেলে হইছে!
বেল গাছের উপর তখন একটি দাঁড়কাক বসা ছিল। ইচ্ছে করলে ডালে বসে যতো খুশি নাচানাচি করতে পারত। তবু তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না যতটা-না ছেলে জন্ম নেবার কারনে উপস্থিত গ্রামবাসির মাঝে দেখা গেল। বেলগাছের নিচে আরো উপস্থিত ছিল গ্রাম্য বুড়ি। তাকে ঘিরে জমে উঠেছিল ছোটদের কৌতুহল। বুড়িদাদীর অবস্থা অনেকটা বাবু সালাম বারে-বার। অর্থাৎ তারও ঘর-বাড়ির কোন ঠিকানা ছিল না। লোকের দেয়া এঁটো খাবারই ছিল তার রুজি-রোজগার। সঙ্গত কারনে তার মনের মধ্যে আনন্দ উৎসবের কোনো চিহ্ন ছিল না। ছেলে হলো কি মেয়ে তা দিয়ে বুড়িদাদীর কি কাজ! নতুন বাচ্চা হলে ভাল-মন্দ কিছু পেলেও পেতে পারে সে জন্য এসে বেল গাছের নিচে অপেক্ষা করা। কিশলুকে যখন বাইরে আনা হলো এবং পুত্রসন্তান হবার কারনে সকলে বাহাবা দিতে লাগল তখন কিশলুর মুখদর্শন করে বুড়িদাদী মন্তব্য করল – বেল পাইকলে কাকের কি!
কিশলুর বাবা বলল, চাচী কি সব অলুক্ষণে কথা যে কও! দেখবা আমার ছাওয়াল দেশের রাজা-বাদশা হবে। তার নাম জানবে দেশের সবাই। বুড়িদাদীও কম গেল না। সে বললো – দ্যাশের রাজা-বাদশাদের পেটেও আইজকাল ভাত জুটে না বাজান। তুমি নিজে একজন না-খাওয়া মানুষ, তোমার ছাওয়ালও হবি তাই। দুনিয়াটা হল একটা পাকা বেল। কাকের ঠোকরে বেল ফুটো হতি শুনিছো কখনো। বুড়িদাদীর অলুক্ষনে কথা যেন বিস্তার না ঘটে সে জন্য তাকে পুরানো একটা শাড়ি উপহার দেয়া হলো। সাথে নগদ কিছু টাকা। ব্যবস্থাটা ভালোই বলা চলে, তা না হলে অলুক্ষণে কথা একটাও আটকে থাকত না। বেলগাছের নিচে সেও একটা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জনম জনম মুখ আলগা করে যেত।
কিশলু যখন স্কুলে পড়ে তখন তার মায়ের যক্ষ্মাকাশি হয়। শেষের তিনমাস অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে সকলে বলতে শুরু করেদিল আল্লা যা ভাল মনে করে তাই যেন হয়! রোগীকে কষ্ট না দিয়ে তার নিজের কাছে যেন নিয়ে যায়। সত্যি সত্যি যখন কিশলুর মা মারা গেল তখন সকলে বলাবলি করল আল্লার জিনিস আল্লা নিয়ে গেছে। সেই প্রথম কিশলুর মনে হতে লাগল রোগমুক্তি কামনা না করে সকলে কেন তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দোয়া করলো না। যিনি দোয়া শুনবেন তিনিতো ভাল করার দোয়াটাও শুনতে পেতেন। বেল পাকলে যদি কাকের কিছু না হয় তবে তার মায়ের মৃত্যু হলে অন্যদের কি লাভ! শুরু হয়ে গেল কিশলুর জন্ম, মৃত্যু আর পাকা বেলের গল্প।
স্ব-ইচ্ছায় হোক কিংবা পরের ইচ্ছায়। কিশলুর বাবা আবারো বিয়ে করল। তার নতুন মা বাধা-বন্ধনহীন এক প্রক্রিয়ায় পা দিল। সব মিলে পাঁচটি ছোট ছোট ভাই-বোনের বড়ভাই হয়ে গেল কিশলু। বড়ভাই নাকি বাবার সমতুল্য। বাবা নিজেই না-খাওয়া, তাই বড়ভাই হবার কারনে কিশলুও বাবার মতো আধপেটে উপোস করে যেত। তবে দায়িত্ব-কর্তব্যে কিশলুকে কেউ কোন দোষ দিতে পারবে না। সবগুলো ভাইবোনদের সে স্কুলে মক্তবে পাঠিয়েছিল। এবং অন্তত একজনকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়িয়েছে। ছোটমাকেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আগলে রেখেছিল কিশলু। ছোটমায়ের মৃত্যু পূর্ববর্তী দিনগুলো ছিল নিজের মায়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর। পেটের পাকস্থলিতে দারুন ক্ষত হয়েছিল তার। শেষের দিকে শুধু এটা-ওটা খেতে চাইত। বলত একটু মিষ্টি ওষুধ এনে খাওয়াতে। মিষ্টি জিনিশ তার খুব প্রিয় ছিল। সুস্থ থাকাকালিন পিঠা-পায়েস খুব একটা খেতে পারে নি। ভেবেছিল পৃথিবীতে কতো সুস্বাদু খাবার, একদিন না একদিন সখের দুএকটা জিনিশ সে খেতে পারবে। যখন কিশলুর ছোটমা বুঝতে পারল দিন ছোট হয়ে আসছে, সখের কোন কিছু খাবার সময় সে আর পাবে না। তখন সে কিশলুকে বলতে শুরু করে দিয়েছিল আমকে একটু মিষ্টি খাবার এনে দে। কিশলু একদিন আখের রস খেতে দিয়েছিল। আরেকদিন নিয়ে এল লালরঙের জিলাপি। কিন্তু তিনি ভাবতেন আরো মজার মজার জিনিশ ছিল যা কিশলু হয়তো পয়সা-কড়ির অভাবে কিনতে পারেনি। তারপর নিজের থেকেই একদিন আফসোস করে বললো, – বাজান কিশলু, আমারে কিচ্ছু খাওয়াতে হবি না। শুধু একটু মিষ্টি অষুধ এনে দেরে বাপজান।
কিশলুর বাবা মারা গেল আরো করুণভাবে। ঢাকা শহরে এসেছিল কোন একটা কাজে। শোনা যায় একরাতে ঢাকা শহরে কার্ফু চলাকালীন বেশকিছু লোক গুলিতে মারা যায়- তার মধ্যে কিশলুর বাবাও ছিল।
কিশলুর নির্দিষ্ট কোন পেশা ছিল না। যখন যেটা লাভজনক মনে করতো, সেটাতেই সে লেগে যেত। এলো পারাপারের দিন। হটাৎ দলে দলে শহরের লোকজন গ্রামের দিকে ছুটেতে লাগল। এই গ্রাম থেকে সেই গ্রাম তারপর সেখান থেক ভিন্ন কোন গ্রামে। কারো অবস্থা এতোই খারাপ ছিল যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা ভারত চলে যেত। স্রোতের উপর ভাসতে লাগল গোটা দেশ। সাধারন নিয়মে গ্রাম ছেড়ে মানুষ যায় শহরে। অথচ তখন হলো উলটো কান্ড। একের পর এক যে যেদিকে পারে শহর ছেড়ে ভাগতে লাগল। ঠিক সেই সময় কিশলু হাতে তুলে নিল কাঠের বইঠ্যা। হালিম মিয়ার পুরানো নৌকা মেরামত করে তার উপর শক্ত একটা ছই বসিয়ে হলে গেল পারাপারের মাঝি। রাত নেই, দিন নেই লোকজনকে নদী পার করে দিতে ব্যস্ত সে। কেউ বলে নদীর অন্য পাড়ে নামিয়ে দাও বাবা। কেউবা চলে যায় বেলা পার করা দুরত্বের কোন ভিন গাঁয়ে।
শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকদের নিজস্ব আলোচনার মধ্যেই যথেষ্ট সংবাদ পাওয়া যেতো। সেখানে কি হচ্ছে কেনইবা এই ওলট-পালট। কিশলুকে আর প্রশ্ন করে কিছু জানতে হতো না। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন যাত্রি, অথচ সবার মুখে একটি অভিন্ন উক্তি। পাকিস্তানি মিলিটারি। হয় মৃত্যু, না-হয় মৃত্যুর খুব কাছাকাছি অবস্থা থেকে ওরা বেঁচে এসেছে। আরো একটা অভিন্নতা লক্ষ্য করল কিশলু। পাড়াপাড়ের অপেক্ষায় বসে থাকা লোকদের কারো সাথে কোন মালপত্র থাকতো না। দেখে মনে হতো এই বুঝি হাঁটতে বের হয়েছিল। তাই হাত-পা ঝাড়া। এদিকে ছেলে মেয়েগুলো সব না-খাওয়া ক্লান্ত আর অনিদ্রায় ঢুলে পড়া। মায়েদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। ছোট বেলায় রাক্ষসের গল্প শুনে কিশলু মনে করতো রাক্ষসের চেয়ে ভয়ঙ্কর বোধহয় আর কিছু নেই। কিন্তু প্রতিদিনের নিত্যনতুন কথার মাঝে পাকিস্তাানি মিলিটারির কাছে হেরে গেল সেই রাক্ষসাতঙ্ক। কিশলু মনে মনে প্রস্তুত হতে লাগলো সুযোগ পেলে একটা হলেও মিলিটারিকে সে পানিতে ডুবিয়ে মারবে। অপরিচিত যাত্রিদের কথা মাঝে কিশলু জানতে পেরেছিল পাকিস্তাানি মিলিটারিরা সাঁতার জানে না। আর বুঝতে পারলো ক’দিনের মধ্যে ওদের গ্রামেও মিলিটারি ঢুকে যাবে। কিশলু বুঝে নিল সে একটি যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। রাজা-বাদশাদের যতো গল্প কিশলু শুনেছিল, তার বেশিরভাগ ছিল যুদ্ধকে ঘিরে। কিশলুর বাবা ভবিষ্যৎবাণী করেছিল বড় হয়ে কিশলু রাজা-বাদশা হবে। চারিদিকে যুদ্ধ দেখে কিশলু মনে করতে লাগল রাজ্যজয়ের যুদ্ধ চলছে। রাজা-বাদশা না হলেও এই যাত্রায় সে অন্তত একজন রাজসৈনিক হতে পারবে। এপাড়-ওপাড় এবং পারাপার করার কাজ তাকে একদিন ঠিকই সুযোগ করে দেবে সৈনিক হবার।
কখনো খন্ডিত সংসার, আবার কখনো পুরো একটা সংসার কিশলুর নৌকার যাত্রি হয়ে যেতো। অল্পদিনের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো কিশলু। শহরের লোকজনের ভিড় একটু কমে যেতেই কোমরে গামছা-বাঁধা কিছু যুবক তার নৌকাতে উঠে গম্ভীর হয়ে বসে থাকত। দিন যতো গড়াতে লাগল সে দেখতে পেল এই সমস্ত যুবকদের সাথে মধ্যবয়সী কিংবা পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ। প্রথমে গামছা কিংবা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখলেও পরের দিকে তাদের সাথে বহন করা জিনিষগুলো নিয়ে অতো মাথা ঘামাতো না তারা। কিশলু কতগুলো নতুন জিনিষের সাথে পরিচিত হল। একটার নাম এস এল আর, কালোটার নাম স্টেনগান। ঢাউসমার্কা বন্দুকের নাম রাইফেল। এভাবেই একদিন সে ছুঁয়ে ফেললো গ্রেনেডের মত মারত্মক এক অস্ত্র। বিদুৎ চমকে গেল তার পুরো শরীরের ভেতর! রক্তে এলো বাঁধভাঙ্গা স্রোত। নোঙ্গর তুলবার ডাক শুনতে পেলো সে। একসপ্তাহ পর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে বলে কথা দিল। সেই এক সপ্তাহ হতে মাত্র তিন দিন বাকি। তখনই তার নৌকায় এসে আশ্রয় নিল হোসেন সাহেবের সংসার। হোসেন সাহেবতো আছেনই আরো আছে কাজের মেয়ে বেগম, তার স্ত্রী, দুই পুত্র আর হোসেন সাহেবের একমাত্র রাজকন্যা সাবা।
হোসেন সাহেব একটি জুটমিলের সুপারভাইজার ছিলেন। মিল-মালিকের প্রতি ছিল তার অগাধ আনুগত্য। যাকে সন্দেহ হতো মেলেটারিরা তখনই তাকে নিয়ে যেত ক্যাম্পে। হাত-পা ভেঙ্গে কাউকে ফিরিয়ে দিত আবার কাউকে রেখে দিত তাদের কাছে। এমন অবস্থাও হোসেন সাহেব মিলের ভেতর থাকতেন পুরো পরিবার নিয়ে। একদিন তাঁকেও ডেকে আনা হলো তাঁবুতে। মিলের কিছু বিহারি কর্মচারি নামের তালিকা করে দিত মিলিটারিদের হাতে। সেই তালিকায় হোসেন সাহেবের নামও উঠে এল। পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক দিন চাকরি করেছেন বলে খুব ভাল উর্দু জানতেন তিনি। তাঁর তিনটি সন্তানের জন্মও করাচিতে। চাকরির প্রতি নিবিড় নিষ্ঠা ও সততা ছাড়া তিনি অন্য কোন কারনে কারো আলোচনায় আসেননি কখনো। সেই হোসেন সাহেবকে ডেকে নিয়ে পাঁচ ঘন্টা একটা দেয়ালের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। একবার বাথরুমে যেতে চাইলে এক বিহারি ছোকড়া তাঁকে বললো -যো করনা কাপড়া ম্যে করো। সন্ধ্যার পর তিনি দুর্গন্ধযুক্ত কাপড় নিয়ে ঘরে এসে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও কাজের মেয়ের সামনে অঝোরে কেঁদে দিয়ে বললেন, সাবাকে দেখতে একটা বিহারি যুবকের বাপ-মা আগামি শুক্রবার আসবে। সাবার সাথে যুবকের বিয়ে না দিলে… আবারো তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। কিশলুর নৌকাতে এসে এই প্রথম এতোগূলো কথা একসাথে বলতে পারলেন হোসেন সাহেব। গেল ছয় দিন তিনি ছিলেন পাথরে মত নির্জীব এক মানুষ। কি করে যে মিলের কোয়ার্টার থেকে নানান পথঘাট পেরিয়ে শেষে এই নৌকাতে এলেন সে কথা তিনি বলতে পারবেন না। তবে এর পেছনে কাজের মেয়ে বেগমের হাত ছিল সেটা তিনি জেনেছেন কাল বিকেলে। বেগমের প্রশংসা করে হোসেন সাহেব বার বার বলে যাচ্ছেন আমাদের জীবন ওর কাছে ঋণী হয়ে থাকল।
এদিকে কিশলুর মধ্যে দেখা দিল বিশেষ পরিবর্তন। প্রথমদিন থেকেই কিশলু সাবার দিকে অপলক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকতো। বিহারি পান্ডাদের হাতে এমন একটি মেয়ের সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল! পশুর হাত থেকে সাব রক্ষা পেয়েছে তাতেও কিশলু খুশি হতে পারেনি। কি হতো যদি সাবাকে তারা ধরে নিয়ে যেত। হয়তো কবুল ছাড়াই বিয়ে করে ফেলতো। কবুল নেই, কাবিন নেই অথচ একই বিছানা! সেই বিহারী ছেলেটাকে জ্যান্ত ডুবিয়ে মারতে চায় কিশলু। মনের রাগ মিটানোর জন্য মাঝে মাঝে পানির গায়ে বইঠা দিয়ে এলোপাথারি দাগ কেটে দেয়।
তিনদিন তিনরাত কিশলুর নৌকাতেই থেকেছে হোসেন সাহেবের পুরো সংসার। নৌকাতেই যে যেমন পারতো ঘুমিয়ে পরত কিংবা কিছু একটা খাবার জোগার করে তার পিছনে সকলে লেগে থাকত সারাদিন। ছোট ছেলে দুটো বেশ চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরপর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ ভারি করে বসে থাকতো তারা। ওদের দেখে বোঝা যেত ওদের বাবার কিছু হয়ে গেলে তারা বড়ই বিপদে পড়বে। তাদের কাছে বাবাই যেন সবকিছু। হোসেন সাহেবের স্ত্রী কাজের মেয়ে বেগমের সাথেই কথা বলেন বেশি। যেন বেগম তার পরম ভরসার পাত্রী। এদিকে বেশির ভাগ সময় সাবা বসে বসে বই পড়তো। ভীষণ নীরবতার ভেতর দিয়ে কিশলু নৌকা এগিয়ে নেয়। নৌকার কোন যাত্রিরা তেমন শব্দ করে না। চারিদিকে অথৈ পানি এবং ভীষণ নীরবতা। এতোটাই নীরব যে মাথার উপর দিয়ে পাখি উড়ে গেলে ডানার শব্দ শোনা যায়। অল্প দিনেই কিশলু পাকা মাঝি হয়ে উঠেছে। যতটুকু সম্ভব বড় নদী এড়িয়ে খাল-বিল-হাওর-বাওরের ভেতর দিয়ে সে নৌকা ঢুকিয়ে দেয়। উঁচু উঁচু ধানগাছ অথবা গাদা গাদা কচুরিপানার মধ্য নৌকা ঢুকিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পরে। অথচ তার নৌকা থেমে থাকে না কোথাও। পেছনে বিপদ, সামনের দীর্ঘ পথ। দিন-রাত্রি চলে তার ভেসে বেড়ানো।
তিনদিনের পানিপথের যাত্রায় নিজের অজান্তে কিশলু এক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে। এই নৌকাযাত্রা তার কালের সাক্ষি হয়ে ওঠে। প্রতিদিন হাল বেয়ে চলা। প্রতিদিনই বিরামহীন এগিয়ে যাওয়া। হোসেন সাহেবই মাঝেমধ্যে নৌকা থামাতে বলে। কাছে হাট-বাজারের দেখা পেলে কিশলুকে দিয়ে এটা-ওটা কিনিয়ে আনেন। একদিন নদীর পাড়ে বসে ওরা সকলে মিলে গোসল করেছে তাও হোসেন সাহেবের ইচ্ছাতে। সেদিন সাবাকে দেখেছে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে! ভেজা কাপড়ে নদীর পাড় থেকে নৌকা পর্যন্ত হেঁটে আসতে তার জড়তার শেষ ছিল না! মাঝে মধ্যে জোলাভাতির মত নদীর বাঁকে বাঁকে আলুভর্তা কিংবা চালকুমড়ার ঝোল খেতে সাবা বেশ আনন্দ পেত। নিজ হাতে সে একে-ওকে ভাত বেড়ে দিত। কিশলুও বাদ যেত না। সাবা একবার বলেছিল, তুমি একটু বেশিবেশি খাও। তোমার শরীরে শক্তি দরকার। এভাবে সাবা যখন সরব কিংবা নীরব, কিশলু সাবাকে দেখতো মুগ্ধ নয়নে। সাবা তার চোখে ছিল অবাক বিস্ময়! সাবার চোখের ভেতর কিশলু দেখেছিল রূপালি নদীর ঢেউ। পায়ের পাতায় কলস গড়ানো আলতা। মুখের কথা কি আর বলবে, মনে হয় সাবা বুঝি চাঁদের দেশের মেয়ে।
সাবার বাঁকানো ভ্রুর শেষ প্রান্তে ছিল একটি কালো তিল। কিশলুর চোখে সেই তিল আরো বেশি বিস্ময় ঢেলে দিল। যখনই সুযোগ পেত সে দেখতে চাইত শুধু কি ডান চোখের শেষ প্রান্তে ঐ মায়াকাড়া তিল! নাকি, দু’ভ্রুর নিচে দুটো। মুখ নামিয়ে বইপড়া সাবার অন্যপাশটা খুব ভাল করে দেখতে পেত না সে। মাথায় থাকতো ওড়না পেঁচানো ঘোমটা। যখন আবিষ্কার করা গেল তিল মাত্র একটি, তখন কিশলুর অনন্দের আর সীমা থাকে না। একজোড়া তিলের অপর তিলটি ছিল কিশলুর বুকের বাম দিকে। কিশলু মনে করে নিল সাবার সাথে তার বুঝি বুকের সম্পর্ক। মনের খুশিতে এক সময় নৌকা সুদ্ধ সাতপাক খেতে শুরু করে দিল। সাবা জিজ্ঞেস করলো, কিশলু ভাই, ওভাবে নৌকাকে পাক খাওয়াচ্ছো কেন? তখন মধ্যদুপুর। বাকী সকলে গভীর ঘুমে মগ্ন। শুধু সাবা জেগে জেগে বই পড়ছিল। সবে মাত্র ছয় পাক হয়েছে। সাত পাক পুরো না করে সাবাকে সে কোন উত্তর দিল না। সাবা বললো, কি হল কিশলু ভাই, আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন? কিশলু বলল, পাকে আটকে গেছি তাই। সাত পাকে আমার মুক্তি!
করাচিতে জন্ম নিয়েছিল সাবা। সাতপাকের মানে সে জানতো না। তার থেকে বয়সে সামান্য বড় একজন যুবককে ভাই ছাড়া ডাকতেও শেখেনি সে। ওর স্বভাবগুণেই বেশি কথা বলতোনা সাবা। তবে ক্ষণে ক্ষণে বই থেকে চোখ তুলে তাকাতো এদিকে সেদিক। মাঝে মাঝে সে চোখে চোখাচোখি হয়েছে কিশলুর উজান-ভাটির চোখে। তখন সাবা হাসতো আর কিশলুর বুকে কান্না জমে যেত!
একবার কিশলু জিজ্ঞেস করেছিল তুমি সারাক্ষণ বই পড় কেন? বই কি নদীর চেয়েও বড়! তোমাকে বুঝি নদী টানে না। সাবা বললো নদীকে আমার ভয় লাগে। তাছাড়া আমি সাঁতার জানি না। আব্বু বলেছেন আমাকে ডাক্তারি পড়তে হবে। যুদ্ধ থেমে গেলে আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হব। অথচ ঠিকমত প্রস্তুতি নিতে পারছি না। কিশলু আরো একটি প্রশ্ন করে সাবাকে। তুমি ডাক্তার হতে চাও কেন? সাবা বলে, দেশের গরীব মানুষদের সেবা করার জন্য।
শত দুঃখ-কষ্ট থাকা সত্ত্বেও সাবার কথা শুনে কিশলুর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে! সে একজন গরীব ছেলে। সাবা থাকবে তাদের পাশে। বেল পাকলে নাকি কারো কিছু আসে যায় না! কিশলু তার গরিবী জীবনটাকে বাহবা দেয়। সে চায় একে একে সাবাকে তার মা, ছোট মা আর বাবার অসহায় যন্ত্রণার কথা শুনাতে। প্রথমে বলবে মায়ের কথা, তারপর ছোট মায়ের মিষ্টি অষুধ খাবার কথা এবং গুলিতে মৃত্যুবরণ করা তার বাবার কথা। অথচ কিশলু কিছুই বলতে পারে না সাবাকে। ভোর হতেই যশোর সীমান্তের কাছে নেমে যায় হোসেন সাহেবের পরিবার। কিশলু ভাবে সেও যাবে তাদের সাথে ভারতে। কিন্তু তারতো মুনীরের বাহিনীতে যোগ দেবার কথা। দেরি হয়ে গেলেও কমান্ডার মুনীরের সাথে তাকে দেখা করতে হবে। একবার প্রতিজ্ঞা করে সেই প্রতিজ্ঞা থেকে কখনো সে ফিরে আসতে পারবে না।
কিছু কিছু ভোর এতো সুন্দর হয়ে উঁকি দেয়, মনে হয় দিনের আলোর কি প্রয়োজন, ভোরের আভাটাই চিরস্থায়ী হোক। সেদিনের ভোরের আলোতেও ছিল সেই মনকাড়া সুখ। হাল্কা শীতের হাওয়া উড়ে উড়ে এর চুল ওর আঁচলে টোকা দিয়ে যাচ্ছিল। সাবার পরনে সাদা রঙের তাঁতের শাড়ি। ঝুলে পড়া চুল, আঙুলে রূপার আংটি। হাল্কা শীতের কিছুটা হাওয়া সাবার গায়ে-পায়ে এসেও ভর করেছিল। কিশলু মনে মনে ভাবতে লাগলো আকাশের চাঁদ বুঝি তার নৌকায় যাত্রি হয়ে এসেছিল। ভোরের হাল্কা আলোতে চাঁদ যেমন হারিয়ে যায় ঠিক তেমনি করে হোসেন সাহেবের সংসার নেমে গেল ভেজামাটির উপর তিন দিনের মায়া ভুলে। নৌকা থেকে নামার সময় সাবা তাল সামলাতে না পেরে কিশলুর হাত চেপে ধরেছিল। তাতেই যেন চাঁদের উত্তাপ ছুঁয়ে গেল কিশলুর হাল ধরা হাতে। ক্রমশঃ সেই উত্তাপ কিশলুর বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল জ্বলন্ত আগুনের মত।
কমান্ডার মুনীরের দেখা কিশলু পায়নি। নির্ধারিত দিনে কিশলুকে নিতে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর এ্যামবুশের নিচে পরে যায় মুনীরের ছোট্ট বাহিনী। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। দল ভেঙ্গে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কমান্ডারদের অধীনে যুদ্ধ করতে থাকে মুনীরের ছেলেরা। শেষে কমান্ডার হাবিবের দলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক হল সে। তার নামেও একটি অস্ত্রের বরাদ্দ হয়েছিল, ঢাউসমার্কা সেই রাইফেলের নাম ছিল থ্রি নট থ্রি। একদিন পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাতে ধরা পরার পর হাত থেকে ছুটে যায় রাজ সৈনিকের সেই মূল্যবান হাতিয়ার। সব যুদ্ধের মত কিশলুর একাত্তরও একদিন শেষ হয়।
কিশলুর স্ত্রীর নাম রেনু। বিয়ের পর থেকেই সে শুনে আসছে ডাক্তার সাবার কথা। শুধু শুনেই আসছে, কোন দিন দেখা হয়নি। রেনু কেন, কেউ দেখেনি ডাক্তার সাবাকে। আদতে সাবা যে ডাক্তার হয়েছে কিনা সে কথাও কেউ জানে না। তবুও তার নাম ডাক্তার সাবা। কিশলুর দেয়া সেই নাম। বিয়ের প্রথম সপ্তাহেই রেনু শুনেছিল বাঁকা ভ্রুর নিচে বড় একটি তিলের কথা। কতো বড় ছিল সেই তিল তা দেখাতে কিশলু তার গেঞ্জি তুলে নিজের বুকটি দেখায়। সাবার বাম চোখের ভ্রুর কোণের তিল আর সেই তিলসদৃশ কিশলুর বুকের তিলের অখন্ড যুক্তি রেনুকে কখনো বিরক্ত করেনি। একদিন হেসে দিয়ে রেনু জিজ্ঞেস করেছিল আগুনের মত ফর্সা আবার হয় নাকি মানুষ! আপনি কথায় কথায় বলেন ডাক্তার সাবার গায়ের রঙ আগুনের মতো ফর্সা। আগুনতো হয় লাল। কিশলু তাতে লজ্জা পেয়ে যায়। তারপর লজ্জা ঢাকার জন্য বলে তুই অই কথার মানে বুঝবি না বউ। কি বললো না বললো তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথা হলো না। কিন্তু সাবাকে নিয়ে সব আলোচনার পর সে যে কাজটা করতো সেবারও তাই করল। নৌকা থেকে নেমে যাবার সময় সাবার হাত ধরা হাতের দিকে তৃপ্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল।
রোগ বালাইয়ের কারনে কিশলুকে অনেক বয়স্ক মনে হতো। মনে হতো মৃত্যুর দিকে সে শাঁশাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিশলুর পীড়াপীড়ির কারনেই তাকে একসময় ঢাকাতে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালে যাকে পেত তাকেই পাঠিয়ে দিত ডাক্তার সাবাকে খুঁজে আনতে। একবার রেনুকে পাঠায়। সে ফিরে এলে পাঠিয়ে দেয় ছেলে স্বাধীনকে। এভাবে কি কোন ডাক্তার পাওয়া যায়! আবার মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে পাঠায় মেয়ে মুক্তিকে। শেষ পর্যন্ত ওদের কেউই ডাক্তার সাবার খোঁজ আনতে পারে না। চিকিৎসার কি হলো না হলো সেদিকে কোন খেয়াল রইল না তার। দুঃখ পেলো ডাক্তার সাবাকে খোঁজার সময় পেলো না বলে। সাত দিন পর কিশলুকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা হলো।
আবার অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকাতে। এবার ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল। টাকা-পয়সা গরু-বাছুর যা ছিল একে একে সব কিছু শেষ হয়ে যেতে লাগল। জীবনের শেষ নিঃশাষ টিকে থাকা পর্যন্ত সে প্রত্যাশা করে ডাক্তার সাবার দেখা পাবার। এছাড়া আর কোন চিন্তা-ভাবনা যেন নেই। পঙ্গু হাসপাতালে থাকল দুই সপ্তাহ। সে যাত্রাতেও তার অসুস্থতা তেমন মারাত্মক বাঁক নিল না। পুনরায় গ্রামে ফিরে যেতে হল তাকে। গ্রামে এসে কবিরাজী অষুধ খেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল সে। সকলে মনে করেলো কিশলু বুঝি বেঁচে গেল!
ইদানিং বুড়িদাদীর কথা ধীরে ধীরে বক্ষ নিংড়িয়ে বের করে আনে কিশলু। তবে কি জন্ম-মৃত্যুর সাথে পাকা বেলের গল্পের এতোটাই মিল! নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলে দেশের আনাচে-কানাচে সব হাসপাতাল সে চষে বেড়াত। কোথাও না কোথাও সে খুঁজে পেত ডাক্তার সাবাকে। উঠানের সেই বেলগাছটা মরে গেছে। সেখানে এখন অন্য একটি গাছ। এই গাছেও নুতন বেল ধরে, বেল পেকে গেল মানুষ ছিঁড়ে নিয়ে যায়। অন্য একটি দাঁড়কাক এসে বসে সেখানে। যখন বেল থাকেনা গাছ ভরে থাকে লতায়-পাতায়। কিশলুর ভেতরটা শুধু কাঁটায় ভরা। একই জাতের দুটি তিল দুই ভাগ হয়ে দুজন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার কোন অর্থ খুঁজে পায় না কিশলু। একভাগ এক সুন্দরী কন্যার দৃষ্টির কিনারায়, অন্য ভাগ তার বক্ষে। ভাগ হয়ে যাবার আগে কি তারা এক বিন্দুতে বসে ছিল? একাত্তর সাল না এলে অনেক কিছু দেখা হতো না কিশলুর। আগে কখনো সে নৌকার ছইতে হেলান দিয়ে কাউকে বই পড়তে দেখনি। দেখেনি ভিজে কাপড়ে এগিয়ে আসা লজ্জারাঙা কোন মুখ। মনে মনে সে অনেক নদী পার হয়ে যায়, তার নৌকায় আর উঠে আসে না হোসেন সাহেবের সংসার কিংবা তার রাজকন্যা।
একদিন একটি নৌকা জোগাড় করে কিশলু গিয়েছিল মাঝ নদীতে। তখনো তার চলার শক্তি ছিল। কষ্ট হলেও একা একা তখন হাঁটতে পারতো। সেদিন নদীতে গিয়ে গুণে গুণে সাতটি উলটো পাক দিয়ে মুক্ত করে দিয়ে এসেছিল সাত পাকের বাঁধন। শুধু সাবাকে একনজর দেখার দাবি ছেড়ে আসেনি। দেখা হওয়াটাই যেন যথেষ্ট। না থাকবে চাওয়া-পাওয়া, না কোন সম্ভাবনা। শুধু আর একবার হাতে হাত ধরা। নদীর পানির দিকে চেয়ে থেকে চোখের পাটাতন খুলে দিয়েছিল সে। সব কিছু ঝরে গেল, শুধু রয়ে গেল একটি আত্মবিশ্বাস। মাঝ নদী থেকে ফিরে আসার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল -তোমার ইচ্ছে হলে আমাকে এখনই নিয়ে যাও। শুধু আমার ইচ্ছে মতো আর একবার দেখতে দাও তাকে। না হলে আমি যতটুকু ছোট তার থেকে তুমি বড় হবে কি করে!
কারো ইচ্ছে ছিল না কিশলুকে আবারো হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার। দিনের বেশির ভাগ সময় যে লোক চোখ বুঝে থাকে তাকে ডাক্তার কবিরাজ করে কি লাভ। সকলে ধরেই নিল কারোর আর করার কিছু নেই। যিনি সব পারেন বোধ হয় তারও কিছু করার নেই। তাই আবারো সেই দোয়া। কষ্ট না দিয়ে তোমার বান্দাকে তুমি নিয়ে যাও। কিশলুর কথা বলার কোন শক্তি ছিল না। থাকলে হয়তো বলতো তোমরা যদি মনে কর তোমাদের ইচ্ছে তিনি পূরণ করে দেবেন তবে ইচ্ছেটাকে কেন অন্যভাবে প্রকাশ কর না। আমি যেন মৃত্যুর মুখ থেকে আর একবার ফিরে আসতে পারি। পাকিস্তান মিলিটারিদের ব্রাশ ফায়ারের পরেও ফিরে এসেছিলাম। ডান পায়ের উরুতে গুলি ফুটে গিয়েছিল। নদীর পারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে ভেবেছিল নদীতে ছুড়ে মারবে। আমি যে নদীর বুকে সাঁতার দিয়ে বড় হয়েছি সে কথা কি সেই মিলিটারিরা জনতো। গুলিতে মরলাম না। নদীতেও ডুবলাম না। সেটা কার দোয়া ছিল। এখন কেন তোমরা আমাকে মরতে বল। আমি মরি না বাঁচি কার তাতে কি। একদিন সুযোগ বুঝে রেনুর পা চেপে ধরলো কিশলু। ইশারা করে বললো তাকে আর একবার হাসপাতাল নিয়ে যেতে। অন্য কেউ হলে তার ইশারা বুঝতে কষ্ট হতো। কিন্তু রেনু ঠিকই বুঝেছিল তার স্বামী আবারো হাসপাতাল যেতে চায়। দুটো পিতলের কলস, একটি নাক ফুল, আর কিছু অতিরিক্ত ধার দেনা করে রেনু তার স্বামীকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। এবার আর ঢাকায় যাওয়া হলো না। তারা গেল খুলনার সদর হাসপাতাল।
রাস্তা-ঘাটের যা অবস্থা। অতোটুকু পথ না এলে হয়তো আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারতো কিশলু। জীবিত না মৃত কিছুই বোঝা যায় না। মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেয়া চাট্টিখানি কথা না। এখনো মাঝে মধ্যে চোখ টেনে তুলতে পারে। কয়েক সেকেন্ড ধরেও রাখতে পারে সেই খোলা চোখ। যদিও পলকেই তা বন্ধ হয়ে আসে। ডাক্তার এলো কি নার্স। হয়তো পাশের বেডের কোন ভিজিটর। শব্দ শোনা মাত্র সে চোখ খুলে তাকেতে চেষ্টা করে। রেনু ঠিকই বুঝতে পারে বন্ধ চোখের পাতার নিচ দিয়ে তার স্বামী এখনো ডাক্তার সাবাকে খুঁজে যাচ্ছে।
দিনের বেশির ভাগ সময় রেনুর করার কিছু থাকেনা। সে চলে যায় এ ডাক্তার, সেই ডাক্তারের খোঁজ-খবর নিতে। তারপর এক সময় ফিরে এসে স্বামীর অচল পা টিপতে শুরু করে। কখনো চোখবোঁজা স্বামীর বিছানায় নিজের হাত দুটো জড়ো করে মাথা নামিয়ে ঘুমিয়ে পরে। এমনি একদিন ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজেছিল, ঠিক তখন নার্স এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিল। তার পর নার্সটি যা বললো, তা শুনে রেনু কান্নায় ভেঙ্গে পরল। কিশলুর সব কিছু বিকল হয়ে গেছে। পা ঠান্ডা হয়ে শরীরের উপরের দিকে উঠছে। বড় বড় শ্বাস টানছে কষ্ট করে। সবুজ একটা সরল রেখা পেছনের মেশিনটাতে ঝুঁকে ঝুঁকে মিশে যাচ্ছে।
কিশলুকে তবুও এই মুহূর্তে মৃত বলা যাবে না। ডাক্তার এসে কাগজ লিখে দিতে হবে তবেই তার মুখ ঢাকা হবে সাদাকাপড় দিয়ে। এলো ডিওটিতে থাকা ডাক্তার মাসুদা। রেনুকে সরিয়ে দিয়ে তিনি রুগীর হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। এক সেকেন্ড দুই সেকেন্ড তিন সেকেন্ড করে অপেক্ষা। মনে হয় না কোন স্পন্দন শোনা যাবে। তবুও নিয়ম বলে কথা। তারপর কি করে যেন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল। আকস্মিক বহু বছরের জমানো আলোকরশ্মি বেড়িয়ে এলো নির্জন দুটি গুহা থেকে। নির্জীব শরীরে জন্ম নিল এক বিজলি চাহনি। পূর্ণকাম দৃষ্টিপাত। ডাক্তার তখনো চেষ্টা করে চলছেন নাড়ির সন্ধান খুঁজে পেতে। তার লক্ষ্য বস্তু ছিল নাড়ির স্পন্দন। তাই তিনি বুঝতে পারলেন না তাঁর দিকে তাকিয়ে মহাপারের যাত্রির দুচোখে ঝরে গেল বৃষ্টিভেজা কান্না। শরীরের সবটুকু শীতলতার ভেতর দিয়েও মুক্তিযোদ্ধা কিশলু তার বাম হাতে অনুভব করল একাত্তুরের মায়াবী উষ্ণতা। এবার তার বিদায়ের পালা।
ব্যাপারটি রেনু লক্ষ্য করল। সেই মুহুর্তে তার মানসিক অবস্থাও ততোটা শক্ত নয়। তবুও সে অঙ্ক কষে বের করে ফেললো মৃত মানুষের চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে পারে না। রেনু ডাক্তার নয়, হয়তো ডাক্তার মাসুদা সে কথার মানে জানেন ভাল। রেনু গ্রামের মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ। সে কি করে অতো কিছু বুঝবে। বড়ই জটিল অঙ্ক। অনুপায়ে সে ডাক্তারের চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো যা ঘটে গেল তা কি অলিখিত পরিণতি নাকি এই ছিল অভীষ্ট। রেনুর নজরে যা এলো তা আর কিছু না। ডিউটিতে থাকা ডাক্তারের ডান চোখের একপ্রান্তে একটি কাঁটাছেঁড়ার দাগ। খুব পুরানো মনে হলো না তার কাছে। হয়তো সেখানেই ছিল সেই কালো তিল।
ডিউটি ডাক্তার মাসুদা ফিরে গেল তাঁর দপ্তরে। সেখানে গিয়ে সে লিখবে ডেথ সার্টিফিকেট। কিশলুর স্ত্রী ডাক্তারেরে পিছে পিছে হেঁটে গিয়ে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করল। এতোক্ষণ লাগে না একটা কাগজে সই করতে। মনে হলো রেনু গিয়ে রাজা-রানির গল্প শুরু করেছে ডাক্তারের সাথে। বেশ কিছুক্ষণ পর ছোট্ট একটা কাগজ বুকের উপর জড়িয়ে ডাক্তারের অফিস থেকে বের হয়ে এলো। কাগজের উলটো দিকে লেখাঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা কিশলু শেখ অদ্য সকাল দশটা বেজে একত্রিশ মিনিটে খুলনা সদর হাসপাতালে শহীদ হন। বহুবছর আগে তাঁর ডান পায়ে গুলি লেগে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল সেই ক্ষত থেকে ছড়িয়ে পরা নানান রোগের কারনে চল্লিশ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়েছে। স্বাক্ষরঃ ডাক্তার মাসুদা হাশমি সাবা।
বিষয়টি নিয়ে নানান কথা বলাবলি হল। খবরের কাগজেও অনেক কিছু লেখালেখি হয়েছে। গুলি লাগার চল্লিশ বছর পর মৃত্যু হলে কাউকে শহীদ বলা ঠিক হবে কি না এ নিয়ে বহু বাকযুদ্ধ হয়েছে। কিশলুর শেষ ইচ্ছে মতো বেল গাছের নিচে তাকে কবর দেয়া হয়। কবরে চারিপাশে বরফি দেয়া বেড়া। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সেখানে এসেও অনেকে শহীদ সংক্রান্ত সেই খবর পড়ে। কিশলুর শহীদ হওয়া প্রসঙ্গ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষের কথা বেল গাছের নিচেও কম হয় না। যখন রেনুর কাছে তার মতামত জানতে চাওয়া হয় সে উত্তর দেয়, ডাক্তার সাবার কথার উপর আর কোন কথা চলে না। রেনু আরো বলে – যাকে নিয়ে এতো কথা সে বেঁচে থাকলেও একই কথা বলতো। অতএব তিনি শহীদ।
বেল গাছের উপর ছিল একটি দাঁড়কাক। রেনুর কথা শেষ হতেই দাঁড়কাকটি উড়ে গেল। কোথায় গেল কেউ জানলো না। ইচ্ছে হলে সে কা কা চিৎকার করে উড়ে যেতে পারতো। অথচ সে গেল সম্পূর্ণ নীরবে। এতোটাই নীরবে যে নিচ থেকে তার ডানার শব্দ শোনা গেল। বলা যায় কেউ শুনতে পেল, কেউ কিছুই শুনলো না।