এক বছর আগে ঠিক এই দিনে ঊনচল্লিশ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় রিফাতের সাথে যে কিনা আমার চেয়ে পাঁচ বছর জুনিওর আর আজ সেই দিনেই আমি মা হলাম এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। জন্মের আগে বাবা মারা যায় আর আমার যখন চারবছর বয়স তখন মা ও আমাকে ছেড়ে চলে যান। অনাথ আমাকে সেদিন বুকে তুলে নিয়েছিলেন সন্তানহীন আমার মামা,মামী। বেশ আদর করতেন মামী তবে তা খুব বেশী স্থায়ী হলোনা আমার ভাগ্যে।
আমার বয়স যখন দশ তখন মামা, মামীর কোল জুড়ে এলো রীমা আর তখন থেকে মামী আমাকে সহ্য করতে পারতেননা। কথায় কথায় বকা, মার চলতো আমার উপর। স্কুলে যাওয়াটাও বন্ধ করে দেয় অবশেষে মামা অনেক হাতে পায়ে ধরে মামীর কাছে আমার লেখাপড়ার পার্মিশন নেন। এরই মধ্যে রীপা, রীতাও এলো মামা, মামীর কোলে।
মামার আর্থিক অবস্থা বরাবরই ভাল ছিল তবু কোথাও আমার জন্য টাকা খরচ করাটা মামী খুব অপছন্দ করতেন অবশ্য আমি ওসব নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। আমাকে লেখাপড়া করতে দিচ্ছে, দুবেলা খেতে দিচ্ছে, কাপড় দিচ্ছে আর কি চাই আমার মতো এক অনাথ মেয়ের!
ধীরে ধীরে আমরা বড় হলাম আর তখন মামী আরও বিরক্ত হতেন। আমাকে বাইরে কারও সামনে যাওয়া বারণ করতেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর থেকে ঘরে বসে টিউশনি করে বাকী লেখাপড়া চালাই। এভাবে প্রাইভেটে ডিগ্ৰী আর মাস্টার্স কমপ্লিট করেই একটা চাকরী পেয়ে যাই কিন্তু তাতে মামীর চরম আপত্তি। তিনি কিছুতেই আমাকে চাকরী করতে দিবেননা এতে নাকি তার মেয়েদের আমি টপকে যাবো। আমিও মেনে নিই আর ঘরের সব কাজ করি।
আমাদের ফ্যামিলি ধার্মিক না হলেও আমাকে মুখ ঢেকে বোরখা পরে চলতে হয় এমনকি কোথাও গিয়েও বোরখার নেকাব খোলার পার্মিশন ছিলনা। নিজের সাহস কোনওদিন হয়নি মামীর কথার অবাধ্য হবো আর নাহলে তো মামী আমাকে বাড়ী থেকে বের করে দিবে। তাই কখনও কাউকে স্বপ্ন দেখাও পর্যন্ত হয়নি।
রীমার,রিপার বিয়ে হলো, আমাকে তখনও কারও সামনে যেতে দেয়া হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানেও আমি ছিলাম বন্দী। অনেক অনুরোধ করেছিলাম আমি আর মামা আমাকে বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে দিতে মুখ ঢেকে বোরখা পরেই কিন্তু মামী রাজী হননি। তবে আমার বিয়েও মামী ঠিক করে রেখেছেন, রীতার বিয়ের পরই আমাকে বিয়ে দেবেন তার ভাইয়ের ছেলে আদনানের সাথে যার আগের দুই বৌ চলে গেছে আদনান, ওর মা আর বোনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে। মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ এসবই তার নেশা। লেখাপড়া ম্যাট্রিকটাও শেষ করেনি। কোনও কাজ কর্ম না করে বাবার ব্যবসার টাকায় ফুর্তি করে বেড়ায়। এমনকি আগের দুই বৌয়ের দুই বাচ্চাকেও ওদের মায়ের থেকে ছিনিয়ে রেখে দিয়েছে তাদের কাছে। রীতার বিয়ের জন্য বরপক্ষ দেখতে এসেছে। ছেলে ডাক্তার, খুব বড়োলোক আর দেখতেও নাকি রাজপুত্র। আমাকে বলা হলো আমি যেন আমার রুম থেকে বের না হই আর অভ্যাসবশত আমি সেটাই করি।
হঠাৎ কেউ আমার দরজা নক করলে মামীকে ভেবে দরজা খুলে দিই, অমনি এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা রুমে ঢুকলেন আর মামী পেছন থেকে চিল্লাচ্ছেন, আপা এইরূমে না,আমার সাথে আসুন। কিন্তু ভদ্রমহিলা কিছু না শুনেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে বাথরুমে ঢুকে ওযু ওযু করে বের হলেন। আমি জায়নামাজ বিছিয়ে দিলাম, তিনি নামাজে বসে গেলেন আর আমিও আরেকটা জায়নামাজ নিয়ে নামাজ সারলাম। তিনি নামাজ সেরে উঠলে আমি জায়নামাজ তুলে রাখছি হঠাৎ খেয়াল করলাম তিনি আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে হাসছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলামনা শুধু জিজ্ঞাসা করলাম, উনার কিছু লাগবে কিনা। উনি আমাকে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন আর আমিও বললাম। তখন তিনি আমাকে ড্রইংরুমে যাবার কথা বললে আমি মানা করি। এরই মধ্যে মামী আবারো আমার রুমে আসেন। তোড়জোড় করে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে যাবেন, কিন্তু তিনি সমানে আমাকে বলে যাচ্ছেন তার সাথে ড্রইংরুমে যেতে। মামী ওপাশ থেকে চোখ রাঙিয়ে আছেন। কিছুতেই যাবোনা আমি তাই তিনি মামীর সাথে ড্রইংরুমে ফিরে গেলেন।
কিছুক্ষন পর তিনি তার মেয়েকে নিয়ে আবার এলেন আর মামীও তীব্র বিরক্ত নিয়ে পেছন পেছন এলেন। এবার প্রায় জোর করেই আমাকে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন। আর সেখানে গিয়ে বললেন তিনি আমাকে তার পুত্রবধূ করতে চান রীতাকে নয়। উনার হাজবেন্ড আর ছেলেসহ বাকিরা সবাই আমাকে দেখলেন তবে তারা কেউ কিছু বলছেননা।
হঠাৎ মামা আবেগের চোটে মামীকে কোনও রকম কেয়ার না করেই বলতে লাগলেন, আমার ভাগ্নিটাকে আপনাদের বাড়ীর বৌ করে নেন, হলফ করে বলতে পারি আপনারা ঠকবেননা।
একটা ভদ্র, বিশাল মনের বৌ পাবেন বাড়ীতে যে কিনা বাড়ীর সবার দায়িত্ব নিয়ে বাড়িটাকে শান্তিপুরী বানিয়ে দেবে। মা, বাপ্ মরা মেয়ে আমার, অনেক কষ্ট আমরা দিলেও আজ অব্দি মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত আর প্রতিবাদতো দূরের কথা। সকল কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। ঊনচল্লিশ বছর হয়ে গেল, আমরা বিয়েটা পর্যন্ত মেয়েটার দিইনি অথচ এতো সুন্দর, শিক্ষিতা আর গুণবতী আমার মেয়েটা। এখনও দেখলে ওকে বিশ কি বাইশ বছর বললেও যে কেউ বিশ্বাস করবে অথচ ওর বয়স উনঊনচল্লিশ বছর। ওর ছোট আমার মেয়েগুলো তাদের বিয়ে দিয়েছি কিন্তু…. বলেই কাঁদতে লাগলেন মামা।
ওদিকে মামী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মামার দিকে কিন্তু সবাই থাকার কারণে কিছু বলতে পারছেননা আর মামাও যেন আজ বেশী রকম সাহসী হয়ে গেলেন, মামীর অগ্নিচক্ষু কেয়ার করছেননা। mছেলের ফ্যামিলি কয়েকমিনিট সময় চাইলেন নিজেদের ভেতর কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। আমি আমার রুমে চলে এলাম। সবাই ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে ছেলেপক্ষকে সুযোগ করে দিলো কথা বলার জন্য। এদিকে মামীতো রেগে আগুন হয়ে আছেন। ডাক্তার ছেলে তারউপর বড়োলোক আর এডুকেটেড ফ্যামিলি অথচ আমার জন্য মামীর আশা ভেঙে যাচ্ছে। আমারও খুব খারাপ লাগছে যে আমার জন্য আমার ছোটোবোনটার বিয়েতে ব্যাঘাত ঘটছে।
একটু পরেই রীতা আমার রুমে এলো আর আমি রিতাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলাম। রীতা আমাকে আশ্বস্থ করলো যেন টেনশন না করি। আমি অবাক হলাম রীতার কথায়। রীতা জানালো ওরা রীতাকে পছন্দ করলেও রীতা নিজে এই বিয়ে ভাঙতো ফ্যামিলিকে না জানিয়ে কারণ রীতার একজনের সাথে এফেয়ার আছে আর সেই ছেলেকে ছাড়া রীতা কাউকে বিয়ে করবেনা। ছেলেটা স্টাডি কমপ্লিট করে দুমাস পরেই অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরবে। আর তখন সে তার ফ্যামিলি নিয়ে আসবে রীতাকে বিয়ের জন্য।
আমি অনেক খুশী হলাম এই ভেবে যে আমার জন্য আমার বোনটাকে কষ্ট পেতে হয়নি। আধঘন্টা গড়িয়ে পৌনে একঘন্টা হলো, ওই পক্ষ কেউ ফোনে কারও সাথে কথা বলছে আবার কেউ নিজেরা ওখানে কথা বলছেন। এরই মধ্যে মামাকে তারা ডাকলেন, মামীও সাথে গেলেন। তারা জানালেন পাত্র আমার সাথে আলাদা কথা বলতে চান। কারণ তাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে এখন মেয়ে যদি পাত্রের সাথে কথা বলে পজিটিভ সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে আজই তারা ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বৌ নিয়ে বাড়ী যাবেন আর বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান পরে তারিখ ঠিক করে করবেন।
তাদের এই সিদ্ধান্ত মামী কিছুতেই মানতে পারছিলেননা, বিভিন্ন কথা বলে বিয়েটা ভাঙানোর চেষ্টা করেন কিন্তু মামা অবিচল। মামার এই রূপ আমি আমার সারাজীবনেও দেখিনি। মামার যে জেদ বলে কিছু আছে আমরা এই প্রথম বুঝতে পারলাম যার ফলে মামীও আর কিছু বলতে সাহস পাননি। ছেলের সাথে আমাকে আলাদা কথা বলতে দেয়া হয়। আমি নিজের বয়সের কথা তুলতেই উনি বললেন, বয়স বেশী তাতে কি! আমাদের ধর্মে কি কোথাও লেখা আছে যে স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর থেকে কম বয়স হতে হবে! আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে এখন আমাকে যদি আপনার পছন্দ হয় তবেই বিয়েটা হবে।
আমি শুধু বললাম, আমার সিদ্ধান্ত মামা আর মামীর। অনাথ আমাকে যদি মামা মামী কোলে তুলে না নিতেন তাহলে আজকের আমি কোথায় থাকতাম! তাই তারা যেই সিদ্ধান্ত নেবেন আমি সেটাই সম্মানের সাথে গ্রহণ করবো।
রিফাত সাহেব তখন বললো, সে না হয় করলেন, অন্তত এটুকুতো বলবেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে কিনা! আমিতো এমন মেয়ে বিয়ে করবনা যে আমাকে পছন্দ করবেনা। আমি লজ্জায় যেন তাকাতে পারছিনা। মনে মনে বলছি, আপনাকে অপছন্দ কেউ কি করতে পারে! আর আমার মতো মেয়ের জন্য আপনিতো স্বয়ং আশীর্বাদ যে কোনওদিন ভাবেইনি কোনও স্বাভাবিক বিয়ে তার হবে। মুখে শুধু বললাম, আমি বলতে পারবনা।
হুম, জানেনতো আমি বেশ বুদ্ধিমান আর তাই হয়তো আমি বুঝে গিয়েছি যে আমাকেও আপনার পছন্দ হয়েছে যেমনটা আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কি ভুল বললাম! বললো রিফাত। আমি তখনও কিছু বলতে পারিনি, লজ্জায় যেন মাথা আরও নীচু হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে গেল আমার আর রিফাতের একদম সাদামাটাভাবে তবে বিয়ের ঠিক ১৪ দিন পর আমার শ্বশুরবাড়িতে বিশাল রিসেপশনের আয়োজন করা হয়, খুব খুব ভাল আছি আমি আমার সংসার নিয়ে অথচ কোনও এক সময় ভাবতাম বিয়েটা আমার জন্য নয় অথচ আজ আমি এক কন্যার জননী, এক গর্বিত স্ত্রী আর এক সুখী পরিবারের বৌ অবশেষে আমারও বিয়ে হলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প