নাম নিয়ে যত কথা

পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম নিয়ে অনেকেই গবেষনা করেছেন। আমি তেমন কোন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম নিয়ে কোন আলোচনা করব না। অথবা ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ এ ধরনের নাম নিয়েও আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়। বলব অতি সরল সোজা একজন মানুষের একটি সরল নাম নিয়ে।
তার নাম মরু মিয়া।

মরু মিয়ার উচ্চতা চার ফুট কয়েক ইঞ্চি, ওজন ৮০ পাউন্ড, মাথার চারদিকে কাচাপাকা চুল। মাঝখানে খালি। মুখে সব সময় একটা হাসি হাসি ভাব। আসলে তার চেহারাই এমন। মনে হয় হাসছে। অচেনা মানুষের দিকে তাকালে অনেকে ভুল করে। মনে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

মরু মিয়া বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকুরি করে। পিয়ন। লেখাপড়া কিছুই জানে না। তবে চাকরির ব্যাপারে সামান্য লেখাপড়া জানা প্রয়োজন। সে যখন দরখাস্ত করে তখন সে লিখেছিল সিক্স পাশ। চাকরির প্রয়োজনে মিথ্যা লিখেছিল। আর একটা মিথ্যা লিখেছিল তার বয়স। তাও লিখেছিল চাকরির প্রয়োজনে। লিখেছিল তার বয়স পঁচিশ। আসলে তখন তার বয়স চল্লিশের উপর। দুই হালি ছেলেমেয়ে। তাও দরখাস্তে উল্লেখ ছিল। চাকরি হবার পর মেডিকেল কার্ড করতে গিয়ে দেখা গেল একটা বিরাট অসঙ্গতি। ঐকিক নিয়মেও সে অংক মিলানো যাচ্ছে না। কার্ড করতে গেলে একটা ফরম পূরন করতে হয়। ছেলেমেয়ের নাম, বয়স ইত্যাদি। মরু মিয়ার কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স বার বছর। প্রথমত বলেছিল দশ বছর। জেষ্ঠ সন্তানের বয়স আঠার হলে এক বছর পর পর যদি আরও সাতটি সন্তানের নাম বসানো হয় তাহলে অংক মিলেনা। সন্তান প্রসবের সময়ও এক বছরের কম করা যায় না। আবার মরু মিয়ার বয়স পচিশ রেখে সন্তান প্রসবের বয়স বের করতে হবে। শেষ পর্যন্ত জেষ্ঠ সন্তানের বয়স বার ধরে মরু মিয়ার সন্তান প্র্রসবের বয়স করা গেল তের বছর এবং কনিষ্ট সন্তানের বয়স করা হল পাচ। কারন মরু মিয়া বড় সাহেবের লোক। চাকরি রাখতে হবে এবং তার সব কটা সন্তানের চিকীৎসার সুযোগ থাকতে হবে। ছোট সাহেব কিভাবে কি করেছিল কেউ জানে না। তবে মরু মিয়ার কোন অসুবিধা হয়নি কোনদিন।

দরখাস্তে সই করতে গিয়েই তাকে নাম সই করা শিখতে হয়েছে। শুধু চারটি অক্ষর দিয়েই তার নাম লেখা যায়। অতি সহজেই সে তার নামটা স্বাক্ষর করতে শিখে ফেলল। চাকরি হয়ে গেছে আর কোন চিন্তা নেই। শুধু বেতনটা আনার সময় সই করতে হয়। চাকরির কাজে আর কোন সই লাগে না। মরু মিয়া লেখাপড়া জানে কিনা তা কেউ কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি। কোন ঝামেলা হয়না। কিন্তু এই নামটা নিয়ে একদিন যে ঝামেলা বাধবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। আর এই ঝামেলাটা কি ধরনের সেটাই পাঠকের কাছে তোলে ধরব।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মচারি ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। দাবী আদায়ে ব্যর্থ হয়ে কর্মচারিরা যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছে। কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে। মামলা হয়েছে গভীর রাতে। কার নাম আছে কেউ জানে না। ইউনিয়নের নেতারা পলাতক। মরু মিয়া ইউনিয়নের কেউ নয়। সে কোন সাতে পাঁচে নেই। তার নাম থাকার প্রশ্নই আসে না।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার কাজ হল একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ফকিরাপুলের বাজারে যাওয়া। সেদিনও সে তার বাজারের বেগটা হাতে নিয়ে বাজারে রওয়ানা দিল। ব্যাংক কলনির গেইটের কাছে যেতেই পুলিশ তাকে নাম ধাম জিজ্ঞেস করে তাদের গাড়ীতে উঠিয়ে নিল। মরু মিয়া কিছুই বুঝতে পারল না। সে তার বাজারের বেগটা হাতে নিয়েই পুলিশের গাড়ীতে উঠে বসল। এভাবে সেদিন তিন চারজন গ্রেফতার হল। জানা গেল মোট আসামি ২৭ জন। বাকী আসামিরা পরবর্তিতে কোর্টে আতœসমর্পন করল। জামিন হল না। এই ২৭ জনকে জেলখানায় পাঠানো হল। জেলখানার কর্মরত সাহেব এক এক করে সকলের নাম লিখছে, আর খাতার নম্বর বলছে। তখনই জানা গেল জেলখানার আলাদা খাতা আছে। আমরা বাংলা খাতা, অঙক খাতা, হাল খাতা ইত্যাদি খাতার সাথে পরিচিত। কিন্তু জেলখানার খাতার একটা আলাদা অর্থ আছে। জেলখানার ভেতর প্রতিটি অট্টালিকার নাম্বার আছে। কোন্ দালানে কতগুলি আসামী আছে তা লেখা থাকে একটা বড় মোটা খাতায়। সেখানে নাম্বার থাকে কোন দালানের এই খাতা। এই ২৭ জনকে পাঠিয়ে দিল ভিবিন্ন খাতায়। মরু মিয়ার নামটি লেখা হল দশ নম্বর খাতায়।
১৯৭৬ সাল। তখন দেশে ইংরেজি হটাও আন্দোলন জোরদার। সব অফিস আদালতে বাংলা চালু হচ্ছে। ইংরেজির বদলে এখন বাংলা চলবে। কিন্তু অনেকদিনের অভ্যাস অনেকেই রাতারাতি বদলাতে পারেনি। কোন কোন অফিসে বাংলা ইংরেজি দুটোই চলছে। কিছু বড় সাহেব আছেন যারা বাংলা লিখতে পারে না বা ভাল বুঝেন না, তাদের জন্য ইংরেজি লেখা হয়। জেলখানায় তখন তেমনি রাজত্ব চলছে। কোন কোন পন্ডিত তাদের মনগড়া তরজমা করে।

দশ নম্বর খাতায় মরু মিয়ার নাম ঠিকানা লিখে জেলের কর্মচারি বললেন, সই কর। মরু মিয়া পাঁচ মিনিট নিয়ে সই করল। এখানে বলে রাখা ভাল, মরু মিয়া সই করতে গেলে তার ‘ম’ হয়ে যায় ‘স’ এর মত। তারপর মরুমিয়াকে পাঠিয়ে দেয়া হল দশ নম্বর দালানে। পাঁচ শত আসামির সংকুলান এই দালানে তখন পাঁচ হাজার আসামি। দাড়াবার জায়গা নেই। এভাবেই থাকতে হবে।

এক দিন পর ইউনিয়নের চেষ্টায় এই সাতাশ জনকে ভিবিন্ন খাতা থেকে সংগ্রহ করে আনা হল পাঁচ নম্বর খাতায় এবং একটি বিরাট হল দেয়া হল। যাক, অন্তত সবাই এক সাথে আছে।

পরের দিন সকালে জেলের একজন কর্মচারি একটা খাতা হাতে নিয়ে এসে সবাইর নাম ধরে ডাকছে। উদ্দেশ্য, আসামিরা ঠিক আছে কিনা, কেউ পালিয়ে গেল কিনা তা পরিক্ষা করা। একে একে সবাইর নাম ডাকা হচ্ছে, যার নাম ডাকা হচ্ছে সে উত্তর দিচ্ছে। যখন সরু মিয়া ডাকা হল তখন কেউ উত্তর দেয়নি। সব নাম ডাকা হয়ে গেলে জেলের কর্মচারি গুনে দেখল সাতাশ জন আছে। তাহলে? মরু মিয়া এগিয়ে এল। বলল, আমার নাম কই?
কি নাম তোমার?
মরু মিয়া।
তাহলে এটা ভুল হয়েছে। লেখা হয়েছে সরু মিয়া। কর্মচারি বলল আচ্ছা, ঠিক করে নিচ্ছি। তারপর বড় সাহেবের কাছে পাঠানো হল ইংরেজি লিষ্ট। লেখা হল: সধৎঁ সরধ. সেই লিষ্ট ধরে আবার বাংলা হবে, পরের দিন আবার ডাকা হবে।

জেলের কর্মচারি প্রতিদিন বদল হয়। সেদিন সকালে এসে সবাইর নাম ডাকা হল। মরু মিয়ার নাম ডাকা হল মারু মিয়া। কারন ইংরেজি থেকে আবার বাংলা হয়েছে। তাতে মরু মিয়ার কোন অসুবিধা নেই। সে উত্তর দিল ‘হাজির’।

তারপরের দিন হল মেরু মিয়া। মরু মিয়া বলল, যে নামটা ডাকলে কেউ উত্তর দিবেনা সেটাই আমার।
তার পরের দিন ডাকা হল সেরু মিয়া।

তারপর হল সারু মিয়া। মরু মিয়ার কোন চিন্তা নেই। বলল, এখান থেকে কোন রকমে বের হতে পারলেই হয়। নামে কি আসে যায়।

কোর্টে হাজিরা দিবার দিন সকালে হল আরও পরিবর্তন। কোন পন্ডিত মহাশয় তরজমা করেছেন মরা মিয়া।

মরা মিয়া ডাকার পর মরু মিয়া উত্তর দেয়না। বলল, সব নামের উত্তর দিয়েছি। এই মরা নামের উত্তর দেয়া যায়না।

সব নাম ডাকার পর কর্মচারি জিজ্ঞেস করল আর একজন কই?
একজন উত্তর দিল, আছে আর একজন। তবে তার নামটা ভুল হয়েছে। চেক করে দেখুন। নামটা হবে মরু মিয়া।
আচ্ছা, ঠিক করে নিচ্ছি।
কোর্টে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। আজকেই সবাই রিলিজ পেয়ে যেতে পারে। মরু মিয়া তার বাজারের ব্যাগটা হাতছাড়া করেনি। ব্যাগে এখন তার কাপড়চোপড় রাখে। তারপর প্রিজন ভ্যানে করে সবাই কোর্টে হাজির হল।

বিচারক একে একে সবাইর নাম ডাকছে। মরু মিয়ার নাম ডাকা হল সারু মিয়া। মরু মিয়া ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, হাজির। মরু মিয়া ভাবল, বিচারকের মুখের উপর কথা বললে বেয়াদপি হবে। হিতে বিপরিত হবে। তাই নাম নিয়ে কোন প্রতিবাদ করেনি।

শুনানিশেষে বিচারক রায় দিলেন বেকসুর খালাস। এই সাতাশ জন সবাই নির্দোষ। রায় শুনে সবাই আনন্দে আতœহারা। এখন ঘরে ফিরে যাবে সবাই। কিন্তু এখান থেকে নয়। আবার জেলখানায় যেতে হবে। পরিক্ষা করে, নাম ধাম মিলিয়ে দেখে তবেই ছাড়বে। সবাইকে যেতে হল আবার জেলখানায়। কে কোন্ খাতায় ছিল, কিভাবে দশ নম্বরে এল, সময় তারিখ মিলিয়ে এই সাতাসজনের একটা তালিকা করতেই চলে গেল কয়েক ঘন্টা। ছাব্বিশ জনের একটা পরিস্কার লিষ্ট হল।

এই সাতাশ জনের আত্মীয়স্বজন ফুলের মালা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। মরু মিয়ার শালক থাটারি বাজার থেকে বেশ বড় একটা মালা কিনে বাইরে অপেক্ষা করছে। সবাই একে একে বের হয়ে আসছে, আর ফুলের মালা গলায় দিয়ে, মামা বাড়ী নয়, নিজের বাড়ীতে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু মরু মিয়া কোথায়? সবাই তো চলে গেছে! মরু মিয়ার কি হল। এ ধরনের আনন্দ কালে কারও খবর কেউ রাখে না। সবাই আনন্দে উৎফুল্ল। নিজের আত্মীয় স্বজন নিয়ে উল্লাস ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্থ থাকে। সবাই বেকসুর খালাস। ভাবনার কিছ নেই। কিন্তু মরু মিয়া যে এমন একটা গ্যাড়াকলে আটকা পড়বে তা কে জানত! মরু মিয়াও কি জানত? তাহলে তো সে বিচারক যখন তার নামটা ভুল ডাকল তখনই প্রতিবাদ করত। করেনি। এখন তার মাশুল দিচ্ছে।

জেলের সাহেবরা কোর্টের অর্ডার নিয়ে, খাতার সাথে নাম ধাম মিলিয়ে তবে ছেড়ে দেয়। কোর্ট অর্ডারে মরু মিয়ার নাম লেখা হয়েছে সারু মিয়। তারা খোজে দেখল এ ধরনের কোন নাম জেলখানায় আসে নাই। মরু মিয়া চিৎকার করে বলছে, আমিই সারু মিয়া। কিন্তু মরু মিয়া বললেই তো হবে না। চাই প্রমান। আসলে সে কে? নাকি নিজের নাম গোপন করছে। জেলের সাহেবরা এ নিয়ে একটা মিটিংএ বসল। প্রথম যে খাতায় প্রবেশ করেছে, প্রতিদিনের হাজিরা খাতা ইত্যাদি সব পরিক্ষা করছে। ভিবিন্ন খাতায় ভিবিন্ন নাম। ওরা নিজেরই বোকা হয়ে গেছে। এটা তো কম্পি­কেটেট কেইস। সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। জেলার সাহেবের অনুমতিক্রমে যা কিছু করতে হবে। অতএব পাঠানো হল জেলার সাহেবের অনুমতির জন্য।

মরু মিয়ার শ্যলক মালা হাতে জেলের সামনে ঘুরাঘুরি করছে। সারাদিনে মালা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত যখন মরু মিয়া বের হলনা তখন তার শ্যালক দারোয়ানকে সব কথা বলল। বলল, আমি ভেতরে সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই। সে ভেতরে গিয়ে সাহেবের কাছে জানতে পারল মরু মিয়াকে আবার পাঁচ নম্বর খাতায়া পাঠিয়ে দিয়েছে। তার নামে গন্ডগোল। এখন জেলার সাহেব যদি অনুমতি দেয় তবেই তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে আজকে হবে বলে মনে হয়না। কারন জেলার সাহেব এখন মিটিংএ আছেন। মিটিং চলবে রাত দশটা পর্যন্ত। মিটিং শেষে তিনি আজ আর কোন ফাইল দেখবেন না।
শ্যালক মালা নিয়ে ঘরে ফিরে গেল।
মরু মিয়া ছাড়া পায়নি শুনে তার স্ত্রী দিশেহারা হয়ে গেল। এখন কি করবে! কার কাছে কি বলবে ভেবে পেল না। ইউনিয়নের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে পাওয়া গেল না। সবাই ছাড়া পাবার আনন্দে উৎসব উদযাপন করছে। কে কোথায় কেউ বলতে পারে না। তাহলে? ব্যাংকের বড়সাহেবদের কারও কাছে সব বলবে? রাত কেটে গেল এসব ভাবতে ভাবতে। পরের দিন ইউনিয়নের নেতাদের দুএকজনকে পাওয়া গেল। শুনে তারাও চিন্তায পড়ল। এখন কি করা যায়! একমাত্র জেলার সাহেব এই ঝামেলা শেষ করতে পারে। আর ঝামেলাটা বাধিয়েছে জেলের কর্মচারি। একথা বলা যাবে না। তাহলে আরও ঝামেলা হতে পারে। নেতারা খুজতে লাগল জেলার সাহেবের সাথে কার পরিচয় আছে। তাহলে সুপারিশ করা যাবে। তারা আবার মিটিংএ বসল। মরু মিয়াকে কিভাবে সাহায্য করা যায়, কিভাবে বের করা যায়।

একজন নেতা রফিক বলল, আমার বোনের শ্বশুর জেলার সাহেবের শিক্ষক শুনেছি। তাঁকে দিয়ে সুপারিশ করালে কাজ হবে মনে হয়।

ইউনিয়নের সেক্রেটারি বলল, তোমার প্রস্তাব হাতে রাখলাম। এত সব না ভেবে আমরা কয়েকজন মিলে জেলার সাহেবের সাথে দেখা করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি না কেন? সবাই এক বাক্যে রাজি হল। পরের দিন পাঁচজন রওয়ানা দিল জেলার সাহেবের সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায় নিয়ে। জানা গেল, জেলার সাহেব আজকে খুব ব্যস্ত। আগামী কাল দেখা হতে পারে বিকেলে। পরের দিন বিকেলে তারা জেলার সাহেবের সাথে দেখা করে সব বলল। শুনে জেলার সাহেব বললেন, তার নামে এত ঝামেলা হল কেন তা ইনকোয়ারি হচ্ছে। আমরা পুলিশ, আমাদের কাজই হল মানুষকে সন্দেহ করা। কে জানে সে হয়ত কোন দাগী আসামি। নাম গোপন করছে। দুএকদিনের মধ্যেই সব জানা যাবে। সব পরিস্কার হলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কোন চিন্তা করবেন না। কাউকে অযথা আটকে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

নেতারা সেখান থেকে ফিরে পরামর্শ করল। এখন একমাত্র উপায় রফিকের বোনের শ্বশুড়কে অনুরোধ করা। কারন ইনকোয়ারির নামে কত দিন লাগে কেউ জানে না। এক বছর দুবছর লেগে গেলে করার কিছুই থাকবেনা। যেমন জেলে দুএকজনের সাথে আলাপ করে জেনেছে ওরা জেলে আছে পাঁচ সাত বছর। কারও ইনকোয়ারি হচ্ছে, আবার কেউ জানেইনা তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ। কাজেই বসে থাকলে চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের করে আনতে হবে। রফিকের বোনের শ্বশুর থাকেন মানিকগঞ্জ। একটা অজ পাড়াগায়ে। চলাফেরা খুব একটা করতে পারেন না। সিদ্বান্ত হল রফিক আজই চলে যাবে মানিকগঞ্জ। যেভাবেই হোক শিক্ষক মহাশয়কে নিয়ে আসবে। রফিক আর ঘরে আসেনি। সোজা চলে গেল মানিকগঞ্জ।

রাত দশটায় রফিক গিয়ে পৌছল তার বোনের শ্বশুর বাড়ী। বোনের জামাই থাকে কুয়েত। বাড়ীতে পুরুষ আর কেউ নেই। তাকে দেখে তার বোন আনন্দে খুশিতে নেচে উঠল ঠিকই, কিন্তু কান্নাজড়িত ভাবে। বলল, তুমি এসেছ খুব ভাল সময়ে। কি করব কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। আমার শ্বশুড়ের অবস্থা খুবই খারাপ। হাপানী এখন নিউমুনিয়া হয়ে গেছে। আজ ডাক্তার বলে গেছে এখানে তার চিকীৎসা হবেনা। তিনি এখন অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। এখন কি করি!

রফিক তার তায়ৈ সাহেবের পাশে গিয়ে বসল। তিনি কোন কথার উত্তর দিতে পারছেন না। খুব জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছেন। খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় এই বুঝি শেষ হয়ে গেল! এ অবস্থা দেখে রফিক সিদ্বান্ত নিল ঢাকা নিয়ে যাবে। এখানে থাকলে তিনি বাঁচবেন না। এত রাতে এখানে কিছুই পাওয়া যাবে না। তাই সকালের অপেক্ষায় রইল।

পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে প্রয়োজনে তাড়িত করে। রফিক মরু মিয়ার কথা ভুলে গেল, কেন এসেছিল তাও ভুলে গেল। এখন মুমূর্ষ রুগীকে বাঁচাতে হবে। সকাল হতেই নৌকা, তারপর রিক্সা, সবশেষে বেবি ট্যক্সিতে এসে পৌছল ঢাকা মেডিকেলে। জরুরী বিভাগে ভর্তি করে স্বস্তি পেল। এখন বেলা চারটা। কাল বিকেল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। বাইরে থেকে কিছু খেয়ে আবার এসে রুগীর পাশে বসল। মনে মনে বলল, যাকে আনতে গিয়েছিলাম, তাঁকে নিয়ে এসেছি! কে আগে বের হবে কে জানে! মরু মিয়া না তায়ৈ সাহেব! তারপর ডাক্তার খোজা শুরু করল। পরিচিত ডাক্তার খুজছে, না হয় ভাল চিকীৎসা হবে না। ইউনিয়নের সেক্রেটারির ছোট ভাই পড়ে এখানে। সেক্রেটারিকে খবর দিল। সে তার দলবল নিয়ে এসে হাজির। খুজে খুজে কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে এল। সবাইকে বলল, এই রুগীকে বিশেষ চিকীৎসা দিতে হবে। সেভাবেই চিকীৎসা চলল। তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।
ওদিকে মরু মিয়ার স্ত্রীর যন্তনায় কোন নেতা ঘরে থাকতে পারছে না। প্রথমত সে নেতাদের অনুরোধ করছিল। যখন দেখল এক সপ্তাহ চলে গেছে তখন তার মুখে মধু ঝরতে লাগল। পৃথিবীর যত রকম নোংরা গালিগুলি আছে তা বর্ষন করতে লাগল নেতাদের ঘরে ঘরে গিয়ে। নেতারা এখন পলাতক, পুলিশের ভয়ে নয়, গালির ভয়ে। এখন সবাই রুগীকে নিয়ে ব্যস্ত। বাচাতে হবে। না হয় সুপারিশ হবে না। সুপারিশ না হলে মরু মিয়া ছাড়া পাবে না।

ডাক্তারের অক্লান্ত চেষ্টায় ছয়দিন পর রুগীর অবস্থা ভালর দিকে গেল। সাত দিনের মাথায় তিনি কথা বললেন। এখনই সুপারিশের কথা বলা হবে অমানবিক। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল, আরও একটু ভাল হোক।

দশদিনের মাথায় যখন রুগি অনেকটা ভাল, তখন রফিক কথাটা বলল। শুনে তিনি বললেন, আমি তো যেতে পারব না। তুমি একটা নোট লেখ আমার নামে। আমি সই করে দিব, তা নিয়ে তুমি গেলেই হবে।

রফিক শিক্ষক মশায়ের চিঠি নিয়ে জেলার সাহেবের সাথে দেখা করে সব বলল। শুনে জেলার সাহেব যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। তিনি যেন জেলার নন, একজন শিক্ষকের একজন বাধ্যগত আদরের ছাত্র। বললেন, স্যার এতদিন হাসপাতালে, আমাকে কেউ খবর দেয়নি। আর্দালিকে ডাকলেন, হাতে টাকা দিয়ে বললেন রুগীর যতরকম পথ্য লাগে সব কিনে আন। আর ড্রাইভারকে বল রেডি থাকতে। অনেক ফল মূল নিয়ে তিনি হাসপাতালে এলেন। কদমবুসি করে মাথা নত করে দাড়িয়ে রইলেন। যেন নিজেই এখন আসামী। শিক্ষক ছাত্রের মাঝে অনেক কথা হল। তারপর এক সময় জেলার সাহেব বললেন, আপনি যে কয়দিন হাসপাতালে আছেন তত দিন আমি যখনই সময় পাই একবার আসব দেখতে। আপনার যা লাগে আমার ড্রাইভার প্রতিদিন আসবে, তাকে বলবেন। আর মরু মিয়া কালই ছাড়া পেয়ে যাবে। আমি সব ব্যবস্থা করব।

তারপরও নিয়ম আছে। মরুমিয়াকে বের করতে জেলার সাহেবেরও বেশ সময় লাগল। মরু মিয়া ছাড়া পেল একবারে সন্ধ্যার সময়। দিনের আলো না থাকায় জেলখানার সামনের টিম টিম আলোতেই দেখা গেল মরু মিয়ার চোখগুলো চিক চিক করছে। আনন্দাশ্র“! হাসতে হাসতে রফিকের দিকে এগিয়ে এল। গলা জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলল। তার স্ত্রী,সন্তান, শ্যালক সবাই শান্তি স্বস্থির নি:শ্বাস ফেলল। সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। কারো হাতে কোন মালা ছিল না। দুটো জিনিষ মরু মিয়া অক্ষত অবস্থায় নিয়ে এল, এক তার আসল নামটা, আর বাজারের ব্যাগটা। কোনটাই হাতছাড়া হয়নি।

এই প্রবাসে অনেকের নামের কিছু অক্ষর পরিবর্তন হয়ে গেছে। মরু মিয়ার মত তারাও ঝামেলায় পড়লে কেউ দায়ী হবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত