রুম নাম্বার ২১৭

নিউ ইয়র্কে স্থায়ী হয়েছি।
জ্যামাইকায় বিশাল বাড়ি ভাড়া করেছি। দোতলা বাড়ি। বেসমেন্ট আছে, এটিক আছে। বাড়ির পেছনে বারবিকিউ করার জায়গা আছে। নানান আসবাবে বাড়ি সাজানো হয়েছে। শোবার ঘরে কিছু যন্ত্রপাতিও বসানো হয়েছে, এর মধ্যে একটির নাম ‘হিউমেডিফায়ার’। এই যন্ত্র থেকে সারাক্ষণ গোঁ গোঁ শব্দ হয়। আধো ঘুম আধো জাগরণে মনে হয় কাউকে যেন গলা টিপে মারা হচ্ছে। সে কাতরাচ্ছে মৃত্যুযন্ত্রণায়। যন্ত্র বন্ধ করতে পারি না। ডাক্তারের নির্দেশ, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ আমার শরীরের জন্য ভালো_এমন পর্যায়ে রাখতে হবে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি ভৌতিক শব্দের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে।
শাওন চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার। তার ধারণা, যেই মুহূর্তে আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসব সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমার রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করবে।

আমার মায়েরও দেখি একই ধারণা। তিনি শাওনকে টেলিফোন করে প্রথমেই বলেন, বৌমা! হুমায়ূন কি কাগজ-কলম
নিয়ে বসেছে?
শাওন হতাশ গলায় বলে, না।
তাঁর হাতের কাছে কাগজকলম আছে তো?
সব আছে। সে চেয়ার-টেবিলে বসে লিখতে পারে না, মাটিতে বসে লেখে। ওর লেখার জন্য টুল কিনেছি। টুলের সামনে নরম উলের শ্যাগ কার্পেট বিছিয়ে রেখেছি।
মা বললেন, চেষ্টা করে দেখো ওকে ভুলিয়েভালিয়ে লেখার টেবিলে বসাতে পারো কি না। একবার কলম হাতে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ।

আমার সমস্যা হচ্ছে, কলমকে আমার বিষাক্ত মনে হচ্ছে। কিছুই লিখতে ইচ্ছা করছে না; বরং মনে হচ্ছে এক জীবনে অনেক লিখেছি, আর কত! প্রথম যৌবনে রাত জেগে পাতার পর পাতা লিখেছি। সন্ধ্যায় লেখার টেবিলে বসে ফজরের আজানের পর টেবিল ছেড়ে উঠেছি। এক রাতে উপন্যাস শেষ করেছি। উপন্যাসের নাম ‘অচিনপুর’। এখন বিশ্রাম।

শাওন আমার লেখার টুল ও শ্যাগ কার্পেট যেখানে বসিয়েছে, সেই জায়গাটাও আমার পছন্দ না। এখান থেকে জানালা দিয়ে প্রকাণ্ড একটা ম্যাপল ট্রি দেখা যায়। এই বৃক্ষের দিকে তাকালেই কেমন যেন লাগে। আসন্ন শীতের কারণে গাছ দ্রুত পত্রশূন্য হচ্ছে। আমি নিজের ছায়াই যেন ম্যাপল গাছে দেখতে পাচ্ছি।

এক সন্ধ্যায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই লেখার টেবিলে বসলাম। হাতে কলম তুলে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে শাওন আমার মাকে টেলিফোন করে গলা নামিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, মা, সুসংবাদ আছে। ও লিখতে বসেছে!

মা কী বললেন শুনতে পেলাম না। নিশ্চয়ই দোয়া-দরুদ পাঠ করলেন।
আমি ঠিক করলাম ‘কর্কট সময়’ নাম দিয়ে ১৩টা গল্প লিখব। গল্পগুলো হবে বাস্তব এবং পরাবাস্তবের মাঝামাঝি সীমারেখায়। কর্কট আক্রান্ত মানুষ বাস্তব এবং পরাবাস্তবের সীমায় বাস করে। তার কাছে সবই বাস্তব এবং সবই অবাস্তব।

আমি কাগজে প্রথম গল্পের নাম লিখলাম, রুম নাম্বার ২১৭, এটা একটা হোটেলের রুম নাম্বার। হোটেলটা রাজশাহীতে। নাম ‘নিরিবিলি’।

এই হোটেলে এক রাতের জন্য থাকতে এসেছে গিয়াসুদ্দিন আখন্দ। তার বয়স তেত্রিশ। সে ঢাকার একটি কোচিং সেন্টারের অঙ্কের শিক্ষক। রাজশাহীতে এসেছে শাহ মখদুমের মাজার জিয়ারত করতে। অতিসম্প্রতি তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। চিকিৎসা শুরু করার সামর্থ্য নেই। ব্যাংকে তার জমা টাকার পরিমাণ সাঁইত্রিশ হাজার তিন শ। এই টাকায় আধ্যাত্মিক চিকিৎসা করা যায়। বাংলাদেশের মাজারে মাজারে ঘোরা যায়। কেমোথেরাপি বা রেডিও থেরাপিতে যাওয়া যায় না। ঢাকায় একেকটা কেমোর দাম ত্রিশ হাজার টাকা।

আমার সমস্যা হচ্ছে, রাজশাহী শহর চেনা নেই। ছোট হোটেলগুলো কোন রাস্তায় তাও জানি না। গল্প বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে প্রতিটি ডিটেল নিখুঁত দিতে হবে। অতি ক্ষমতাবান লেখকদের ব্যাপারে কোনো কিছুই খাটে না। তাঁরা যা করেন তাই মনে হয় যথার্থ। ‘আনা কারেনিনা’ নামের উপন্যাসে টলস্টয় তাঁর নায়িকাকে এনেছেন উনিশ নাম্বার চ্যাপ্টারে। এর আগ পর্যন্ত আমরা আনা কারেনিনার বিষয়ে কিছুই জানি না। যা-ই হোক, আমি আমার গল্প শুরু করি।

রাত একটা পঁচিশ কিংবা একটা কুড়ি। সময় গিয়াসুদ্দিনের দিক থেকে, তার ঘড়িতে বাজছে একটা পঁচিশ, মোবাইলের ঘড়িতে একটা কুড়ি। একসময় রেডিও টাইম বলে একটা বিষয় ছিল। সবাই রেডিওর সঙ্গে ঘড়ি মেলাত। মোবাইলের যুগে কেউ রেডিওর সঙ্গে ঘড়ি মিলায় না।

গিয়াসুদ্দিন যে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তা দেখে মনে হয় এখানে অসামাজিক কার্যকলাপ হয়। হোটেলের হলুদ রঙের সাইনবোর্ডও অদ্ভুত_হোটেল নিরিবিলি। আবাসিক। প্রোপ্রাইটার আবুল কালাম মিয়া।

হোটেল মানেই তো আবাসিক। অনাবাসিক হোটেল বলে কিছু আছে নাকি? কোনো হোটেলের নামের শেষে প্রোপ্রাইটারের নাম থাকে না। গেটের দারোয়ানের চেহারাও সন্ত্রাসী ধরনের। মাথা কামানো। গলায় লাল রঙের মাফলার। চৈত্র মাসের গরমে গলায় মাফলার দিয়ে কেউ ঘুরে বেড়ায় না। বিভিন্ন সন্ত্রাসী দলের পোশাক-আশাকে চিহ্ন থাকে। হয়তো এদের চিহ্ন লাল মাফলার।

এত রাতে অন্য কোনো হোটেলের সন্ধানে যাওয়ার অর্থ হয় না। আকাশের অবস্থাও ভালো না। মেঘ তেমন নেই কিন্তু ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গিয়াসুদ্দিন আকাশের দিকে তাকাতেই ঠিক তার বাঁ চোখের মণিতে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল। ঘটনাটা অদ্ভুত। বৃষ্টির পানি কারো চোখের মণিতে পড়ে না।
গিয়াসুদ্দিন হোটেলে ঢুকল। লম্বা টেবিলের আড়ালে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। বৃদ্ধের পেছনে খোপ খোপ করা কাঠের গর্তে চাবি। বৃদ্ধই মনে হয় রিসিপশনিস্ট। তাঁর গলায়ও লাল মাফলার। রহস্যজনক ব্যাপার। বৃদ্ধের চেহারা হোচি মিনের মতো। চোখ ছোট ছোট। থুতনিতে ছাগলা দাড়ি। বৃদ্ধ মনে হয় অসুস্থ। একটু পর পর হাঁচি দিচ্ছেন। তাঁর সামনে একটা টিনের কৌটা। বৃদ্ধ বেশ আয়োজন করে টিনের কৌটায় থুথু ফেলছেন।

গিয়াসুদ্দিন বলল, রুম আছে?
বৃদ্ধ শ্লেষ্মাজড়িত গলায় বলল, আছে। এসি রুম, ননএসি রুম। এসি সাত শ টাকা, ননএসি পাঁচ শ।
একটা এসি রুম নেব।
নিতে চাইলে নিবেন। এসি কিন্তু কাজ করে না। ঘড়ঘড় শব্দ হয়। ঠাণ্ডা হয় না।
নন এসিতে কি ফ্যান আছে?
আছে।
ফ্যান চলে?
চলে। তিনটা রুম খালি আছে। ২১৪, ২১৩ আর ২১৭। কোনটা দিব?
যেটা ভালো সেইটা দিন।
ভালো মন্দ কিছু নাই। সবই এক পদের। কোনটা দিব?
আপনার যেটা ইচ্ছা সেটা দিন।
বৃদ্ধ বিরক্ত গলায় বলল, আমি আমার ইচ্ছায় কেন দিব? আপনি বোর্ডার। আপনি যেটা বলবেন সেটা দিব।
দুই শ সতেরো দিন। বাথরুমে গরম পানি আছে?
গরম পানি দিয়ে কী করবেন?
গোসল করব।
এত রাতে সিনান করবেন?
জি।
সিনান করতে হয় ঠাণ্ডা পানিতে। যা-ই হোক, গরম পানির ব্যবস্থা হবে। হাশেম এক বালতি গরম পানি দিয়ে আসবে।
কোনো খাবার কি পাওয়া যাবে। রাতে খাওয়া হয় নাই।
বৃদ্ধ বিরক্ত গলায় বলল, রাত দেড়টার সময় খানা কই পাবেন? এটা তো ফাইভ স্টার হোটেল না। রুম সার্ভিসে খবর দিবেন, খানা চলে আসবে।

গিয়াসুদ্দিন বলল, মশা আছে? বৃদ্ধ অনেকক্ষণ কেশে একগাদা কফ বের করে টিনের কৌটায় ফেলতে ফেলতে বলল, সোনারগাঁ-শেরাটন হোটেলে যান। সেখানেও মশা আছে। তবে আপনার চিন্তার কারণ নাই। রুমে মশারি আছে। মশারি খাটাতে না চান, টেবিলের ড্রয়ারে কয়েল আছে।
চাবি দিন, রুমে চলে যাই।

বৃদ্ধ হাই তুলতে তুলতে বলল, তাড়াহুড়ার কিছু নাই। অপেক্ষা করেন। হাশেম রুম ক্লিনিং করবে। তারপর ঢুকবেন। আপনার আগে যে বোর্ডার ছিল, সে মাল খেয়ে বমি করেছে। ক্লিনিং হয় নাই।
বলেন কী! তাহলে অন্য রুম দিন। দুই শ তেরো কিংবা দুই শ চৌদ্দ।

আগে তো চান নাই। স্ব-ইচ্ছায় ২১৭ চেয়েছেন। চিন্তার কিছু নাই, হাশেম ক্লিনিং করে দিবে। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সিগারেট ধরান। সিগারেট শেষ হতে হতে রুম ক্লিনিং হয়ে যাবে। পাঁচ শ টাকা দেন। রেজিস্টারে নাম তুলি।

ধূমপানের অভ্যাস গিয়াসুদ্দিনের ভালোমতোই আছে। এখনো তার পকেটে বিদেশি বেনসন সিগারেটের এক প্যাকেট আছে। এর মধ্যে তিনটা খরচ হয়েছে। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর একটা খেয়েছে, শাহ মখদুম সাহেবের মাজারে ঢোকার আগে একটা। মাজার থেকে বের হয়ে পদ্মার পারে বসে আরেকটা।
বেনসন সিগারেট খাবার সামর্থ্য গিয়াসুদ্দিনের নেই। সে সস্তা সিগারেট খায়। রোগটা ধরা পড়ার পর থেকে দামি সিগারেট খাচ্ছে। এতে লাভ কিছু হচ্ছে কি না সে জানে না। হবার কথা না। তার পরও মনের শান্তি।

গিয়াসুদ্দিন খুব সাবধানে একটা সিগারেট ধরাল। সাবধানে মানে আস্তে টান দেওয়া। একসঙ্গে অনেকখানি ধোঁয়া যেন জখম হওয়া ফুসফুসে না যায়। সিগারেটে টান দেওয়ামাত্র সমস্ত শরীরে ঝাঁকির মতো লাগে। বৃদ্ধ মানুষের মতো অনেকক্ষণ ধরে কাশতে হয়। গিয়াসুদ্দিনের কাছে কাশিটা ঘণ্টার মতো লাগে। মৃত্যুঘণ্টা।

রুম রেডি হইছে। ধরেন চাবি।
গিয়াসুদ্দিন সিগারেট অ্যাসট্রেতে ফেলতে ফেলতে বলল, গরম পানি কি দেওয়া হয়েছে?
গিয়া দেখেন।
তোমার নাম হাশেম?
জি।
কোনোখান থেকে খাবার এনে দিতে পারবে? আমি বখশিশ দিব।
হাশেম কঠিন গলায় বলল, বৃষ্টি শুরু হইছে_ঝমঝম আওয়াজ পান না? অখন কোনো দোকান খোলা নাই। সিগারেটে টান দিয়া শুয়ে পড়বেন। ক্ষিধার গুষ্টি শেষ।

রুম দেখে গিয়াসুদ্দিন খুশি, পরিষ্কার ঘর। বাথরুমে প্লাস্টিকের লাল বালতিতে গরম পানি দেওয়া হয়েছে। পানি থেকে ধোঁয়া উঠছে। এই ধরনের হোটেলে কাপড় হয় কটকটা রঙের, যাতে ময়লা ধরা পড়ে না। এই রুমের বিছানার চাদর ধবধবে সাদা। চাদরের ওপর দুটি শ্যাম্পুর মিনি প্যাকেট, একটা কসকো সাবান, দুটি মোমবাতি, একটা দিয়াশলাই।

মোমবাতিটা মনে হয় কাজে লাগবে। বৃষ্টির সঙ্গে জোর বাতাস দিচ্ছে। এই অবস্থায় বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন কারেন্ট বন্ধ করে দেয়। এখনো কারেন্ট আছে এটা এক রহস্য।

গোসল করে পরার মতো আলাদা কাপড় গিয়াসুদ্দিন আনেনি। পরনের নোংরা কাপড়ই আবার পরতে হবে। গিয়াসুদ্দিন নগ্ন হয়ে বাথরুমে ঢুকল। গায়ে কয়েক মগ পানি ঢালল। সাবান ঘষে শরীরে ফেনা তুলল। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। একইসঙ্গে ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। গোসলের পর পর যদি গরম এক প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানি পাওয়া যেত! গিয়াসুদ্দিন মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে ঘষতে শুরু করামাত্র কারেন্ট চলে গেল। চারদিক ঘন অন্ধকার। খুব ভুল হয়েছে, একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল।

গিয়াসুদ্দিন মেঝে হাতড়াচ্ছে, মগ খুঁজে পাচ্ছে না। অন্ধকারে মানুষ দিকভ্রান্তিতে ভোগে। হাতের কাছে মগ ছিল, এখন নেই। ঘরে মোবাইল ফোন বাজছে। রাত দুটায় তাকে টেলিফোন করার মানুষ একজনই আছে, তার বড় বোন শরিফা। তার বাসায় যখন বড় ধরনের সমস্যা হয়, তখন সে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে টেলিফোন করে।

শরিফার সমস্যা একটাই_মাতাল স্বামীর চড়থাপ্পড়, ঘুসি। শরিফা টেলিফোনে বাসায় কী ঘটেছে তা গুছিয়ে বলে। সবশেষে স্বামীর হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো বলে, মানুষটার দোষ নাই। আজেবাজে জিনিস খায় তো। তখন মাথা ঠিক থাকে না।

আজও নিশ্চয়ই মারধর হয়েছে। শরিফার স্বামী বছরতিনেক আগেও স্বাভাবিক মানুষ ছিল। হঠাৎ কী এক ব্যবসায় বানের পানির মতো টাকা আসা শুরু করল। গাড়ি, ফ্ল্যাটবাড়ির সঙ্গে যুক্ত হলো বোতল। বোতলের সঙ্গে আজেবাজে বন্ধু। গিয়াসুদ্দিনের ধারণা_মেয়েমানুষঘটিত কোনো ঝামেলাও আছে। বিবাহিত মানুষের জীবনে নতুন মেয়েমানুষ এলেই স্ত্রীকে অসহ্য বোধ হয়।

অনেকক্ষণ বেজে ক্লান্ত হয়ে মোবাইল থেমে গেছে। গিয়াসুদ্দিন মগ খুঁজে পেয়েছে। মাথায় এক মগ পানি ঢালতেই তার ঘরে কে যেন মোমবাতি জ্বালাল। মোমবাতির আলো বাথরুমের আধ খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেছে। গিয়াসুদ্দিন অবাক হয়ে বলল, কে?
মেয়েমানুষের তরল গলায় কেউ একজন বলল, আমি।
আশ্চর্য কাণ্ড! গিয়াসুদ্দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকেছে। বাইরে থেকে দরজা খুলে কেউ ঢুকবে কিভাবে?
গিয়াসুদ্দিন হতভম্ব গলায় বলল, আমিটা কে?
আমার নাম চাঁপা।
চাঁপা মানে_চাঁপাটা কে?
সিনান শেষ কইরা আসেন, তখন বলি। মুখ না দেইখা কথা বলার ফায়দা কী?
তুমি ঘরে ঢুকেছ কিভাবে?
দরজা ধাক্কা দিছি। দরজা খুলছে। আপনি ঠিকমতো ছিটকানি লাগান নাই।
গিয়াসুদ্দিন হতভম্ব হয়ে বসে আছে। সে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। নগ্ন অবস্থায় এই মেয়ের সামনে যাবে কিভাবে?

সস্তা হোটেলে খারাপ কিছু মেয়ে আসা-যাওয়া করে। হোটেল মালিকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকে। চাঁপা নিশ্চয়ই সে রকম কেউ। গিয়াসুদ্দিনের মোবাইল ফোন আবার বাজছে।
চাঁপা বলল, আপনার ফোন বাজতাছে। ধরব?
গিয়াসুদ্দিন কঠিন গলায়, তুমি ফোন ধরবে কেন?
ফোন ধইরা বলি যে আপনি সিনান করতেছেন। রাত দুটার সময় ফোন। মনে হয় আপনের স্ত্রী।
গিয়াসুদ্দিন বলল, তুমি এক্ষনি ঘর থেকে বের হবে। এই মুহূর্তে। বাতি নিভাও। বাতি নিভিয়ে চলে যাও।
বাতি নিভাইতে হবে কেন?

তোমাকে বাতি নিভাতে বলেছি, বাতি নিভাও। কৈফিয়ত দিতে পারব না।
চাঁপা বলল, আমি বুঝেছি। আপনি নেংটা হইয়া সিনানে গেছেন। আমি কাপড় দিতেছি। কাপড় পরেন তারপর বাইর হন। এই নেন, ধরেন আমার চউখ বন্ধ। আমি কিছু দেখতেছি না। আল্লাহর কসম। নেংটা পুরুষ মানুষ দেখার কিছু নাই। এক জীবনে অনেক দেখছি। থু থু থু।
গিয়াসুদ্দিন হাত বাড়িয়ে কাপড় নিল। কাপড় নিতে গিয়ে মেয়েটার আঙুলের সঙ্গে আঙুল লেগে গেল। গিয়াসুদ্দিনের মনে হলো, আরেকবার গোসল করা দরকার। বালতিতে পানি নেই।

গিয়াসুদ্দিন এক দৃষ্টিতে চাঁপার দিকে তাকিয়ে আছে। সুখী সুখী চেহারার মেয়ে। গোল মুখ। চায়নিজদের মতো ছোট চোখ। নাকও খানিকটা চাঁপা। মাথার চুল কোঁকড়া। গিয়াসুদ্দিনের মনে হলো, সে অনেকদিন পর কোঁকড়া চুলের মেয়ে দেখল। মেয়েটার সঙ্গে তার পরিচিত চেহারার কারো সঙ্গে খুব মিল আছে। তার বড় বোন শরিফার সঙ্গে মিল না তো! শরিফা বিয়ের পর মটকি হওয়ার আগে যেমন ছিল। মেয়েটা সে রকম। মেয়েটা সহজ ভঙ্গিতে প্লাস্টিকের বড় ব্যাগ হাতে বসে আছে।

চাঁপা তার হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বলল, চাইরটা বিয়ার আছে। ইন্ডিয়ান বিয়ার। ঠাণ্ডা আছে। কিনবেন? দুই শ টাকা পিস। হাশেম ভাই বলতিছিল আপনার খানা লাগবে। খাসির তেহারি আনছি। দুই প্লেট। আপনার জন্য একটা, আমার জন্য একটা। আমিও খানা খাই নাই। ত্রিশ টাকা প্লেট। চাইরটা বিয়ার আর দুই প্লেট খানায় হয় আট শ ষাইট টাকা। আপনে এক হাজার দিলেই হবে। আমার সার্ভিসও এর মধ্যে।

তোমার কী সার্ভিস?
মেয়েটা ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ হেসে বলল, বুঝেন না কী সার্ভিস?
না, বুঝি না।
না বুঝলে নাই। খানা কি দিব? গরম আছে। নাকি আগে একটা বিয়ার খাবেন? যদি বিয়ার খান তাইলে আমারেও একটা দিবেন।
গিয়াসুদ্দিন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে। আশ্চর্য সে মদ খাচ্ছ? বিয়ার নিশ্চয়ই মদ।
চাঁপা বলল, আপনারে কী ডাকব?
ডাকাডাকির কথা আসছে কেন?
ডাকতে হবে না?
অন্যদের কী ডাকো?
একেকজনের জন্য একেক ডাক। কাউরে বস ডাকি, কাউরে ভাই ডাকি। আপনারে কি ‘বস’ ডাকব?
গিয়াসুদ্দিন জবাব দেওয়ার আগেই আবারও মোবাইল বেজে উঠল। সে ফোন ধরল। যা ভেবেছিল তাই, শরিফা টেলিফোন করেছে। শরিফা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, খোকন (গিয়াসুদ্দিনের ডাকনাম), তোর দুলাভাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমি এখন এপার্টমেন্টের নিচে রিসিপশন রুমে বসে আছি।

বলো কি!
তোর দুলাভাই সবার সামনে আমাকে বলেছে বেশ্যা মাগি।
মাতাল অবস্থায় কী বলেছে এটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমারও তা-ই ধারণা। সকালবেলা ঠিক না হলে কী করব? তোর বাসায় চলে আসব?
বুবু, আমি তো ঢাকায় না। রাজশাহীতে।
রাজশাহীতে কেন?
একটা কাজে এসেছি, বুবু।
রাজশাহীতে যেন কোন পীরের দরগা? খান জাহান? না, শাহ মখদুম। শাহ মখদুম সাহেবের দরগায় আমার জন্য একটা শিরনির ব্যবস্থা করতে পারবি?
পারব।
শিরনি নিতে কত টাকা লাগে, জানিস?
না।
যা-ই লাগুক দিয়ে দিবি। পরে আমি তোকে দিব। শাহ জালাল সাহেবের দরগায় একবার শিরনি দিয়েছিলাম, তিন হাজার টাকা লেগেছে। এখানে নিশ্চয়ই আরো কম লাগবে। উনার পাওয়ার তো শাহ জালাল সাহেবের চেয়ে কম।

বুবু, আমার শরীরটা ভালো না। আমি এখন ঘুমাব।
শরীর ভালো না মানে কী? কী হয়েছে? জ্বর? ডেঙ্গু না তো?
কী হয়েছে ঢাকায় এসে বলব।
গিয়াসুদ্দিন মোবাইল ফোন বন্ধ করতেই চাঁপা বলল, আমারে একটা সিগারেট দেন। সিগারেট ছাড়া বিয়ার খাইয়া মজা নাই। জর্দা ছাড়া পান আর সিগারেট ছাড়া বিয়ার একই।
গিয়াসুদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই এগিয়ে দিল। চাঁপা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, শরীর খারাপ বললেন, আপনার কী হয়েছে?
কী হয়েছে জেনে কী করবে? চিকিৎসা করবে?
আপনে বললে করব। আমি চিকিৎসা জানি। ডাক্তারি চিকিৎসা না_অন্য রকম চিকিৎসা। ঝাড়ুর শলা দিয়ে ঝাড়তে হয়। পাঁচবার ঝাড়া দিলে শরীরের বিষ ঝাড়ুর শলাতে উইঠা আসে। পানির মধ্যে ঝাড়ুর শলা ডুবাইলে পানি হয় কুচকুচা কালো। আমার কথা বিশ্বাস হয়?
না।

তাও ঠিক। বেশ্যা মেয়ের কথা বিশ্বাস হওয়ার জিনিস না। তয় বিশ্বাস না হইলেও ঝাড়াইতে পারেন। ঝাড়া শিখছি মায়ের কাছে। মা-ও আমার মতো নটি বেটি ছিল। তার কাছে এক কাস্টমার আসছে, সাথে টেকা নাই। টেকার বদলে মারে সে এই বিদ্যা শিখাইছে। মা শিখাইছে আমারে। ঝাড়ুর শলা দিয়ে পাঁচবার ঝাড়তে হয়।
ঝাড়ুর শলা পাবে কোথায়?
ঝাড়ুর শলা আমার সঙ্গেই আছে। কখন প্রয়োজন হয় বলা তো যায় না।
তুমি সব কাস্টমারকেই ঝাড়ুর শলা দিয়ে ঝাড়?
যারা অসুখবিসুখের কথা বলে, তাদের ঝাড়া দেই। সবাই তো আর অসুখবিসুখের কথা বলে না। ফুর্তি করতে আসে ফুর্তি কইরা চলে যায়।
ঝাড়তে কত টাকা নাও?
টাকা নেই না।
চাঁপা মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে শব্দ করে হাসছে। গিয়াসুদ্দিন বলল, হাসছ কেন? হাসার মতো ঘটনা কী ঘটল?
এমনিতেই হাসলাম। বিয়ার তাড়াতাড়ি শেষ করেন। ভুখ লাগছে। আসেন খানা খাই।
গিয়াসুদ্দিন বলল, আমি খানা খাব না। বিয়ার খেয়ে ক্ষুধা নষ্ট হয়েছে। তুমি এক হাজার টাকা চেয়েছ, এক হাজার টাকা দিচ্ছি। নিয়ে যাও। আমার কোনো সার্ভিস লাগব না।
আমারে মনে ধরে নাই?
না।
আমার গায়ের রং ময়লা, কিন্তু শইল টাইটফিটিং আছে। কাপড় খুলব, দেখবেন?
না।
চাঁপা বলল, বিয়ার একটা শেষ করেছি। আরেকটা খেয়ে তারপর যাই।
গিয়াসুদ্দিন জবাব দিল না। তার মোবাইল আবার বাজতে শুরু করেছে। গিয়াসুদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে টেলিফোন ধরল। শরিফার টেলিফোন।
খোকন! জেগে আসিছ?
হুঁ।
তোর দুলাভাইয়ের কাণ্ড শুনলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়বি। ঝড়ু হাতে নিচে নেমে এসেছিল।
ঝাড়ু?
হ্যাঁ, শলার ঝাড়ু। আমাকে ঝাঁটাপিটা করবে। এপার্টমেন্টের লোকজন নেমে এসেছিল, ফ্ল্যাট মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার স্ত্রী রুমা ভাবিও এসেছিলেন। কেলেংকারি অবস্থা! রুমা ভাবি বললেন, ভাবি, আমার সঙ্গে চলুন। আমি রাজি হই নাই।
রাজি হও নাই কেন?
তোর দুলাভাই পরে এটাকে নিয়ে ইস্যু করবে। এখন মনে হচ্ছে গেলে ভালো করতাম। এমন ক্ষিধা লেগেছে। নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে।
বুবু, আমি টেলিফোন রাখি। তোমাকে তো বলেছি আমার শরীর ভালো না।
শরিফা হতাশ গলায় বলল, টেলিফোন বন্ধ করে রাখ। আমি একটু পর পর টেলিফোন করতে থাকব, তোর ডিসটার্ব হবে। আমি এখন কী করছি জানিস?
কী করছ?

দারোয়ান যে চেয়ারে বসে, সেই চেয়ারে ঝাড়ু হাতে বসে আছি। তোর দুলাভাই যে ঝাড়ু ফেলে গেছে সেই ঝাড়ু। তুই কি চিন্তা করতে পারিস এই ঝাড়ু দিয়ে তোর দুলাভাই চেয়ারম্যান সাহেব আর রুমা ভাবির সামনে বাড়ি দিচ্ছিল। রুমা ভাবি এসে ঝাড়ু কেড়ে নিলেন।
গিয়াসুদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে টেলিফোন রেখে দিল।

চাঁপা তার লাল ভ্যানেটিব্যাগ খুলে উপুড় করে ধরেছে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কিছু ঝাড়ুর কাঠি বের হয়েছে। একটা লিপস্টিক বের হয়েছে। দুটো কনডম বের হয়েছে।

গিয়াসুদ্দিন এক দৃষ্টিতে কনডম দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। একবার চাঁপা মেয়েটার দিকে তাকাল। নির্বিকার মুখ সে হাতে ঝাড়ুর কাঠি সাজাচ্ছে। বড় থেকে ছোট কোনো ব্যাপার মনে হয় আছে।
বিয়ের আগে শরিফা বুবু যেমন ছিল এই মেয়েটা সে রকম। শরিফা বুবু ঝাড়ু হাতে বসে আছে। এই মেয়েটার হাতেও ঝাড়ুর কাঠি। কাকতালীয় ব্যাপার, নাকি অন্য কিছু? শরিফা বুবুর গায়ে বাসি বকুল ফুলের গন্ধ আছে। এই মেয়েরও কি আছে?

চাঁপা ঝাড়ুর কাঠি হাতে নিতে নিতে বলল, একটু কাছে আসেন। আমি ঝাড়া দিয়া যাই। রোগ থাকবে না, চলে যাবে।
কোথায় চলে যাবে?
যে রোগ দেয় তার কাছে যাবে।
রোগ কে দেন? আল্লাহপাক!
উনি রোগ দিবেন কী জন্য? রোগ দেয় ইবলিশ শয়তান। মাথাটা নিচু করেন। আমি কপালে ঝাবড়। ঝেড়ে চলে যাব।
ঝাড়তে হবে না। তুমি চলে যাও।
চাঁপা বলল, এমুন করেন ক্যান। আমি আপনারে হাত দিয়া ছোঁব না। কাঠি দিয়া ছোঁব। আপনার জাত যাবে না। আপনার কারণে খানা খাইলাম, বিয়ার খাইলাম। সার্ভিস না দিয়াও সার্ভিসের পয়সা পাইলাম। বিনিময়ে কিছু দিয়া যাই। মনে ভাবেন আমি আপনার ছোট ভইন। এইটা ভইনের আবদার।
গিয়াসুদ্দিনের গল্পের এইখানেই সমাপ্তি। তার সঙ্গে আমার দেখা নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকায়। তিনি তিন বোতল অরেঞ্জ জুস নিয়ে আমাকে দেখতে এসে এই গল্প করলেন। গল্পের শেষটা অনুমান করা যায়। আমি অনুমান করে বললাম, ‘চাঁপা নামের মেয়েটার ঝাড়ার ফলে আপনার রোগ সেরে গেল, ঠিক না?

জি, ক্যাচ স্ক্যান করে ধরা পড়ল কিছু নাই।
আমি বললাম, এমন কি হতে পারে যে প্রথমবার স্ক্যাচ ক্যানে কিছু ভুল ছিল?
হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।
আপনি কি চাঁপা মেয়েটিকে খুঁজে বের করেছিলেন?
জি না। ইচ্ছা যে হয় নাই, তা না। যাওয়া হয় নাই। এর মধ্যে ডিভি লটারিতে আমেরিকা চলে এসেছি। আমার বোনকে আনার চেষ্টা করছি। একটু দোয়া করবেন, যেন আনতে পারি।
আপনি বিয়ে করেছেন?

জি না। সুযোগ সুবিধামতো দেশে যাব। একটা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করব। আমার বোন মেয়ে দেখছেন। একজনকে মেটামুটি পছন্দ হয়েছে। বিএ পাস। বরিশালের ঝালকাঠিতে বাড়ি।
গিয়াসুদ্দিন বিদায় নিল। স্বাস্থ্যে-সৌন্দর্যে এবং আনন্দে সে ঝলমল করছে। তার এই আনন্দের পেছনে ঝাড়ুর পাঁচটি কাঠির কোনো ভূমিকা কি আছে? জগৎ রহস্যময়। থাকতেও পারে। শেকসপিয়ার তো বলেই গেছেন, There are many things… ইত্যাদি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত