গোধূলির দুটো রঙ

অসম্ভব সুন্দর ছিলো শরতের সোনাঝরা বিকালের রোদ! জলাশয় পাশে পাট কাটা হয়ে গেছে সারা। চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত অবারিত গাঢ় সবুজ যৌবনবতী ধানের মাঠ। ক’দিন পরেই যার বুক চিড়ে ফসলের সম্ভার নিয়ে বের হবে ক্ষুদ্র শুভ্র নরম ফুল, এমন মাঠের ঠিক মধ্যিখান দিয়ে অন্তরপুর থেকে অলস দুপুরের আঁকাবাঁকা শরীরের মতো করে যে পথটি ওঠে এসে মিশে গেছে আমার গ্রামের ভিতর, সেই পথের মোহনায় যোগল কদম্ব গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কবোষ্ণ রোদের আদর গায়ে মেখে মেখে সে দিন আমি তার জন্যে নিমগ্ন প্রতিক্ষায় ছিলাম। নিরাশ হয়নি। পভু প্রতিমা কেউই সে দিন আমাকে নিরাশ করেন নি। হঠাৎ দেখলাম ধীর পায়ে সরু রাস্তার বাজু দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে আসছে। দেখলাম দু’ধারে খালের পাড়ের গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা কাশ ফুল দুলে দুলে আনন্দে আন্দোলিত হচ্ছে, শালিক চুড়–ই টুনটুনিরা নবনৃত্যে উল্লসিত, দখিনা মলয় কী মমতায় ধানের শরীর চুমে চুমে ঢেউ খেলে যাচ্ছে, উর্ধ্বে নীলাভ আকাশের বুক জুড়ে শরতের খন্ড-বিখন্ড হালকা-পলকা মেঘেরা বিলাস ভ্রমণে বিভোর। প্রকৃতির এতো আহ্লাদ এতো প্রিয় আয়োজন যেন আমারই প্রিয়ার আগমনী পদশব্দের মুগ্ধতায়, আমাদেরই কাঙ্খিত মিলন রচনায়।

হাঁটতে হাঁটতে সে যখন আমার সন্নিকটে নিকটস্থ হচ্ছিল তখন অনতি দূর থেকে সে দিন আমি চোখ ভরে তাকে দেখছিলাম। দেখছিলাম রোদমাখা অমল বিমল বিমুগ্ধ কান্তি তৃষ্ণার তীর ছুঁয়ে থর থর ছুটে আসছে আমারই পানে পরম পরিতৃপ্তির আশায়। দেখছিলাম পড়ন্ত বিকালের রক্তিম রোদ্ররশ্মি তার সমস্ত মুখাবয়বে আদর মাখছে, নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামের বুদবদে ঝিলিক পাড়ছে, সুর্যের লালিমা মেখে চিবুকদ্বয় তার লালে লাল হয়ে ওঠছে, দেখতে দেখতে মনে হয়েছে সুর্যের শেষ আরক্তিম আভাটুকু আমার প্রিয়ার অধর উষ্ণতায় ভরে দিয়ে যাচ্ছে, আমার ওষ্ট দিয়ে তার অধর তুলে ধরে চুম্বনে চুম্বনে বিগলিত করবার জন্যে। গোধূলি গায়ে মেখে বাঁশ ঝাড়ের পাশ দিয়ে শুভ্র বেতস ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একান্ত কাছে আসতেই প্রানপণ ইচ্ছে হয়েছিলো তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে সমাগম সন্ধ্যায় একাকার হয়ে যাই। সনাতন সমাজ ব্যবস্থাপনা তা হতে দেয়নি, নিরাশ করেছে আমায়! কিন্তু গালে টুল পড়া তার একখানা হাসি সে দিন আমাকে প্রাপ্তির তৃপ্তিতে পূর্ণ করে দিয়েছে।

সন্ধ্যার রঙ মুছে গেছে। চারি দিকে অন্ধকারের নিমগ্ন আয়োজন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আলাপচারিতায় কেটে গেছে বেশ সময়, হয়ে গেছে অনেক রাত। জানালার বাইরে চেয়ে দেখলাম শুক্ল পক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ গাছপালার ফাঁক দিয়ে উকি দিচ্ছে আকাশে। দেখতে দেখতে ধবল জ্যোছ্নায় ভরে গেছে সমস্থ উঠোন এবং প্রকৃতির রমণীয় শরীর। এমন উদ্ভাসিত স্নিগ্ধ আলোর বন্যা বাইরে রেখে এই বয়সের দুটো মানব-মানবীকে ঘরের ভিতরে কোনো বাঁধন কী বেঁধে রাখতে পারে? আর আমরা তো তখন পারিবারিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিক্ষায় ছিলাম মাত্র। তাকে নিয়ে গল্পে গল্পে রাত কাটানোর ব্যাপারে বিব্রতকর কোন পরিস্থিতি ছিলো না আমার এই নির্জন বাড়ীতে। তাকে নিয়ে উঠোনে ধবল জোছনায় বসে রাত কাটানোর মতো পরিবেশ বেশ অনুকূলেই ছিলো বলেই বাড়ীর আর সব ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ‘সুনীল’ আর সে ‘বীণা’ আমরা দু’জন ঘুমোতে যাইনি। নক্ষত্র খচিত নীলিমার নীচে ধুলি ধূসর আঙিনায় শীতল পাটি বিছিয়ে দু’জন দুটো বালিশে হেলানের মতো করে শুয়ে শুয়ে কথোপকথনে অতীত স্মৃতি মন্তনে বিভোর হয়ে গেলাম। পশ্চিম ঘরের দক্ষিণ কোণায় হাসনাহেনার সাদা প্রসন্ন ফুল থেকে বিমোহিত গন্ধ ভেসে আসছে, উঠোনের পূর্ব কোণে শিউলী এখনও তার কোরক মেলে নি, গাছের শুভ্র ফুল গুলো আধোখোলা আদরমাখা চোখে থাকিয়ে আছে আমরা যুগলের দিকে। এমন প্রিয় প্রত্যাশিত সুখময় সময়ের ভেতরও সন্তর্পনে উঁকি দেয় দুঃখের পুরানো সেই কথকতা। নবম শ্রেনীর ছাত্রী থাকাকালীন সময়ের একদিনের একটি ঘঠনা বীণা আমাকে বর্ণনা করতে লাগলো, যে ঘঠনাটি সে আমাকে চোখের জলে চিঠিতেও সেদিন লিখতে গিয়েও বর্ণনা করতে পারে নি। কথায় আছে না ‘ অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। ’ আজ এই বেলা তার এমন দুঃখের কথাটি বলবার সাধ যখন হয়েছে, আমি তখন তার মুগ্ধ নিরব শ্রোতা। একদিন নাকি তার এক ল্যাংড়া সহপাটির হাতে কি ভাবে কী করে আমার লিখা বীণার চিঠিখানি ধরা পড়ে এবং সে চিঠিখানি বীণাকে না দিয়ে সে প্রধান শিক্ষকের হাতে পৌছে দেয়। না দিবেইবা কেন? সে যে বীণার কাছে বার বার প্রণয় প্রার্থী হয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে ফিরে যায়নি শুধুু, লাঞ্চিতও হয়েছে নির্মম ভাবে। ঐদিন বীণাকে ডেকে পাঠিয়ে অফিস কক্ষে এনে, প্রেম করা আমাদের সামাজিক বিচারে অমার্জনীয় অপরাধ এমন মিথ্যা প্রবচন শুনিনে শুনিয়ে প্রধান শিক্ষক খুব করে সেদিন বীণাকে শাসিয়ে ছিলেন। সে নাকি তখন লজ্জায় ক্রোদে লাল হয়ে কী যে প্রচন্ড কান্না করেছিলো সেদিন! পরের দিন থেকে শুরু হয় তুমুল কানাঘুষা, শ্রেনীকক্ষে থাকবার উপায় নেই, বীণার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশে কঠোর বিদ্রƒপ। বেঞ্চে ডেক্সে ব্লাকবোর্ডে স্কুলের দেয়ালের গায়ে আমার নামের সাথে তার নাম যোগ করে লিখা। আর কত বিশেষণে বিশেষায়িত করা শুরু হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে বীণা এক সময় বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকলো বাড়ীতে। দুঃখ কষ্টের ভেতর দিয়ে গৃহীত অভিঞ্জতা মানুষ কোন দিনই ভূলতে পারে না বরং মাঝে মাঝে নতুন করে পুরানো সেই ক্ষত থেকে ক্ষরণ হয়। মানুষকে বড় অসহায় ভাবে পীড়িত করে। বীণাও ভূলতে পারেনি বলেই ল্যাংড়া-খোঁড়া সেই সহপাঠি সম্পর্কে বীণার যে প্রতীতি জন্মে ছিলো, সে তা আজও ভূলে নাই। আর ভূলে নাই বলেই এই করুণ কষ্টের কাহিনীটি বলতে বলতে চোখ ভরে তার জল আসলো, চাঁদের বিচ্ছুরিত আলো দু’চোখের পাতায় ঝলমলিয়ে উঠলো। তার চোখে জল দেখে আমি অস্থির হয়ে উঠলাম! বিলম্ব ছাড়াই আমি তাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। চোখের পাতায় জমা জল আমার বুকের উপর টক্কর খেয়ে ছিটকে পড়লো। অবুঝ শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে এমন কাঁদতে শুরু করলো যেন আর কিছুতেই থামবে না। আমি তাকে শান্তনা করবার প্রচেষ্টায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে তার মুখখানা তুলে ধরলাম তারাভরা আকাশের পানে, বিনয় করলাম নিঝুম নীলিমার শান্তি ছুঁয়ে হৃদয়টাকে শান্ত করতে। খুব করে মনে পড়ে, শান্ত হতে হতে বীণা সে দিন আমাকে জিঞ্জাসা করেছিলো, ‘আমাকে তুমি আর কতভাবে কতকাল এভাবে কাঁদাবে? নিজের পায়ে কবে দাঁড়াবে, আর কতোটা দিন মাস বছর লাগবে তোমার স্বনির্ভর হতে? তুমি যে পরশু দিন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই প্রিয় মাটি ছেড়ে আর প্রিয়াকে রেখে সুদুর কানাডায় চলে যাচ্ছো। ওপারে আমাকে তোমার পথচেয়ে কতটা কাল কাটাতে হবে? এমন কঠিন বিরহ আমি কি কাটিয়ে উঠতে পারবো? আমাকে কি একটু খুলে বলবে; কতদিন পরে তুমি ফিরে আসবে?’ অবিশ্বাস্য ভাগ্যের উপর বিশ্বস্থ ভরসা রেখে বীণার চোখের জল মুছতে মুছতে যে উত্তর সে দিন আমি তাকে দিয়ে ছিলাম আজ ওখানে কী বা দরকার আছে বলবার; স্বপ্ন-সাধ যখন কিছুতেই বাস্তবে রূপান্তরিত হলো না।

আশ্বিনের উদ্ভাসিত জ্যোৎস্নায় বীণার মুখমন্ডল শান্ত স্নিগ্ধতায় সরসীর বুকে শ্বেত-শুভ্র পদ্মের মতো আমার তৃষিত চোখের সামনে সমোজ্জ্বল হয়ে ভেসে উঠলো। আমি তার বিমুগ্ধ সুন্দরের মাঝে নিমগ্ন হলাম, ক্রমশ হারিয়ে গেলাম, হারিয়ে যেতে শুরু করলো সেও। বীণা যৌবনবতী পূর্ণ রজস্বলা, আমি সুনীল, যৌবন মাদকতায় কামনার ভারে বিদগ্ধ অধীর! রাতের শেষ প্রহরের এমন নিরব নিটোল প্রাণময় আবহ আমরা দুটো যুবক-যবতীকে অস্থির চল-চঞ্চল করে তুলেছে, মিলন মোহনার এমন শীর্ণ তীরে এসে কামুক হৃদয় দুটো বিদগ্ধতায় উদ্ভ্রান্ত উন্মাতাল হয়ে ওঠেছে, পৃথিবীর আর সকল দুঃখ-কষ্ট ক্লেশ-গ্লাণি ভূলে গিয়ে স্পর্শে স্পর্শে জ্যোৎস্নাস্নাত শুভ্র শরীরে আদর চুম্বন মাখ্তে মাখ্তে যখনই গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি, গলিয়ে যাচ্ছি আমরা দু’জন; ঠিক তখনই চারিদিক থেকে ভেসে আসা ভোরের আযান ধ্বণি ছিঁড়েছুঁড়ে ফিরে নিয়ে আসলো বাস্তব পৃথিবীর নিরস কঠিন ভূমে। আমরা দু’জন তন্ময় থাকিয়ে থাকলাম একে অন্যের দিকে। আমরা দু’জন ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলাম বাহু বন্দন! চোখে চোখ রেখে বীণা ভোরের আভায় কেন যেন আমাকে সেদিন আরেকটি ছোট্ট প্রশ্নটি করে ছিলো, ‘আমরা কি আবার বার বার এমন করে সুখের সাগরে ভাসবো?’ সে কী বিষাদমাখা প্রশ্ন আর মায়ামৃগাক্ষীর মতো করুণ চাহনী! কিছুতেই ছেড়ে যেতে চাই না! আমরা কেউ না, তবুও ছেড়ে দিতে হয়, চলে যেতে হয়; আমরা চলে যাই Ñকঠিন কর্তব্যের সাথে সন্মুখ যুদ্ধা হতে।

পাখির কাকলী শুনে শুনে ভোরের আদর গায়ে মেখে মেখে আমরা ঢুকে যাই নিদ্রার প্রত্যাশায় যার যার শয়ন কক্ষে। স্মৃতি মন্থন করতে করতে এক সময় আমরা ঘুমিয়েও পড়েছি। নির্ঘুম রাত কেটেছে তাই বকেয়া ঘুম পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেছি। চা-নাস্তা সেরে সে ছুটে গিয়েছে শিউলী তলায়। শাড়ীর অঞ্চল ভরে তুলে এনেছে অনেক গুলো ফুল। আম তলায় শীতল পাটি বিছিয়ে দুপুরের সারাবেলা ধরে যতœ করে একখানি মালা গেঁথেছে। আমার বোনের আদরে আমের আমসত্ত্ব খেয়ে, দখিনা বাতাস অনুকূল পেয়ে এই আম তলায়ই আবার সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বীণা যখন গাঁথা মালাখানি হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে ঘুমিয়ে পড়ে; সে দিন সে সময় খুব কাছে থেকে আমি তাকে দেখেছি। দেখলাম তার আষাঢ়ে মেঘের মতো ঘনকালো কেশে বাউল বাতাসের নর্থকী নাচন, ধবধবে সাদা মুখের উপর চুলের সঞ্চালন, দেখলাম সমস্ত দেহের ভাঁজে ভাঁজে ভরা যৌবনের উন্মাতাল ঢেউ, দেখলাম তার নিভৃত নয়নের উপর বিধাতার বসানো রামের ধনুন মতো বাকা ভূরু, কৃষ্ণচুড়া রঙ মাখা মসৃণ চিবুক, ঘর্মাক্ত নাক, বিলাসী বাতাস খেয়ালীপনায় উড়িয়ে সরিয়ে দিয়েছে বুকের বসন, স্তনযুগল তার উর্ধ্ব পানে উন্মুখ শঙ্কের মতো, নাভির অন্ধ গহ্বরে চোখের পরম আরাম, পার্শ্বদেশ মাখনের মতো পেলব তুলতুলে, ভরাট নিতম্বখানি যেন হৃদপিন্ডের সঞ্চারণ। নিতম্ব থেকে নেমে আসা উরুদ্বয় যেন উপুড় করা কলাগাছের মতো আর কোমল পা দুটো যেন পদ্মপাত্রে রাখা সরস্বতির শুভ্র পায়ের অবিকল। সাথী হারা একটি কাকের ডাকে আড়মোড়া ভেঙে বীণা জেগে ওঠতেই আমার দিকে তার চোখ পড়ে! বিনম্র লজ্জায় লাল! পরক্ষণেই গালে টুল পড়া একখানা বিমল হাসির আলম্ব দ্যোতিতে বুকখান ভরে যায় আমার।

বেলা পড়ে যাচ্ছে দেখে তাড়া করে স্নান করতে পুকুর ঘাটে চলে গেল বীণা। ধীরে ধীরে জলে নামতে শুরু করে বুক পর্যন্ত নেমে বার বার শরীর ঢুবায় সরসীর শান্ত শীতল জলে। সিক্ত স্তনযুগল তার নীলাম্বরী বিদীর্ণ করে দৃষ্টির তৃষ্ণা বাড়ায়। তড়িৎ স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে শানবাঁধানো ঘাটের উপর বীণা যখন দাঁড়ায়, আমার তখন প্রবল ইচ্ছে হয়েছিলো সিক্ত শাড়ির মতোন আমিও যেন তার দেহের পরতে পরতে মিশে যাই অনন্ত শান্তির আশায়। ভেজা কাপড় ছেড়ে একখানা সোনলী পাড়ের খয়েরি শাড়ি পরে বীণা চলে আসে ঘরে। দেরী না করে আমিও গোসল সেরে ঘরে চলে আসি। একসাথে বসে খাবার খেয়ে, সবার সাথে এলোমেলো আলাপে বিকালের সবটুকু সময় যেন বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চলে গেলো।

পশ্চিম আকাশ আজ বিষন্ন । ম্লান গোধূলির করুণ চেহারা আমার বীণা’র মুখমন্ডল জুড়ে আসন গেড়ে যেন বসে আছে। তার সমস্ত অবয়ব জুড়ে কালো মেঘের আনাগুনা, এই বুঝি বৃষ্টি নেমেই আসবে, কোন বারণ যেন শুনবে না আর। বেলা পড়ে যাচ্ছে দেখে তার প্রস্থাব, ‘আমার যে বেরিয়ে পড়তে হবে, দেখছো না বেলা বয়ে যাচ্ছে, আমার যে চলে যেতে হবে!‘ হ্যাঁ; ওটা কেবল তার প্রস্থাব নয়, সামাজিক প্রস্থাবও বটে। চলে তো সে যাবেই, তবে প্রস্থাবটা শুনামাত্র বুকে বড় মুচড় লেগেছে। বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না আমি আমাকে, তাকে যে আমার চলে যেতে দিতে হবে। আর আমি যে কাল সকালেই এই বাড়ি এই ঘর এই জলাশয় পুকুর বাগান, প্রাণের টুকরো বীণা এবং সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে প্রতিষ্টা নামের স্বপ্নীল সোপানে উঠতে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রাক্ষালে অনেক কষ্টে অনেক সাধনায় চোখের জল সে দিন আমরা দু’জন গোপন রেখেছিলাম কিন্তু পথ এগিয়ে দিতে গিয়ে যেখানটা থেকে আমি ফিরে আসবো ঘরে, সে চলে যাবে তার বাড়ি; ঠিক সেখানটায় যাওয়ার পর বীণা তার হাতের ব্যাগ থেকে শিউলী ফুলের মালাখানি স্বজল নয়নে আমার হাতে তুলে দিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়ে। প্রানপণ প্রচেষ্টায় বহু কষ্টে তাকে আশ্বস্ত করেছি। আমি যেমন চাইছি না, বীণাও কিছুতেই ছেড়ে যেতে চাইছেনা, তা আমরা দু’জনেই জানি। আমার যেমন রয়ে গেছে না বলা অনেক কথা, তারও আরো কতো হাজারও কথা রয়ে গেছে বুকের পাজরে গাঁথা। কান্নারত বীণাকে শান্তনা দিতে সেখানে পথিমধ্যে বুকে নিতে পারলাম না আমি, এই কষ্টটা বুকের ভিতর কাঁটার মতো বিধে রইলো। কেননা অর্বাচীন সমাজের অন্ধ মানুষের কঠোর দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব ছিলো না। তবে কখন যে তার হাতখানি বিনয়ের সুরে জড়িয়ে ধরেছি নিজেই জানি না। চোখ মুছতে মুছতে একান্ত অনিচ্ছা সত্বে একজন আরেক জনের হাত ছেড়ে দিতে হলো। বারী বর্ষণ করতে করতে বীণা চলে গেলো।

পৃথিবীর আর কেউ না জানলেও অন্ততঃ আমি জানি, সেদিন সেই চলে যাওয়ার পর থেকে রাধার রাত্রির মতো কত সুদীর্ঘ রজনী গেছে তার। আর আমার বুকের ভিতর উত্তপ্ত মরুর বিবাগী বাতাস সেই যে বইতে শুরু করেছিল আজও অবিশ্রান্ত বয়েই চলছে। এখনও সুনীল আকাশের বুকে বীণার ব্যঞ্জনময়ী সুর অহরহ বাজে। সুরের মূর্ছনার বিমুগ্ধতায় মনপ্রান আজও আশ্বিনের উদাসীন মেঘমালা হয়ে অসীম অন্তরীক্ষে কেবল উড়ছেই উড়ছে।

বীণা আর আমার বাড়ী খুব বেশী দূরে ছিলো না। মধ্যিখানে ছিলো কেবল একটি মাত্র নদী। পৃথিবীর কতো নদী ভরাট হয়, চর জেগে জেগে পথ হয়ে যায়, আমাদের এই নদী প্রশস্ত হতে হতে সীমানা হারায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত