মন্ট্রিয়ল শহরের করত ভারতু মেট্রো থেকে বেরলেই হাতের বা দিকে বিরাট একটি কফি শপ নাম “টিম হরটন”। উত্তর আমেরিকা আর কানাডার একটি অন্যতম বৃহত্ ও জনপ্রিয় কফিশপ। কানাডা আমেরিকার আনাচে কানাচে, পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে এই কফিশপ। এটি একটি চেইন ষ্টোর। আমেরিকা কানাডার যে প্রান্তেই যাওয়া যাক না কেন টিম হরটনে বাহ্যিক আঙ্গিক ভিন্ন হলেও কফি ও খাবার দাবারের স্বাদ এক ও অনন্য। শুধু মানুষগুলি ভিন্ন আর প্রাত্যহিক জীবনের যে ধারা বয়ে চলে তার রূপ আর রঙটাও ভিন্ন। এখানে জ়ীবনের জলছবি আঁকা হয় নানান রঙ্গের তুলিতে। সেই রকম জ়ীবনের রূপ কাহিনী প্রতিদিন বর্ণিত হয় করত ভারতুর এই টিম হরটনে। মেট্রো আর বাস টা্রমিনাল কাছে বলে এই টিম হরটন হামেসাই জমজমাট। কত রকম মানুষ সেখানে। শাদা, কালো, বাদামী, হলুদ। কত রকম ভাষা। এ যেন এক ভুবন পুরের হাট।
প্রতিদিন ভোরে তা শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যে ঋতুই হোক না কেন টিম হরটনের কাউন্টারে লম্বা লাইন হয়। ভীষণ ব্যস্ত সময় এটা। দম ফেলার ্ফুরসত নাই বিক্রেতাদের। কম বয়সী ছেলেমেয়ে আর কাজমুখো নারী পুরুষের ভীড় জমে। লাইনে দাঁড়িয়ে দ্রুত কিনে ফেলে কফি আর প্রাতঃরাশ। হরেক রকমের পশরা সেখানে। কেউ কেনে শুধু ডওনাট আর কফি, কেউ বা কেনে সান্ডুইচ আর কফি। কোনটারই অভাব নাই এখানে। কফি ও ডোনাটের রকমারি আয়োজনও অগাধ। ভোরের এই বেলায় বসে খাবার সময় নাই কারুর। কফি হাতে ছুটছে সবাই মেট্রো আর বাস পানে। মেট্রো আর বাসেই সেরে নেবে প্রাতঃরাশ আর প্রিয় কফি। প্রচন্ড ব্যস্ততার সময় কাল সেই ভোর থেকে ৮টা সাড়ে ৮টা।সকালের এই ব্যস্ত সময়টা পার হলে একটু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বিক্রেতারা। বড় বড় কাঁচের জানালার ধার ঘেঁষে রাখা টেবিল গুলি এ সময় ফাঁকা। জানালা দিয়ে দেখা যায় দেকারি নামের কালো পীচ ঢালা পথ আর পথচারী, নীল রঙ্গের বাস আর নানান রঙ্গের গাড়ী। ফুটপাথ দিয়ে হেটে চলা নানা রকম মানুষ। মায়ের হাত ধরে চলেছে ছোট্ট খুকীটি। বাজার হাতে কোনো গৃহিনী, লাঠি হাতে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, হনহনিয়ে চলেছে কোনো তরুণ বা তরুণী।জীবনের এই বহ্ মান স্রোত যেন চলেছে কোনো এক মোহনার পানে।কে জানে সে কোথায়।
৯টার পর থেকে আবার রংগ পট পালটায় টিম হরটনের। আসতে থাকে স্কুল বা ডে কেয়ারে বাচ্চাদের পৌঁছিয়ে ঘর মুখো মায়েরা।আসতে থাকে ভোর থেকে এ অবধি কম রত নারী পুরুষ। আসে কিছু কাছের কলেজের ফাঁকি দেয়া তরুণ তরূণী। আশে পাশের দোকানের দোকানীরা। এরা এসে বসে যেন এদের জন্যি নিধারিত টেবিলে। প্রতিদিনের পরিচিত মুখ—কারুর কারুর প্রিয় মুখ। সকাল বেলার ঝক্কি সামলিয়ে একটু আয়েস করে বসা। প্রিয় কোনো কফির ফ্লেভারে বিভোর অনেকেই। কেউ নিসঙ্গ, কেউ বা সঙ্গীর সাথে। দুচারটে বলে নেয় কথা হয়তোবা সুখ দুঃখের কিংবা কাজের। একাকী বসে খবরের কাগজ উল্টায় অনেকেই। আবার অনেক পড়ুয়া পড়া তৈরী করে কফির কাপ সামনে রেখে, laptop একাগ্র চিত্তে কাজ করে কেউ কেউ। তাদের কফির কাপ ঠান্ডা হতে থাকে কেবল। বসে অনেক ব্যবসায়ীও বৈষইয়িক কথোপক্থন আর হিসাব নিকাশের পাশাপাশি কফি পান চলে অবিরাম। গ্রীষ্ম বস ন্ত তে মিষ্টি রোদ পোহাতে কফি হাতে বাইরের খোলা জায়গায় দাঁড়ায় অনেকেই।
সময় গড়িয়ে যায়, ঘড়ির কাঁটা ১২টার কাছাকাছি আসতেই আবার ব্যাস্তো টিম হরটন। লোক সমাগমে গম গম করে উঠে। বিক্রেতারা আবার ব্যস্তো হয়ে উঠে ক্রেতাদের হাতে তাদের যথাযথ অর্ডার তুলে দিতে। মধ্যনহ ভোজন সারতে টিম হরটনের জ়ুড়ি মেলা ভার। ন্যায্যা মুল্যে পাওয়া যায় মুখ রোচক ও স্বাসথ্য কর খাবার দাবার। ভীড় হ্ইয়ে যায় টিম হরটন। পথে যেতে যেতে মধ্যানহ ভোজনের ্সময় হয়ে যাওয়া মানুষেরা ভীড় করে। আসে আশে পাশে বাজার ক্রতে আসা বাজারীরা। আসে বেড়াতে বেরোনো ক্ষুধাথ রা হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ে হাই স্কুলের উনি ফ্রম পড়া ছোক্ রা আর ছু ক রী রা। আসে সিজেপ (কলেজে) পড়ুয়ারা। দেদারসে বিকোয় মধ্যানহ ভোজ। হৈ চৈ হট্টোগোলে ব্যাবসা চলে টিম হরটনের। মধ্যানহ ভোজের পালা সাঙ্গ হলে ঝিমিয়ে পড়ে টিম হরটন। ঝিমিয়ে পড়া এই বেলায় গুটি গুটি পায়ে আসে বয়স্ক মানুষেরা। জ়ীবনের সব পালা সাংগ করা অবসর জীবনের যাত্রীরা ভীড় করে আসেন। অশীতিপর বৃদ্ধ্রাও বাদ যান না। এরা প্রতেকে প্রতেকের চেনা। যেন একটি দল। প্রতি দিন এসে বসেন জানালার ধারের বড় টেবিলটায়। ঝাঁপি খুলে বসেন জীবনের অভিঙ্গতার আর এন্তার চলতে থাকে একাল আর সেকালের তুলনা। জ়ীবনের শেষ প্রান্তে এসে “কি পাইনির” হিসাব কষেন। এরা কেবল কাজ থেকে অবসর নেয়া, জ়ীবন থেকে নয় । কোন না কোন কিছু নিয়ে এরা সদাই ব্যাস্তো। এদের টেবিল সদাই মুখর । ধুমায়িত কাপ আর উচ্ছসিত আলাপ আলোচনা। সেই সাথে আছে সেই চিরন্তন শ্বাশুড়ী বউ এর তিক্ত্ত আর ফিরিস্তি।
বিকাল হতেই আবার শোরগোল। শব্দ আর কথা মালার ঢেউ তুলে কলেজ আর হাই স্কুলের ছেলেমেয়েরা। গ্রীষ্ম কালে এরা নেবে অতি জনপ্রিয় “আইস কাপুচিনো” আর শীতে ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা” সাথে টুক টাক ডোনাট মাফিন তো আছেই। কাজ ফেরতা মানুষেরা কাজ আর পথের ক্লান্তি ঘুচাতে ঢুকে পড়ে এখানে। এ সময় টেবিল উপচে পড়ে। সবাই চায় একটু বসতে। কোন দিকে প্রেমিক প্রেমিকার নিম্ন স্বরে, কোন দিকে শিশুকে সামলাতে ব্যাস্ত মা, কোথাও রিপোট লিখতে নিমগ্ন ব্যাবসায়ী, কোন দিকে প্রজেক্টের কাজে আলোচনায় রত ৪/৫জনের দল। কোন দিকে দুঃখী মুখী কোন হতাশ লোক শূণ্যা দৃিষ্টতে উধাও। চির নিসঙ্গ কেউ কেউ যেন চিরসাথী টিম হরটনের। কখনো কোন টেবিলে বচসা বাঁধে। আবার পরকীয়া করতে এসে ধরা পড়ে যায় কেউ কেউ স্ত্রী বা প্রেমিকার হাতে। হেনস্থা হয় এত মানুষের সামনে। আবার কত মানুষের প্রেমের ফুল ফোটে। কত জন শোনে সেই অতি পুরাত্তন সেই মধুর বাণী “আমি তোমায় ভালবাসি”। কত ভাষায়, কত ভাবে। আবার অনেকের অনেক আশার সলিল সমাধি হয় এখানেই।
যদিও কফিশপে দীর্ঘক্ষন বসে থাকার রেওয়াজ নাই তবুও মানুষ বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা সামনে থাকে এক কাপ কফি।
আর বিক্রেতারা অবিরাম খেটে মরে। কত জনের কত কথা থাকে, কেউ পরিবারের দাবী মেটাতে কাজ করে, কেউ পড়ার খরচ মেটাতে। কেউ কাজ কেবল কাজের আনন্দে। ক ত বিক্রেতা ক ত ক্দুঃখ বুকে নিয়ে কত কষ্ট চেপে হাসি মুখে কাজ করে। হয়ত কারো স্বামী বা স্ত্রী অসুস্থ, কিংবা ছোট ছেলেটির অসুখ। কাজ থেকে ছুটি নেয়া যায় বৈকি কিন্তু বেতনটি যে যায় কাটা। সেই বেতন যে সংসারে ভীষণ দরকার ।এসব কথা ভাবতে ভাবতে অনেক বিক্রেতা হয় অন্যমনস্কো। ফলে বার বার ভুল হয় কাজে আর বচসা বাধে ক্রেতাদের সাথে। বিক্রেতাদের সাথে থাকে টিম হরটনের পাক শালায় ক্ররম রত আরো কিছু মানুষ যারা দেয়ালের ওধারে থেকে বানিয়ে চলে যত রকমের খাবার দাবার। এক্ টুও সময় নেই তাদের। ক্রেতাদের দাবী মেটাতে এদের থাকতে হয় সদা তৎপর । ট্রাক থেকে মাল নামানো তার পর সেগুলি গুদামে রাখা পচনশীল খাদও দ্রব সব হিসাব অনুযায়ী তুলে রাখে ফ্রিযে। নিয়মিত দেখভাল করতে হয় এসবের। আর এদের কথা এদের জীবনের গল্প বলতে গেলে লিখতে হবে আরেক অধ্যায়। সেটা হয় থাকলো পরের বারের জন্য।
এভাবেই বয়ে চলে কফি হাউসের আড্ডা- কতজনে আসে যায়, কতজনে আসবে, কত কিছু বাকী থেকে যায়। জীবন বয়ে চলে দেকারির পথ ধরে এই টিম হরটনে। রাত গিয়ে দিন আসে আবার ও টিম হরটন তৈরী হয় আগামী দিনের জন্য।