মেয়েটিকে সবাই পাগল বলে কিন্তু পাগলদের যে ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট থাকে সে বৈশিষ্ট গুলি মেয়েটির মাঝে তেমন প্রকট ছিল না। মেয়েটি অবুঝ, কিছুটা এলোমেলো ভাব চলন বলনে। প্রয়োজনীয় কথার চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বেশী বলে মেয়েটি। এক কথার সাথে অন্য কথার সামঞ্জস্য তেমন রাখতে পারে না মেয়েটি। অভিজাত এলাকার পেছনে ঢালু হয়ে যে পথটি চলে গেছে সেখানে যে বস্তিটা সেখানে মেয়েটি থাকে তার রুগ্ন মাকে নিয়ে।
প্রতিদিন সকালে মেয়েটি বের হয়ে পরে। এবাড়ী সেবাড়ী এপাড়া সেপাড়া ঘুড়ে মেয়েটি যা রোজগার করে তা দিয়ে মা মেয়ে একবেলা পেট ভরে খেতে পারে। মেয়েটি ভিক্ষুকের মত কারো কাছে ভিক্ষা চায় না। সে ঁহাক দিয়ে বেড়ায় নাচ দেখবেন? গান শুনবেন? মেয়েটি সবার কাছে পরিচিত এই অভিজাত এলাকায় এবং আশপাশ এলাকায়। কেউ তার নাচ গান দেখতে চায় শুনতে চায়, কেউ চায় না । বেশীর ভাগ মানুষয়েরই আগ্রহ নেই এ ব্যাপারে । তাতে মেয়েটির কিছু আসে যায় না। সে তার আপন ভঙ্গীতে নাচে ,হাত নেড়ে কোমর দুলিয়ে দু তিনটা লাফ দিয়ে । প্রতি দিন সে একই নাচ নাচে একই গান গায়। মেয়েটির গানের গলা যে খুব একটা মিষ্টি সে রকমও না। তবুও মেয়েটি গেয়ে যায়—– অল্প বয়সে দক্ষিনা নারী কে করিল মন মোর চুরি।
সত্যি কইরা বলনা সই তুই আমার নাম কি চম্পাবতী।
সে থেকে মেয়েটির নাম চম্পাবতী হয়ে গেল । তাকে সবাই পাগলী চম্পাবতী বলেই ডাকে। পাগল ভিখেরীর নাম চম্পাবতী। সে যেন কোন রাজ্যের রাজকন্যা ! চম্পাবতী নাচ গান দেখিয়ে কোন বাড়ী থেকে দুমুঠো চাল এক মুঠো ডাল কারো কাছ থেকে রুটি বিস্কুট কারো কাছ থেকে দুই টাকা কারো কাছ থেকে পাঁচ টাকা, সারা দিনের উপার্জন নিয়ে বিকেল পড়ে যাবার আগেই বাড়ী ফিরতো। চম্পাবতরি মায়ের আদেশ ছিল, “চম্পী সূর্য আকাশে থাকতে থাকতেই বাড়ী ফিরবি।” মায়ের আদেশ অনুযায়ী চম্পাবতী সূর্য্য মাথার উপর উঠার সাথে সাথেই কপালে হাত রেখে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে দেখতো সূয্য ঠিক মত আছেতো? বাড়ী ফেরার সময় হয়ে গেল নাতো?
অভিজাত এলাকা থেকে বস্তির পথে যাবার যে ঢালু পথটি সেখানে যে বিশাল গাছটি, সেটি সূর্য্য হেলে যাবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেই আপন মহিমায় তার ছায়া বিলিয়ে দেয় অনেকটা জায়গা জুড়ে। চম্পাবতী প্রায় দিনই বাড়ী ফেরার পথে ক্লান্ত দেহটি নিয়ে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে নেয়।
সেদিনও চম্পাবতী তার সারাদিনের রোজগারের পুটলিটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে ঘুমিয়ে গেছিল ।্ সেদিন চৌদ্দ বছরের চম্পাবতীর শরীরের ক্লন্তি একটু বেশী ছিল, যার ফলে ঘুমটাও গভীর ছিল। ঘুমের মধ্যে চম্পাবতী অনুভব করে তার মুখটা কে যেন চেপে ধরেছে। দেহে উপর একটা চাপ, যন্ত্রনা। চম্পাবতী গো গো শব্দ করে চৈতন্য হারিয়ে ফেলে। যখন চম্পবতীর চৈতন্য ফিরে তখন সূর্য্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েটি বুঝতে পারলো না তার জীবনে কি ঘটে গেল। বাড়ী ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চম্পাবতী অনুভব করে তার সমস্ত শরীর যন্ত্রনায় ভেংগে যাচ্ছে। চম্পাবতীর ধারনা হলো, বস্তির ছেলে মেয়েরা যে বলে, এই গাছে ভুত থাকে, তাই হয়তো হবে । ভুত তাকে একা পেয়ে ঘুমের মধ্যে মারধোর করেছে।
ক্লান্ত দেহ নিয়ে পা টেনে টেনে অনেক কষ্টে চম্পাবতী যখন বাড়ী ফেরে তখন সূর্য্যর আলো পুরোপুরীই বিদায় নিয়েছে। চম্পাবতীর মা উদ্বীগ্ন হয়ে পথের দিকে তাঁকিয়ে ছিল। চম্পাবতী যন্ত্রনা ক্লান্ত দেহ নিয়ে শুয়ে পড়ে। মাকে বলে,“মাগো আমি আর গাছের তলায় ঘুমামু না । আইজ গাছের ভুতটা আমারে মারছে।” চম্পাবতীর মা তার কথা কিছুই বুঝতে পারে না । শুধু অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে চম্পাবতীর মুখের দিকে। তারপর চার দিন চম্পাবতী শরীরের যন্ত্রনায় ঘর থেকে বেড় হতে পারে না । অজানা আশঙ্কায় চম্পাবতীর মা আস্তির হয়ে পড়ে। মেয়েকে এভাবে সেভাবে হাজারো প্রশ্ন করে । চম্পাবতীর একই কথা“ গাছের ভুতটা আমারে মারছে।” পেটের দায়ে চম্পাবতী আবারো বের হয়। আবারো নাচে ,আবারো গায়। ধীরে ধীরে চম্পাবতীর দেহের ক্লান্তি বেড়ে যায়। আগের মত নাচতে ভালো লাগে না । গান গাইতে মন চায় না । কান্ত কন্ঠে টেনে টেনে গায়, “সত্যি কইরা বলনা সই তুই আমার নাম কি চম্পাবতী।”
চম্পাবতীর পুষ্টিহীন কিশোরী দেহে কিছুটা পরিবর্তন আসে । কিন্তু তার শাড়ী পেচানো পুটলী বুকে জরিয়ে রাখার দরুন কারো তেমন ব্যপারটা চোখে পড়ে না। কিন্তু চোখ এড়ায় না বস্তির মানুষদের । বস্তিতে একটা থমথমে ভাব বিরাজ হয় । দীর্ঘস্ব^াস ফেলে তারা ভাবে ,এই বাচ্চা মেয়েটার সর্বনাশ কে করলো? বস্তির স্বজনরা ব্যপারটা জানার জন্য প্রশ্ন করলে চম্পাবতীর একই জবাব ,“বড় গাছের ভুতটা আমারে মারছে।” চম্পাবতী মাকে বলে,
“মাগো আমি আর নাচ গান করার লেইগা হাঁটতে পারুম না, আমার পেটের ভিতর কি জানি নড়ে। আমার পেটটাও কেমন বড় হইয়া যাইতাছে দেখ।” অবুঝ মেয়েটি বুঝতে পারে না তার দেহে জন্ম নিয়েছে আরেকটি প্রান।সে প্রানটি এখন কথা বলছে।
চম্পাবতীর মা কপাল চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদে“,হায় আল্লাহ তোমার কাছে তো আমরা কিছু চাই না। বাড়ী না ঘর না দুই বেলা পেট ভইরা খাওয়াও চাইনা। তারপরও তুমি আমাগো দিকে ফিরা চাইবা না? আমার এই পাগল বাচ্চা মাইয়াডারেও তুমি বাঁচাইতে পারলা না? আমরা কি অন্যায় করছি তোমার কাছে? তুমি কি সারাদিন ঘুমাইয়া থাক আল্লাহ, কিছুই চোখে দেখ না? আমাগো কোন দায়িত্বই কি তুমি নিবা না? তুমি ছাড়া আমাগো কে আছে?”
চম্পাবতী মায়ের কান্নার কারন খুঁজে পায় না, ফ্যাল ফ্যাল করে মার দিকে তাঁকিয়ে থাকে আর টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি ঝরে।
সমাজের কুৎসিত হাত থেকে চম্পাবতীর মত একটি কিশোরী পাগল মেয়েও রক্ষা পেল না । চম্পাবতীদের নালিশের কোন জায়গা নেই, তাই তাদের সব অভিযোগ সৃষ্টি কর্তার কাছে। সমাজ রাষ্ট্রে অনেক কিছু ঘটবে, অনেক পরিবর্তন হবে কিন্তু পরিবর্তন হবে না চম্পাবতীদের জীবনে। টাকার পাহাড় আরো উচুঁ হবে। রাজ নৈতিক অস্তিরতা কখনো বাড়বে, কখনো কমবে। মিছিল হবে, শ্লোগান হবে । নেতানেত্রীরা দেশের উন্নতির কথা বলবে, কাঁদা ছুড়াছুড়ির খেলায় লিপ্ত হবে কিন্তু চম্পাবতীদের নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই। চম্পাবতীর ঘরে জন্ম নিবে হয়তো পরিচয় হীন আরেক চম্পাবতী। সেও ঘুরে বেড়াবে পথে পথে অরক্ষিত অবস্থায়। এক বস্তি ভেংগে গেলে তারা আরেক বস্তি গড়বে। চম্পাবতীরা চির দিন চম্পাবতীই থেকে যাবে। তাদের কথা ভাববার জন্য সুশীল সমাজ নেই, তাদের কথা ভাবার জন্য রাষ্ট নেই, সরকার নেই।