সুপ্রভাত

অনেক অপেক্ষার পর আন্তজেলা ক্রিকেট প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়ন হলো তাজউদ্দিন আহমেদ কলেজ। চ্যাম্পিয়ন হলে কি হবে ছেলে-মেয়েদের আনন্দ মাটি হয়ে যাচ্ছে। এত বড় একটা জয় অথচ ‘অঙ্ক স্যারে’র মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। যেই ব্যাক্তি প্রতিযোগীতার প্রথম থেকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন তিনিই এখন মন মরা হয়ে বসে আছেন। মনে হচ্ছে বিজয় অনুষ্ঠানেও তিনি আসবেন না। এমন একটা অনুষ্ঠানে এমপি সাহেব এলে মানাতো ভাল আর সেই অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন তাজউদ্দিন আহমেদ কলেজের ‘অঙ্ক স্যার’! কলেজ মাঠে উৎসবের বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের চেয়ারম্যান এসেছেন প্রধান অতিথি হয়ে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দলে দলে লোক আসছে। সন্ধ্যার পর ঢাকার শিল্পীদের গান দিয়ে শেষ হবে উৎসব। ‘অঙ্ক স্যার’ এসবের কিছুই দেখবেন না।

প্রধান অতিথি বসে-বসে ঘড়ি দেখছেন আর সামান্য আলাপচারীতার মাঝ দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন। যে সন্দেহ ছিল অনেকের মনে প্রধান অতিথি ঠিক সেই কথাটি এক সময় মুখ ফুটে বলে ফেললেন। ‘আমি আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে পারব না’। সাথে সাথেই কলেজ কমিটির প্রেসিডেন্ট অনুষ্ঠানের শুভসূচনা করলেন। একটি রিক্সা ভ্যানে বসিয়ে বিজয়ের কাপ মাঠের চারিদিকে ঘুরিয়ে আনা হল। মুহুমুর্হু করতালি আর উল্লাসে ফেটে পড়ল গ্রামবাসী। তারপর পু্রস্কার বিতরণ হল, বক্তৃতা চললো এবং সবশেষে ব্যান্ড সঙ্গীত দিয়ে শেষ হল বিজয় অনুষ্ঠান। সকলে বাড়ি ফিরে গেলেও রাতুল চলে গেল তার ‘অঙ্ক স্যারে’র কাছে।

রাতুলের আগে আরো কিছু লোক এসেছিল মোহাম্মদ মাহবুবুর রাহমানের সাথে দেখা করতে যার মধ্যে কলেজ কমিটির প্রেসিডেন্টও ছিল। তবে তিনি কারো সাথে দেখা করেন নাই। তার মেয়ে তাহিয়া এসে এসে বলে গেছে আব্বা কারো সাথে দেখা করতে পারবেন না। তার শরীর ভাল নেই। ঘরে গিয়ে কেউ দেখা করেন – সেটাও তিনি চান না। কিন্তু রাতুল সে কথা মানবে কেন। রাতুলের সাথে তাহিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। অতএব সে চলে গেল ভেতর ঘরে।

রাতুল ভেবেছিল ‘অঙ্ক স্যার’ বুঝি কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। তা ঘুমাক, যখন উঠবেন তখনই তাকে কিছু প্রশ্ন করে রাতুল ঘরে ফিরবে। রাতুল জানতে চায় তার ক্যাপ্টেন্সিতে কোন ঘাটতি ছিল কিনা। খুশি হবার মত রাতুলের দল যদি কিছু না করে থাকে সেটাও জানতে হবে। ভেতর ঘরে ঢুকে রাতুল দেখে তার প্রিয় শিক্ষক চেয়ারে বসে মাটির দিকে চেয়ে আছেন। রতুলের আগমন অনুভব করেও তিনি অনড় রইলেন। সে কারনে তাহিয়াকেই বরফ ঠেলতে হল।
আব্বা রাতুল এসেছে। তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।
তাকে চলে যেত বল
বলেছিলাম। আর সকলের মত তাকেও বলেছি তুমি কারো সাথে দেখা করতে চাওনা কিন্তু ও বলেছে যত রাত হোক তোমার সাথে কথা না বলে যাবে না।
লাভ হবে না। আমি কারো সাথে কোন কথা বলবো না।
আব্বা তুমিতো ওকে চিন খুব জেদি ছেলে একবার যা বলে সেটা করেই ছাড়ে।
আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। যে কথা দেশের ষোল কোটি লোকের কেউ বুঝে না সে কথা একজন ছাত্রকে বলে কি লাভ।
লাভ হবে কি হবে না তাতো তুমি আগের থেকে ধরে নিয়েই চুপচাপ বসে আছো। একবার বলেই দেখ আমরা তোমার কোন কাজে আসি কিনা।
পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে রাতুলের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে তাহিয়া। না হলে ‘আমরা’ এলো কোত্থেকে। দুজনে একত্রে হয়েছে তার নীরবতা ভাংগতে।
কথা বলবে না বলবে না করেও এখনতো বেশ কথা বললো। গেল দুদিনে তিনি এতো কথা কারো সাথে বলেননি। ফাইনাল খেলা দেখে এসে সেই যে চুপ করে বসে আছেন আর মুখ খুলছেন না। মনে হচ্ছে রাতুলকে কাছে পেয়ে একটু হলেও মন নরম হয়েছে। তাহিয়া তার নিজের সন্তান আর রাতুল হল সব চেয়ে প্রিয় ছাত্র। সেও সন্তান সমতুল্য। কিছু একটা করতে হলে কাউকে না কাউকে দিয়ে শুরু করতে হয়। তবুও ‘অঙ্ক স্যার’ মনে ভরসা পান না।
রাতুল আমতা আমতা করে কথা বলতে শুরু করে।
স্যার আপনিতো জানেন কোন কিছুকে এগিয়ে নিতে হলে তাকে মুক্ত করে দিতে হয়। অথাত তার মধ্যে গতি আনতে হয়। আপনার মনের মধ্যে যে অভিমান বাসা বেঁধেছে সেটাকে যদি মুক্ত করে দেন তবেইতো সেই অভিমান আপনাকে ছেড়ে পালাতে পারবে। নাহলে সেগুলো যে মনে বাসা বেঁধেছে সেই মনেই বড় হতে থাকবে। আমরা কিছুই করতে পারবো না।
‘অঙ্ক স্যার’ বুঝে ফেলেছেন এই আমরা আমরা’র জোট ভাঙ্গা তার জন্য শক্ত হবে। তাই কিছুটা নরম হলেন। বললেন তোমরা কি করতে পারবে, তোমাদের কি ক্ষমতা!
ক্ষমতা দিয়ে স্যার কেউ কিছু করতে পারে না। পারে মনের জোর দিয়ে। আমাদের মধ্যে সেই জোর আছে। আপনার জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা করতে রাজি। আমরা আপনার ভাল চাই তাই সাহস করে বেয়াদপের মত কিছু কথা বলে ফেললাম।
রাতুল চোখ উঠিয়ে একবার তাহিয়াকে দেখে নেয়। তারপর বলে, আপনি আমাদের সব কিছু খুলে বলতে পারেন। আমরা জানতে চাই এতো বড় বিজয় কেন আপনাকে খুশি করতে পারল না।
এবার তিনি আলাপে এলেন।
তোমাদের বিজয় নিয়ে খুশি হব না কে বললো! তাতেতো সকলের মন ভরে গেছে। আমিও খুশি।
তাহলে এত নীরব কেন আপনি।
ভীষণ একটা দুঃখ আর গ্লানিবোধ নীরব থাকতে বাধ্য করেছে।
রাতুল আর তাহিয়া নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। বরফ এবার গলতে শুরু করেছে।
আব্বা আমরাতো সেই কথাটাই জানতে চাই। আমরা না বুঝলে তোমার কথা কে বুঝবে বল।
তাহিয়ার বাবা বললেন, তোমরাতো দেখেছো আমি সেমি-ফাইলান এবং ফাইনাল দুইটা খেলাতেই স্বশরীরে হাজির ছিলাম।
রাতুল তার স্যারের পাশে গিয়ে খাটের উপর বসে পড়ল। তারপর বললো
তাইতো অবাক হচ্ছি। ব্যাট হাত নিয়ে যখনই আপনার মুখ দেখেছি তখনই শক্তি পেয়েছি। প্রতিটি সিক্স মারার পর আপনার মুখ খুঁজে দেখেছি আপনি খুশি হয়েছেন কি না। হলে কতটুকু খুশি। এখন ভাবছি আমার বোধ হয় আরো ভাল করা উচিত ছিল। মানুষ এতো খুশি হল, আমাকে নিয়ে কত চিৎকার করলো এরপরেও যখন আপনি খুশি হলেন না তারতো একটা কারণ থাকবে।
কি বললে- চিৎকার করেছিল। এটাইতো আসল কথা। কেন! চিৎকার করবে কেন। তুমি কি বনের পশু যে চিৎকার দিয়ে তোমাকে তাড়াতে হবে।
খেলার মাঠে সবাইতো চিৎকার দেয়, ঢাক ঢোল পিটিয়ে উল্লাস করে। কথাগুলো রাতুল ভয়ে ভয়ে বলে।
ঢাক ঢোলই বা পেটাতে হবে কেন।
এটা কি দোষের কিছু। এইতো নিয়ম। এইতো ঐতিহ্য।
এবার মোহাম্মদ মাহবুবুর রাহমান চট করে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার দেখাদেখি রাতুলও।
কোথাথেকে পেলে এই ঐতিহ্য। কে শেখালো তোমাদের এই নিয়ম। সেই সব উল্লাস চিৎকারে কি কোন উক্তি ছিল, না ছিল কোন ভক্তি। ইয়া-ইয়া – আ আআ করে চিৎকার দিলে প্রানের কোন ভাবটা প্রকাশ পায় বল। মানুষগুলো কি পশু হয়ে যাচ্ছে যে তাদের হাম্বা হাম্বা করে চেঁচাতে হবে।
তাহিয়া তার বাবার পেছনে হাত বুলিয়ে বললো এতো উত্তেজিত হয়ে গেলে সত্যি সত্যি তোমার শরীর খারাপ করবে। আমরা যে তোমার মনের কথাটা এখনো বুঝতে পারলাম না। এখানে এসে একটু বস। আগে বল আমাদের কি ভুল হয়েছে।
তাহিয়া তার বাবাকে না বসিয়ে ছাড়ল না। চেয়ারে বসার পর তিনি আংগুল উঁচিয়ে বললেন
তোমাদের ভুল হল তোমরা ঐতিহ্য ভুলে গেছ কিংবা সেটা জানতে আগ্রহী নও। আমি এই মধ্য বয়সে গ্রামে বসে কম্পিউটার খুলে বিশ্বের সব খবরা খবর জোগার করি আর তথ্য প্রযুক্তির প্রতি তোমাদের অনাগ্রহ দেখে বিস্মিত হই?
আব্বা, আরো একটু খুলে বল।
এতো বড় একটা বিজয় আর তোমারা কিনা চিৎকার চেঁচামেচি করে দায় মিটিয়ে দিলে। অহেতুক চিৎকারে সমবেত শক্তি প্রকাশ পায় না সে কথা কি বুঝ না। ওভাবে চিৎকার করলে খন্ড খন্ড ভালোলাগা একত্রে উচ্চারিত হয় বটে তবে সেটাকে কোন ভাবেই একতা বলা যায় না। খেলার মাঠে দু দলের পক্ষে তোমরা যা করলে সেটা কতগুলো মানুষের নিজস্ব চেঁচামেচি।

কি করলে একতা প্রকাশ পেত বুঝিয়ে বল। সকলে মিলে ঐক্য প্রকাশের জন্য আমাদের কি কোন স্লোগান আছে?
আছে কি না জানি না তবে এক সময় ছিল।
কি সেটা
‘জয় বাংলা’
‘জয় বাংলা’!! রাতুল আর তাহিয়া একত্রে উচ্চারণ করল শব্দটি।
অবাক হচ্ছ কেন। ‘জয় বাংলা’র কথা তোমরা শোননি।
তাহিয়া বললো আব্বু তুমি কি খেলাধুলার মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আসতে চাও। ওটাতো একটা দলের স্লোগান
তিনি আবারো দাঁড়িয়ে গেলেন। এতোক্ষন যাও একটু শান্ত হয়ে বসে ছিলেন সে ভাবটি আর থাকল না।
এখানেই তোমাদের অসুবিধা। যা জানো না তা জানবার চেষ্টাও কর না। জানতে হলে পড়তে হবে, শিখতে হলে শুনতে হবে। তোমাদের কে বললো ‘জয় বাংলা’ রাজনৈতিক স্লোগান।
তবে ওটা কি?
‘জয় বাংলা’ ছিল আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এবার লম্বা এক বক্তৃতার জন্য তিনি প্রস্তুত হলেন।

পাকিস্তানের মধ্য বসবাস করে আমরা যখন বলতে লাগলাম যে আমরা পাকিস্তানের নাগরিক হলেও বাঙালি হিসেবে এক ভিন্ন জাতি। যেমন ওদের পশ্চিমে ছিল পাঞ্জাবি, বেলুচি ইত্যাদি। তখন পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বাঙালিত্বের থেকে সম্পূর্ন সরিয়ে এনে পাকিস্তানী করে রাখতে চাইল। পরিস্কার একটা বিভাজন মাথা তুলে দাঁড়াল। আমরা সৌরভে গৌরবে বাঙালিত্ব প্রকাশ করতে লাগলাম আর পাকিস্তানিরা আমদের পাকিস্তানের বস্তার মধ্যে বিড়াল ঠাসা করে রাখতে চাইল। আমরা ব্যাপ্তিতে বিশ্বাসি হলাম ওরা আমাদের খুটিতে বেঁধে রাখতে চাইল। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না বলে বাঙালিদের প্রতি শোষণ নিপীড়ন শুরু করে দিল। আমারা প্রশ্ন করলাম ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন’। ওরা চামচা যুগিয়ে বললো পাকিস্তানি পাকিস্তানি ভাই ভাই। বাঙালি হলে মুসলমান হতে পারবে না। চলনে বাঙালি, বলনে বাঙালি ভাবে বাঙালি হয়ে থাকতে যে যখন আমাদের মধ্যে থেকে কথা বলেছে তার বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকার লেগে পরতো। তাদের শাষণ শোষণ ছিল গোটা জাতিয় চেতনার বিরুদ্ধে কোন দল বা নেতার বিরুদ্ধে নয়।
বাঙালি জাতীয়তার পক্ষে যেন শক্তিশালি কোন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে না পারে তার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকে দেশের শত্রু চিহ্নিত করে সাজা দিয়েছে। সবচেয়ে তেজী ছিলেন যিনি তিনিই পেয়েছেন সব চেয়ে বড় সাজা। এতসবের পরেও বাঙালি জাতিসত্বা বিকাশের মুল ধারায় যখন ‘জয় বাংলা’র সংযুক্তি হলো, সবার কন্ঠে কণ্ঠে উঠে এল ‘জয় বাংলা’ তখনই বাঙালিদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ঐক্যবদ্ধ শক্তি পেল।
ভারতের যেমন ছিল ‘বন্দে মাতরাম’ মানে মাতৃভুমির জয়। ইংরেজদের কাছ থেকে ভারতের মুক্তির জন্য সেটাই ছিল শক্তির উৎস এবং সমবেত ধ্বনিরেখা। আমরাও তেমনি ‘জয় বাংলা’র কাছে আশ্রয় নিলাম। ইতিহাসে নিশ্চয় পড়েছ, ইংরেজরা বলে ‘লঙ্গ লিভ দি কুইন’, অথবা অন্যান্য দেশে যেমন ‘জনতার সংগ্রাম’ বা ‘সার্ভ দ্য পিপল’ এর মত স্লোগান আছে কিংবা পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এই ধারায় বাঙালিদের নিজস্ব শ্লোগান হয়ে উঠেছিল ‘জয় বাংলা’। এই একটি উচ্চারণে আকাশে বাতাসে আলোড়ন উঠে যেত।
তাহিয়া এবং রাতুল নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছে অজানা কিছু কথা। তাদের মধ্যে কোন প্রতিবাক্য নেই।

এখনকার মানচিত্রে যে বাংলাদেশকে তোমরা দেখ সেটাই তখন ‘জয় বাংলা’র দেশ বলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই ‘জয় বাংলা’য় ভারতের ওয়েস্ট বেঙ্গলকে বাদ দিয়ে এবং ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাইরে থাকা অন্যান্য দেশের বাংলাভাষীদের বাদ দিয়েই একটি রাস্ট্রের চিন্তা করা হয়েছিল। সে জন্য আমাদের প্রথম পতাকাতে ‘জয় বাংলা’র সীমানা বোঝাতে মানচিত্রও আঁকা হয়েছিল।
‘জয় বাংলা’কে বুঝতে না পারলে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের মর্ম বুঝা যাবে না। ‘আমার সোনার বাংলা’ হৃদয়ে ধারণ করতে না পারলে বাংলাদেশকে ভালবাসতে পারবে না। এই তিন সত্য একই সূত্রে গাঁথা।

পাকিস্তান আমলে আমাদের এই অঞ্চলে যারা বাম রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন তারা ‘জয় সর্বহারা’ নামে আর একটি স্লোগান দিত। তবে সব কিছুকে ডিংগিয়ে ‘জয় বাংলা’ যার অর্থ লংগ লিভ বাংলাদেশ তাই হয়ে উঠেছিল আমাদের নতুন প্রেরণা।
তোমরা বললে ‘জয় বাংলা’ রাজনৈতিক দলের স্লোগান। রাজনৈতিক-তো নয়ই এটা ছিল ধর্ম বর্ণ শ্রেনীর উর্ধে একটি জাতীয় পরিচয়।
মুসলমানেরা যখন আল্লাহ আকবার স্লোগান দেয় তখন হিন্দু খৃষ্টানদের সেখানে ঠুকবার সুযোগ থাকে না। তেমনি হিন্দুরা যখন বলে ‘জয় মা কালি’ তখন মুসলমানদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে উপরে উঠে না। সেই জন্য ধর্ম ভেদ, বর্ণ ভেদ তুলে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ আমাদের শুধু বাঙালি পরিচয় দিয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের কিছু নাগরিক আছে যাদের ভাষা বাংলা না কিংবা জাতিতে তারা বাঙালি না। তারা কেন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান মেনে নিবে। যেমন চাকমা, সাওতাল ওরা। প্রশ্নটি করল রাতুল।

রাতুল তোমার এই প্রশ্ন নতুন কিছু না। এমনটা অনেকে আগের থেকে বলা হচ্চে। তোমরাই বল ভারতকে যদি হিন্দুস্থান বলা হয় তবে কি যারা হিন্দু নয় তারা সেই দেশের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করবে না। ইন্ডিয়া ভারত হিন্দুস্তান যাই বল না কে সব নামের সাথেই হিন্দু ধর্মের যোগাযোগ আছে। টার্কির সবাই কি টার্ক, নাকি আফগানিস্তানের সবাই আফগান। এমনকি ইঙ্গল্যান্ডের সবাই ইংলিশ নয়। অন্যদিকে দেখ আমেরিকানদের মাতৃভাষা ইংরেজি হলেও তার ইংরেজ নয়। সব দেশের মধ্যেই একটি মিশ্র জাতিগোষ্ঠী থাকে। তাদের সমান স্বত্ব মেনে নিয়েই বিশেষ বিবেচনায় নাম করণ করা হয় একটি জাতি বা দেশের।
আমরা হাজার বছর ধরে বাঙালি হলেও এক জাতি এক দেশের চেতনাকেই ‘জয় বাংলা’র চৌহদ্দি ধরা হয়েছিল। এই স্লোগানের পেছনে এমন একটা শক্তি ছিল যা আমাদের যুদ্ধ জয় করার সাহস দিয়েছিল।
যখন মুক্তিযোদ্ধারা কোন ব্রিজ উড়িয়ে দিত তখন তারা ‘জয় বাংলা’ বলে গর্জে উঠত।
যখন মুক্ত অঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিত কোন মুক্তির দল তখনও তারা বলতো ‘জয় বাংলা’।
রাতে অন্ধকারে শত্রুর টার্গেটের দেখিয়ে কমান্ডার তার যুদ্ধ প্লান শেষ করে যখন বলতো ‘জয় বাংলা’ তার অর্থ দাড়াতো সম্মুখে এগিয়ে যাবার আদেশ।
আর কত বলবো।
উনসত্তর থেকে একাত্তুরের মার্চ মাস পর্যন্ত দিনে রাতে কার্ফু দিয়ে বাঙালিদের ধরে নিয়ে যেত পাকিস্তানি মিলিটারিরা। তখনও জনতা একত্রে বলে উঠতো ‘জয় বাংলা’। সেই আওয়াজে কত শক্তি সেটা আন্দাজ করতে না পেরে ভয়ে থমকে থাকতো পাকিস্তানিরা। আর তোমারা বলছো এটা একটি রজনৈতিক দলের শ্লোগান। এই ‘জয় বাংলা’র নামে দেশে বিদেশে অগণিত লেখা ছাপা হয়েছে। পত্রিকার নাম করণ করা হয়েছে। সিনেমার নাম রাখা হয়েছে। বিখ্যাত বিখ্যাত সব গান রচনা করা হয়েছে এসবের কিছুই জানো না কেন। ইতিহাস ভুলে গেলে জাতি দূর্বল হয়ে পরে। তাতে অনায়াসে অন্যের দ্বারা আক্রান্ত হয় জাতিস্বত্তা।

আব্বু তুমি কিছু মনে করবে না আমি নিজের চোখে দেখেছি আওয়ামীলীগের পোস্টারে ‘জয় বাংলা’ লেখা থাকে।

এইখানেই আমার প্রশ্ন অন্যান্য দলের লোকেরা কেন তাদের পোস্টারে ‘জয় বাংলা’ লিখে না। এতক্ষন আমি তবে কি বললাম। ‘জয় বাংলা’ পুরো জাতির ঐক্যের প্রতীক। কেউ বলে না দেখেই স্লোগানটি ধীরেধীরে একটি দলের হয়ে গেছে এবং তারা সেটার বাহাবা ও ফায়দা নিচ্ছে। এত বড় একটা জাতীয় ঐতিহ্য কে না ভাগ বসাতে চাইবে। কিন্তু কি বিচিত্র সিদ্ধান্ত দেখ- একটি দল ছাড়া কেউ সেটা ব্যবহার করতে চায় না। ওরা নিয়েছে তো আমরা ছেড়ে দিলাম এই হল তোমাদের মীমাংসা। যেন গাছের ফল ভাগাভাগি নিয়ে সালিসি ফয়সালা।
তোমারা যুবক, তোমাদের উচিৎ নিজ নিজ দলকে জিজ্ঞেস করা কেন তারা ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে না।

আব্বু তুমি বুঝতে পারছো না যেটা আওয়ামীলীগ ব্যবহার করে সেটা বিএনপি বা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে না।
আচ্চা আওয়ামীলীগের কথা বাদ দাও। তোমারা বলতে পারবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার সব চেয়ে বড় অবদান কোনটা।
তিনি কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার পক্ষে করণীয় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বিদেশের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।

তাহলে তোমাদের জানা উচিত তার সেই নির্দেশনার সবগুলো কথা। তিনি তার সেই নির্দেশনা কি বলে শেষ করেছিলেন বা তার সবশেষ কথাটি কি ছিল জান?
কি
‘জয় বাংলা’
তাই! সেতো জানতাম না।

জানবে কি করে। তোমারাতো সব তোতা পাখির মত ইতিহাস শিখছো। তাই বড় বিজয়ের জন্য কি ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হয় তা জানো না। যখন ঢাকা স্টেডিয়ামে কোন বিদেশী দলের সাথে জাতীয় দলের খেলা হয় তখন পুরো স্টেডিয়াম যদি এক সাথে ‘জয় বাংলা’ বলে গর্জে উঠতো তবে তার মধ্যে একটা বাঙালিপানা থাকতো। বিদেশীরা তাদের দেশে গিয়ে ‘জয় বাংলা’র কথা বলতো হয়তো। এক সুরে পুরো দেশটা গাঁথা থাকতো।

বিদেশী খেলাগুলোতে দেখ না তাদের নিজস্ব একটা চান্ট সঙ্গীত বা চান্ট শ্লোগান থাকে। তারা কি সুন্দর সমেবেত ভাবে নিজ দেশের দলকে উৎসাহ দিতে গ্যালারিতে বসে গলা মেলায়। আমি লিভারপুল ফুটবল দলের খেলা দেখেছি। ওদের দেখেছি ‘লিভারপুল’ ‘লিভারপুল’ করে সমস্ত স্টেডিয়াম সুরে সুরে মাতিয়ে রাখতে। তোমাদের মত বনের মহিষ তাড়ায় না কেউ। অহেতুক কতগুলো চিৎকার দিয়ে তোমারা কখনো এক হতে পারবে না- থাকবে গুচ্ছ গুচ্ছ বাঙালি হয়ে।

কথা বলবেন না বলবেন না বলেও মোহাম্মদ মাহবুবুর রাহমান কথার খই ছিটিয়ে দিলেন। তিনি যখন বলতে শুরু করলেন তখন রাতুল আর তাহিয়া নীরব হয়ে গেল। নীরব বলা ভুল হবে অবাক হয়ে গিয়েছিল ওরা।

অনেক রাতে রাতুল তার প্রিয় ‘অঙ্ক স্যারে’র ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বলা যেতে পারে তখন গভীর রাত।

মোহাম্মদ মাহবুবুর রাহমান এক সময় হাত জোর করে মিনতি করে বলেছিলেন আমাকে ‘জয় বাংলা’ বলার অধিকার ফিরিয়ে দাও। তোমাদের দোহাই লাগে ‘জয় বাংলা’ বললে আমাকে কোন রাজনৈতিক দলের কোল ঘেষা করে দিও না। কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেলেও আরো কিছু কথা বলতে তিনি ভুললেন না।
এই ভূঘন্ডে এক সময় স্বদেশী যুবকদের দাপট ছিল। তারা ইংরেজ তাড়াতে অস্ত্র ধরেছিল। আমরা তখন জন্ম নেইনি তাই স্বদেশীদের দলে যোগ দিতে পারি নাই। তবে আমাদের সময় এসেছিল সর্বত্তোম সুযোগ। স্বদেশীদের তুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুসংগঠিত যোদ্ধা। তারাই তোমাদের একটা দেশ এনে দেবার জন্য অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করেছিল। তাদের দেয়া সেই দেশটি নিলে আর ভুলে গেলে তাদের মুখের বচন।
আসো তোমরাও আমার সাথে ‘জয় বাংলা’ বলার অধিকার দাবী কর। দরকার হলে আইন করে সব দলকে ‘জয় বাংলা’ লিখতে বাধ্য করব। কথার শেষে এক সময় কান্নায় ভেঙ্গে পরেন মোহাম্মদ মাহাবুবুর রাহমান। তারপর তার ক্লান্ত দেহে গভীর ঘুম নেমে আসে। বুকের জ্বালা বেড় করে দিতে পেরে তিনি ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।

রাতুল চলে যাবে বলে ঘর ছেড়ে উঠানে এসে দাঁড়ায়।
উঠানের চারি কোনায় এতো আলোর উৎস খুঁজতে গিয়ে সে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। রাতুলের মুখ ধুয়ে দিল রুপালি জ্যোৎস্না। আকাশ থেকে গড়িয়ে আসা জ্যোৎস্না শুধু তাহিয়াদের উঠানকেই আলোকিত করে রাখেনি সমস্ত জগৎ যেন আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে। তাহিয়ার সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে যেই হাটতে যাবে তখনই তাহিয়া পিছন থেকে ডাক দিল ‘রাতুল’
রাতুল ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিছু বলবে।
তাহিয়ার কন্ঠ তখন মেঘে ভেজা আদ্রতা। সে আস্তে করে বললো ‘জয় বংলা’।
রাতুল কানটা বাড়িয়ে দিল যেন কিছুই শুনতে পায়নি সে।
ঠিক আগের মতই মৃদু শব্দ করে বললো ‘জয় বাংলা’। জীবনে এই প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করে তাহিয়ার চোখের তারা জ্বল জ্বল করে উঠল। মনে হল এতো আলোর উৎস আকাশের জ্যোৎস্না থেকে আসেনি। সেগুলো বেরিয়ে এসেছে তাহিয়ার চোখের গহীন থেকে। তাহিয়ার তৃপ্ত মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তার শরীর থেকেও অগ্নি উত্তাপ ঝরে পরছে। দূর থেকে সেই উত্তাপের কিছুটা নিজের শরীরে অনুভব করে রাতুল হাটতে শুরু করল।

দরজা আড়াল করে একা দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। বড় আম গাছটার নিচে এসে রাতুল বরাবরের মতন আজ পেছন ফিরে তাকালো না। এবার সে বড় রাস্তায় উঠে হাটতে শুরু করেবে। কিন্তু ঠিক তার আগেই মুষ্টিবদ্ধ একটা হাত উপরে উঠিয়ে সেও বলে উঠল ‘জয় বাংলা’

খুব ভাল করতো রাতুল যদি পিছন ফিরে তাহিয়ার মুখটি দেখে নিত। বর্ষা আর জ্যোৎস্না কদাচিত এক সাথে দেখা যায়। আর হয়তো কোন দিন এমন দূর্লভ জিনিষ সে দেখতে পাবে না।

‘জয় বাংলা’র ঘ্রান নিতে সারারাত হেটে বেড়াবে তাই বলে এসেছিল তাহিয়াকে। কিন্তু একাএকা কলেজ মাঠের মধ্যখানে বসে ‘অঙ্ক স্যারে’র হিসেব কশা অঙ্কের কথা ‘তাদের দেয়া সেই দেশটি নিলে আর ভুলে গেলে তাদের মুখের বচন’ চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল মনে করতে পারে না। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই রাতুল চোখ খুলে দেখতে পায় সোনা দিয়ে বাঁধানো আকাশ। তারপর চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে তার সোনার বাংলা। অঙ্ক স্যার বলেছিলেন ‘জয় বংলা’র শক্তি থেকেই এই সোনার বাংলার জন্ম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত