জ্যামে পড়ে এক ঘণ্টা দেরী হল তবুও দুপুরের আগে বাস এসে থামল সূর্যডাঙ্গায়। কাউকে কিছু না জানিয়ে গ্রামে এসেছে রুনা। প্রতিবার আসার আগে খবর পাঠাত বলে ওর মা কাউকে না কাউকে বাসস্ট্যান্ডে বসিয়ে রাখত। এবার কেউ বসে ছিল না তবে বাস থেকে নেমে দেখা হল তানভীরের সাথে। রুনা চাইছিল তানভীরের সাথে যেন তার দেখা না হয়, অথচ তারই সাথে প্রথম দেখা! তানভীরের হাতে কোন কাজ ছিল না তাই হাঁটতে হাঁটতে রুনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। পথে বেশ কথা হল, শেখা হাসিনা, খালেদা জিয়া থেকে ওবামা পর্যন্ত। কথার ফাঁকে ফাঁকে রুনা কয়েকবার ভেবেছে তানভীরকে বলে দেবে কি কারণে এবার হটাৎ গ্রামে আসা, আবার পিছিয়ে যায় এই ভেবে মাকেই এখনো কিছু বলা হল না অন্য কাউকে বলা কি ঠিক হবে?
তানভীরও সুযোগ পেতেই ছোটবেলার কিছু ঘটনা মনে করিয়ে বটগাছটাকে ইঙ্গিত করেছে। স্কুল মাঠ, বৃষ্টি ভেজা দুপুর আর ওদের বাড়ির পুকুরের কথা তুলে এনেছে হেঁটে আসা পথে। মনে মনে বলতে চেষ্টা করেছে ছেলেবেলার খেলার সাথী হলেও এখন রুনাকে সে ভালবাসে। লেখাপড়াতে রুনার সমকক্ষ হতে পারেনি, তাছাড়া সামান্য স্কুল শিক্ষকের চাকরি, রুনা যদি হেসে দেয়! তানভীর কিছু বলল না বলে রুনাকেও কিছু বলতে হল না। খালেদা হাসিনার দখলেই থাকল আলোচনা।
কিছুদিন থেকে রুনা চেষ্টা করে আসছিল কানাডায় যাবার। মাকে কথাটা শুনিয়েছিল, তবে সব কিছু এক সাথে মেলালে মনে হবে মাকে সে কিছুই বলেনি। এরকম স্বপ্ন-তো বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সকলে দেখছে। কানাডা আমেরিকাতে আজকাল সবাই যেতে চায়। কেউ পারে কেউ পারে না। রুনার মা ধরে নিয়েছিল রুনাও সেই না পারার দলে।
রুনা যে হটাৎ করে আজ চলে এলো ইচ্ছে করলে এভাবে না এসে বরাবরের মত আসতে পারত। ভিসা হাতে পেয়েছে তাও পনেরো দিন হবে তবে এসবের কিছু মাকে বলেনি কেন। মা ছাড়া তার আর কে আছে। তাও যদি মাকে দেখা মাত্র কথাটা ঝটপট বলে দিত তাহলে বোঝা যেত নানান ঝামেলা ছিল তাই এতদিন বলতে পারেনি। দুপুরে ভাত খেল, হাল্কা একটা ঘুমও দিল তারপর বিকেলে পুকুর ঘাটে বসে মাকে অবাক করে দিল। আর একটু হলে রুনার মা পানিতে পরে যেত। এমন করে কি কেউ দূরে যাবার কথা বলে।
পুকুর ঘাট বলতে তিনটে আধ পচা তাল গাছের গুড়ি। এই গুড়িগুলোর উপর বসিয়ে ছোট বেলায় রুনার মাথায় পানি ঢেলে গোসল করিয়ে দিত ওর মা। এক সময় মায়ের হাত ধরে পানির উপর ভেসে থাকার জন্য সাঁতার শিখতে চেয়েছিল। তারপর অল্পদিনের মধ্যে সাঁতারে মাকে ছাড়িয়ে গেল। মায়ের বারণ উপেক্ষা করে ডুব দিয়ে চলে যেত পুকুরের এপার ওপার।
রুনার মায়ের গল্পে কোন নতুনত্ব নেই। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে এবং রুনাই তার একমাত্র সন্তান। সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারার অংশ হিসেবে পুকুর বাড়িটি সে পেয়েছে। গাছ-গাছালিতে ভরা দোতলা টিনের ঘরে এতোই গাছের বাহার যে বাইরের থেকে উঠানটাও দেখা যায় না। ছায়ায় ঢাকা নির্জন পরিবেশ। লোকজন নেই বলে পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ করত। ডাব-নারকেল পড়া মাত্র ভেতর ঘর থেকে শোনা যেত। অথচ সেই নীরবতা আর থাকলো কোথায়। রুনা বড় হতে হতে ভেগে গেল দম আটকানো শূন্যতা। বাড়িটাকে মাথায় তুলে রাখতো সে। স্কুল ছুটি হলেতো কথা নেই, রাজ্যের ছেলে মেয়েরা সব ছুটে আসতো রুনার কাছে। গোল্লাছুট, কুতকুত, কাবাডি কি না খেলত ওরা। ব্যাডমিন্টনও খেলেছে হাই স্কুলে উঠে। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে সাঁতার ছিল তার সখের খেলা। অনেকে হয়তো দীঘি বলবে তবে সেটা ছিল পুকুর। যতোই বড় হোক না কেন সেই পুকুর প্রতিদিন তিন চারবার পাড়ি দিত রুনা। প্রথম প্রথম ওর মা পাড়ের উপর থেকে মেয়েকে ডাকাডাকি করত ‘এই রুনা উঠে আয় আমার ভয় করছে’। রুনা যে পাড়ে যেত মা পুকুরের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যেতে সেই পাড়ে। আবার ঘুরে ফিরে পুকুর ঘাট। পরের দিকে রুনার মা বুঝতে পেরেছিল তার মেয়ে সাঁতারে পটু হয়ে গেছে।
ঢাকায় চলে যাবার পর যখনই গ্রামে আসতো রুনার প্রথম কাজ ছিল ঝাঁপিয়ে পুকুরের মধ্য আলোড়ন তোলা। কি হতো কে জানে, মাঝে মাঝে রাতে এসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিত পুকুরের পানিতে। এক ঘণ্টা অনেক বেশি সময় তাই তার কিছু ছেলেমানুষীও থাকতো। গুণগুণ করে গান গাইত। পানিতে ভেসে নৃত্য করতো। আবার চোখ বন্ধ করে কখনো কখনো মাছের ঠোকর খেত। এমনও দেখা গেছে পানির নিচে তাকিয়ে নিজের ফর্সা রঙকে খুঁজে ফিরত সে। যতোটা সম্ভব নিজেকে বিলিয়ে দিত পুকুরের কাছে। মনে হত একটি যুবক তরল পদার্থের মত চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে রাখত। যেদিন গ্রাম ছেড়ে প্রথমবারের মত ঢাকায় যাচ্ছিল সেদিন পারলেতো পুকুরটাকে টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে নিয়ে যায়। যাবার আগে বই-খাতা ছুঁড়ে দিয়ে বলল যাব না ঢাকায়। যে লেখা-পড়া গ্রামে থেকে করা যায় না সেই লেখা-পড়া দিয়ে কি করব। শেষে ওর মা একটা বয়ামে করে পুকুরের পানি ভরে দিলে সে যেতে রাজি হয়। ফেলে যাওয়া পুকুরের প্রতিটি কণায় জমা আছে রুনার ভেসে বেড়ানোর উল্লাস। রুনার হাসি তার উল্লাস মিশে আছে পুকুরের প্রতিটি বিন্দু কণায়। সে চলে যাবার পর পুকুর ঘাট থেকে ভেসে আসত জলের কান্না। যে শুনতে পেত সেও কেঁদে দিত।
রুনার বিদেশ যাবার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে মরে যাবার দশা হল ওর মায়ের। তবু মেয়ের জন্য কি ব্যবস্থা করা যায় সেটা ভেবে এক সময় চলে গেল ভেতর ঘরে। রুনা অনেকক্ষণ একা একা বসে থাকল তাল গাছের ভেজা গুড়ির উপর। রুনার মা ফিরে এসে বলল তানভীর আবার এসেছে, জিজ্ঞেস করছে তুই কি বটতলায় ঘুরতে যাবি?
ওকে চলে যেতে বল। আমি আজ কোথাও যাব না।
তুই নাকি কাল চলে যাবার ব্যাপারে ওকে কিছু বলিস নাই।
মা ওকে চলে যেতে বল। আর তুমিও এখান থেকে চলে যাও।
মায়ের দিকে না তাকিয়ে একা একাই বকে যেতে লাগল – পুকুরের চারিদিকে কি জংগল হয়েছে তোমার দেখতে পাও না? আমি চলে গেলে এই পুকুরয়ে কেউ আসবে বলে মনে হয় না। লোকে বলবে মরা পুকুর।
রুনার মা কিছু না বলে চলে গেল। রুনা তার মায়ের দিকে ফিরে তাকাল না। ফিরে তাকাবার উপায়ও ছিল না। তখন ওর চোখে ভরা পুকুর। লতায় পাতায় কত ডাকাডাকি তবুও সে কিছুই শুনতে পায় না। ধপাস করে একটা ডাব পরল তাতেও চমকাল না। সে এখনো বুঝতে পারছে না কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না। কিছু একটা না করেও উপায় ছিল না। সৈকত জেদ ধরেছিল বিদেশ যাবে যদি ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। তা না হলে লাখ টাকার স্কলারশিপ সে ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। একক সিদ্ধান্তে তাই ক্লাস টিচারকে বিয়ে করতে হয়েছিল রুনাকে। বিয়ের দু সপ্তাহ পর সৈকত চলে যায় কানাডায়। সেখান থেকে কাগজ পাঠিয়েছে রুনাকে নিয়ে যাবার জন্য। ওদের প্ল্যান মন্দ না। কানাডায় গিয়ে একটা অনুষ্ঠান করে বিয়ের ঘোষণা দেবে। মাকে বলবে তার ইয়ুনোভার্সিটির এক টিচার বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে সেও রাজি হয়ে গেল। বিদেশে বাড়ীতে মেয়েদের একা থাকা ভীষণ মুস্কিল, এমন কথা শুনলে মা খুশি না হয়ে যাবে কোথায়। এভাবে বিয়ের ঝামেলা শেষ করতে পারলে সবকিছু গোপন করার জবাবদিহি আর দিতে হবে না। ওরা দুজন ছাড়া ত্রিভুবনের কেউ জানে না এই বিয়ের কথা। সাক্ষী ছিল অচেনা এক লোক। যতদিন রুনা কিছু না বলছে কেউ কিছু জানতেও পারবে না।
মায়ের কাছে বিয়ের কথা লুকানোর একাধিক কারণ ছিল। যাকে সে বিয়ে করেছে সে খৃস্টান সেটা তার কাছে বড় কিছু না, অন্যতম কারণ হল তানভিরকে রুনার মা মেয়ের জামাই ভেবে বসে আসে। রুনা ঢাকায় চলে যাবার পর তানভীরই ওর মায়ের দেখাশুনা করে যাচ্ছে। হাট-বাজার থেকে শুরু করে বাড়ির বেশির ভাগ কাজ তানভীর হয় নিজে নয়তো অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে দেয়। ছোট বেলার খেলার সাথী ওরা। দুজনকে এতো সুন্দর মানাবে যে বলে শেষ করা যাবে না। তাই এক মাত্র মেয়ের বিয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে বসে আসে রুনার মা। রুনা অবাক হচ্ছে এই ভেবে এখনো তার মা কেন বলছেন না তানভীরকেও সাথে নিয়ে যেতে। এরকম প্রস্তাব উঠলে সাত পাঁচ কথা বলতে হবে। একদিনে সেই জট ছুটবে বলে মনে হয় না। রুনা মনে মনে আল্লা আল্লা করে। এদিকে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে রুনার মা। দম ফেলার ফুরসত পেল না তবুও মা আর মেয়ের অনেক কথাই হল। প্রথমে রাগ করে বসে থাকলেও বুদ্ধি এবং যুক্তি দিয়ে রুনা তার মাকে বুঝিয়ে বলল অন্যরা জানতে পারলে স্কলারশিপ কেড়ে নিত। অনেকগুলো টাকা নষ্ট হয়ে যেত। ক্লাসের সবাই ছিঃ ছিঃ করত। এসব নেহায়েত বানানো কথা তবুও রুনাকে এভাবেই লুকোচুরির সমাপ্তি টানতে হল। মেয়ের কথা অবিশ্বাস করতে পারে না রুনার মা। রুনা যুক্তিতে খুব পোক্ত অন্যদিকে রুনার মায়ের মত সরল মানুষ আর একটাও নেই এই গ্রামে। তাই তাকে মানাতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি। কিছুক্ষণ পরপর চোখ মুছে রুনার মা ব্যস্ত হয়ে দৌড়াতে থাকে। ঘরের সব জিনিষপত্র নামিয়ে খাটের উপর স্তূপ করে ফেলে। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেবে। এমন সময় যদি তানভীর কাছে থাকত সে না হয় কিছু বুদ্ধি দিতে পারতো। আবার পরক্ষনেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই ভেবে তানভীর কি ভাবে বুঝবে কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ সে কি কখনো বিদেশে গেছে? ভরতে ভরতে ব্যাগ ছিঁড়ে যাবার অবস্থা। একটার যায়গায় দুটো লাক্স সাবান দিয়ে বলে কানাডায় যদি বিদেশী সাবান না পাওয়া যায় অন্তত পক্ষে দুই মাস চালাতে পারবি। কাঁচের বয়েমে ওজন বেশি তাই গামছার উপর পলিথিন বিছিয়ে এক কেজি চিনি বেঁধে ব্যাগের ভেতর ঠুকিয়ে দেয়। এটা ব্যাগ নম্বর তিন। রুনা চায়ে তিন চামচ চিনি খায় বিদেশে গিয়ে কি করে চিনি যোগাড় করবে সেই দুশ্চিন্তা তার কাটে না। চিনির বিকল্প হিসেবে দুটো পাটালি গুড় বেঁধে দেয় পলিথিন ব্যাগে। গুড়ের ওজন বেশি হবে ভেবে সেগুলো কেটে ছোট ছোট টুকরো করে দিতে ভুল করে না সে। এক সময় রুনা তার মায়ের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে তুমি এমন করলে আমি আজ রাতেই চলে যাব।
মাকে শুতে পাঠিয়ে দিল কিন্তু বিছানায় শুয়ে ছটফট করেও নিজে ঘুমাতে পারল না। মধ্য রাতে বিছানা থেকে উঠে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে দরজা খুলে সে বেরিয়ে এলো। অনেক স্মৃতি মসজিদের পেছনের বট গাছটাকে নিয়ে। দেখতে দেখতে সে কত বড় হয়ে গেলে অথচ বটগাছের বয়সের কোন নড়াচড়া নেই। তানভীরই তাকে এই বটগাছে চড়া শিখিয়েছিল। বটগাছের দুই ডালে বসে ওরা কথার মালা গেঁথেছে কত। এই গাছের নিচে বসেই কাগজের নৌকা বানিয়ে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ভাসিয়ে আসতো। বট গাছের যতোটা উপরে উঠা যায় সেখানে বসে একদিন চিৎকার করে নীল মেঘের সাথে কথা বলেছিল রুনা। সে বলেছিল আমার সব কথা মেঘের পেটে গিয়ে জমা হয়েছে। সত্যি সত্যি মেঘ তার কথা শুনতে পারে ভেবে বাবা বাবা বলে অনেক ডেকেছে। বাবা তুমি কোথায়। আমাকে দেখতে পাচ্ছ। এই যে আমি বট গাছের উপর। আমি সাঁতারও শিখেছি। তানভীর বরাবরের মতই চুপ ছিল। রুনার চেঁচামেচি শেষ হলে সে রুনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এক জনের কথা কি অন্য জনের কাছে লুকিয়ে রাখা যায়। রুনা বলেছিল কেন যাবে না দেখলে না মেঘের সাথে কি করে কথা বললাম। তানভীর বলল আমার কথাগুলো কি তোর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নিবি? যখন একা থাকবি কান পেতে শুনতে পারবি। ও আমি পারব না, তোমার দরকার হয় তুমি গিয়ে মেঘের সাথে কথা বল। আমি গেলাম।
আরো কিছুদিন পর বট গাছের বাঁধানো গুড়িতে বসে তানভীর রুনাকে বলেছিল খুব তাড়াতাড়ি তুই বড় হয়ে যাবি। তোর শরীর বড় হবে, তোর বুদ্ধি বড় হবে তখন তোকে দূরে দূরে থাকতে হবে। আমার সাথে আর এভাবে খেলতে পারবি না। তারপর একদিন সন্ধ্যায় তানভীরের কথার সত্যতা পরীক্ষা করা হল। রুনার শরীর কেঁপে উঠেছিল তানভীরের হাতের ছোঁয়ায়। বড় হবার সত্যতা পরীক্ষা হল, তবুও রুনা হার মানতে রাজি ছিল না। দূরত্ব বজায় রেখে আগের মতই বড় বেলায় খেলত ছোট বেলার খেলা। আজ সেই বট গাছটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। রাত অনেক গভীর হয়েছে তবু রুনার মনে কোন ভয় নেই। সাপ-ব্যাঙের ভয় তার কোন দিনই ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই চলে এলো এতোটা পথ। বট গাছের পাকা শানের উপর বসে মসজিদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল প্রতি শুক্রবার সে আর তানভীর মিলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো পায়েস খাবার জন্য। কলা পাতা কিংবা বট পাতায় মুড়ে পায়েস কিংবা লাল রঙের জিলাপি দেয়া হত। তানভীর কিছু না খেয়ে তার পোটলা নিয়ে বসে থাকতো রুনা নিজেরটা শেষ করে তারটাতে হাত দিবে বলে। নিজে না খেলেও তানভীরের মন খারাপ হত না। রুনা খেলেই তার খাওয়া হয়ে যেতে। যেমন সাতারে রুনা ফার্স্ট হলেই খুশি হত তানভীর। রুনাকে সে বুঝতে দিত না ইচ্ছে করেই সে হেরে যেত। এখন না হয় সে মাস্টার হয়েছে কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তানভীরের ছিল গোছালো চিন্তা-ভাবনা। ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের সব ছেলে-মেয়েকে সে নির্ভীক ধীরচিত্ত মানুষ বানিয়ে দিতে পারত। কিন্তু রুনা একাই ছিল তার জীবনের সব মানুষ। তাই সে রুনাকেই ঠিক ভাবে তৈরি করে গেছে। রুনা আত্মবিশ্বাসী হলে জীবনের সব পথ বিনা বাধায় পারি দিতে পারবে। রুনার মাকে দেখে সে শিখেছে সহজ সরল হলে কিভাবে সমাজের কোণ ঠাসা হয়ে পরে মানুষ। রুনা যেন তার মায়ের পরিস্থিতিতে না পড়ে সে চেষ্টাই করেছে তানভীর। সব সময় ছায়ার মত থেকেছে রুনার সাথে সাথে।
তুমি আসবে আমি জানতাম। আমার জন্য না হোক বট গাছের জন্য।
কথাটি শুনে চমকে ওঠেনি রুনা। তানভীর থাকলেও থাকতে পারে এটা তার ধারনায় ছিল। সে বরং জিজ্ঞেস করল অনেকক্ষণ থেকে বসে আছ?
বসে না শুয়ে আছি। এতক্ষণ কি বসে থাকা যায়। যখন এসেছিলাম চাঁদ ছিল নদীর পেটে এখন বট গাছের মাথা ছাড়িয়ে তোমাদের বাড়ির দিকে হেলে পড়েছে।
সেকি তোমার ঠাণ্ডা লাগবে না। পাক ঘুরে এসে তানভীরকে বট গাছের অন্য পারে শুয়ে থাকতে দেখে রুনা প্রশ্ন করে। তারপর গায়ের ওড়না তানভীরের শরীরের উপর বিছিয়ে বলে, কার্ডিগানে আমার শীত মানিয়ে যাবে আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।
শুনলাম কানাডাতে নাকি খুব শীত পড়ে তাই প্র্যাকটিস করছ বুঝি?
শুরু হয়ে যায় ওদের টকশো। বিষয়টা খুব গুরু গম্ভীর, স্বভাবতই হাসিনা আর খালেদা সেখানে যায়গা পেল না। জীবন রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। জীবনের সব কথাই পাহাড় সমান ভারী। বলতে গেলে অসুবিধা হয় না তবে তুলতে গেলে তোলা যায় না। গলা ভারী, চোখ ভারী, মন ভারী এরই নাম ছাড়াছাড়ি। যে কথা হাজার রাতেও শেষ হবার না সে কথা কেন মধ্যরাতে ওরা তুলতে গেল। ওদের কথা আর থামে না দেখে মেঘের পালে বাতাসের দোল থেমে গেল। কালো আকাশ দিতে থাকল কালো আলো। বৃষ্টি হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না তবুও বৃষ্টি এলো। দুজনের এলোমেলো কথা শুনে থেমে যেতে চায় বটগাছের বেড়ে উঠার সখ। রুনা এবারো জিতে যাবে। আবারো হেরে যাবে তানভীর। কিছু মানুষ জয়ী হতেই বাজি ধরে, কিছু মানুষ পরাজয় মেনে নিয়ে ভালবাসায় জয়ী হয়। ভালবাসা বুঝি দুই দিয়ে ভাগ করা যায় না। এক পাল্লা থাকে উঁচু হয়ে, এক পাল্লা ভারী।
রুনা চলে যাবার দিন তানভির আর রুনারা মা ঢাকায় গিয়েছিল। দূর সম্পর্কের এক আত্মিয়ের বাসায় ছিল দু রাত। গ্রামে ফিরে এসে ওর মা সারাক্ষন আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। দিনে রাতে যখনই সুজোগ পায় সকলের আড়ালে এই কাজটা করে। কেমন করে যেন আবারো সেই শুন্যতা ফিরে এল গাছ গাছালিতে ভরা টিনের দোতালা বাড়িটিতে। ঘুরেফিরে রুনার মা মেয়ের স্মৃতি খুঁজে বেরায় আর ক্ষনে ক্ষনে ঢিল মেরে পুকুরের পানিতে দোলা দেয়। রুনার অনেক পাগলামি ছিল, ছিল অনেক ছেলেমানুষী। সব কিছুতে জয়ী হবার চেষ্টা করত সে এবং সদা তৃপ্তির হাসি দিত। কিন্তু তার অনেক কথা সত্য হত না। যেমন সে বলেছিল ‘আমি চলে গেলে এই পুকুর পারে কেউ আসবে বলে মনে হয় না’। তার এই কথাটি মিথ্যে হয়েছিল। তানভীর এখনো পুকুর ঘাটে আসে। ঝরা হোক কিংবা কাঁচা, তার হাতে থাকে একটি করে বট পাতা। পানি নষ্ট হয়ে যাবে তাই বট পাতা পানিতে না ছেড়ে রেখে যায় পুকুর পারে। তানভীরের মন বিষণ্ণ থাকে এই ভেবে কানাডাতে তাল গাছের গুঁড়ি দিয়ে বাঁধান পুকুর ঘাট নেই কেন। পুকুরের বাইরে পুকুরকন্যার কতই না কষ্ট। এই যে সামান্য বট গাছ তাও নাকি নেই কানাডাতে তাহলে ওখানে আছেটা কি? সেখানে রুনা কি ভাবে মেঘের সাথে কথা বলছে কে জানে।
তানভীরের সব কথা মনে মনে অথবা সে কথা বলে নিজের সাথে। রুনার সাথে কথা বলতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। এখনো পুকুর ঘাটে এলে তার মাথা নিচু হয়ে যায়। যেন পুকুরের মধ্যখানে চোখ বন্ধ করে মাছের ঠোকর খাচ্ছে রুনা। তানভিরকে লক্ষ্য করে মাঝ পুকুর থেকে বলে উঠে ‘বোকার মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছ কেন আমি কি দেখতে ভুতুম পেঁচার মত’।
শুকনো চোখে এসে তানভীর প্রতিবার পুকুরের জল নিয়ে ফিরে যায়। অথবা বলা যেতে পারে পুকুরকন্যা এখন বাসা বেধেছে তার কাঠ নয়নে। গড়িয়ে পড়ে তবুও জমতে থাকে। কেউ কেউ দীঘি বললেও বলতে পারে তবে আসলে এর নাম পুকুর।