বাবার সাথে জন্মদিন

দিনটি আর সব দিনের মতই সাধারণ একটি দিন। সকালে পূবের আকাশে সূর্য উঠেছে। চারিদিকে কোলাহল। সবকিছুই সাধারণভাবে চলছে আর আমি দাড়িয়ে আছি বারান্দায় একা। আজ আমি ছুটি নিয়েছি। বন্ধুরা সবাই আসবে রাতে পার্টি। হ্যা, রেস্তোরাতে করতে পারতাম কিন্তু তা করা যাবে না কারণ বন্ধুরা সবাই আমার হাতের রান্না খাবে। বাজার করা, রান্না করা অনেক কাজ। অসম্ভম গরম আজ। গ্রীষ্মের দুপুর। পথে খুব ভীর। বছরে একটি মাত্র শুভোদিন আমার। কি হয় একটু গরম কম হলে? সূর্যটা কেন যে বুঝলো না। আমি গাড়িতে করে সুপার মার্কেটে এলাম। মার্কেটের সামনে ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিং এ নিয়ে চলে গেলো। প্রচন্ড খরতাপে আমার চোখ ঝলসে যাবার মতন অবস্থা হলো।আমি ব্যাগ থেকে সান গ্লাস বের করবার জন্য যখনি ব্যাগ খুললাম ঠিক তখনই দেখি যে একটি কালো গাড়ি আমার দিকে ছুটে আসছে। আমাকে প্রায় চাপা দেয়। আমি দৌড়ে একটু নিরাপদ জায়গায় যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রেহাই পেলাম না। গাড়িটি আমাকে চাপা দিয়ে ড্রাইভার পালিয়ে গেলো . আমি চিত্কার করে মাটিতে পড়ে গেলাম। এরপর কি হলো তা আমার জানা নেই।

আমার জ্ঞান যখনফিরে এলো তখন দেখি সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পরিবেশে আমি। চারিদিকে নিরব। খুব সুন্দর করে কামরাটা গোছান। অনেকটা ছেলেবেলার আমার সেই বেডরুম এর মতোন। সেই নীল পর্দা। চোখ মেলতেই দেখি বালিশের পাশে কমলা রাখা। ব্যাপার কি -বাবা ছাড়া এ কাজতো কেউ কোনো দিন করেনি। আমি কোথায়। অবাক হয়ে কিছু না বুঝেই লোভ সামলাতে না পেরে কমলা খেতে শুরু করলাম। এ ফলটি কেন যে আমার এত পছন্দের তা ঠিক বলতে পারব না। যখনই মজা করে বিছানায় বসে বসে কমলা খাচ্ছি ঠিক তখনই মনে হলো -আমি তো দুর্ঘটনার কবলে পরছিলাম, কিন্তু আমার শরীরে কোনো ব্যথা নেই কেন? এটা ভাবতে ভাবতেই একজন লোক এলেন আমার কাছে। বললেন , কেমন আছ? জবাবে বললাম আমি ভালো আছি কিন্তু তুমি কে?

সে আমাকে হেসে উত্তরে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো আমি কে? সব জানবে। এত অস্থির কেনো? একথা বলেই সে আমার হাতে একটি প্যাকেট দিল। আমি পকেটটি খুললাম। দেখি সুন্দর একটি সাদা রঙের জামা।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি? আর তোমার নাম কি?
সে আমাকে বললো ,আমাকে তুমি অরওয়ান বলে ডাকতে পারো আর এ জামাটি তোমার জন্মদিনের উপহার পরে নাও।
আমি বললাম, তুমি বললেই পরবো কেনো ? কে দিয়েছে এই জামা ?
অরওয়ান বললো, তোমার বাবা পাঠিয়েছে।
বাবা!
হ্যা, তোমার বাবা . তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তৈরী হয়ে নাও।
আমি তাড়াহুড়ো করে তৈরী হয়ে নিলাম। কত দিন বাবাকে দেখি না। কি যে সুন্দর জামা! এরকম জামা তো আগে কখনো দেখিনি।
অরওয়ান আমাকে বললো, আজ তুমি আরো অনেক কিছুই দেখবে মানুসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে নাও। ঠিক বুঝতে পারছি না-আমি কোথায়? কি হতে যাচ্ছে।

সব কিছু কেমন জানি পরিচিত মনে হয় আবার এও মনে হয় না এটা আমার ছেলেবেলায় বেড়ে ওঠা সে বাড়ি না। আমাকে একটু ছোট একটি পঙ্খিরাজ ঘরে চড়িয়ে একটা বাগানের মাঝখান দিয়ে নিয়ে চললো অরওয়ান। এটা কি পৃথিবীর কোনো বাগান। বোধ হয়না। এতো সুন্দর বাগান তো পৃথিবীতে থাকবার কথা না। এটা কি অন্য কোনো পৃথিবী? অরওয়ানকে যতবার জিজ্ঞাসা করি অরওয়ান ততবার বলে মেয়ে পাগলামি করে না। ধর্য্য ধরো। আমার তো আর তর সয়না। খুব তারাতাড়ি চলে এলো পঙ্খীরাজ ঘোড়া আরেকটি বাগানের সামনে।বাগানের মাঝে খুব সুন্দর একটি বাড়ি। অরওয়ান বললো তুমি আগে প্রবেশ করো। আমি ধীরু পায়ে ধীরে ধীরে ভয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। কি সুন্দর বাড়ি। কখনো দেখিনি। অরওয়ান বাড়ির সবচেয়ে বড় কামরাটি তোমার জন্য রাখা হয়েছে। কামড়ায় প্রবেশ করতেই অবাক দৃষ্টিতে আমি দেখি বাবা সুন্দর সাদা পাঞ্জাবি পড়ে বসে বসে তসবিহ জপছেন। আমাকে দেখেই সেই সুন্দর হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কেমন আছ মা?
কতোদিন পর মা ডাক শুনলাম। আমি আবেগে এত বেশি পরিমান আপ্লুত হয়ে গেলাম যে আর কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
বাবা বললেন , ছি: মা আজ কাদে না। আমি এখন আছি না।
একটু অবাক হলাম এসময়ে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন না কেন? বাবাতো এমন ছিলেন না।
বুঝলাম না। আমার উপর কি কোনো কারণে রাগ?
অরওয়ান আমাকে বললো, আজ একটি দিন তুমি তোমার বাবার কাছে থাকবে। এটা তোমার বাবার পক্ষ থেকে তোমার এই জন্মদিনে বিশেষ উপহার। আমি খুশিতে আত্বহারা। আমি দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। অরওয়ান বললো, না এতো কাছে যাবে না।আমি থমকে দাড়ালাম। অরওয়ান বললো, তুমি তোমার বাবার কাছে কি চাও? আমি বললাম, রিক্সায় চড়ে ঘুরে ঘুরে বাদাম খেতে চাই। অরওয়ান হেসে উঠলো -হাসলো বাবাও।বেহেস্তেও রিক্সা? বুঝতে পারলাম যে আমি বেহেস্তে বেড়াতে এসেছি। এ কারণেই এ জায়গা এত সুন্দর।

বাবা সেই আগের মতন বললো ঠিক আছে মা চলো ঘুরতে যাই। আমরা রিক্সায় চড়লাম। রিক্সাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে বানানো।অনেক বড়। আমি আর বাবা পাশা পাশি কিন্তু কেউ কাউকে ছুতে পারছি না। কেনো জানি বাবা আমাকে ধরছে না। কিন্তু আমি বাবার গায়ের সেই গন্ধ পাচ্ছি। একবার ধরলে কি হয়?

রিক্সা চলছে। পথে বাগানে সুন্দর সুন্দর পরীরা আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। হঠাত একজন পরী কতগুলো বেলী ফুলের মালা নিয়ে এলো। আমি বললাম , বাবা মালা কিনে দাও। বাবা হেসে বলে এখানে কোনো কিছু বিক্রি হয় না। নাও মা -মালা নিয়ে নাও। নিলাম।খোপায় পড়লাম। সাদা -জামা আর সাদা মালা। বাবার কাছে আমি সবসময় সুন্দর। আমি বাদাম খেয়েই যাচ্ছি। বাবা বললেন, দুপুরে কি খাবে? জবাবে বললাম, চাইনীজ খাবো বাবা আবার হেসে বললেন পাগলি, এখনো পাল্টায় নি।

আমরা দুপুরের খাবার খেতে রেস্তোরায় প্রবেশ করলাম। খাবারের অর্ডার করা হলো।পরীরা এলেন খাবার নিয়ে। আমি খেয়েই যাচ্ছি আর আমার এই পাচ বছরের যত ঘটনা সব বলছি। মার কথা বললাম। বাবা বললো মার আরো বেশি করে যত্ন করতে। বাবা মন্ত্রমুগ্ধভাবে আমার কথা শুনছিলেন।

গল্প করতে করতে বিকেল হয়ে গেলো । একজন পরী আমাকে একটি বাক্স দিয়ে বললো এটি তোমার বাবার পক্ষ থেকে তোমার জন্য সামান্য উপহার।

বাক্সটি অনেক ছোট। এত ছোট বাক্সে কি থাকতে পারে? বাবা বললেন, এখানে কেউ কোনো জিনিষ দেয় না মা। ওখানে আমার আশির্বাদ দেয়া আছে।যা তোমাকে সমস্ত বিপদ থেকে বাচাবে আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এটা কখনো খুলোনা-মা।আমি তারাতারি করে বাক্সটা ব্যাগে ভরে নিলাম। এবার ফিরে যাবার পালা।আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম। পথে দেখি একটি ছোট বাচ্চা পপ কর্ণ খাচ্ছে। বাবা সেই আগের মতোন বললেন, মা আমাকে একটি পপ কর্ণের প্যাকেট দেবে? আমি তরিঘরি নিয়ে দিলাম। কিন্তু বাবা ধরলেন না। বাবা বললো, সিটে রাখো মা। আমি অবাক -কেনো আমার হাত থেকে নিলো না? মন খারাপ হলো , রাগ ও হলো। কি এমন দোষ আমার যে আমাকে একটু ছোয়া যায় না? রেখে দিলাম রাগে সিটে পপ কর্ণ। বাবা হেসে পপকর্নের প্যাকেট দাত দিয়ে বাচ্চাদের মতন ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগলো . সেই আগের দিনের মতোন। খুব ভালো লাগছিলো দেখতে। শরীরটাও আগের চেয়ে অনেক ভালো বলেই মনে হলো। বাড়ীতে পৌছে গেলাম। আমরা কফি খাবার জন্য বাগানে বসলাম। সাথে এলো বিশাল একটি জন্মদিনের স্ট্রবেরি কেক। দু’জন মানুষ কি করে খাই। বাবার আবার ডায়বেটিক।কি করা। কেক কাটলাম, খেলাম এবং শেষে মোমবাতি জালালাম।এখানকার নিয়মগুলো একটু ভিন্ন।

কফি খেতে খতে আরেকজন ভদ্রলোক এলো এবং বললো তোমার জ্ঞান ফিরে আসবার সময় হয়েছে। তোমাকে চলে যেতে হবে। আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ও কে? বাবা জবাবে বললো, ওর নাম বরখান। অরওয়ান নিয়ে আসে আর বরখান দিয়ে আসে। যাও মা।
যাও?তুমি তো কখনো যাও বলনি। তুমি তো বলতে এসো। এবার যাও কেনো?
বাবা বললো, পাগলি।
বরখান বললো তুমি কি আর কিছু চাও?
আমি ততক্ষনাত বললাম,হ্যা চাই।
বরখান বললো, কি চাও?
আমি বললাম, বাবাকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই।
এটা শুনে বাবা তার দু’হাত বাড়িয়ে দিলো।
আমি দৌড়ে গেলাম। বাধা হলো বরখান-না ! দাড়াও -যাবে না তুমি ওদিকে?এজগতের বাসিন্দাদের ধরতে নেই।
তুমি অন্য জগতের বাসিন্দা। আমি একবার শুধু একবার।
তোমার জ্ঞান ফেরার সময় হয়ে এসেছে। মা কাদছে তোমার। তোমার ভাই-বোন্।
বরখান বললো, এই না ফেরার পৃথিবীতে সবাই আসবে একদিন। তোমাকে অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে ওই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। ফিরে যাও। আসবেই তো একদিন না একদিন-এত তারা কেনো?
বাবা বললো -মা ভালো থেকো -একটি বারের জন্যও এবার বললো না ফিরে এসো।
আমি হতাশ হৃদয়ে চলে এলাম। বাবা একবারও বললো না , মা আবার এসো। একবারোও না!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত