রুম নম্বর ৫২২

রুম নম্বর ৫২২
জানেন, ৫২২ নম্বর রুমের আমাদের চারজনেরই সিজি ফোর পাওয়ার কথা ছিলো? ভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর একদিন আগে ক্যাম্পাসে এসেছি আব্বুর সাথে। প্রোভোস্ট অফিসে গিয়ে শুনি, ৫২২ নাম্বার রুমে আমার এলটমেন্ট। রাগে দুঃখে হতাশায় হতভম্ব হয়ে গেলাম!! ইয়া মাবুদ, প্রতিদিন পাঁচ তলায় উঠা নামা করতে হবে সিঁড়ি ভেঙে? এ তোমার কেমন বিচার?
বি ব্লক, পাঁচ তলার সিঁড়ির উপর বড় বড় করে লেখা, জমিদার পাড়া। ফ্লোরের নাম দেখে কিছুটা শান্তি পেলাম। আরো শান্তি পেলাম যখন দেখলাম আমাদের তিনজন ফার্স্ট ইয়ারকেই এক রুমে দেওয়া হয়েছে, তিনজনই ফিশারিজ। আমরা আড্ডা দিতে বসে পড়লাম। তুমি থেকে তুইতে নামতে সময় লাগলো না। রুমের নাম দ্য রয়্যাল ফ্যামিলি। নামেই কেমন একটা এলিট এলিট ভাব আছে। পাঁচ তলায় উঠার কষ্ট ততক্ষণে পানি হয়ে গেছে। রুমমেট কাব্য রংপুর বোর্ডে স্ট্যান্ড করা। বললো ভাই, আমি সিরিয়াস মানুষ। আমার সিজি ফোর লাগবেই। সিজি ফোরের জন্যই আমি ফিশারিজ নিয়েছি, আমি ফিশারিজের উপর কয়েকটা বইও কিনেছি নীলক্ষেত থেকে।
একথা বলেই ও কয়েকটা ইংরেজি বই দেখালো। দাগানোর ঠেলাতে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো সব লাল হয়ে গিয়েছিলো।
কাব্যর সিরিয়াসনেস দেখে তব্দা খেয়ে বসে আছি। এমন সময় আরেক রুমমেট জুবায়ের বললো সে চান্স পাওয়ার পরই বুয়েটের এক ভাইয়ের কাছে দুইমাস ফিশারিজ পড়ে এসেছে। বেসিক ক্লিয়ার থাকলে সিজি ফোর পানিভাতের মতো সহজ। ঢাকা কলেজের পোলাদের বেসিক থাকে অলটাইম ক্লিয়ার-ফকফকা সাদা, বলেই ও ওর গোবদা মাথাতে একটা ঠোকা দিলো। আমি নিজে কিছু বললাম না।সত্যি কথা হলো সিজি নিয়ে আমার কোনোই আইডিয়া নাই, দ্বিতীয় কথা হলো ফিশারিজ নিয়ে আমার বেসিক তো দূরের কথা, ন্যূনতম আইডিয়াও নাই। চান্স পাওয়ার পর থেকে হুমায়ূন আহমেদ আর সমরেশ মজুমদারে ডুবে ছিলাম। কী ভুলটাই না করে ফেলেছি!! মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। আমার নিজের বেহাল অবস্থা দেখে লজ্জাতে মরি। আল্লাহকে মনে মনে ধন্যবাদ দিই, মাবুদ গো!! তোমার অসীম দয়া, এতো ভালো ভালো ছাত্রের সাথে এক রুমে থাকতে পারছি, আমার এক জীবনে এতো পূণ্যও ছিলো?
আড্ডা দিতে দিতেই ঝাঁকড়া চুলের এক ভাই রুমে ঢুকলো। ঢুকেই বকাবকি শুরু করলো, এই ফার্স্ট ইয়ারের পোলাপাইন, এতো গল্প কিসের? এইটা কি লুতুপুতু গল্পের জায়গা? এইটা লেখাপড়ার জায়গা, পড়তে বস। সিজি ফোর না পাইলে সব কটারে পিটাইয়া ঘর থেকে বাইর করমু। সিজি ছাড়া জীবন অচল, সিজিই জীবনের সব, বুঝছস?
এই ঝাঁকড়া চুল হলেন হিমেল ভাই। আমাদের রুমের সিনিয়র। এগ্রিকালচার সেকেন্ড ইয়ার। আবেগে আমার চোখে জল আসলো, যাক, ৫২২ এ ফাঁকিবাজির কোনো জায়গা নাই। কত বড় সৌভাগ্য হইলে মানুষ এত মেধাবী সব রুমমেট পায়? কাব্যর থেকে অনেক চেয়ে চিন্তে একটা বই চেয়ে নিলাম রাতে পড়ার জন্য। জুবায়েরকে দেখলাম ফোনে প্রেমালাপ করছে, বুঝলা বাবু, সিজি ফোর পাইয়া ভার্সিটির টিচার হয়েই তোমারে বিয়ে করবো। বেসিক একদম ক্লিয়ার….খালি পরীক্ষাটা দিতে দাও একবার । দশমিনিট পড়ার পরে হিমেল ভাই ডাক দিলেন, এই পোলাপাইন, টিচার্স ডায়েরি মুভিটা দেখসস তোরা? আমরা মাথা নাড়ি।
হিমেল ভাই বলে, আরে গাধা, কাল থেকে তো ইউনিভার্সিটি লাইফ শুরু করবি। এই মুভি না দেখলে হয়? চলে আয় একসঙ্গে মুভি দেখি। তাছাড়া ক্লাসই শুরু হইলো না, এখনই কিসের পড়া ? কাল থেকে কোপাইয়া পড়ুম সবাই মিলে।
কাব্য বই বন্ধ করে বলে, আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ।মাথা ফ্রেশ করার জন্য মুভিটা দেখছি। জুবায়ের বলে, এতো পড়ে কী হবে? আমার বেসিক ক্লিয়ার আছে। মুভি দেখলেও পরীক্ষায় ফাটাবো। আমরা মুভি দেখি। টিচার্স ডায়েরি মুভিটা সুন্দর, নায়িকা আরো বেশি সুন্দর। আমরা ক্রাশ খাই। আমাদের বই খোলা পড়ে থাকে টেবিলে, আগামীকালের কোপানোর অপেক্ষায়। পরেরদিন বহুল কাঙ্ক্ষিত ভার্সিটি লাইফের শুরু হলো। অমরা আগেভাগে গিয়ে ফার্স্ট লাইনের তিনটা ডেস্ক জোগাড় করলাম। ক্লাসের বাকি সাতান্ন জন হিংসার চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেদিনই আমি প্রথম জানলাম, ভার্সিটির ক্লাস দুইটা পর্যন্ত না, পাঁচটা পর্যন্ত। শুনে বুকে ধাক্কার মতো লাগলো, সারাদিন ক্লাস-ল্যাব করলে পড়াশোনা করবো কখন? আমার ভাতঘুমের কী হবে?
কাব্যর কোনো ভাবান্তর নাই, ও বললো, আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ। পড়াশোনা করতেই আসছি। কষ্ট একটু করতেই হবে, সিজি ফোর পাওয়া হলো আসল কথা। জুবায়ের তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, আরে ব্যাটা তোরা রাজশাহীর লোক এতো অলস কেন? আমরা ঢাকার পোলা, রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা ক্লাস করার এনার্জি নিয়ে চলি। পরীক্ষাটা আসুক, বেসিক ক্লিয়ার আছে, ফাটাইয়া ফেলবো জাস্ট। সারাদিন ক্লাস ল্যাব করি। রাতে হিমেল ভাই ডাক দেন, কইরে পোলাপাইন!! সিচোরে মুভিটা দেখসিস?? আরে ব্যাটা খালি পড়াশোনা করলেই হবে? ভার্সিটি লাইফে সবকিছু করতে হবে, সিজি ফোরও তুলতে হবে।পরীক্ষার আগের রাতে একটা কোপ দিয়ে দিবি। ওয়ান নাইট ফাইট।
কাব্য মুভি দেখতে চলে যায়, ওর সব আগেই পড়া আছে, জুবায়ের বলে, ভার্সিটিতে অতো পড়াশোনা নাই, বেসিক ক্লিয়ার থাকলেই সিজি ফোর। আমরা মুভি দেখি, রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরনো সেই রাত। ফার্স্ট মিড পরীক্ষা চলে এলো। ভার্সিটি লাইফের প্রথম পরীক্ষা । মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখি। কাব্য বললো, আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ, পঁচিশই পাবো। জুবায়ের বললো সব বেসিক কথা লিখে দিয়েছি, এক মার্কসও কাটতে পারবে না। যদিও নিজের কথা বলতে লজ্জা লাগে, তারপরও বলেই ফেললাম, আমিও পঁচিশ পাবো। হিমেল ভাই বুকে থাবা দিয়ে বলেন সাবাশ বাঘের বাচ্চা!! সিজি ফোর এবার ঠেকবে না। আমরা চার, আমাদের সিজিও চার।সেলিব্রেশন করা দরকার, চল সালনা যাই, গ্রিল খেয়ে আসি। এত ভালো পরীক্ষা দিয়ে সেলিব্রেশন না করা অন্যায়।
পরীক্ষা দিতে দেরি হলো, রেজাল্ট এলো ঝড়ের গতিতে। কাব্য পেলো সাড়ে ছয়, জুবায়ের সাত আর আমি পেলাম আট। হিমেল ভাইয়ের মার্কস জানতে পারা গেলো না, শুধু দেখলাম রুমে আসার পর থেকে কাকে যেন গালাগাল করছেন আর এ দেশের এডুকেশন সিস্টেম যে কত খারাপ, সেইটা নিয়ে স্ট্যাটাস লিখছেন। কম মার্কস পেয়ে সবারই মেজাজ খারাপ। কাব্য বললো, আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ, সেকেন্ড মিডে ফুল মার্কস তুলে সিজির ফোর পাইতে হবে। বলেই পড়তে বসলো। জুবায়ের বললো, বেসিক ক্লিয়ার করতে হবে। বলেই ও গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিলো। হিমেল ভাই বললেন কঠোর সাধনা চাই। তবে তার আগে এনার্জি লাগবে। ক্যাম্পাসে আম কাঁঠালের গাছের অভাব নাই, চল খাইয়া আসি। কাল থেকে কোপাইয়া পড়মু। আমরা কাঁঠাল কোপাইতে গেলাম। বই টেবিলে খোলা পড়ে থাকলো, আগামীকালের কোপানোর আশায়। সেকেন্ড মিড এসে চলে গেলো চোখের পলকে।
এবারের রেজাল্ট পেয়ে হতাশায় একবারে মুষড়ে পড়লাম।কেউই দশের কোটা পার হতে পারিনি এবারও । হিমেল ভাই আমাদের মোটিভেশন দেন, আরে ব্যাটা, মিড কোনো পরীক্ষা হলো? আসল পরীক্ষা তো টার্ম ফাইনাল। দুই মিডে মিলে বিশ, ফাইনালে পাবো একশোতে একশো। সিজি হবে ফোর। কাব্য বলে, আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ। আমার আসল টার্গেট ছিলো ঐ ফাইনালই। ফাইনালের সিলেবাস আমি আগেই শেষ করে ফেলেছি। খালি পরীক্ষাটা আসুক। জুবায়ের বলে আরে মিড কোনো পরীক্ষা হলো? বেসিকের খেলা দেখবি ফাইনালে। বলেই ও ওর গোবদা মাথায় ঠোকা দেয়। ওদের কথা শুনে আমি ভরসা পাই। ভাগ্যিস এই অসাধারণ রুমটা পেয়েছিলাম!! আমাদের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছিলো দুর্দান্ত। নিশ্চিত সিজি ফোর। পরীক্ষা দিয়ে কেমন স্বাধীন স্বাধীন লাগে। একটা ট্যুর দিলে কেমন হয় এই টার্ম ব্রেকে?
কাব্য বলে,আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ। সাতদিনের বেশি ট্যুর দেওয়াই যাবে না। পরের টার্মের পড়া এখন থেকেই রেডি করতে হবে। ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট দিলো। আমরা ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। এত ভালো পরীক্ষা দিয়েও যখন সিজি তিনের ঘরেও গেলো না, এ জীবন রেখে লাভ কী? আমি সমরেশের কালবেলা পড়া শুরু করলাম, জুবায়ের তখন ওর গার্লফ্রেন্ডকে বলছে, বুঝলা বাবু, এই দুনিয়াতে বেসিকের কোনো মূল্য নাই, বাঙালির এই জন্যই তো দুর্দশা। আবারও মোটিভেশন দিলেন হিমেল ভাই। বললেন এই পোলাপাইন, সিজি সিজি করিস না, সুশান্ত পালের সিজি কত ছিলো জানোস ব্যাটা? সিজি দিয়ে কী হবে? বিসিএসে আসল খেলা হবে।
কাব্য দৌড়ে গেলো সিয়াম ভাইয়ের রুমে। এমপিথ্রি নিয়ে আসলো একটা, আমিও ওর দেখাদেখি সৌদি ভাইয়ের থেকে আরেকটা এমপিথ্রি নিয়ে আসলাম, জুবায়ের অবশ্য এমপিথ্রি না, নিয়ে এলো ক্লাস ফাইভের বোর্ড বই, বেসিক ক্লিয়ার করতে হবে। কাব্য পড়া শুরু করলো, বললো, আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ, ফার্স্ট ইয়ারেই সিলেবাস শেষ করে ফেলতে হবে। জুবায়ের বললো, ওসব এমপিথ্রি দিয়ে কিছু হবে না, বেসিক ক্লিয়ার করতে হবে। ঢাকা কলেজের পোলাদের বেসিক হয় ক্লিয়ার, একেবারে সাদা ফকফকা। আমি ওদের বুদ্ধি দেখে ইম্প্রেস হয়, ভাগ্যিস!! এই রুমটা পেয়েছিলাম!!
হিমেল ভাই বলে, পোলাপাইন!! থ্রি ইডিয়টস মুভিটা দেখছস? আয় দেখি। কাল থেকে কোপাইয়া পড়বো। কাব্য বলে আমি ভাই সিরিয়াস মানুষ। মুভি দেখলে সময় নষ্ট হয়, তবে মোটিভেশনও দরকার আছে। জুবায়ের বলে, খালি ম্যাথের বেসিক ক্লিয়ার করলেই হইবো? ভালো ভালো মুভি দেখে জীবনের বেসিকও ক্লিয়ার করতে হবে। ঢাকা কলেজের পোলাদের বেসিক থাকে ক্লিয়ার, ফকফকা সাদা। আমরা মুভি দেখছি। চতুর রামালিঙ্গাম মেশিনের সংজ্ঞা বলছে, আমরা মুগ্ধ চোখে ওর বলা দেখছি। আমাদের চারজনের টেবিলে চারটা এমপিথ্রি বই খোলা পড়ে আছে, কালকের কোপানোর অপেক্ষায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত