‘জীবন যুদ্ধে যাচ্ছি মা, ফেরার পথে দিদিকে দেখে আসবো’। এই বলে রণজিৎ বেরিয়ে যেতে চায়।
মা বললেন, হাতে খাবার তোলা একটু মুখে দিয়ে যা বাবা। দাও দাও জলদি করো, এই বলে রণজিৎ মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
ওর হাঁ করা মুখ দেখে পাশের বাড়ির চিলেকোঠা থেকে একটা নীরব হাসি ভেসে আসে।
রণজিতের মা ছেলের মুখে এক টুকরো রুটি তুলে বলেন এটা তোর বড়দা’র ভাগ। রণজিৎ কবুতরের মত মুখে তুলে নেয় সেই অংশটি। এর পর সামান্য হালুয়া পুড়ে বলেন এইটা তোর ঠাকুরমার ভাগ। এই ভাবে সংসারের মৃত ব্যক্তিদের নাম উচ্চারণ করে রণজিতের মা তাঁর ছেলের গলা দিয়ে নামিয়ে দেন আস্ত একটা রুটি। তাঁর ধারণা অন্তত এতোটুকু খেয়ে গেলে রণজিৎ পুরো বেলা পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। গার্মেন্টসের সুপারভাইজার হলে কি হবে কৌশলে প্রশ্ন করে তিনি জেনে নিয়েছেন ছেলের বসার জন্য কোন চেয়ার টেবিল নেই।
রণজিতের মা সুযোগ পেলেই আড়ালে-আবডালে চলে যান এবং তাঁর চোখের পানি কাক পক্ষীকেও দেখতে দেন না। এই বয়সে যাকে খেলার মাঠে মানায় অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরিবারের চাপ সামলাতে সেই ছেলে সারা দিন খেটে মরছে কিশোর বয়স থেকে।
‘যাচ্ছি মা’, এই বলে পাশের বাড়ির চিলেকোঠার দিকে এক নজর তাকিয়ে শিকল খুলে বেরিয়ে যায় রণজিৎ।
মা বললেন ‘কতবার না নিষেধ করেছি যাই বলবি না। বল আসছি’।
শুধু রণজিৎ এর মা কেন, কোন মা-ই দিব্যি দিয়ে বলতে পারবেন না হরতালের দিন তাঁর সন্তান ঘরে ফিরে আসবে কি না। এবার রণজিৎ ফিরে এলো না। ফিরে এলো তার মৃত্যুর সংবাদ। খবরটা শোনা মাত্র রণজিতের মায়ের মাথা ঘুরে গেল। চারিদিকের আলো বাতাস তাঁর নিঃশ্বাস চেপে ধরল। মৃত্যুর আগে রণজিৎ নিশ্চয়ই মা মা বলে চিৎকার করেছিল সেই শব্দ তখন শুনতে না পেলেও এখন তিনি সেটা শুনতে পেলেন। তারপর ধপ করে মেঝের উপর পড়ে গেলেন।
জল পানি ছিটিয়ে অনেক চেষ্টা করার পর রণজিতের মায়ের জ্ঞান ফিরে এলো। দুপুরের মধ্যে রণজিতের মৃত্যু সংবাদ পুরো দেশে উল্লেখযোগ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে গেছে। সংগত কারণে রণজিতের মাকে দেখতে এলো অগণিত মানুষ। এর ওর মুখ থেকে নানা রকম রাজনৈতিক আশ্বাস আসতে শুরু করলো এবং টেলিভিশনের ক্যামেরা এসে ঢুকল রণজিতদের বাড়ি। লোক চক্ষুর আড়াল বলে কিছু রইলো না, রণজিতের মাকে পুত্র শোক করতে হচ্ছে অচেনা লোকদের সামনে।
সাংবাদিকরা জানতে চাইছে রণজিৎ কোন স্কুলে পড়তো। সে বিবাহিত ছিল কিনা। শেষ বাতি নিভে যাওয়ায় এখন সংসার কি ভাবে চলবে, ইত্যাদি। এরই মধ্যে রণজিতের পোয়াতি দিদি কাঁদতে কাঁদতে এসে হাজির। খবরটা সে পেয়েছিল সাথে সাথেই। বহুদিনের পোষা রাগ ভেঙ্গে পিছন পিছন এলো জামাইবাবু।
বেশিক্ষণ পুত্র শোক করতে পারলেন না রণজিতের মা। রিয়াজ সর্দারের স্ত্রী আমেনা বেগম বলল যে ভাবে কুপিয়েছে সেভাবে বলির পাঠাকেও কেউ আঘাত করে না। এক্ষেত্রে বলির পাঠা ছিল রণজিৎ তাই রণজিতের মা পুনরায় হুঁশ হারালেন।
রিয়াজ উদ্দিন এই মহল্লার একজন মুরুব্বি। তার বাপ-দাদারা ছিল সর্দার জাতীয় লোক। অনেক আগে পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি দখল করে এলাকায় দাপটের সাথে চলা ফেরা করতো। সে সমস্ত দিন আজ নেই। থাকার মধ্য রিয়াজ উদ্দিনের পুরানো দোতালা বাড়ি আর পুরানো ইজ্জত। তারই স্ত্রী আমেনা বেগমকে মহিলারা বেশ মান্য করে। মহিলাদের বিপদ আপদ হলে সবার আগে সেই এসে পাশে দাঁড়ায়। যে রণজিৎ আজ মারা গেল তার জন্ম হয়েছিল আমেনা বেগমের চোখের সামনে। পাশাপাশি বাড়ি তাদের। আমেনা বেগমের মেজ ছেলে সালাম আর রণজিৎ একই স্কুলে পড়তো, এক সাথে ওরা স্কুলে যেত আবার একই বল দিয়ে খেলত মসজিদের মাঠে। অভাবের কারণে রণজিৎ পড়া লেখা চালিয়ে যেতে পারলো না। সংসারের হাল ধরতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ঠুকে পড়েছিল মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও।
রণজিতের মায়ের জ্ঞান পুনরায় ফিরে এলে তিনি শুনতে পেলেন, ‘আহারে শরীরে অনেক শক্তি ছিল তাই রক্তে ভিজে গিয়েও দু’পায়ের উপর দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটি’। এ কথা শোনা মাত্র রণজিতের মায়ের চোখে ভেসে উঠলো সকালের জল খাবারের দৃশ্য। সংসার থেকে গত হয়ে যাওয়া সদস্যদের নাম করে কিছুক্ষণ আগে ছেলের পেটে সামান্য দানা-পানি দিতে পেরেছিলেন বলে রক্ষে। তিনি আবারো জ্ঞান হারালেন।
খুব সকালে রণজিৎকে হত্যা করা হয়েছিল। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে বেশি দূরে ঘটেনি তার মৃত্যু। ছোট ছোট দল বেঁধে হরতাল উপেক্ষা করে শ্রমিকরা যাচ্ছিল কাজে। উল্টো দিক থেকে লাঠি সোটা নিয়ে তেড়ে এলো একদল যুবক। রণজিতদের পেছন দিয়ে এলো আরেক দল। পট পট দুটো বোমা ফেটে ধোঁয়া বের হতে লাগলো। চোখের পলকে পরিস্থিতি বদলে গেল। একদলের ধাওয়া খেয়ে অন্যদল ভাগতে শুরু করলো গলির দেয়াল টপকিয়ে। যাকে ধরতে পারলো তাকে ঘিরে চলল এলোপাতাড়ি লাথি কিল চড় ঘুষি। কেউ একজন রণজিতকে দেখিয়ে বলল ‘ওই চিকন ছেলেটা ককটেল ছুঁড়েছে’। আর যায় কোথায় মৌচাকের মত লাঠি সোটা নিয়ে ছুটে এলো কিছু যুবক। রণজিতের আকুতি কেউ শোনেনি। তাঁর কথাও কেউ বিশ্বাস করেনি। সে যে রাজনৈতিক কর্মী না বরং একজন গার্মেন্টস শ্রমিক সে কথায় কেউ আগ্রহ দেখাল না। খুব সহজেই তাকে ধরাশায়ী করে ফেললো সাত আটজন ছেলে। এক পর্যায়ে নেতা গোছের এক যুবক এগিয়ে এলো ধারালো একটি অস্ত্র নিয়ে। পার্টির স্থানীয় লিডারের কাছে বিশ্বস্ততা পাবার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। বিপক্ষ দলের কাউকে মারতে পারার পুরস্কার হয় অন্যরকম। রণজিতের উপর সে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করলো নিজের নামকে ধারালো করতে। বীরত্ব ফুটিয়ে তোলার প্রতিটি আঘাত করা হয়েছিল শরীরে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যে কারণে চোখের পলকে রণজিতের সার্ট লাল হয়ে গেল। ভিডিও ফুটেজে সে দৃশ্য দেখল দেশের লোকে। রক্তে ভেজা সার্ট গায়ে রেখে সে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল বেঁচে থাকতে। তার বাবাও অনেক দিন আগে এভাবেই রক্তে ভিজে স্বর্গবাসী হয়েছিল। রণজিৎ দেখতে পাচ্ছিল মৃত বাবা এবং তার মধ্যে দূরত্ব দ্রুতই কমে যাচ্ছে। যেন হাত দিয়ে ছুঁতে পারলেই বাবার বুকে লেপটে যেতে পারবে। কতদিন বাবাকে দেখেনি অথচ সেই মুহূর্তে বাবার মুখটা বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল। কিন্তু মায়ের কথা মনে হতেই তাঁর কাছে থেকে যেতে মন চাইলো। বড় একা হয়ে যাবেন তিনি। মায়ের কোলে যেতে পারলেই যেন শান্তি। মা মা বলে পালাবার চেষ্টাও করেছিল। বেশি দূর যেতে পারেনি, জীবন বাঁচাবার যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ফুটপাথের উপর পড়ে থাকলো তার নিষ্প্রাণ দেহ। তখনো অনেকে সেদিনের সকাল দেখেনি ভাল করে, দেখেনি ভোরের কুয়াশা মিটে গেলে কি করে জেগে উঠে ব্যস্ত শহর। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে সেদিন রণজিৎ দেখছিল একটি তাজা প্রাণ কি করে দেহ ত্যাগ করে উড়ে যায় দূর আকাশে।
রণজিতদের প্রতি মহল্লা বাসীর আগ্রহ যেন অল্পতেই মিটে গেল। এমনতো প্রতিদিনই হচ্ছে তাছাড়া রণজিতের কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। দলীয় পরিচয় না থাকলে হরতালের মৃত্যু সাধারণত কোন গুরুত্ব পায় না। সকলে ধরে নিলো সড়ক কিংবা লঞ্চ স্টিমারের দুর্ঘটনার মতো এটাও একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনা। সন্ধ্যায় হাওয়া অন্যদিকে মোড় নীল। রণজিৎ কাদের লোক, এবং তার মৃত্যুতে কোন পক্ষের জয় হয়েছে কোন পক্ষের মাথা হেট হয়েছে তার একাধিক বিবরণ আসতে লাগলো। এক দল বললো হরতাল সফল অন্য দল গলা ফাটিয়ে বললো এটা ছিল মানুষ মারার হরতাল। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে একজন বললো ‘সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ কবে বন্ধ হবে কে জানে’। ফেসবুকে উঠে এলো রণজিতের ছবি। টেলিভিশনের টকশোতে বিদ্যুৎ গ্যাস পানির মতো রণজিতও কিছু দিনের জন্য আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।
সকালের উত্তাপ বিকেলে এসে যেমন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। রণজিতের গল্পও সেভাবেই শেষ হতে লাগলো। তবে শেষ হতে হতেও গল্পের শিকড় গজিয়ে উঠলো রিয়াজ উদ্দিনের ছোট্ট চিলেকোঠায়। আদিবা তার এক মাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকতো চিলেকোঠায়। ছেলেটির বয়স ছয়। রণজিতের বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা দেখার জন্য ছাদের রেলিং ধরে ছেলেটি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে গেল ক’টা দিন। রাতে ঘুমাবার আগে বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে ছেলেটি তার মায়ের কাছে গল্প শুনতে চাইতো। তার প্রিয় বিষয় ছিল পাখি।
একসময় আদিবার স্বামী এবং রণজিৎ একই স্কুলে পড়তো। একই বল দিয়ে খেলত মসজিদের মাঠে। সিনেমা দেখতে যেত একই সাথে। পড়ার লোক ওদের বন্ধুত্বের নাম দিয়েছিল সালাম-জিত। বিয়ের পর থেকেই এসব কথা শুনে আসছে আদিবা। বিয়ের মাত্র দুই বছরেরে মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে সে ভুলে যেতে বসেছিল স্বামীর আচার আচরণ অথবা তার চেহারা কেমন ছিল। চিলেকোঠায় দাড়িয়ে পাশের বাসার রণজিতকে সে দেখত আড়াল থেকে। রণজিৎ যখন হাটা-চলা করত তখন আদিবা যেন তার মৃত স্বামীর ছায়া দেখতে পেত। রণজিৎ যখন শব্দ করে কথা বলতো তখন আদিবার কাছে মনে হত কে যেন তার কাছে কিছু চাইছে। ব্যাপারটা রণজিতের চোখে পড়ে যায় একদিন। তারপর ওদের চোখাচোখি হয়েছে অনেক বার। হয়েছে চোখে চোখে কথা। রিয়াজ উদ্দিনের যৌথ পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক। কে কি খেল কে কোথায় গেল তার খবর রাখা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। লোক চক্ষুর আড়ালে কেমন করে যেন স্বামীর বন্ধু এক সময় খুব আপন হয়ে উঠেছিল আদিবার চোখে।
রণজিতের মৃত্যুর কয়েকদিন পর এলো পূর্ণিমা। সে রাতেও আদিবার ছেলে গল্প শুনতে চাইলো এবং পূর্ণিমার রাত থাকার কারণে ছেলেটি পাখি বিষয়ক গল্প শোনার আবদার করলো। ছেলেকে কোলে টেনে নিয়ে আদিবা গল্প বলতে শুরু করলো, বিষয় পাখী।
মা, কোন পাখি তোমার সব চেয়ে বেশি প্রিয়।
ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদিবা বলে- নীল পাখি।
তুমি নীল পাখি দেখেছো।
হাঁ দেখেছি। এইতো এখনো দেখছি। দুটো নীল পাখি পাশাপাশি উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে।
কোথায় নীল পাখি আমাকে দেখাবে
সবাই নীল পাখি দেখতে পারে না।
পাখির রঙ কিভাবে নীল হয়।
দূরের জিনিস দেখতে নীল হয়। যে যতো দূরে সে ততো বেশি নীল।
ছেলে ঘুমিয়ে গেলে আদিবা এক মনে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। তার বুকের মাঝখানে অনেক ক্ষণ থেকে আটকে ছিল একটা নিঃশ্বাস। এক সময় সেটাকে ছেড়ে দিতে সে বাধ্য হয়। বুকটা তখন বেশ হাল্কা লাগে তার। আবারো তার চোখ চলে যায় আকাশে উড়ে বেরানো দুটি পাখির দিকে। তারপর স্বপ্রণোদিত হয়ে আদিবা বুকের মধ্যে চেপে রাখার চেষ্টা করে অন্য একটি নিঃশ্বাস। এভাবে সে পাখি হবার পরীক্ষা নেয় নিজে নিজে। বুঝতে চেষ্টা করে পাখী হবার কষ্ট। একদিন সেও আকাশের পাখি হয়ে দুটি পাখির মাঝে জায়গা করে নিবে। তারপর ডানা মেলে ওদের সাথে উড়ে বেড়াবে আকাশে। সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসতে বিলম্বিত হওয়ায় চিলেকোঠায় বসেই মাঝে মাঝে সে উড়তে থাকে। তার অদৃশ্য ডানা কেউ দেখতে পায় না। সেগুলোকে সারাক্ষণ লুকিয়ে রাখে সাদা শাড়ির নিচে।