নারকেল পাতা থেকে টিনের চালে টুপটুপ শিশির পড়ে। দোতলা থেকে শিউলি গাছটার আবছা জেগে থাকা দেখা যায়। পাশের পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে মহালয়ার পর থেকেই ভোররাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ বাজে। সামনেই প্রথম সেমেস্টার, ভোররাতে মা ডেকে দেয় পড়ার জন্য।
১.
বিদ্যুত্হীন গ্রামগুলোয় সন্ধ্যা ঘনায় দ্রুত। আমায় ডেকে দিয়ে কেরোসিন বাতি নিয়ে ঢেঁকিঘরে ধান ভানে মা। ভোররাতে এই ঢেঁকির শব্দ, রাতের হৃদ্স্পন্দন মনে হয়। শিউলি খসা শুরু হয় আর একটু পরে।
মহালয়ার পর থেকেই প্রতীক্ষা শুরু হয়। চোখ চেয়ে থাকে। শিশিরের শব্দ ভেঙে শিউলি গাছের নীচে এসে বসবে দু’টি রাঙা পা নিয়ে মৌবনী। আঁধার পায়ে, চুপিচুপি মৌবনী এসে বসে শিউলিতলায়। হৃদ্স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে যায়। মৌবনীর হাতে ভেঙে যায় শিউলির লজ্জা। নরম হাত খঁুটে নেয় সাদা ফুল। সাজিতে তুলে রাখে। কাঁপা-কাঁপা চোখে চেয়ে থাকি। আমার আলোজ্বলা দোতলার জানলায় চোখ রাখে মৌবনী। চুরি করে দেখে নেয় আমায়। আমি দেখি না, অথবা দেখি অন্ধ শরীর।
আমি শব্দ করে পড়ি। আঁচল ভরে উঠলে ফুলে, উঠে যায় চুপিসারে। মা অন্ধকারে দেখে নেয় মৌবনীর উঠে যাওয়া। ঢেঁকিঘর পেরোতেই মা ডেকে উঠে, ‘‘মৌ কবে এলি?”
“কাল সন্ধে ছ’টায়।”
মৌবনী মায়ের কাছে গিয়ে বসে, আমি পড়া থামিয়ে দিই। মা ঢেঁকির তালে-তালে, মৌবনীকে প্রশ্ন করে চলে। মৌ উত্তর দেয়। দুটো ঢেঁকির শব্দের মাঝে কথাগুলো চেপে আমার কানে আসে।
মা চিত্কার করে বলে,‘‘নীল ঘুমিয়ে পড়লি?”
মা এত শব্দের মাঝেও কী করে বোঝে আমি পড়া থামিয়েছি! আবার শব্দ করে পড়তে শুরু করি।
সারা বছর অপেক্ষায় থাকি পুজোর ক’টা দিনের জন্য। এই সময় মামার বাড়ি আসে মৌবনী। দু’ হাতে শিউলি কুড়োয়। সবাই জেগে ওঠার আগে, আমি শিউলিতলায় মৌবনীর পায়ের পাতার দাগগুলো অনুভব করি। দু’ হাত থেকে শিউলি ফুলের উপর ঝরে পড়া আদর, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে সারা শিউলিতলা।
মা সকালে গোবর দিয়ে শিউলিতলা লেপে দেয়। মৌয়ের ছোঁয়া আমাদের আঙিনা থেকে সেদিনের মতো মুছে যায়। শুনেছি, মৌবনীর মায়ের সঙ্গে আমার বাবার প্রেম ছিল। পাড়ায় বিয়ে দিতে রাজি হয়নি ঠাকুরদাদা। দুই পরিবারের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ ছিল অনেকদিন। দূর গাঁয়ে মৌবনীর মাকে বিয়ে দিয়েছিল। তাই মৌবনীরা মামাবাড়ি খুব কমই আসত।
২.
হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরে ক’টা দিন বাবার শাসনে আর মায়ের আদরে কাটে। পড়া শেষ হলে মা নাড়ু, মোয়া খেতে দেয়।
শেষ আশ্বিনের নদীপাড় জুড়ে কাশ আর হোগলায় মাখামাখি। বড় কাশ ফুলগুলো যেন সমুদ্র ফেনার মতো ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতিময়। একমুখী প্রবাহ ছেড়ে নদী ফেরে জোয়ারভাটায়। হৃদয়টাও একমুখী প্রবাহ ছেড়ে ফিরে আসে।
বেলা বাড়লে বাবা মাঠে ডেকে নিয়ে যায়। বাবার সঙ্গে কড়াইশুঁটি ক্ষেতে চাষ করি। দৈর্ঘ্য চাষ, প্রস্থ চাষ, লাঙলফলা বেঁকে যায়। বাবা ধমক দেয়, হাত পেকে ওঠে আমার। বলদের লেজে হাত দিলে অদ্ভুত সব শব্দ বেরোয়। পোষমানা গরুগুলো বাবার কথা বোঝে। আমার শব্দ ওদের কাছে বড্ড অচেনা, তবু বলদ দুটো হেলেদুলে হেঁটে যায়। শক্ত মাটির ঢেলাগুলো পায়ে লাগে, ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। আর বুক ভরে নিই মাটিচেরা উষ্ণঘ্রাণ। বুঝি, এখানেই নবজাতক আসবে ক’দিন পর। এটা তারই প্রস্তুতি। তবে বাবাও ‘দাই’। আমিও কি?
রোদ ওঠে। মাঠ থেকে দেখা যায় রাস্তা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মৌবনী লাঙল দিয়ে আমার মাটি চষা দেখে। মাঠ পিষে যায় দুটো জোয়ালের শরীরে। মৌবনীর শরীরে শিহরণ জাগে। হলুদ পাখির মতো নেচে ওঠে মৌবনী। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। চাষের লাইন বেঁকে যায়। ঢেলাগুলো পায়ে এসে আরও জোরে লাগে। শিশিরভেজা মাটি পা মুড়ে দেয়। ডান হাত, বাঁ হাতে ঘোরে লাঙলের গুটি। বাবা কোদাল দিয়ে আল কাটে।
সাদা মেঘ ভাসে আকাশে। তুলোর মতো নরম-নরম। লাঙলের সঙ্গে হাতের ঘর্ষণে আমার হাতে ফোসকা পড়ে। তরঙ্গের মতো সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়ে লাঙলের চাষ। মাথায় কম্পাঙ্ক, দোলনকাল ঘোরে। ক্লাসের সেরা সেঁজুতি, দোলন কালের অনাবিষ্কৃত সূত্র বোঝায় আমায় একা পেলে, প্র্যাক্টিকাল রুমে, চোখ ও ঠোঁটের ভাষায়। বলদের পায়ে কোনও ব্যাস বা ব্যাসার্ধ থাকে না, গরু দুটো সমান্তরালে এগিয়ে যায়। হিসেব মিলে যায় সহজে।
আর আমি গুলিয়ে ফেলি, এই দুপুর রোদের সঙ্গে সেঁজুতিদের এসি গাড়িতে সুখকর যাপন, স্ট্রেট ভেলোসিটি, রোটেশন-মোশন ও দোলন কালের। চাষ এলোমেলো হয়ে যায় মৌবনী ও সেঁজুতির মাঝখানে। বাবা অশ্লীল ভাষায় নিজেকেই গাল পাড়ে, “নবাবজাদা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খরচ কোথা থেকে আসে একটু বোঝার চেষ্টা করো, হালটা তো ঠিক করে ধরতে শেখো।”
৩.
মৌবনী বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসে, আমার পড়ার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “চলো নীলদা, আমাদের বিলের ধার থেকে ঘুরে আসি।”
আমি বলি, “তুই মাকে বল।’’
ও মায়ের কাছে যায়। মাকে বুঝিয়ে রাজি করায়। মা বলে, সন্ধের মধ্যে ফিরে আসিস। মায়ের মনে কি ভয় কাজ করে?
মৌবনী আমাকে টেনে তোলে পড়ার টেব্ল থেকে। দু’জনে হাঁটি। হাঁটতে-হাঁটতে ও আমায় বলে, “আমি কিন্তু কাদা মাখতে পারব না। তুই আমায় কোলে করে নৌকায় তুলে দিবি। বলিস না, লোক দেখবে।’’
বিলের কাছে এলে ওকে কোলে করে নৌকায় তুলে দিই। ও মাচানে বসে থাকে। আমি নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাই। মৌবনী জল ছিটিয়ে দেয় আমায়। আমি কোনও কথা বলি না। জানি, বললেও শুনবে না। আমি ওকে সেঁজুতির গল্প বলি।
ও বলে, “ওকে আমি দেখে নেব।”
“আমি তোর কে? যে, আমার জন্য তুই ওকে দেখে নিবি?’’
“তুই শুধুই আমার। এখানে কেউ হাত দিলে, আমি গলায় দড়ি দেব।”
“তুই কী করে জানলি, আমি তোর?”
“ভোরে আমি যখন শিউলি কুড়োতে আসি, তুই পড়া বন্ধ করে তাকিয়ে থাকিস।”
“তুই কী করে বুঝিস?”
“আরে বোকা, তুই তো আলোয় থাকিস, আমি অন্ধকারে। যারা আলোয় থাকে, তাদের তো দেখা যাবেই।”
আমার হাসি পায়। হাতের ফোসকাগুলোয় চাপ লাগে, ব্যথায় ককিয়ে উঠি। মৌবনী বুঝতে পারে।
“নীলদা, তুই লাঙল চালাস কেন, হাতে ফোসকা পড়ে। তুই পারিস এসব?”
“বাবা সারাবছর মাঠে খাটে। আমি এই ক’টা দিন বাবাকে একটু সাহায্য করি। হাড়ভাঙা খেটে বাবা শহরে টাকা পাঠায়, মাও কষ্ট করে।”
“তুই যখন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবি, তখন তো এদেরই অনেক সুখ হবে।’’
“জানি না রে!”
পুকুরপাড়ে নৌকা ভেড়াই। দু’জনে নেমে যাই। পুকুরের পাড় জুড়ে পেঁপে, কলা, সুপারি, কয়েকটা আম-জাম গাছ।
হালকা উত্তুরে হাওয়ায়, মৌবনীর গা থেকে বীজতলার গন্ধ ভেসে আসছে। আমি ভাবছি, প্রত্যেক নারী একটা বীজতলা। এখানেই ফসল ফলে আর সেই ফসল আমরা কেটে নিই। সবুজ চুড়িদারে মৌবনীকে একটা শিউলি গাছ মনে হয়।
আমি মৌবনীর চোখে তাকিয়ে বললাম, “আমি তোর শিউলি ফুল দেখব।”
ও বলল, “বোকা, এই বিকেলে কি শিউলি ফোটে? ওটা রাতের ফুল, সূর্য দেখলেই ঝরে যায়।”
“তা হলে হাসনুহানা, গোলাপ, জবা, যা কিছু একটা দেখা।”
আমায় বলল, “আমার চোখের দিকে তাকা, এটা পদ্মকলি। ঠোঁটের দিকে তাকা, এটা গোলাপ পাপড়ি।” পাপড়ির আঘাত দেবে বলেই ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটকে জাপটে ধরে। আমার ঠোঁট ভিজে যাচ্ছে গোলাপ জলে।
সন্ধ্যা নামলে আমি আর মৌবনী নৌকায় উঠি। বাড়ি ফেরার সময় মৌবনী বলল, “নীলদা, তুই এই অন্ধকার ভেদ করতে পারিস?”
আমি লগা ছেড়ে মাচানের দিকে আসি। ছোট ডিঙিনৌকা দুলে উঠে। আমি ওর শরীরকে ছঁুয়ে দেখি। আমায় জাপটে বসে থাকে মৌবনী। আমি ওর শিউলি বোঁটায় হাত রাখি। শিউলি কুঁড়িতে সবে গন্ধ দানা বেঁধেছে। আমি ঠোঁট রাখি শিউলি বোঁটায়। আমার ফোসকা-পড়া হাতের তালুতে কিছু পাপড়ি খসে পড়ছে। নৌকায় জল উঠছে দ্রুত। আমরা কি দু’জনেই ডুবে যাচ্ছি?
শিশিরের স্রোত নামছে মৌবনীর গা থেকে। বিন্দু-বিন্দু এই শিশিরধারা নদী হয়ে বইছে আমার হৃদয়ে। এই নদীপাড় জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সেঁজুতির মতো যারা।