বাবা

বাবা
আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি আর আমার ছোট ভাই ক্লাস সেভেনে। বাসার সামনে দুইভাই মিলে ক্রিকেট খেলছিলাম। হঠাৎ বাবা আমাদের ডেকে বললো,
-চল সামনে থেকে হেটে আসি আমরা হাটতে হাটতে মেইন রাস্তার সামনে আসলাম। বাবা যখন রিকশা ডাক দিলো তখন আমি বললাম,
— রিকশা ডাকছো কেন? বাবা হেসে বললো,
– কয়েকদিন পরে তো ঈদ। তোমাদের শপিং করে দিতে হবে না? আমি আবাক হয়ে বললাম,
— তুমি শপিংয়ে যাবে আগে বলবে না? তৈরি হয়ে বের হতাম। তাছাড়া তুমি লুঙ্গি পরে এসেছো বাবা হেসে বললো তখন,
-পোশাকে কি আসে যায়? তোদের ভালো জিনিসটা কিনে দিতে পারলেই হলো বাবার কথা শুনে খুব রাগ হলো আমার। বাবার পরনে লুঙ্গি, আমার পরনে সুতি টাউজার আর রং জ্বলে যাওয়া টিশার্ট আর ছোট ভাইটা ক্রি-কোয়ার্টার পরেছে। তাছাড়া আমাদের ৩জনের পায়ে প্লাস্টিকের সেন্ডেল ছিলো। এই অবস্থায় দোকানদার আমাদের ঢুকতে দেয় কি না কি জানি সচরাচর শপিংমলে ঢুকলে দোকানদারগন ক্রেতাদের ডাকাডাকি করে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে হলো উল্টো। আমরা যদি কোন দোকানে ঢুকে কাপড় দেখতে চাই দোকানদার আমাদের কিছু না দেখিয়ে অন্য ক্রেতাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। একজনতো বলেই দিলো, ” ভাই যান তো। বিরক্ত করেন না যে” রিচম্যান শো-রুমে যখন ঢুকি তখন কর্মচারী ছেলেটা আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুব ভালো করে দেখলো। আমরা কাপড়চোপড় যখন হাতে নিয়ে দেখছিলাম তখন দোকানের ম্যানেজার এসে বাবাকে বললো,
~স্যার, এটা কিন্তু একদরের দোকান। এইখানে কোন দামাদামি হয় না। যত মূল্য লেখা থাকে ততই দিতে হয়। আপনারা বরং অন্য কোন দোকানে যান। বাবা কিছু না বলে একমনে কাপড় দেখতে লাগলেন সেদিন আমরা সেই শো-রুম থেকে ২১ হাজার টাকার মার্কেট করি। বাবা ম্যানেজারকে টাকা গুলো দিয়ে বললেন,
-অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সময় আমি বেশিভাগ সময় লুঙ্গি পরেই থাকতাম । আর দেশে আপনি কি না সামান্য দোকানেই ঢুকতে দেন না ম্যানেজার কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলো। যখন বের হয়ে যাবো তখন ম্যানেজার বাবাকে বললো,
~স্যার আবার আসবেন
বাবা হেসে বললো,
-আসলে ঢুকতে দিবেন তো? ছোট মামার বিয়ে উপলক্ষে আমরা সমস্ত আত্মীয়-স্বজন সবাই এক হয়ে ছিলাম। রাতে যখন সবাই মিলে আড্ডা দেই তখন আড্ডার এক পর্যায়ে ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের খাবারের প্রসঙ্গ উঠে। বাবা তখন আমাদের বললো,
-ছাত্র জীবনে আমি যতবার ঢাকা গিয়েছি ততবারই হয় ইটালিয়ান হোটেল নয়তো সালাদিয়া হোটেলে খাবার খেয়েছি। ওদের খাবের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। যে একবার খাবে সে কখনোই ভুলবে না বাবার কথা শুনে ছোট খালা বললো,
~দুলাভাই, আমরা তো ঢাকাতেই থাকি। এই হোটেলগুলো কোথায়? একদিন না খাবার খেয়ে দেখলাম বাবা তখন বললো,
-এইসব হোটেলে খাবার যোগ্যতা তোমার এখনো হয় নি বাবার কথাতে ছোট খালা খুব রেগে গিয় বললো,
~দুলাভাই, আপনার থেকে আমার জামাই আল্লাহ রহমতে কোন অংশে টাকা কম ইনকাম করে না। ঢাকার নামকরা প্রতিটা রেস্টুরেন্টে আমার খেয়ে অভ্যাস আছে আমি তখন বাবাকে বললাম,
— খুব দামী হোটেল নাকি বাবা? বাবা হেসে বললো,
-হ্যাঁ, খুব দামী হোটেল। ইটালিয়ান হোটেল মানে ইটের উপর বসে খেতে হয় আর সালা দিয়া হোটেল মানে সালা(পাটের বস্তা ) দিয়ে ঘেরা হোটেল। তোমার ছোট খালার জামাই অনেক টাকা ইনকাম করে তো। তাই এইসব হোটেলে তোমার ছোটখালা খাওয়ার যোগ্যতা রাখে না বাবার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো আর ছোটখালা মুখ গোমড়া করে বসে রইলো ভার্সিটিতে পড়ার সময় একবার এক বিষয়ে ফেল করলাম। অথচ এই বিষয়ে আমার ফেল করার কথা না। রাতে না খেয়ে মন খারাপ করে যখন বসে ছিলাম তখন বাবা আমার কাছে এসে বললো,
-আমি বি এ পরীক্ষায় এক বিষয়ে কেন ফেল করেছিলাম জানিস? আমি লুঙ্গি না পরে ভুল করে প্যান্ট পরে গিয়েছিলাম । তাই ফেল করেছিলাম আমি অবাক হয়ে বললাম,
–মানে! বাবা তখন বললো,
– ছোট থেকে যেহেতু ব্যবসা করি সেহেতু পড়ার তেমন একটা সময় পেতাম না। পরীক্ষার আগের দিন রাতে সাদা লুঙ্গির মধ্যে নকল লিখতাম। আর লুঙ্গি পরে পরীক্ষার হলে যেতাম। সেবার সারা রাত লুঙ্গির মধ্যে নকল লিখলাম কিন্তু সকালে ভুল ক্রমে লুঙ্গির বদলে প্যান্ট পরে হলে চলে গেলাম। তাই আমার বি এ পাস করা হয় নি। বাবার কথা শুনে আমি হাসতে লাগলাম তখন বাবা বললো,
– সামনের সেমিস্টারে তোকে সাদা লুঙ্গি কিনে দিবো। এখন মন খারাপ না করে খেতে আয় বলছি আমরা ভাইবোনরা যখন মেসে থেকে পড়াশোনা করতাম বাবা বাসায় একদিনও বড় মাছ কিংবা গোশত এই গুলো বাজার করে আনে নি। বাবা বলতো, আমরা ছেলেমেয়েদের রেখে এইসব খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না। বাবা যখন জানতো আমি বাসায় আসছি বাবা আগে থেকেই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতো। বাস থেকে নামার সাথে সাথেই বাবা আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিতেন।
কিন্ত এখন আর আমার বাবা আমার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করে না। আমার নামটাও বাবা ভুলে গেছে। ৫বছর আগে বাবার ব্রেইন টিউমার হয়েছিলো। অপারেশনের পর বাবার সারাশরীর অবশ হয়ে গেছে। ইদানীং বাবার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। আর এই ক্ষতগুলো আস্তে আস্তে পচে যাচ্ছে। বাবার জীবনের এই শেষ মুহুর্তেও বাবাকে কখনো বলতে পারি নি, বাবা তোমায় ভালোবাসি; বাবা তোমায় প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। যে ছেলেটা বাবার এক কথাতে মরে যেতে রাজি আমি তার থেকেও তোমায় ১০০গুণ বেশি ভালোবাসি বাবা
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত