বাসাটা শেষপর্যন্ত ছেড়েই দিলাম।না,ছেড়ে দিলাম কথাটা ঠিক না,বাড়িওয়ালাই একরকম নামিয়ে দিলো।আট বছর ধরে এখানে আছি।আমার মেয়েটার জন্ম এই বাসায়।আমার স্ত্রী তো রাত থেকে কেঁদেকেটে অস্থির।ওর নাম জুঁই।আমি বুঝতে পারছি,বাসাটা ছাড়তে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।কষ্ট যে শুধু ও একা পাচ্ছে,তা না।আমিও পাচ্ছি।আর পাওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের দীর্ঘ আট বছরের অসংখ্য হাসি-কান্না আর সুখ-দুঃখের স্মৃতি মেখে আছে এই বাসার দেয়ালে দেয়ালে।অদ্ভুত একটা মায়া পড়ে গেছে বাসাটার উপর।তাই বলে বাসা ছাড়তে এতোটা কষ্ট হবে ঘুনাক্ষরেও তা টের পাইনি আগে।যাই হোক,মায়া দিয়ে তো আর পৃথিবী চলে না,বেঁচে থাকার জন্য দরকার টাকা।প্রচুর টাকা।পৃথিবী চলে টাকা দিয়ে।
যারা বলে টাকা পয়সা আসলে কিছু না,খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরা কোনদিন টাকার অভাব কী,তা বোঝেনি।টাকার অভাবে একবেলা না খেয়ে থাকেনি।টাকার জন্য মানুষের কটু কথা শোনেনি।সবাই প্রচুর পয়সা পাতির মালিক।গরীব মানুষের দুঃখ নিয়ে চটকাচটকি করতেই মূলত এরা এইসব কথাবার্তা বলে।এসব বলে এরা ভারী আনন্দ পায়।
আমি প্রথম ঢাকায় আসি ২০১১ সাথে।এসে উঠি আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের পাশে একটা মেসে।এর পরের বছর বিয়ে করি।বিয়ের পর জুঁইকে ঢাকায় নিয়ে আসি।তখন উঠি এই বাসায়।বাসাটা দৈনিক বাংলা মোড় আর মতিঝিলের মাঝামাঝি,ক্লাব পাড়ায়।একতলা আধাপাকা বাড়ি।দুইটা রুম,একটা বারান্দা,একটা বাথরুম আর রান্নাঘর।বাড়িটা দক্ষিণ মুখী।প্রচুর আলো বাতাস।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে,এই বাড়িটার গেটের কাছে এক ঝাড় কলাগাছ আছে অনেক বছর ধরে।ঢাকা শহরে আর কোনো বাসায় এমন কলাগাছ আছে বলে আমার মনে হয় না।তাও আবার এতো প্রপার জায়গায়!
আমার মেয়েটার নাম সেজুঁথি।ও ‘ক’ বলতে পারে না,বলে ‘ত’।একটু পরপর কলাগাছের সামনে এসে কলার দিকে তাকিয়ে বলে,’তলা’।বাবা এইতা তলা।কবিতাকে বলে তবিতা।রাতে ওর মা কবিতা বলে বলে ঘুম পাড়ায়।এইজন্য শুতে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,বাবা তবিতা বলো।বাসাটা ছাড়তে হচ্ছে,আমার দুই বছরের এতটুকু বাচ্চা কিছু বুঝতে পারছে কি না,জানিনা।তবে দুইদিন থেকে মেয়েটার মুডও অফ।শিশুরা বিপদাপদ টের পায় সম্ভবত সবার আগে।
এই বাড়িটা বানানো হয়েছিলো মনে হয় ড্রাইভার,কর্মচারী ধরনের স্টাফদের জন্য।পরে বাড়িওয়ালা হয়তো দেখলো যে,ভাড়া দিলে যেহেতু বারো-চৌদ্দ হাজার টাকা আসছে মাসে মাসে,সেহেতু এভাবে ফেলে না রেখে ভাড়া দেয়াই ভালো। আমি দৈনিক বাংলা মোড়ে একটা ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে ফাস্টফুড বিক্রি করি।এছাড়া জুঁই বাসা থেকে বিভিন্নরকম পিঠাপুলি বানিয়ে দেয়,সেইগুলাও বিক্রি করি।ইনকাম খারাপ না।প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে আব্বা-মাকে ছয় সাত হাজার টাকা পাঠাই,নিজের সংসার খরচ,বাসাভাড়াসহ টুকটাক খরচের পরও কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামে একটু জায়গা কিনেছি।
বাড়িওয়ালার বাবা মারা গেছেন বছর চারেক আগে।এই বাড়িতে ওঠার আগে থেকেই ভদ্রলোক আমার দোকানে কফি খেতেন নিয়মিত।এভাবে তার সাথে আমার ভালো সখ্যতা হয়।তাঁর মাধ্যমেই আমি এই বাড়িটা ভাড়া পাই।বাড়িওয়ালা পরিবার নিয়ে থাকে পাশেই দোতলা বাড়িটাতে।তার দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েটা বড়ো।তার নাম ইয়াসমিন।সে জামাইকে নিয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়।তার সাথে জুঁইর ভালো বন্ধুত্ব ছিলো।সে বোধহয় আমাদের ব্যাপারটা জানে না,জানলে বাড়িওয়ালা এমন আচরণ করতে পারতো না। একবার ইয়াসমিনের পেটে টিউমার ধরা পড়লো।ভয়ে মেয়েটা কুকড়ে গেলো।জুঁই সারাক্ষণ তার পাশেপাশে থাকলো নিজের বোনের মতো।ল্যাব এইড হাসপাতালে অপারেশন হলো,সেখানেও জুঁই থাকলো।ইয়াসমিন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত জুঁই ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে পারেনি।কিছু কিছু মানুষ অন্যকে ভালোবাসার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে জন্মায়,জুঁই তাঁদের একজন।
ইয়াসমিন যখন অস্ট্রেলিয়া চলে যায়,তখন সবার সাথে মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছে।জুঁইয়ের কাছে এসেই ভেঁউভেঁউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়েছে।মাঝেমধ্যে সে অস্ট্রেলিয়া থেকে সেজুঁতির জন্য খেলনা কিনে পাঠায়।জুঁই একবার বলেছিলো ইয়াসমিনকে ব্যাপারটা জানাতে,কিন্তু আমিই রাজি হইনি।সামান্য একটা বাসার জন্য মানুষের দয়া ভিক্ষা করার কোনো মানে হয়না।মধ্যবিত্তদের আত্মসম্মানটাই বড়ো কথা।ধনীদের লাগে না এই জিনিস।
সবকিছুই ঠিকঠাকই চলছিলো,মার্চ মাসের মাঝামাঝি এসে সব এলোমেলো হয়ে গেলো।লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ হয়ে গেলো।জমানো টাকা দিয়ে এতদিন চলেছি।ইনকাম বন্ধ থাকলেও খরচ কমেনি,বরং বেড়েছে।বড়োভাই গ্রামে মিথ্যা একটা মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল,সেই ঝামেলা মেটাতে অনেক টাকা দিতে হলো আমার।সব মিলিয়ে জমানো টাকা প্রায় শেষ।এইজন্য চলতি মাস সহ মোট তিন মাসের বাড়িভাড়া দিতে পারিনি।
অবশ্য বাড়িওয়ালাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছি।প্রথমে উনি রাজি ছিলেন,কিন্তু যখন দেখলেন দেশের এই অচল অবস্থার আশু কোনো সমাধান নেই,তখন আর ভরসা পেলেন না।অবশ্য তারই বা কী দোষ?কবে এই সমস্যার সমাধান হবে আর কবে আমার দোকান চালু হবে,তার ঠিক নেই।সুতরাং দিনের পর দিন বাকিতে বাসাভাড়া দেয়ার কোনো মানে হয়না যেখানে নগদ পরিশোধ করার মতো ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে হরদম।মানবতা এক মাস -দুই মাস দেখানো যায় বড়োজোর, এর বেশী না।
ঢাকায় যখন প্রথম আসি,তখন আমার সাথে কিছুই ছিলো না।এরপর মেস থেকে যখন এই বাসাটায় উঠি,তখন মাল জিনিস বলতে বালিস,তোষক,বিছানার চাদর, একটা চৌকি খাট,নিজের প্লেট গ্লাস আর ব্যবহারের কাপড়চোপড়,এইসব।এরপর আস্তে আস্তে জুঁইকে নিয়ে সংসার শুরু করলাম। আজ এটা কিনি,কাল সেটা কিনি,এইভাবে সংসারে আজ অনেক জিনিসপাতি হয়ে গেছে। মাল জিনিস সব দুইটা মিনি পিকাপে তোলা হয়ে গেছে।এখন পিকাপের উপরে ত্রিপল দিয়ে বাঁধা হচ্ছে।এগুলো নিয়ে যাবো গাজীপুর আমার এক বন্ধুর বাসায়।ওখানে তার নিজের বাড়ি।অনেকখানি জায়গা নিয়ে ওর বাড়িটা।জুঁইকে নিয়ে কয়েকবার গেছি বেড়াতে।ওরা সবাই খুবই আন্তরিক।আমাদের এই চরম দুঃসময়ে ওদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলো,কিন্তু আমি রাজি হইনি।
দূরে আছি বলেই সম্পর্কটা ভালো আছে,কাছে গেলে গিট্টু ছুটে যাবে।তারচেয়ে ওদের স্টোর রুমে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ মালামালগুলো রাখতে দিচ্ছে,এই বেশী।উপায় নেই দেখে রাখছি।কবে সবকিছু ঠিকঠাক হবে,কবে আমার ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারবো,আল্লাহ জানেন।ততদিন জিনিসপাতিগুলা নিরাপদে থাকুক। সকাল আটাটা কুড়ি বাজে।এখন গিয়ে সবকিছু গাজীপুর রেখে এসে জুঁইদের নিয়ে বিকেলের বাসে বাড়ি যাবো।আমার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায়।ঢাকা থেকে যেতে ৬-৭ ঘন্টা সময় লাগে।প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার সময় মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ হয়,শুধু এবারই মনের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে। বাড়ি গিয়ে কী করবো,তাছাড়া এই সময় ঢাকা থেকে কেউ গ্রামে গেলে তাকে মোটেও ভালো চোখে দেখছে না গ্রামের মানুষ।সে যেই হোক না কেন।সবার ধারণা,ঢাকা থেকে মানুষ ইচ্ছা করে করোনা ভাইরাস নিয়ে বাড়ি ফিরছে।কিছুতেই ঢাকা ফেরত মানুষজনকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না এরা।
ঢাকায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অসংখ্য মানুষ দীর্ঘ তিন চার মাস যাবত কর্মহীন,একবারেই কোনো ইনকাম নেই।জীবন যাচ্ছে কোনরকম খেয়ে না খেয়ে,বাড়িওয়ালারা বাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে,এইজন্যই তো গ্রামে ফিরছে এরা।কেউ তো আর শখ করে বেড়াতে যাচ্ছে না গ্রামের বাড়ি। ঈদের আগের দিনও একটা পরিবার এভাবে ঢাকা থেকে গ্রামে চলে গিয়েছিলো,তাদের সাথে এলাকার মানুষ নাকি অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেছে।শেষপর্যন্ত তারা সেখানে টিকতে না পেরে অন্য কোথায় যেন এক আত্মীয় বাড়ি গিয়ে উঠেছে।
মানুষ সৃষ্টির সেরা,কারণ একমাত্র এদেরই কিছুটা বুদ্ধি বিবেক আছে।সেই বুদ্ধি বিবেক সম্পন্ন মানুষ মানুষের এই চরম দুঃসময়ে এতো অবিবেচকের মতো আচরণ করবে কেন?এখন তো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়,সহমর্মিতা দেখানোর শ্রেষ্ঠ সময়,নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত প্রমাণের আসল সময়।আশরাফুল মখলুকাতের এমন হিংসাত্মক আচরণ করার সময় না।তারপরও এমন কেন করছে গ্রামের মানুষ? পিকাপের ড্রাইভার হর্ণ বাজাচ্ছে।সম্ভবত প্যাকাপ হয়ে গেছে।সে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুত।আমি জুঁইকে বললাম থাকো তাহলে,আমি মাল জিনিস রেখে আসি।জুঁই চোখ মুছে বললো,আমাকেও নিয়ে চলো।একা একা থাকতে ইচ্ছে করছে না।আমি আর না করলাম না।একা একা আসলেই ওর খারাপ লাগবে থাকতে।এইজন্য বললাম,চলো।বাসার চাবি,গেটের চাবিসহ সবকিছু বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়ে দিয়েছি আগেই।
গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য গোছানো ব্যাগ দুইটাও পিকাপে তুলে দিয়েছি।এরা গাজীপুর মাল জিনিস নামিয়ে দিয়ে সায়দাবাদে ফিরবে।এদের পিকাপেই আমরা ফিরবো।এভাবেই কথা বলে নিয়েছি,অসুবিধা হবে না। সেজুঁথিকে কোলে নিয়ে জুঁইকে বললাম,যাওয়ার সময় একবারও পিছনে ফিরে তাকাবা না।ও ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।আসলে মেয়ে মানুষের সারা শরীর ভরা মায়া।আমি বললাম,তোমার সবকিছুকে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে।আমরা এরপর যেখানে উঠবো,দেখবে এইটাকে তুমি ঠিক এভাবেই ভালোবেসে ফেলবে।তবে তোমাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করি,মায়া জিনিসটা একটু কমাও।মায়া কোনো ভালো জিনিস না,আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য তো না-ই।
পিকাপ মগবাজার চৌরাস্তা ক্রস করছে।দুইটা পিকাপ পরপর চলছে।আমরা সামনেরটাতে বসেছি।এই পিকাপের হেলপার উঠেছে পিছনের পিকাপে।সেজুঁতি আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।আমি বসেছি ড্রাইভারের পাশে আর জুঁই বসেছে আমার পাশে।আমি বা হাতটা ওর কাঁধে রাখলাম,ও আমার কাঁধে আলতো করে মাথা গুঁজলো।ও জানে পৃথিবীর সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও কাঁধের এই আশ্রয়টা জীবন মরণের বিশ্বস্ত জায়গা,যেখান থেকে পৃথিবীর কেউ তাকে সরিয়ে দিতে পারবে না।
গল্পের বিষয়:
গল্প