রাজকন্যার আহ্নিক

রাজকন্যার আহ্নিক

এক ছিল রাজকন্যা। তার একছিল দেবতা আর এক ছিল পূজারী।

রাজকন্যার সারাদিন কাটে আহ্নিকে পার্বনে। দেবতার জন্যে ফুল তোলা, মালা গাঁথা, ভোগ দেয়া আরো কতো কী! বুকের মধ্যে সুগন্ধী রুমাল রেখে তার জন্যে কখনো রাত জেগে বসে থাকা – এ যেন এক অমোঘ উপাসনা। দেবতার কতো কী কাজ। সব সেরে তবেতো রাজকন্যার ভোগ নেবার সময়! রাজকন্যা অর্ঘ্য সাজিয়ে বসে থাকে। এমন দেবতার জন্য এক রাত কেন সারা জীবনই বসে থাকা যায়। রাজকন্যা ভাবে আর রাত জাগে। দেবতা যেমন করে চায় সে ঠিক তেমন করেই সাজে। দেবতার পায়ে থাকে স্বর্গলোকের সিঁড়ি। রাজকন্যা বুক পেতে দেয়। দেবতা পায়ে পায়ে হেঁটে যায়। কখনোবা আঙ্গুল দিয়ে হাঁটে। এই দেবতা সর্বগামী। পাহাড়ের চূড়া থেকে উপত্যকার গভীর, সব জায়গায়ই দেবতার অবাধ বিচরনভূমি। দু’জনে এক সাথে স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে নামে। রাজকন্যা ভাবে, স্বার্থক জনম তার এমন দেবতা ভোগ নেয় যার।

কখনো সখনো দেবতার উপবাস হলে রাজকন্যার কষ্ট ঝড়ে পড়ে। এ কোন নিয়ম ভবে? দেবতারও উপবাস ব্রত তবে? তবে কেন ফুল তোলা, মালা গাঁথা? নদীর মোহনা তার হয়ে যায় চাতকীর ঠোঁট । দেবতার পুতুল সে। চাতকী হয়েই জেগে থাকে। ধ্যান ভাঙ্গলেই চাই তাকে। পাহাড়ের চূড়া চাই। নদীর মোহনা চাই। রাজকন্যা জেগে থাকে। মালা গাঁথে। পাহাড় সাজিয়ে রাখে। নদীকে জাগিয়ে রাখে। দেবতা জেগে উঠলেই নিয়ে যাবে বাঁকে।

দেবতার স্নান শেষে তবুও সে জেগে থাকে কী এক ভিন্ন তৃষ্ণায়। এই কি সব শেষ তবে? পূজো নেয়া, পানাহার, ভোজ শেষে স্নানাগার? পৃথিবী কি কেবলি পাহাড় আর উপত্যকার আধাআধি? পৃথিবীর সব কিছু এমনই দিগম্বর নাকি? তারওতো আবরন থাকে, ছাদ থাকে, সুনীল আকাশ থাকে। রাজকন্যার স্বপ্নে জাগে পাখি ডাকা নীলাকাশ। আহা, কতোদিন আকাশ দেখেনা মেয়ে! কে না জানে আকাশ না ডাকলে জোয়ারের ঢেউ কখনো আসেনা ধেয়ে? তবুও সে দেবতার জলাধার, কাস্পিয়ান সাগর। যতোই বিশাল হোক, নামেতে সাগর হোক, আসলেতো স্থিরজল ধরে রাখা হ্রদের প্রকার। তাকেই সাগর ভবে দেবতা সাঁতার কাটে। আহা কাস্পিয়ান! হোক না স্থিরজল, বিশালতায় তুমিইতো সাগর সমান। শুধুইকি বিশাল সে? যদিওবা হ্রদ, জল তার সাগর-নোনা। দেবতা তাতেই খুশি। এমন এক যুবরানী যার পূজো দেবে সেকি আর সাধারন কোন এক দেবতা থাকে? সেতো দেবতার ঋষি হয়ে উঠে, দেবতাদের দেবতা হয়। আমাদের রাজকন্যাও কৃতার্থ মানবী। এমন দেবতা যার জলাধারে স্নানে আর সাঁতারে সাধনা করে, তার সারাটি জীবন উঠে আশির্বাদে ভরে। ভাগ্যিস, বুকে তার ধরেছিল এমন সাগর এক!

তবুও কখনো তার মন চায় আকাশের দয়িতা হতে। ডাকলেই জোয়ারের ঢেউ হয়ে ভেঙ্গে দিতে বাঁধ। কাস্পিয়ানের স্থির বিশালতা ছেড়ে এসে কখনোবা সত্যিকার সাগরের ছোট এক মোহনা হতে চায়। দেবতা থাকুক বুকে সূর্যের মতো জ্বলজলে। ভোগ, পূজো, গাঁথা মালা, জলাধার সব কিছু তার অধিকারে থাক। রাজকন্যা কেবল কখনো সখনো বাইরের পৃথিবীতে এসে শ্বাস নিতে চায়। এ সব ভাবতে আর অর্ঘ্য সাজাতে তার দিন কেটে যায়। তারতো দীপ্তমান সূর্য আছে, একটা পৃথিবী কি বড় বেশি চাওয়া হয়ে যায়?

বেশি কেন চাওয়া হবে! তারো যে পূজারী আছে একজন। সে যে তার পৃথিবী হতে চায়। পূজারী দরোজায় কড়া নাড়তেই রাজকন্যার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। ফুলের স্তবক নিয়ে এসে তার পায়ে নিবেদন করে। রাজকন্যার খোঁপায় গুঁজে দেয় কয়েকটা তার। ঘুঙুর এনেছিল এক জোড়া। পায়ে পরিয়ে দিতেই রাজকন্যা খিল খিল করে হেসে উঠে। কপট লাজে দৌড়ে পালানোর ভান করতেই রিনিঝিনি বেজ উঠে। পূজারীর বুকের গহীনে তার অনুরণন স্থায়ী হয়ে যায়। রাজকন্যার ভূবন মোহিনী হাসি আর ঘুঙুরের ঝংকারে পূজো দেয়া সার্থক হয়ে যায়।

খোঁপায় ফুল গুঁজে আর আলতা পায়ের ঘুঙুর বাজিয়ে রাজকন্যা দেবতার আহ্নিকে মন দেয়। পূজারী দু’চোখ ভরে দেখে। কখনোবা কষ্ট হয় একটু আধটু। তবুও দেবতাতুষ্টিতে রাজকন্যার স্বর্গলাভ। পূজারীর সাধ্য কি সে প্রাপ্তির বাধা হয়!

মেয়ের কতো কী যে অনুযোগ। ‘কী এমন ক্ষতি হতো ফুলের স্তবক নিয়ে আরো আগে এলে? আমিতো তখনো বসিনি দেবতার ভোগের পিঁড়িতে। কতোদিন পথ চেয়েছিলাম পূজারী আসবে কোন একজন, নিজ হাতে ঘুঙুর পরিয়ে দেবে। সেতো হায় আসেনি কতোদিন। পূজারী নেয়নি আমায়, দেবতাই নিয়ে গেছে। আমি তার সেবাদাসী। দাসীর আর কতোটুকু স্বাধীনতা থাকে বলো পূজারীর অর্ঘ্য নেবার!’

সত্যিইতো। পূজারীর হয়েছে বিপদ। যদি বলে ‘কষ্ট হয়’ রাজকুমারী বলে, ‘তোমার কষ্ট হওয়াই উচিত। নরাধম তুমি। কেন তবে দেরি করে এলে?’ যদি বলে ‘ধুর! কে বলেছে কষ্ট হয়? এইতো বেশ সব কিছু মানিয়ে নিয়েছি’। রাজকন্যার অভিমান ঝরে পড়ে। ‘ও, এই কথা! আমি কাউকে ভোগ দিলে যদি কষ্টই না হবে, তবে তুমি মিছেই পূজারী আমার’।

এই হলো আমাদের রাজকুমারী । এই তার দেবতা আর এই তার পূজারী। দেবতার অর্চনা না হলে যেমন তার দিন কাটেনা, পূজারীর নৈবেদ্য ছাড়া তার দিন ঠিক তেমনি অর্থহীন মনে হয়। কেন যে সে এতো দেরি করে এলো! যদি আগেই মানুষ পূজারীর দেখা পায়, তবে কে হায় এই ভবে দেবতা খুঁজতে যায়!

ভাবতে ভাবতেই রাজকুমারী তলিয়ে যায় সুখের অতল তলায়। দেবতা তখন চৌকষ তীরান্দাজ, বিদ্ধ করে তীক্ষ্ণ ফলায়। রাজকন্যা দেবতার কানে কানে যোগের মন্ত্র বলে যায় মোহন গলায়। মন্ত্রের সুরে সুরে আবার সে জ্বলে উঠে দেশালাইয়ের শলায়। সে ঋদ্ধ হয় দেবতার উষ্ণতার ভাপে। কখনো নিজের অজান্তেই শ্বাস ছড়িয়ে যায় পূজারীর অপেক্ষার মনস্তাপে।

পূজারীর কুসুম কুসুম কষ্ট হয়। সে যাকে পূজো দিতে চায়, সে কিনা ফের দেবতার তুষ্টিতে নিজেই ক্ষয়ে যায়।

যে তাকে কুলটা বলে বলুক। রাজকন্যা জানে সেতো একগামী। তারতো একজনই দেবতা, পূজারীও একজন। তার একটিই সূর্য। পৃথিবীও একটি। দেবতার জন্যে সে রেখেছে বিশাল শান্ত কাস্পিয়ান। পূজারীর জন্যে ঢেউ। মেঘনা যেখানে সাগরের সাথে মিশেছে, ঠিক সেরকম কিছু ছলাৎ ছলাৎ

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত