রক্ত নয় শুধুই ফেনা

রক্ত নয় শুধুই ফেনা

কতজনকে মেরে ফেলতে সে হুকুম করেছে? আর কতজনের হাত পা কেটে ফেলতে বলেছে – থাক ওসব কথা না ভাবাই ভাল। ক্যাপ্টেন টরেসও জানে না আমি তার কত বড় শত্রু। শুধু সে কেন, সামান্য কিছু লোক বাদে অন্য কেউ-ই জানে না যে আমি মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করি এবং আমার কাজ হল গোপনীয়তার সাথে খবর পাঠানো। ক্যাপ্টেন টরেস কখন কি অপারেশন করতে আছে সে খবরও। কাজেই অনেকে হয়তো বুঝতে চাইবে না কেন আমি হাতের কাছে পেয়েও তাকে জীবিত ছেড়ে দিলাম।

রক্ত নয় শুধুই ফেনা
কিছু না বলেই লোকটি চুপচাপ ঢুকে পড়ল। আমি তখন ক্ষুরে ধার দিচ্ছিলাম। তাকে চিনতে পেরে আমিতো ভয়ে অস্থির। অবশ্য সে কিছুই বুঝতে পারলো না। আমি উৎকণ্ঠা গোপন করে ক্ষুরে ধার দিয়ে চললাম। বুড়ো আঙ্গুলের উপর ধার পরীক্ষা করে উঁচু করতেই ক্ষুরটি চকচক করে উঠল। বেশ ধার হয়েছে।
এদিকে সে তার কোমরের বেল্ট, যাতে একটি পিস্তল ঝুলে ছিল সেটা খুলে দেয়ালের পেরেকের উপর ঝুলিয়ে দিয়ে সেটার উপর মাথার টুপিটি রাখল। তখনই আমাদের চোখাচোখি হল। এরপর আমার দিকে এগিয়ে আসার সময় গলার বোতাম ঢিলে করতে করতে বলল
‘বেল পাকা গরম পড়েছে, ভাল করে দাড়িগুলো কামিয়ে দাওত’।
কথাটা বলেই সে চেয়ারের উপর বসে পড়ল। দেখে মনে হল তিন-চারদিন দাড়ি কামানো হয়নি কেননা এই কয়দিন তন্ন তন্ন করে সে আমাদের ছেলেগুলোকে খুঁজেছে। রোদে পোড়া লাল টকটকে মুখ দেখেই বোঝা যায় বিদ্রোহীদের ধরতে বেশ ছুটাছুটি করতে হয়েছে তাকে। আমার অস্থিরতা সে যেন ধরতে না পারে তাই সর্তকতার সাথে একটুকরো সাবান বাটিতে ছেড়ে দিয়ে ঘষতে শুরু করলাম। সাথে সাথেই বাটির উপরের দিকে ফেনা উঠে এলো। এদিকে সে একা একাই কথা বলে যাচ্ছে –
‘বিদ্রোহী ছেলেদের দাড়ি-মোচও আমার মত বেড়ে উঠেছে হয়তো, কেননা ওদেরকে দৌড়ের উপরই রেখেছিলাম এতদিন’।
আমি কান পেতে ওর কথা শুনতে লাগলাম আর বাটিতে ফেনা তোলার কাজে ব্যস্ত থাকলাম।
‘এবার কোন ভুল করিনি, আমরা ঠিক ভাবেই এগিয়েছিলাম। আসলগুলোকে জীবিত ধরতে পেরেছি তাতেই খুশি লাগছে। কিছু মৃত দেহও সাথে করে নিয়ে এসেছি। যারা বেঁচে আছে তাদের সবাইকে হত্যা করা হবে’।
কতজনকে ধরেছ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘চৌদ্দ জন। গভীর জংগলে গিয়ে তবেই ধরতে হয়েছে। এদের কাউকেই ছাড়া হবে না’।
আমার হাতে ব্রাশ ভরা ফেনা দেখে সে চেয়ারে হেলান দিল। তখনো তার গায়ের উপর কাপড় দেয়া হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না আমি তখন ভীষণ উত্তেজিত। ড্রয়ার থেকে একটা পরিষ্কার কাপড় বের করে তার গলায় পেঁচিয়ে দিলাম। সে মনে করল আমি বুঝি তার উপর বেশ সহানুভূতি দেখাচ্ছি। তখনো সে বলেই চলছে।
‘এবার এই অঞ্চলের একটা শিক্ষা হয়েছে, কি বল’?
ঘামে ভেজা গলার কাছে একটা গিঁট দিতে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।
‘মনে রাখার মত একটা ফাইট হয়েছে, তাই না’?
আমি বললাম, তা বটে। এই বলে ব্রাশটার দিকে হাত বাড়ালাম। লোকটি ক্লান্তির ভাব দেখিয়ে দাড়ি কামানোর জন্য চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো। আমি তাকে এতো কাছ থেকে কখনো দেখিনি। যেদিন স্কুলের মাঠে চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য গ্রামবাসীকে জড়ো করেছিল সেদিন অল্পক্ষণের জন্য তাকে দেখেছিলাম। যার হুকুমে সহযোদ্ধাদের ক্ষত-বিক্ষত দেহ দেখতে হয়েছিল সাহস করে সেদিন তার মুখোমুখি হতে পারিনি অথচ সেই মুখটি এখুনি হাতের মুঠোয় নিয়ে নেব। মুখটা দেখতে খারাপ না। যদিও খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মোটেও মানাচ্ছিল না তাকে, কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগছিল।
ওর নাম টরেস, ক্যাপ্টেন টরেস। সে একজন উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসার, তা নয়তো কি? কে পারে মুক্তিকামীদের ওভাবে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে, টার্গেট প্রাকটিসের নামে শরীরের নানা জায়গা উড়িয়ে দিতে।
আমি তার মুখে ফেনা লাগাতে শুরু করলাম। একটা শীতল পরশ পেয়ে চোখ বন্ধ করে বলে যেতে লাগলো;
‘আমি এতোটাই ক্লান্ত যে যখন তখন ঘুমিয়ে যেতে পারি কিন্তু তার কি উপায় আছে। সন্ধ্যার আগে অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হবে’। ফেনা তোলার কাজ বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘ফায়ারিং স্কোয়াড’!
‘ওরকমই একটা কিছু’।
তার গালে পুনরায় ফেনা লাগাতে শুরু করলাম। এবার আমার হাত কাঁপতে লাগলো যদিও সে কিছুই টের পেল না। খুব ভাল হতো ও যদি এখানে না আসতো। সম্ভবত তাকে কেউ এখানে আসতে দেখেছে। শত্রু হলেও নিজ আশ্রয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। অন্যান্য খদ্দেরের মত তারও পরিচ্ছন্ন সেবা পাবার কথা। ক্ষুর চালাতে গিয়ে দাড়িগুলোর নিচে যেন রক্তের ধারা বয়ে না যায় কিংবা দাড়ি কামানো শেষ হলে হাতের তালুতে খোঁচা না লাগে এমন শুভ্র একটা শেভ তার কাম্য। এ কথা সত্য যে বিদ্রোহীদের সাথে আমার সংশ্লিষ্টতার কথা কেউ জানে না। তাই আমাকে কেউ সন্দেহ করে না।
আজ আমার কি হল! ক্যাপ্টেনের চোয়ালে গজিয়ে উঠা চারদিনের দাড়ি কামাতে গিয়ে এতো কথা ভাবছি কেন।
ক্ষুরটাকে সোজা করে জুলফির নিচে এক পোঁচ লাগিয়ে দিলাম। চমৎকার ধার! অনেক বড় না হলেও দাড়িগুলো বেশ ঘন এবং শক্ত। খরখর আওয়াজের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে চামড়া ফুটে উঠতে লাগলো। পেঁজা পেঁজা ফেনা আর জুলফির নিচ থেকে কেটে ফেলা দাড়িতে ক্ষুর ভরে উঠেছে। ক্ষুরটাকে পরিষ্কার করে আবারো ধার দিতে শুরু করলাম কেননা আমার ইচ্ছা লব্ধ কাজটি সঠিক ভাবে করতে হবে। লোকটি চোখ খুলে আমাকে খুঁজল। আমি ক্ষুর ধার দেবার কাজে ব্যস্ত দেখে কাপড়ের নিচ থেকে একটা হাত বের করে যতটুকু কাটা হয়েছে সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলো
‘আজ সন্ধ্যা ছয়টার সময় স্কুলে এসো’।
শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম সেদিনের মতই কি?
সে উত্তর দিল ‘হয়তো তার চেয়েও ভাল কিছু’
সে দিনের চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে?
‘আমি এখনো কিছু জানি না, দেখি সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নেব’। এই বলে সে পুনরায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। আমি ক্ষুর উঁচু করে তার দিকে এগিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললাম, তুমি কি সবগুলো বিদ্রোহীকে মেরে ফেলার কথা ভাবছ।
‘হ্যাঁ সবগুলোকেই’
ফেনাগুলো তার মুখে শুঁকিয়ে যেতে শুরু করেছে আমাকে যথাসম্ভব দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। আয়না দিয়ে রাস্তাটা দেখে নিলাম। সেই সুনসান গলি। দু’একটা খরিদ্দার রয়েছে মুদির দোকানে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি দুইটা বিশ অর্থাৎ খাঁখাঁ দুপুর। ক্ষুরটাকে চলাতে শুরু করলাম। তারপর হাত প্রশস্ত করে অন্য জুলফির দিকে ক্ষুরটা নিয়ে এলাম। এতো ঘন দাড়ি না কেটে ওর উচিত ছিল সাধু সন্ন্যাসী কিংবা কবিদের মত সেগুলো রেখে দেয়া। তাতেই ওকে মানাত বেশ। ঘাড়ের কাছে ক্ষুর চালানোর সময় ভাবলাম ওর জন্য সেটাই ভাল হতো তাহলে কেউ চিনতে পারতো না। এখন আমাকে খুব দক্ষতার সাথে কাজ করতে হবে। কিছু দাড়ি ঘূর্ণি আকার পেঁচিয়ে আছে। একটু অসতর্ক হলেই রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়বে। আমার সুনাম রক্ষা করতে কোন ভাবেই তা হতে দেয়া যাবে না।
কতজনকে মেরে ফেলতে সে হুকুম করেছে? আর কতজনের হাত পা কেটে ফেলতে বলেছে – থাক ওসব কথা না ভাবাই ভাল। ক্যাপ্টেন টরেসও জানে না আমি তার কত বড় শত্রু। শুধু সে কেন, সামান্য কিছু লোক বাদে অন্য কেউ-ই জানে না যে আমি মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করি এবং আমার কাজ হল গোপনীয়তার সাথে খবর পাঠানো। ক্যাপ্টেন টরেস কখন কি অপারেশন করতে আছে সে খবরও। কাজেই অনেকে হয়তো বুঝতে চাইবে না কেন আমি হাতের কাছে পেয়েও তাকে জীবিত ছেড়ে দিলাম।
দাড়ি কামানো মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। কিছু ক্ষণ আগে তাকে যেমন বয়স্ক লাগছিল এখন তার থেকে অনেক বেশি যুবক লাগছে। এ রকমটি আশা করেই সকলে নাপিতদের কাছে আসে। তীক্ষ্ণ ধারালো ক্ষুর এবং অভিজ্ঞতার কারণেই আমি ট্রেসের বয়স এতোটা কমিয়ে দিতে পারলাম যেটা এই তল্লাটে অন্য কোন নাপিতের দ্বারা সম্ভব হতো না। সামান্য একটু ফেনা তখনো কণ্ঠমণিতে লেগে আছে যেখানে রয়েছে সবচাইতে বড় রক্ত শিরা।
মনে হয় অনেক গরম পড়েছে, টরেস কি আমার মতই ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠেছে? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ওর মুখ দেখে কোন কিছুই বোঝা সম্ভব না যেমন বোঝা যাচ্ছে না আজ বিকেলে বন্দী ছেলেগুলোকে নিয়ে সত্যি সত্যি সে কি করবে। অন্যদিকে আমি ওর মত শান্ত থাকতে পারছি না। লোমকূপের গোঁড়া দিয়ে যাতে রক্ত বেড়িয়ে না আসে তেমন সতর্কতার সাথে ক্ষুরটিকে বাগে রাখতে পারলেও এই মুহূর্তে কি করণীয় সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। ও কেন এখানে আসতে গেল! আমিতো যোদ্ধা, ওর মত খুনি না। ওর জন্য মৃত্যুই একমাত্র সাজা যে কাজটা এখন আমার হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমার হাতে এই হায়েনার মৃত্যু কি ওকে শহীদ বানিয়ে দেবে আর আমার কপালে খুনির দুর্নাম?
কি লাভ জীবন নাশের এই খেলায়। একজন অন্যজনকে মারবে আবার অন্যের হাতে আর কেউ, এভাবেই তৈরি হয় এক সাগর রক্ত। ক্যাপ্টেন টরেসের রক্তও সে সাগরে মিশে যাবে। সুরত করে ওর গলাটা নামিয়ে দিলে সে কিছুই টের পাবে না।
চোখ বন্ধ থাকার কারণে আমার চোখের ভাষা এবং ধারালো ক্ষুর কোনটাই সে দেখছে না। খুনির হাত কি এভাবেই কাঁপে! ওর গলা থেকে কি ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে সাদা কাপড়টা লাল হয়ে উঠবে। তারপর রক্তের নহর আমার হাতের উপর দিয়ে বয়ে যাবে মেঝেতে। দরজাটা বন্ধ করে দেব? তাতেই বা কি হবে। রক্তের দাগ তবুও এক সময় স্পর্শ করবে জনপদ। দক্ষতার সাথে চামড়ার গভীরে একটা হেঁচকা টান দিতে পারলে কোন কিছু বোঝার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু মৃতদেহটাকে কি করবো, কোথায় লুকবো সেটা?
তারপর! তারপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আমাকে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যত দূরেই পালাই না কেন আমাকে না ধরা পর্যন্ত ওরা ক্ষান্ত হবে না। এদিকে এমনও হতে পারে যে আমাকে হত্যাকারী চিহ্নিত করে ওরা বলে বেড়াবে পেশাদারিত্বের সময় ক্যাপ্টেন টরেসকে খুন করে বাপ দাদার পেশায় কলঙ্ক লেপে দিয়েছি। তখন কি কেউ এগিয়ে এসে বলবে যে আমি ছিলাম মুক্তির চেতনায় বিশ্বাসী। কি হচ্ছে এসব? বীর না খুনি হবার চেষ্টা? আমার ভবিষ্যৎ কি এখন নির্ভর করেছে এই ক্ষুরটির উপর? হাতটাকে একটু বাড়িয়ে নরম চামড়ার নিচে ক্ষুরটা ঢুকিয়ে দিলে রক্তের কমতি হবে না। এ ক্ষুর আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। এটা আমার সব চাইতে প্রিয় ক্ষুর। কিন্তু আমি কেন খুনি হব!
না, তুমি আমার কাছে এসেছ আমি একজন দক্ষ নাপিত বলে। আর আমিও আমার পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিতে চাই। দক্ষ নাপিতের হাতে কখনো রক্ত লাগে না। আমার কারবার শুধু সফেদ ফেনা তোলা। তুমিই বরং একজন খুনি।
মানুষের কর্মই তার পরিচয়।
লোকটি উঠে দাঁড়াল। তার মুখটি ভীষণ শুভ্র দেখাচ্ছে। আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে হাত দিয়ে নির্মলতার স্বাদ নিলো।
‘ধন্যবাদ’। এই বলে ঝুলে থাকা কোমরের বেল্ট, পিস্তল এবং মাথার টুপিটি উঠিয়ে নিতে এগিয়ে গেল। আমি ততোক্ষণে ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছি। যেন ঘামের স্রোত বয়ে যাচ্ছে জামার নিচ দিয়ে। ক্যাপ্টেন টরেস কমরের বেল্ট টাইট করে বেঁধে পিস্তলটাকে খাপে ঢুকিয়ে আবারো মুখটা আয়নাতে দেখে নিলো। হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে মাথার উপর টুপি বসিয়ে চারিদিকে একবার ঘুরে তাকাল। তারপর, আমার মজুরি চুকিয়ে পথের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে পিছন ফিরে বলল,
‘ওরা বলেছিল তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। আমি সেটাই দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু হত্যা করা এতো সহজ কাজ না। কথাটা মনে রেখ’।
এই বলে সে হাটতে শুরু করলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত