তোমার আমার গল্পটা

তোমার আমার গল্পটা

রুমঝুম বৃষ্টির শব্দের মাঝেই নুপুর পায়ে নায়াগ্রা ষোলশহর রেলস্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার নুপুরে অবশ্য কোন বোল নেই। স্টেশনের কোলাহলে তা থাকলেও হয়তোবা শোনা যেত না। সম্ভবত: এটাকে পায়েল বলে। এখন অবশ্য এনকেলই বেশি আসে মুখে। বিদেশীদের মতন পরেও আছে একপায়ে। অন্য পা-টা খালি। দেখতেই কেমন শির শিরে লাগতো একসময়। শীল পাটার উপর আঙ্গুল ঘষে মসলা টেনে নামানোর মতন। সেই কিলবিল করে কাপুনী লাগাটা এখন থেমে গেছে। সময়ই শিক্ষক। নিজেই এখন এক পায়ে সরু পায়েল পরে এসে দাড়িয়ে রয়েছে। দাড়িয়ে আছে মুখোমুখি অতীতের এক দরজায়, সেই রেলস্টেশনে, যা ছিল একদিন অনেক অনেক অনেক স্বপ্নে ভরা এক যাত্রাকথার সূচনা লগ্ন।

ট্রেন আসার কি সময় হয়নি এখনও? ছাত্রছাত্রীও বেশ কম চারদিকে। বৃষ্টির কারণে কি এরকম, নাকি শাটল ট্রেনের সময়সূচীই বদলে গেছে। কত এসেছে এই সময়ে এইখানে কত বছর ধরে সেই কত আগে। বহুকালের চেনা জানা দেখা ছোট একটা ছাউনী ঘেরা পারাপারের এই স্টেশনটা।

এত বছরেও স্টেশনটির বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। যেমনটি ছিল তেমনই আছে। একই রকম। শুধু বদলে গেছে চরিত্রের চেহারাগুলো।
ঐ যে ঐখানে বসে আছে সেই মিঠু আর মমতাজের যুগল। চেয়ে আছে চুপচাপ একে অপরের দিকে। মুখটাই শুধু বদলে গেছে। আর তো সবই এক। চাহনীও এক। স্বপ্নে ভরা সে এক মায়ার বাধন যেন। সবার মাঝে থেকেও যেন চলে গেছে অন্য কোন এক জগতে। ব্রীজের কোনার সিড়িটা সব সময়ই থাকতো ওদের দু’জনার দখলে। এতো মানুষ উঠতো নামতো, ওরা নির্বিকার, ডুবে আছে একে অপরে দিকে, চেয়ে আছে অপলক। দিকে দিকে এত যে কোলাহল কিছুই যেন তাদের ছুঁইছে না। সব ভুলে কইছে কথা পরস্পরের সাথে। বাকবাকুম পায়রা যেন। এত কি কথা কইতো তারা দুজন দুজনার সাথে! কি জানি কি কথা। কি এত কথা ছিল বলার জন্য কে জানে।

আজ ভেবে অবাক লাগছে। ঐ ছেলে মেয়েগুলোর পাশে বসে শুনতে বড় মন চাইছে ওদের কথার কলকাকলী। আলাপচারিতা। এতে কি শুধু আপনাকে নিয়েই কাব্য চলে। নাকি থাকে জগৎ সংসার, জীবন যাত্রা, অনাগত ভবিষ্যত। যাপিত জীবন। যেমন তেমন সব কিছুই কি মধুময় হয়ে সাত রংয়ের বর্নীল কোন রংধনুররূপ নিয়ে ওদের আকাশেও খেলা করে। আহা যদি জানা যেত। আহা-ই বা বলছে কেন! ঐ সময় তো সেও পেরিয়ে এসেছে। বসেছিল সেও সেই যুবকের পাশে। তাহলে কেন ভাবছে জানে না সে। সে জগত তো তারও দেখা। জানা কথা। অজানা তো নয়। তারপরও কেন মনে হচ্ছে সব অচেনা, অনাবিস্কৃত। অনাস্বাদিত। অনিবার্য প্রয়োজনীয় কিছু নয়। জানতেই যে হবে, তারপরও যেন জানার অপার অসীম আকাংখা। কেমন এই ভালবাসার রূপকথা। কোন সুরে তালে লয়ে বইছে চলে এত বছর পরেও ঐখানে ঐ সেই একই জায়গায়। বিশটি বছর পরে বিশাল কোন ব্যতিক্রম কি হয়েছে ঐখানে বসে থাকা লাস্যময়ীর সেই হাসিতে। না তো। সবই তো এক সুরে বাজছে। একই ছন্দে দুলছে। শুধু নেই শুধু সেই একজন। আর সবাই যেন সর্বত্র একই ছন্দে বাধা দোলনায় দুলছে। প্রকৃতি ভালই দোলাচ্ছে। তার হৃদয়েও কাঁপন তুলছে। থেকে থেকে মনে পড়ছে কত কিছু, কত কী। সে তো ভেবেছিল সব ভুলে গেছে। কই কোথায়। সব তো তাকেই ছুঁয়ে দিচ্ছি হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে। মিঠুন আর মমতাজের জায়গাটা জুড়ে যারা বসে রয়েছে তাদের পাশে অযথাই এসে দাড়ালো। কিছু কথা শোনার কি লোভ বুঝি সামলানো গেল না! মনে মনে এই ইচ্ছেও কি হচ্ছে না যে ওখানে দাড়ালে আগের কোন একটা জায়গায় আবার গিয়ে দাড়াতে পারবে, পরক্ষণেই মনে হলো না না, সে যেতে চায় না। কোনদিনও যেতে চায় না। এক্কেবারে ফুলস্টপ।
এবার দেশে ফেরার পথে লণ্ডন হয়ে এসেছে। কাটিয়েছে দুটো রাত মিঠুন আর মমতাজের সাথে। তাদের সাজানো সংসার আর ভালবাসার গল্পকথায় কেটেছে অনবদ্য দুটো রাত।

দু’জনাই প্রচুর মুটিয়েছে। হিথরো এয়ারপোর্টে ওদের দেখেই সে বললো,
: বাহ্ বাহ্ মোটামুটি ভাল রুপই ধারণ করেছিস দেখছি।
: জী আমি মিস্টার, মোটা আর ও মিসেস মুটি দুজনে ভালই আছি মোটামুটি।
মিঠুন আগের মতনই ঝটপট উত্তর দিয়েছে, আচ্ছা সেও কি আজও তেমনই আছে আগের মতন কিছুটা কাব্যে কিছুটা বাস্তবতায় কিছুটা দ্বিধায় কিছুটা দ্বন্দে¡ এখনও একজন ভঙ্গুর নতজানু মানুষ। শিরদাড়া-টা কি আজও খুঁজে পায়নি। কে জানে হয়তোবা তাই। মিঠুন তো আগের মতনই প্রচুর কথার মারপ্যাঁচের ভেতরই আছে। ঐ জালেই তো মমতাজকে জড়িয়েছে। মমতাজ অন্তত তাই বলে। বলে কথা বলে বলে পটিয়েছে। মনে পড়তেই তার হাসি পেয়ে গেল। কথার ক্ষমতা অসীম। ভাল আছে কথাওয়ালা ওয়ালী। এখন দুই বাচ্চা, সাজানো সংসার, আর সেই সাথে প্রচুর ঝগড়াঝাটি নিয়ে, সাজানো সেটাও, মেকী ঝগড়া। মমতাজ সারাক্ষণই হৈ হৈ করে প্রচুর কথার খৈ ফুটিয়েছে। আর অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে বলেছে আগে যদি জানতো তবে ঐ মিঠুন নামের ছেলেটিকে সে কোনদিনও বিয়ে করতো না। মিঠুনও সাথে সাথে গো গা করে বলেছে সেও না। সেও না। তবে সে যা বলে সব কিছু বলে বেশ নীচু স্বরে। গলা বেশি বাড়াতে পারে না। তার আগেই মমতাজের ঝামটা খায়। তবে বোঝাই যাচ্ছে যা বলছে তা বলছে না। মিন করছে না। তাই মিন মিন চিন চিন করে বলছে। সেই ছিপছিপে লম্বা বাজখাই গলার ছেলেটা এখন চারকোণা হয়ে যাওয়া বিশাল বপুর এক লোকে পরিণত হয়েছে। কতটুকু বদলেছে সে, সেই যুবক! সেও কি আজ পড়ন্ত বেলার এক শ্রান্ত পথিক? ক্লান্তি দুচোখে নিয়ে কি সেও ভাবে ফেলে আসা কোন এক সোনালী সময়ের কথা? নাকি ভাবছে বেশ হয়েছে যা হয়েছে। ওরা দু’জনা তো অযথাই হি হি করে হাসছে আবার পরক্ষণেই ঘোষণা দিচ্ছে আবার সুযোগ পেলে ঐ পথে আর পা বাড়াতো না। মাড়াতো না ষোল শহরের রেলস্টেশন। বসতো তো না ঐ জায়গায়। আজ সে এসে ওখানে চুপচাপ দাড়িয়ে রয়েছে। ওদের পাশে ওরাও যে বসতো। চারজনের জুটি ছিল। কী ভীষণ ভাললাগা ছিল। আহা। আহারে। আহ্। পপকর্নের সৌরভে ভরা লন্ডনের মেঘময় সেই রাতে কতভাবে কতবার ভেবেছে একটি বার জিজ্ঞাসিত যদি হয় তার কথা কি বলবে সে। তারাও বলেনি। সেও জানতে চায়নি। তারা দুজনাই তো কেবলই বলেছে ফিরে গেলে আর এ পথে নয় অন্য পথে চলতো। অন্য কোন উৎসের সন্ধানে যেত যেন তারা। কিন্তু সে কেবলই অনুভব করেছে আবারও যদি ছেড়ে দিত শূন্য থেকে গুনতে, তবে তারা দ্রুত পৌঁছে যেত ১৮-তে, ১৬ শহরের রেলস্টেশনে, আবার যেন দেখা হয় দুটিতে। মিঠু আর মমতাজের আবার পরিচয় আবার পথ চলা শুরু।

সে কি আর চাইবে আসতে এইখানে আর কোনদিন? এত বছর পরে এসেও এত চমক এত কাপুনী কেন যে এলো। না না, সে ফিরে যাবে। এই খানের সেই সময়ের কোন স্মৃতিই সে চায় না সাথে রাখতে। অতীত থাকুক অতীতেই। থাকুক পড়ে হেলায় অবহেলায় অযত্নে। হয়তো ওরাও তা বুঝে গেছে, তাই এত জনের এত কথা বললো শুধু। বড় সঙ্গোপনে এড়িয়ে গেল একজনের কথা। যেন আর কেউ ছিল না এই পৃথিবীতে যার কথা জিজ্ঞেস করা যায়। একজনকে তারাও যেন বড় আলতো করে ঠেলে ফেলে দিল উপেক্ষার জগতে। তারপরও অবাক হয়েছে। সে করেছে বলে বুঝি তারাও তাই করবে। এখনও অবাক দুচোখ নিয়ে চেয়ে আছে কাঠের ব্রীজটার শেষ ধাপ-টার দিকে। ঐ সিড়ি থেকে তারা দুজন ছিটকে গেছে কোথায়। উঠেছে কি পড়েছে জানে না। শুধু জানে দুজনাই ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। দু’জন থেকে দু’জনাই আজ বহুদূরে। দূরত্ব বহু বহু বহু দূরের। নিজেদের ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে নিজের জীবনে। জীবন বয়ে গেছে তীর তীর বেগে। ভিন্ন আলোয় নতুন আঙ্গিকে পেচিয়ে গেছে নতুন ঘূর্ণনে। সবার ভাগ্য একরকম হয় না। কেঊ শুধু দেখেই যায়। দেখে দেখেই জীবন পার করে দেয়।

ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে পায়ের কাছটাতে। ভিজে গেছে পায়ের নিচেরটা। রিকশায় এসেছে। প্ল্যাস্টিকের চাদর টেনে রেখেছিল তারপরও জিনসের স্কাটটা ভিজে গেছে। আজ সে সারাটা দিন যাপন করতে চেয়েছিল অনেক বছর আগের একটা সময়ে। বিশ বছর আগের কোন একটা দিনে। নায়াগ্রা যখন ২০ বছরের। বইছে জলপ্রপাতের মতন। কি প্রচণ্ড ভয়াবহ গতিময় সে।

নায়াগ্রা ফিরে চায় রাস্তার দিকে।
রিকসা আছে কি? ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ যেন বেড়ে গেছে। বুকের ভেতরও ঝমঝমাচ্ছে কিছু। রিনরিনিয়ে উঠতে চাইছে কোন এক না বলা কষ্ট। যে কষ্টের অনুভূতি সে কখনোই অনুভব করতে চায় না। কখনোই না।
বুক ফুলিয়ে থাকবে। থাকবেই। মাথা উচিয়ে চলবে। সে কখনোই এই কষ্টের ভেতর দিয়ে যাবে না। সে থাকবে অপরাজিতা।
বৃষ্টিটা যেন বেড়েই চলেছে।
এরকম বৃষ্টির দিনে রিকশায় ঘুরে বেড়াত না তারা দুজনে। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টির মাঝে চলতো রিকসাটা। সে তখন কখনো আবৃত্তি করতো বা হেড়ে গলায় গান গাইতো।
একদিন বললো,
: চল, রিকসা জার্নি করি। ষোলশহর টু ভার্সিটি।
: রিকসা করে ভার্সিটি পর্যন্ত যাবে! মাথায় বুঝি গণ্ডগোল হয়ে গেছে তোমার।
: সে তো তোমাকে দেখার দিন থেকেই।
: ওরে আমার কে রে?
: কে রে মানে? আমি কে জান না!
: না।
: না?
: না।
ধুপ করে নেমে গেল পাগলটা। তারপর বৃষ্টিতে ভেজা। ভিজে চুপসে যেতে লাগলো।
: আরে রিকসায় উঠে আস, জ্বর আসবে তো।
: আগে বলো মনে পড়েছে কি আমি কে?
: কি বলছো শুনতে পাচ্ছি না।
: কি? এই রিকসাওয়ালা ভাইজান, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
আহা দরকারে রিকসাওয়ালাকে ভাইজান বানিয়েছে। কী বুদ্ধি, রিকসাওয়ালাকে আবার জিজ্ঞেসও করা হচ্ছে।
রিকসাওয়ালাটাও কম না।
: আফা না হুইনলে, আই হুনবো কোত্থেইক্যা। আর বুঝি ছয়খান কান আছে? কী কন আপা।
: আরে এতো দেখি আফার চামচা।
ভ্রুকুচকে কোমরে হাত দিয়ে এমন ভঙ্গীতে চাইলো যেন আরে এতো বেইমান। সবাই কেন তার দলভুক্ত হচ্ছে না এই আফসোসে বৃষ্টির পানিতেই ঝুপঝাপ করে পা পিটালো।
রিকসাওয়ালাও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। যেন সে তার প্যাসেঞ্জারের দলে। পথচারীর না। সে যখন নেমে গেছে পথে সে তখন মাঝরাস্তার পথিক।
: উঠে এসো, ভিজে চুপসে গেছ তো প্রায়।
: আমিও শুনতে পাচ্ছি না।
ভাগ্যিস এটা চট্টগ্রাম শহর। নাহলে এতক্ষণে ট্রাফিক জাম লেগে যেত। রাস্তার উপর দাড়িয়েই তার ঝাকরা চুলের পানি ঝাড়ছে। কানা চোখে আবার চেয়ে চেয়ে দেখছেও। আহারে, সে কি করছে তাও তার দেখতে হবে। না ডাক দিলে কেমন হয়। ভিজুক। আচ্ছা মতন ভিজে কাকগুলোর বন্ধু হোক। সে আবারো কানা চোখে চাইছে। আশা করছে সে আবার ডাকবে। কোনভাবেই তাকে না ডেকে সেও কি পারবে! ডাক দিল,
: উঠে আস বলছি।
আসছে না। হাসছে অন্যদিকে চেয়ে।
: উঠে আস বলছি কাক মিঞা।
: আগে জবাব, তারপরে।
: কী ছেলেমানুষী করছো।
: ভাইজান উইঠ্যা আসেন। ভিইজ্যা শেষ হইয়া যাইতাছেন। শেষে আফনের কাপড়ের তুন আফারও কাপড় ভিজবো।
: কী দরদ রে বাবা আফার জন্য। কোন জনমের বোন রে তোর।
রিকশাওয়ালাও কম না, বললো,
: ভাইজান থেকে শালায় নামায়ে দিলরে দিল আমারে।
রিকশাওয়ালা আর তার কথোপকথন থামাতে নায়াগ্রা ঝটপট বলে উঠেছিল,
: তুমি হচ্ছো, তুমি হচ্ছো, ভাবছি, তাড়াতাড়িই বলবো, উঠে এসো আগে। একটি বছর শেষ হয়নি। একটি বছর পার করে তারপরে বলবো বলেছি।
: তোমার এ নিষ্ঠুরতা কবে শেষ হবে বলতে পার,
: এক বছর পরে।
: ভাইজান এক বছর অপেক্ষা করেন। বেশি দিন না।
: তুই কি বুঝিস, বেশি না কম। প্রেমে পড়েছিস কখনো।
: বহুতবার।
এটাই সে চাইছিল এড়াতে রিকসাওয়ালাকে নিজেদের ভেতরে আনা, কথার কোন প্রাইভেসী থাকে তাহলে। কিন্তু সে দিব্যি রিকসাওয়ালার সাথেই আলাপ জুড়ে দিল। এই করেছে সব সময়। তৃতীয় ব্যক্তিকে সবসময় মাঝে এনে দাড় করিয়েছে। ভিজছে সেদিকে খেয়াল নেই, রিকশাওয়ালাকেই জিজ্ঞেস করছে,
: উঠলি কেমনে।
যেন তার নিজের ওঠাও খুব জরুরী। পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
সাহায্যকারী বললো,
: মায়ে রশি দিয়া বাইন্ধা তুলছে।
: আরে সবখানে মায়েরাই কি ভিলেন নাকি? এই হাত মেলা আমার সাথে।
: আমিও একদিন ছেলের মা হব তাই নায়কবাবু শোনেন, ভিলেনের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। চলবে না।
‘চলবে না, চলবে না’ বলতে বলতেই রিকসায় উঠেছে রাজপুত্র। উঠেই যথারীতি হুটে বাড়ী খেল।
: লম্বু মিঞা।
: মিয়াও মিয়াও। তালগাছ ভাবছো আমাকে। হু আমি কিন্তু তাহলে আকাশে উঁকি মারবো, তারা রানীর খোঁজে, তখন বুঝবে।
: ওরে আমার কেরে?
: আবার? আবার যাব নাকি নেমে। নাহ্ এই মেয়েকে আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না।
: আগে দেখ প্রেম হয় কিনা। তারপর তো বিয়ে। একবছর পেরুতে পেরুতে দেখ আমিই না শ্বশুরবাড়ী চলে যাই।
: যাও দেখি! ধরে নিয়ে আসবো। যেখানেই থাক না কেন বছর পূর্ণ হতেই জবাব চাই, পাশ ফেল জানতে হবে। জানতে হবে আমার। তোমার হ্যাঁ বা না। শ্বশুর বাড়ীতে পৌঁছে গেলেও এবং সেটা যদি আমার বাপের বাড়ীও হয় তাহলেও দরজায় নক নক করে জানতে চাইবো, বল এবার ভালবাস কি না!

এতবড় ভাষণে নায়াগ্রা হা হা করে হেসে ফেললো। রিকসাওয়ালাও প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
: আমারেও খবর দিয়েন। আমিও যাব রিকশা লইয়া আফারে আননের লাই।
ভালই লাই পেয়েছে তো এই ব্যাটা। সাথে চলছে আর মতামত দিয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত চোখে পাশের লোকের দিকে চাইলো। সব দোষ তার। মানুষটা তাড়াতাড়ি বললো,
: আমি গাড়ী কিনে তারপরে যাব বিয়ে করতে, বুঝেছো। তোমাকে নেব না।
বুঝতে পারছে সে বিরক্ত হচ্ছে দেখে রাজার কুমার গাড়ীর কথা তুলে রিকসাওয়ালাকে বাতিল করছে।
কিন্তু সে কি আর থামে। বললো,
: আমি তো ভাইবতাম হেই তারে আননের লাগি পক্ষীরাজে যামু।

রিকসা থামতে না থামতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়লো রাজা সাহেব। যেন তার ইচ্ছাই সব। ভাড়াও মিটালো। বেড়ার চায়ের দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
: রিকসাওয়ালাটা বেশি বেশি তোমার দিকে চাচ্ছিল, আমার পছন্দ হচ্ছিল না, তাই নেমে পড়লাম। কেঊ তোমার দিকে তাকালেই আমার কেন যে এত রাগ লাগে।
নায়াগ্রা হাসলো। কি পাগল ছেলে। অযৌক্তিক কথাবার্তা বলে বেশি। নির্বিকার চিত্তে ভেজাচুল ঝাকালো তার গায়ের উপর। পানি ছিটালো তার চোখে মুখে। পরোটা আর বুটের ডালের অর্ডার দিল। সবজী ভাজাও। তার প্রিয় খাবার।
নায়াগ্রা হেসে বললো,
: যদি অন্য কারো সাথে চলে যাই তাহলে তুমি সত্যিই কি করবে?
: যাও তো দেখি। বেনী ধরে টেনে রেখে দেব।
: সে কারনেই ভাবছি ববকাট করে ফেলবো।
: মুণ্ডু তো থাকবে ঘাড়ের উপর, নাকি তাও বাদ দেবে। সেটাই ধরে রাখবো। একদম পকেটে পুরে রেখে দেব।
খাচ্ছে, গল্প করছে, খুব খুশীতে আছে সে। নায়াগ্রা জানে সে পাশে থাকলেই ঐ যুবক হেসে উঠে প্রাণের পরশে। বলেও সে প্রায়ই, তুমি হচ্ছো আমার জিয়ন কাঠি।
: জিয়ন কাঠি এবার যেতে চায়। ভার্সিটির বদলে বাসায় ফিরে যাব।
: হু, রাখাল কুমার বুঝি আর রাজকন্যার পছন্দ হচ্ছে না। বাসায় ফিরতে হবে না। আজ সারাদিন আমার সাথে থাক।
: আবদার!
: আমি হচ্ছি তোমার তাবেদার।
: চল ফিরি তাবেদার কোথাকার।
: কেমন করে ফিরবো।
: কেন রিকসা করে।
: তুমি মুখে বলছো যাবে কিন্তু আসলে তো যেতে চাইছো না।
: এত বুঝো! হা হা।
: ইয়েস, বুঝতে পারি। আমি হচ্ছি তোমার ব্যাপারে সবজান্তা ডিকশনারী।
: ওরে আমার কে রে?
: বুঝে শুনে বল, সত্যি যদি কোনদিন সত্যি-সত্যিই হারিয়ে যাই তাহলে কিন্তু কেঁদে কুল পাবে না।
: দেখা যাবে।
নায়াগ্রা আজ বসে ভাবে একা একবৃষ্টি মাথায় নিয়ে কেউ কেঁদেছে কি কোন দিন গত ২০টা বছরে। ভালবাসার সেই যুবকের জন্য। নাহ্। একেবারেই নাই। না তো। কখনোই না। কোনদিনও না। পরের জন্য কাঁদতে হয় কেমন করে নায়াগ্রা জানেও না। বৃষ্টি বাড়ছে। প্রকৃতিইবা এত কাঁদছে কেন?

সেদিনও কেঁদেছিল প্রকৃতি। আনমনে। বলেছিল কি গোপনে নিরবে এই দিনই শেষ দেখা। সে তো তা কই ধরতেও পারেনি। নায়াগ্রার মুগ্ধ দুচোখে ছিল শুধু ধরা প্রিয় সেই মুখ। চেয়েছিল অপলক তার দিকে যাকে সে বলেনি ভালবাসি। একটা বছর ধরে ভাববে বলে ঘুরিয়ে রেখেছে। চা দোকানের কাঠের টেবিলে বসে গালে হাত দিয়ে দুনয়ন মেলে চেয়ে থেকেছিল শুধু সেই অপরূপ ভাললাগার দিকে। বাহিরে বৃষ্টি। টিনের চালে টাপুর টুপুর, চায়ের ঘ্রানে কি অবিনাশী সুন্দর এক লগ্ন। কী কাটা কাটা চেহারা তার। এত বুজদার অথচ তার কাছে এলে যেন শিশু। এত হুমকি ধামকী দিয়ে বেড়ায় অথচ তার আশেপাশে এলে যেন এক বিড়াল ছানা। নয়ন ভরে থাকে নায়াগ্রার দুচোখে ভালবাসার প্রপাতে।
আজ হঠাৎ সেই পানি তার চোখে নামতে চাইছে কি? চমকে উঠে নায়াগ্রা। লাফ মেরে উঠে। নাহ্ যাবে না ভার্সিটি। অতীতকে ছোঁবে না। ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আসছে ট্রেন। না, সে ফিরে যাবে তার নিজের জীবনে, ফিরে যাবে না অতীতে। এক বছর শেষের জন্য সে তো বসে থাকতে পারেনি। বলা হয়নি জবাবটা। বিয়ে হয়ে গেছে তার। আর ওটা ওখানেই শেষ। দাড়ি, কমা, সেমিকলন সব পরে গেছে।
নায়াগ্রা রেলস্টেশন থেকে বের হতে হতে আপন মনে বলে, তোমার আমার যে একটা গল্প ছিল তার নটে গাছটি মুড়ালো। এখানেই ফেলে রেখে গেলাম। এ গল্পে আমার আছে শুধু একফোটা অশ্রুজল। থাকুক তা আঁধারে কোথাও একান্ত অজানায় অবহেলায় পড়ে।

ট্রেনের শব্দটা শুধু দ্রুত কাছে চলে আসছে। সে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে প্লেটফর্ম থেকে। হঠাৎ পেছন থেকে মনে হলো, চলমান ট্রেন থেকে কেঊ চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো নায়াগ্রা, নায়াগ্রা। চমকে সে ফিরে তাকালো। কই কোথাও কেঊ তো নেই। ট্রেনটা তো থেমে গেছে স্টেশনে। বুঝে গেল ওটা ফ্লাশব্যাক। হঠাৎ ফিরে আসা একটা পলক। এক ঝলকে হঠাৎ পাওয়া পলকটি আবার কোথাও হারিয়ে গেছে। সেই গল্প থেকে ছুটে বের হয়ে আসা একটি খণ্ড চিত্র মাত্র।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত