সন্ধ্যার বিষণ্ণতা আমায় কুরে কুরে খায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর হাল্কা হিমেল হাওয়া যেন প্রলয়ের সংকেত বয়ে আনে। বাস ট্যাক্সি মিনি প্রতিটি যাত্রীযানই পরিপূর্ণ। নিত্য অফিস যাত্রীরা দিশাহারা। জীবনযুদ্ধের এ দৃশ্যপট আমার ক্লান্তি আরও গাঢ়তর করে। বাড়ি ফেরার কোন তাগিদ আমি অনুভব করি না। চঞ্চলা বালিকা, আধুনিকা যুবতী আর অতি আধুনিকা প্রৌঢ়ার দল নিজ নিজ দ্বীপের সীমানা মুছে আজ নতুন দ্বীপের সীমানা রচনায় ব্যাস্ত-আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়। এক একটি যাত্রীবাহন আসে-থামে-যায়। বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নতুন বৃত্ত রচনা হয়, নতুন দ্বীপ জেগে ওঠে।
হঠাৎই আমার দ্বীপে আবিষ্কার করি তাকে। এক প্রায় বৃদ্ধ লোকের ছাতার তলে তরুলতা। সময়ের ব্যবধানের স্বাক্ষর সারা দেহে। চোখে ক্লান্তি, দেহ শিথিল। মুখের কমনীয়তায় এসেছে বয়সের প্রজ্ঞা।
চোখে চোখ পড়ে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করে-আপনি?
আমি বলি-আপনি?
সেকেন্ড কাটে, মিনিট কাটে, ঘন্টা কাটে-তারপর কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ পরে সে জিজ্ঞাসা করে-এখানে?
শব্দের জন্ম হয়। লিপি-ভাষা-ব্যাকরণ-অভিধান। আমি প্রয়োজনীয় শব্দ খুঁজে পাই না। পরীরা আসতে শুরু করে।
তখন অনেক পরী আসত। লাল পরী, নীল পরী, হলুদ পরী। আমার স্কুলের মাঠ পেরিয়ে রায়েদের বাঁশ বাগান ছাড়িয়ে ছিল জলার মাঠ । সারি সারি লাউ পালঙের বাগান। সেখানে লালুদের কিছু জমি ছিল। সে সুবাদে আমরা ছিলাম জমিদার। আমি লালু আর শক্তিপদ অবাধ রাজত্ব করতাম।
রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ আসত। আমার হাত ধরত। আমি জলার মাঠে খেলা করতাম। একে একে হাজির হত আমার প্রিয় সখীরা। লাল পরী আসত নেচে নেচে পেখম মেলে আগুন রঙা উড়নি গায়ে। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি করত নীল পরী। আর সবশেষে আসত হলুদ পরী-ঠিক ভোর বেলায়। তখন লাল আর নীলের চোখে ঘুমের ছোঁয়া। তীব্র সুন্দরী হলুদ পরী ঝাঁঝালো আলোয় আলোকিত করে তুলত জলার মাঠ । আমার গ্রন্থিরাশি আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসত। সিক্ত স্বপনে আমি আবিষ্কার করতাম হলুদ পরীর মুখ-সে ছিল তরুলতা।
আমি বলতেই লাফিয়ে উঠল শক্তিপদ। বলল-তুই লোভে পড়েছিলি। প্রথমে আস্বীকার করি। দেহে এক অজানা অনুরণন আসে। মুখ নীচু করি।
একে লোভ বলে, দেখ তোর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। লালু বিজ্ঞের মত মন্তব্য করে।
আমি সাংঘাতিক ভয় পাই। বাবার মুখটা ভেসে আসে। পরিণামের কথা চিন্তা করে দেহ শক্ত হয়।
তখন এই ছোট শহরে আমাদের একমাত্র পরিচিত প্রেমিক ছিলেন গনাদা। বছর পঁচিশ বয়স। সুপুরুষ। ইঞ্জিনিয়ার। ওঁর প্রেম শহরের তাপমাত্রা অনেকদিন উঁচু স্কেলে বেঁধে রেখেছিল। আমাদের মত নতুন গোঁফ-ওঠা কিশোরদের কাছে গনাদা ছিলেন আদর্শ। যখন সন্ধ্যা বেলা সদ্য ভাঙা তুষাররঙা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে তিনি আমাদের পাশ দিয়ে যেতেন, আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলতাম। ফেলে যাওয়া হাল্কা সেন্টের গন্ধ আমাদের অবিষ্ট করত। শক্তিপদ বলত-টিউশনি যাচ্ছেন। আমি বলতাম-অনুরাধার কাছে। অনুরাধা ছিল গনাদার প্রেমিকা। ক্লাস টেনে পড়া লম্বা বিনুনীর এক ভীরু বালিকা। বাবা রেলের গুডস ক্লার্ক। ব্যাপারটা তিনি জানতেন। হয়ত নীরব সমর্থনও ছিল। যা কিছু আপত্তি ছিল গনাদার বাড়ির দিক থেকে। ঠিকযেমন জমাটি নাটকে হয়। ঘটনার টানাপড়েনে শহরে মাঝে মাঝেই ঢেউ উঠত।
গনাদার একছত্র প্রেমের রাজত্বে আর একজন দ্বিতীয় প্রেমিকের প্রবেশ যে শহরকে তোলপাড় করে দেবে তা আমি জানতাম। আসলে সময়টা তখন এত জটিল ছিল না। দূষণ শব্দটি নেহাতই প্রয়োজনে ব্যবহার হত। অর্থাৎ জল, বায়ু, শব্দ এমনকি সংস্কৃতির পরে এটিকে লাগানোর দরকার পড়ত না। কিশোর জগৎ তখন উত্তম সুচিত্রার দখলে। শক্তিপদ আর লালু স্কুল পালিয়ে এগারোবার দেখে এসেছে। সেই অসাধারণ প্রেমের বর্ণনায় আমি দিশাহারা। আমরা ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে লালু তার অননুকরণীয় কন্ঠে মৃদুস্বরে গান শোনাল-ওগো তুমি যে আমার। তারপর একটা চোখ টিপে অর্থবোধক হাসি হাসল। আমি সমঝদারের ভঙ্গীতে আর একটা চোখ টিপে উত্তর দিলাম।
হঠাৎবাঘাটে গলায় চিৎকার-চমকে উঠি – অতনু স্ট্যান্ড আপ। অংকের মাস্টারমশাই অশোকবাবু আগুন ঝরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উঠে দাঁড়ালাম।
-কাল্পনিক সংখ্যা কাকে বলে?
সংখ্যাত্ত্বের সব সংখ্যাই আমার জানা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে যে কোনটি কাল্পনিক তা আমি কল্পনায় আনতে পারলাম না
– মিত্তির স্ট্যান্ড আপ।
লালু মুখের মধ্যে শিশুর সরলতা মিশিয়ে উঠে দাড়ায়।
– গায়কটি কে?
– অতনু স্যার। লালু আমার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়। কথাটার মধ্যে অবিশ্বাসের কিছু ছিল না। কারন ক্লাসের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রতিষ্ঠিত গায়ক।
– অতনু। নিল ডাউন ফর রেস্ট অফ দা পিরিয়ড। তারপর অশোকবাবু আমার কল্পনাকে খান খান করে দিয়ে কাল্পনিক সংখ্যা বোঝাতে লাগলেন।
তুই প্রেমে পড়েছিস- শক্তিপদ আবার বলল। কি সাঙ্গঘাতিক ব্যাপার! রায়েদের বাড়ির দুধরঙের মেয়ে তরুলতাকে প্রেম। আমার মাথা রিমঝিম করে। এ ধরনের চিন্তা আমার মত আধা-শহুরে কিশোরের পরিপাক করা শক্ত ছিল। কারন তখন সামান্য উপকরনই আমার যৌন চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। পরিচিতা, আত্মীয়ার অন্তর্বাসের এক ঝিলিক দেখা, গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকার বৃহৎ রাঙামুলোর বিঙ্গাপন কিংবা বই পাল্টানর সময় অপর্নাদির আঙ্গুলের একটু ছোঁয়া আমার কাছে অজানা রাজত্বের চাবিকাঠি ছিল। কিন্তু গোটা রাজত্বের অধিকার সম্বন্ধে আমি নিজেই সন্দিহান ছিলাম। বললাম তাই হয় নাকি? এতো স্বপ্ন। যে কেউ দেখতে পারে।
শক্তিপদ রেগে গেল। বলল- জগতে এত মেয়ে থাকতে তুমি তরুকেই বা স্বপ্নে দেখতে গেলে কেন? ন্যাকামি ছাড় তো বাবা। ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে?
– তুই তো সায়রাবানুকে স্বপ্নে দেখলি, তার মানে সায়রাবানু তোর লাভার হয়ে গেল।
– বোকা, বোকার ডিম। সায়রাবানু হিরোইন। হাজার হাজার লোক স্বপ্নে দেখে। কিন্তু তরু? তরুলতাকে একমাত্র স্বপ্নে দেখে আমাদের অতনু। শক্তিপদ প্রান খুলে হাসতে থাকে।
তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? যাতে একটা হিল্লে হয় দেখছি। শক্তির সাথে একটা প্লান করতে দে। লালুর গলা আত্মবিশ্বাসে ভরপর।
শক্তিপদ ভাল মানুষের মত বলল-ক’দিন রোদে বেরোস না, আর ‘লা বেলা’ সেলুনে ঘাড়টা গোল করে ছেটে আয়।
আমি খোলসে প্রবেশ করি, যাতে স্মরণে-মননে হলুদ পরী হারিয়ে না যায়। বিকেলে খেলার মাঠে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। লাল কর্ডের প্যান্টটা বার করলাম। সঙ্গে সানিটের সার্ট। কড়া করে মাড় দেওয়া। ঘড়িওয়ালা মোড়ে দাঁড়াই।
সেন্ট মার্গারেটের বাস আসে এ শহরে অর্ধেক সুন্দরীকে নিয়ে। চাঁপারঙের স্কুল বালিকারা একে একে নামতে থাকে। মুখে ছুটির আনন্দ। সবশেষে নামে তরুলতা। কচি কলাপাতা রঙের স্কুল ইউনিফর্ম, সাদা মজা,পায়ে কেডস। ভীরু চোখে এস্ত হরিণীর মত যাত্রা করে বাড়ির দিকে। কোনদিকে দৃষ্টিপাত না করে।
এক কিশোর মুগ্ধ বিস্ময়ের স্থবির হয়ে যায়। তারপর ভয়ংকর বয়সের অস্থির যন্ত্রণায় সে ছটফট করে। সে যন্ত্রণা পোষাকের বাধা মানে না। সভ্যতা, ভব্যতা, নীতি, রুচি ইত্যাদি শব্দগুলোকে কামান দাগতে থাকে। মনে হয় শহরের সব কটা মাইক ভাড়া করে ঘড়িওয়ালা ঘোড়ে লাগিয়ে দেয়। বলতে শুরু করে-তরু-তরু-তরুলতা।
বৃষ্টির তেজ কমে আসে। আমি জিজ্ঞাসা করি-আপনি এখানে? তরুর চোখে নিভন্ত প্রদীপের আলো। জবাব দেয়-ক্যামাক স্ট্রীটে একটা ক্রোশে কাজ করি। ছটায় ছুটি। বৃষ্টিতে আটকে গেছি। আমি বলি আশ্চর্য! আমিও তো ক্যামাক স্ট্রীটে ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে কাজ করি। একদিনও তো আপনির সঙ্গে দেখা হয়নি।
পৃথিবীতে তো কত আশ্চয়ই থাকে, আমি-আপনি কতটুকুই বা জানি? তরু ম্লান হেসে জবাব দেয়। তারপর বলে-প্রায় একঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি, কোন বাসে উঠতে পারছি না। আমায় একটু পৌঁছে দেবেন! কোন সুদূর অজানা দেশ থেকে ইহার তরঙ্গে ভেসে আসে-আমায় একটু পৌঁছে দেবেন। আমি তরুকে নিয়ে চলতে থাকি। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করি না-কোথায়?
সকালে শহরে হৈ চৈ পড়ে যায়। কারা যেন সারা বছর দেওয়ালে লিখন ভরে দিয়েছে। অতনু+তরু। কোথাও বাদ রাখেনি। শীতলা মন্দিরের চাতাল শ্যামশ্রী সিনেমার প্রস্রাবাগার, করিম মিঞার মাংসের দোকান, এমনকি তরুদের বাড়ির দেওয়াল। একঘন্টার মধ্যে খ্যাতির পাদপ্রদীপে চলে আসি। বাবা দুগালে সপাটে চপেটাঘাত করেন। ক্রন্দনরত মা আমার কর্ডের প্যান্ট আর সার্টিনের জামা আলমারি বন্দী করেন। পচা নাপিত এসে আমার মাথায় রোলার চালিয়ে দেয়।
বিকালে লালু আর শক্তিপদ এসে হাজির হয়। আমি কান্নাভেজা কন্ঠে বলি – তোরা বন্ধু হয়ে এত বড় সর্বনাশ করলি। লালু অবাক হওয়ার ভান করে- উপকার বল! ভিত আমরা করে দিয়েছি। মহল গড়ার দায়িদ্ব তর। শক্তিপদ বলে- তরু এখন জানে তুই ওকে ভালবাসিস। এবার তর জিনিষ তুই বুঝে নে। আমি রাগত সুরে বলি- আমি আর এসব ব্যাপারে নেই। তদের জন্য আমার এই বদনাম। লালু ক্ষেপে গিয়ে বলে- বদনাম। প্রেম করবে বদনাম হবে না, ক্ষির খাবে- গোঁফে দাগ লাগবেনা, তবে শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে যাত্রা নাচো। শক্তিপদ বলে- আমরাও এর মধ্যে নেই, আর কোনদিন আমাদের কাছে মিনমিন করতে এস না।
স্বাভাবিক নিয়মেই ক’দিন পর ঢেউয়ের তীব্রতা কমে আসে। বিকেল হলেই ঘড়ি মোড় আমায় নেশার মত টানে। একদিন নানা গুপ্তচরের চোখ এড়িয়ে চলে আসি। এক্টু দুরে দাড়িয়ে সময়ের অঙ্ক কষি। হটাৎ এক ঝাঁক মুনিয়ার ডাকে চমকে যাই। ওরা বাস থেকে একে একে উড়ে আসে। তরুকে দেখি। ও আমায় দেখে। দৃষ্টির শীতলতায় আমার ব্যারমিটারের পারা দ্রুত নামতে থাকে। ক’হাত দুরে আবিষ্কার করি তরুর মাকে। চখে বাঘিনীর হিংস্রতা। যে কোন মুহুর্তে রক্তপাত হতে পারে। একপাটি হাওয়াই ছিটকে চলে যায় নর্দমায়। আর একপাটি নিয়ে দিই ভোঁ দৌড়।
আমাকে অবাক করে একদিন শহরের প্রতিষ্ঠিত প্রেমিক গনাদা জিঞ্জাসা করলেন- তোমার নাম অতনু না ? আমি মুখ নিচু করে জবাব দিই- হ্যাঁ। তারপর কোন ভুমিকা ছাড়াই বললেন- তুমি তরুকে ভালবাসো? চুপ করে থাকি, কি জবাব দেব ভেবে পাই না।
– তুমি ভালবাস। তোমার মুখ তাই বলে। তারপর কি ভেবে আবার প্রশ্ন করেন- তরুকে জানিয়েছ, তোমার মনের কথা?
– না
– কেন ?
– লজ্জা করে, ভয় লাগে।
– ভয় পেলে প্রেম করা চলে না, মেয়েরা সাহসী ছেলে পছন্দ করে।
– বাবা বলেছেন বাড়ি থেকে বার করে দেবেন।
– তা হলে তোমার প্রেম করা উচিত হয়নি।
– কিন্তু আমার যে তরুকে ভাল লাগে!
– বেচারা! গনাদা মৃদু হেসে পিঠ চাপড়ে দেন। তারপর বলেন,
– দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি।
কি আশ্চর্য! দু-মাস পরে দেখি গনাদা তরুকে পড়াতে আরম্ভ করেছেন। লালু বলে- এবার তোর একটা হিল্লে হবেই। এ ব্যাপারে গনাদার প্রচুর অভিজ্ঞতা। ভরসা রাখা যায়।
আমি ভরসা রাখি। দিন যায়। লালু মাঝে মাঝে খবর আনে। প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা পাঁচিলের ধার থেকে গনাদার পড়া দেখে। একদিন এসে বলে- আজ দেখলাম গনাদা রোমিও-জুলিয়েট পড়াচ্ছেন।
কি অপুর্ব আবৃত্তি। সারা ঘর গম গম করছিল।
– আর তরু? আমি প্রশ্ন করি।
– তরু? তরু এক মনে বাঁগালে হাতদিয়ে শুনছিল।
আর একদিন এসে বলে- আজ বৈষ্ণব পদাবলি শুনলাম। রাধার মানভঞ্জন।
শক্তিপদ আশ্চর্য হয়ে বলে- ইংলিশ মিডিয়ামে এ সব পড়ানো হয় নাকি? আমি বলি- হয় হয় সব হয়। ভাল মেয়েরা রেফারেন্স হিসাবে সব কিছু পড়ে।
আবার খবর আনে। তরুকে সে কাঁদতে দেখেছে। গনাদা বকেছে। বোধ হয় পড়া পারেনি। আমি ব্যাথিত হই। গনাদা বকেছে। তরু নিশ্চই রাতে কিছু খায়নি। আমি সে রাতে এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মা বারবার ডাকাডাকি করল।
– শরীর খারাপ, বিরক্ত কর না, বলে পাশ ফিরঅলাম।
একদিন বাজারে গনাদাকে পাকড়াও করি।
– গনাদা, আমার কি হল?
– আরে অতনু না? বলে আমার কাঁধে হাত রাখেন।
– অনেক দিন হয়ে গেল, কি খবর গনাদা?
আমার করুন কন্ঠে আর্তি।
– ও তরু? তাই বল। এত তাড়াহুড়ো করলে কি সবকিছু হয় ভাই? সময় লাগে, সময় লাগে।
– আর কতদিন গনাদা- আমি আর্তনাদ করি।
– বোকা ভাইটি। একি বেগুনী-ফুলুরি নাকি? দোকানে গেলে আর কিনে আনলে। এর নাম প্রেম। শুধু জমি তৈরি করতেই বছর ঘুরে যায়।
– জমি? অবাক হই।
– হ্যাঁ জমি! আমি তৈরি করি তুমি ফসল তুলো। গনাদা প্রান খুলে হাসতে শুরু করেন।
আমি বোকার মত চেয়ে থাকি। গনাদা বলেন- এ সব তুমি বুঝবে না, শাস্ত্রীয় ব্যাপার। সময় হলে সব জানাব।
সব শুনে শক্তিপদ ক্ষেপে গেল। চেঁচাতে লাগল- আমার এ সব ভাল লাগছেনা। গনাদা কিছু চাল চেলেছে।
– আমার ও তাই মনে হয়, লালু বলে।
– তুই গনাদার কাঁধে মই দিয়েছিলি কেন? পুরুষ মানুষ একা লড়তে পারিস না? শক্তিপদ রাগে ফুঁসতে থাকে।
– তুই যদি সত্যি ভালবাসিস, তরুকে সোজাসুজি জানা। আমি দপ করে জ্বলে উঠি – জানাবটা কি করে? মাত্র দুবার বাড়ির বাইরে দেখি। একবার স্কুলে যাবার সময় আর একবার ফেরার সময়। আর সব সময় ওই মেয়েমানুষটা ঘিরে ঘিরে রাখে।
– অতনু। শক্তিপদ ধমক দেয়। তারপর বলে- নিজের গুরুজন সম্বন্ধে ওরকম অসভ্য কথা বলতে নেই। শোন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলেছে। তরু রোজ রাত নটা নাগাদ পুবের বারান্দায় আসে। চুল আঁচড়ায়। আমি পিসির বাড়ি যেতে গিয়ে দেখেছি।
– তাতে কি? লালু বিরক্ত হয়।
– আমাকে বলতে দে, তারপর অতনু একটা চটঠিতে ওর মনের সব কথা জানাবে। আর চিঠিটা গুলতিতে একটা ঢিলের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দিলেই চলবে। শক্তিপদ ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে যায়।
– কেল্লা ফতে- লালু চিৎকার করে ওঠে।
প্রিয়তমা তরুলতা। দুবার কাটাকুটি করি। না, শুধু তরুলতাই থাক। সারা জীবন তমার ক্ষতিই করে গেলাম। বিশ্বাস কর, আমি যা করেছি তা শুধু তোমায় ভালবেসে। জানি, তুমি আমায় ভালবাস না। কিন্তু আমি তো বাসি, চিরকালই বাসব। সেয় যবে আমার ভুরু হবে তোমার গায়ের রঙের মত- সেদিনও তোমায় ভালবাসব। আমার দিকে একটু তাকিও। না অমন করে নয়, ঠিক হলুদ পরী যেমন করে তাকায় তেমনি করে। অবাক লাগছে না? যদি কোন দিন সুযোগ পাই খুলে বলব। না হয় হলুদ পরীকেই জিজ্ঞেস কোরো। একটু বাদেই তো পরীর দেশে যাবে। শুভরাত্রি- অতনু ।
ঠিক রাত্রি সাড়ে আটটায় আমরা ‘অভিযান- তরুলতাস’ বেড়িয়ে পড়ি। লালু সাইকেলে, আমি আর শক্তিপদ হেঁটে। শহরের শেষ সীমায় এ জায়গাটা প্রায় নির্জন। দু-এক জন লোক দেখা যায়। রাস্তার মোড়ের একটা টিমটিমে আলো ঘন অন্ধকারকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। নিজের অজান্তে শক্তিপদর হাত চেপে ধরি। ও নিঃশব্দে আমার হাতে গুলতি তুলে দেয়। তারপর আমাদের দাঁড় করিয়ে হটাৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
লালু আর আমি অন্ধকারে গোঁজ হয়ে বসে থাকি। মশার কামড় খাই কিন্তু মারতে সাহস হয় না- পাছে আওয়াজ হয়। শক্তিপদ ছুটতে ছুটতে আসে। তারপর বলে তরু এসে গেছে, ছুটে যা।
অস্ত্রে শাণ দিই। একটা গোলমত ইঁট তুলে নিই। যত্ন করে চিঠিটা ইঁটে জড়াই। তারপর আস্তে আস্তে রওনা দিই তরুসুন্দরীর দিকে। আজকের অভিযানে ভয় পাই না। কারন পাওয়া কিংবা না পাওয়া এই সরল অথচ আপাত জটিল সমস্যার সমাধান করে দেবে এ অভিযান। আমি নির্বিকার চিত্তে এগিয়ে যাই।
পুবের বারান্দায় তরু দাড়িয়ে। পরনে লম্বা হাউস কোট। গায়ের রঙের। অপরুপ ভঙ্গির সেই কেশ প্রসাধনে ফুটে উঠে নৃত্যের মুদ্রা। আমি স্তব্ধ হই। জোনাকিরা মিটিমিটি আল জ্বেলে পুজো করে- তাদের প্রিয় দেবীকে। প্রানভরে পান করি সেই অপার্থিব রুপসুধা। আমার মরনে খুঁজে পাই জীবনের সব সুখ। ভুলে যাই আমার অভিযান। আর এগিয়ে গেটের কাছে চলে আসি। ভাল করে দেখার জন্য।
হটাৎ তরু আমাকে দেখতে পায়। চিৎকার করে ওঠে কে? কে ওখানে?
আমি চকিতে গান্ডীবে টান দিই। আর্তনাদ ভেসে আসে- মাগো! মেরে ফেলল! দেখি তরু মুখ ঢেকে বসে পড়েছে। অনেক কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসে।
দৌড় দিই। জীবনের সেরা দৌড়। লালু শক্তিপদ দাঁড়িয়ে। আমি কাছে এসে বলি- পালা, তরুকে মেরে ফেলেছি। ওদের হতচকিত করে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার দৌড়তে থাকি। পেছনে অস্পস্ট কোলাহল শুনতে পাই। সাঁ সাঁ করে সাইকেলে লালু আর শক্তিপদ আমায় ফেলে চলে যায়।
আমার কোন গন্তব্যস্থল নেই। কোন লক্ষ্য নেই। নিজের অজান্তে কখন হাজির হই গনাদার বাড়িতে। এতরাত্রে আমায় দেখে গনাদা অবাক হন। তারপর জিজ্ঞাসা করেন- হাঁফাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?
– আমি তরুকে মেরে ফেলেছি। ভয়ে কুঁকড়ে যাই। গনাদা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন- কি হয়েছে, ঠিক ঠিক করে বল।
গোটা ব্যাপারটা বলি। সব কিছু। কিছু বাদ না দিয়ে।
– তুমি এখানে বস। আমি যতক্ষন না আসি বাইরে পা দেবে না। গনাদা সাইকেলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যান।
আমি অকৃতকার্য। আমার কোন অনুভুতি নেই। ফেল করার ভয়ে আর আমাকে কুঁকড়ে থাকতে হবে না। কিছু হারানোর ভয় নেই। কারন আমি হারিয়ে ফেলেছি। নিজের অজান্তে গনাদার বিছানায় দেহটা এলিয়ে দিই। কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা, গনাদার দাকে ঘুম ভাঙে।
– উঠে বস। তরুর কপালে তিনটে স্টিচ হয়েছে। চোখটা খুব জোর বেঁচে গেছে।
আমি শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি।
– তোমার চিঠি তরুর মা পেয়েছে। কাল থানায় ডায়েরি করবে।
আমি গ্রিক ভাষা বুঝি না। কোন দিন শিখিনি।
– তোমার বাবাকে খবর দিয়েছি। সকালে বাড়ি যেও।
আমি ফ্রেঞ্চ জানি না। আমি ক্লান্ত, শুয়ে পড়ি।
বাবার ব্যক্তিগত মুচলেখা, তরুদের বাড়িতে মায়ের ঘন ঘন গমন এবং ক্ষমা প্রার্থনা- আমার কোর্ট ঘর থেকে বাঁচিয়ে দিল। আমি প্রেমরোগ মুক্ত হলাম। কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হলাম।
এর পরের দৃশ্যগুলি খুব দ্রুত অভিনীত হতে লাগল। পুজোয় বাড়ি এসে শুনলাম তরুর বিয়ে গনাদার সঙ্গে। অবশ্য নতুন কিছু খবর নয়। এটা জানতাম। শাস্ত্রজ্ঞ প্রেমিক গনাদাকে ধরা রাখার ক্ষমতা নেই অনুরাধা নাম্নী ভীরু বালিকার ছিল না।
পথে ঘাটে মাঝে মধ্যে ওদের দেখতাম। তরু সুখি বিড়ালীর মত স্ফীত হতে লাগল। বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে রিক্সায় দুজনে হুস করে চলে যেত। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবতাম এ রকমই বুঝি সুখের চেহারা। আমার মনে কোন দুঃখ ছিল না। দেবদাস হবার ইচ্ছাও ছিল না। অক্ষমতার ক্রোধ সময়ের ব্যবধানে তেজ হারিয়ে ফেলেছিল।
গরমের ছুটিতে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শক্তিপদ বলল- গনাদা একটা স্কাউন্ড্রেল। আমি চমকে উঠি। গনাদা নাকি আবার অনুরাধার কাছে যাতায়াত শুরু করেছে। এ নিয়ে খুব অশান্তি। তরুর বাবা-মা আর নেয়। দাদাদের পৃথক সংসার। তা সত্ত্বেও তরু প্রায়ই দাদাদের কাছে চলে আসে।
তারপর থেকে বাড়ি এলেই তরুর খোঁজ করতাম লালু কিংবা শক্তিপদর কাছে।
লালু বলল- তুই জানিস না? তরু আর এখানে থাকে না। কলকাতায় কোন লেডিস হোস্টেলে থাকে। ওর দাদাই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। গনাদা ফের অনুরাধাকে বিয়ে করেছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। সন্ধ্যার বিষন্নতা কেটে এখন আকাশ মেঘমুক্ত। চাঁদ প্রলয়ের স্মৃতি মুছে দিতে মিটি মিটি হাসে। কখন তরুর হাথ আমার হাতে ধরা দিয়েছে আমি নিজেই জানি না। আমি এগিয়ে চলি।