শিশুদের ছোট দলটি ক্রমে আরও দৃশ্যমান হয়। কাছে এলে শুধোই,
‘কই যাও তোমরা?’
পাঁচজনের দলটির মধ্যে সবার বড় ও সবার ছোট দু’জন মেয়ে। বাকি তিনজন ছেলে। বাঁশের টুকরি হাতে বড় মেয়েটির বয়স নয় কি দশ। একটু দ্বিধা নিয়ে সেই উত্তর দেয়।
‘লাকড়ি টোয়াইতে।’
চারদিকে তাকাই। নিঝুম দ্বীপের পশ্চিমে সাগর পারের বিস্তীর্ণ এই বেলাভূমিতে শুধু ধুধু বালি। লাকড়ি কোথায় যে সংগ্রহ করবে?
মেয়েটি হয়তো আমার মনের কথাটি ধরতে পারে। তার ছোট হাতটির আন্দোলন অনুসরণ করে দূরে পানির দিকে তাকাই। ভাটার এই সময়ে পানি দূরে সরে গেছে। ফেলে গেছে গাছের মরা ছোট ডাল। কাদা-বালিতে দেখা যায় কি যায়না। শীতের এই ভোরে সেগুলো সংগ্রহে যাচ্ছে শিশুদের দলটি।
‘কি নাম তোমার? বাড়ি কোথায়?’
‘বিবি মরিয়ম।’
দূরে পূবদিকের বাড়িটি দেখায়।
আরও কিছু কথা হয় বিবি মরিয়মের সাথে। ওরা চার ভাইবোন। পাঁচ বছরের ছেলেটি পাশের বাড়ির। সবার ছোট বোনটির বয়স চারের বেশী হবেনা।
মাঘের এ সময়ে খুব ঠাণ্ডা পড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে তাপমাত্রা এখন বসন্তকালের মত। সবার পরনে জামা থাকলেও খালি পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত অনাবৃত। ছবি তোলার কথা বলতেই ওরা জড়সড়। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ায় ওরা। বিবি মরিয়মের শরীর জুড়ে পেঁচানো চাদর। তড়িৎ তা খুলে সে মাথা ঢাকে।
‘সবাই হাস।’
ছবি তোলার সময় যে হাসতে হয়, তা তাদের জানা। ছবি তোলা হয়।
একটু পেছনে গোটা দশেক খেজুর গাছের বাগান ফেলে এসেছি। নিঝুম দ্বীপের খেজুর গাছের কাণ্ড বলিষ্ঠ। খুবই বাড়ন্ত। সংখ্যায়ও অনেক। শীতের এই ভোরে সবগুলো গাছে প্লাস্টিকের বোতল ঝোলানো আছে। সারা রাতের সংগ্রহে বোতলগুলো রসে প্রায় ভরে গেছে।
‘পেছনের ঐ খেজুর বাগান কি তোমাদের?’
‘আংগো ন, চৌধুরীগো। হেতাগো বহুত জমিন।’
মরিয়মের এ জবাবে বোঝা গেল চৌধুরীরা ধনবান। এদের কথা পরে আবার আসবে।
‘তোমাদের খেজুর গাছ নেই?’
‘বাইত আছে।’
একটু আগে ফেলে আসা বাগানের ছোট খেজুর গাছটিতে হাতের নাগালে ঝোলানো বোতল নামিয়ে আমি যে একটু রস খেয়েছি, তা জানাই ওদের। এক অর্থে তা তো চুরিই। আমার এ কথা শুনে ওরা যে মজা পেয়েছে, তা বোঝা গেল ওদের হাসি দেখে। অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে শিশুরা। এদের তিনজন ব্রাকের স্কুলে যায়। বিবি মরিয়ম পড়ে ক্লাস থ্রিতে। আজ শুক্রবার বলে স্কুল নেই।
নিঝুম দ্বীপের খেজুরের গুঁড়ের কথা এসেই শুনেছি। চিনির দাম কম বলে খেজুরের গুঁড়ে চিনি মেশানো হয়। বিশুদ্ধ গুঁড় এখন আর পাওয়া যায় না। এ দ্বীপের খেজুরের গুঁড়ে কোন ভেজাল নেই। তাই খেয়ে দেখার ইচ্ছা ছিল।
‘তোমরা রস জ্বাল দিয়ে গুঁড় বানাও না?’
‘বানাই ত।’
‘ঘরে কি গুঁড় আছে?’
মরিয়ম জানালো, গতকাল বাজারে বিক্রির পর অল্প কিছু আছে।
‘তোমাদের বাড়ি গেলে একটু কি খাওয়াবে?’
সানন্দে সম্মতি জানায় ওরা। আমরা বাড়ির দিকে হাঁটছি।
‘অ্যাঁর মা বিষ খাই মরি গেছে।’
হটাৎ মরিয়মের এ কথায় চমকে যাই।
আরও বিস্ময়ের কথা বলে মরিয়ম।
‘অ্যাঁর নানিগো বাড়িত তুন মামলা দিছিল। নানী কয় হেতেনে নিজে বিষ খায় ন। অ্যাঁর বাপে মারে মারি হালাইছে। পুলিশ অ্যাঁই অ্যাঁর বাপ, দাদা-দাদী, চাচা – বেগগুনরে বান্দি লই গেছে।’
এক বছর আগে ঘটে যাওয়া মায়ের মৃত্যুকাহিনী বিবি মরিয়ম জানায় একটু তড়বড় করে।
‘তো তোমার বাবা তোমার মাকে কেন মারলো?’
‘বাবা ত মারে ন। অ্যাঁর নানী মিছা কথা কইছে। হেতি হেই সম আংগো বাড়িত আছিল। মায় বলে তারে কইছে, অ্যাঁর কেমুন যেন লাগে। ফরে বেউশ অই মা মরি গেছ।’
‘তা হলে তো নানী ঠিকই বলেছে। হয়তো তোমার বাবাই বিষ দিয়েছিল খাবারে। আচ্ছা, বলত কেন তোমার মা বিষ খাবে?’
‘আংগো বাইর ধারে চৌধুরীগো বাই। হেতাগো ছাগল আই আংগো তই-তরকারী খাই হালায়। ইয়ার লাই মায়ে গাইলমন্দ কইচ্ছিল। হেঁই বাইততুন বেডা অগল অ্যাঁই অ্যাঁর মারে মাইরধর কইচ্ছে। হেই শরমে মা বিষ খাইল।’
‘তুমি কি বিষ খেতে দেখেছো।’
‘অ্যাঁই দেই ন। ইশকুলে আছিলাম। তয় হরে হুইনছি।’
‘তোমার বাবা কি আবার বিয়ে করেছে?’
‘না করি কি কইরবো। অ্যাঁর এই বইন কত ছোড। কে দেইখবো। মা মইরবার তিন মাস হরে বাবা বিয়া কইচ্ছে। অ্যাঁর এই মার আগে বিয়া হইছিল। হেতেনের জামাই ছাড়ি দেয়। হরে বাবার লগে বিয়া বইছে।’
‘তুমি না বললে, তোমার নানীরা মামলা দিয়েছিল, পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাবাকে।’
‘মা মইরবার পাঁচ মাস পর পুলিশ অ্যাঁই বেকগুণরে ধরি লই গেল। হরে বাবারে রাই বাকি হগলরে ছাড়ি দেয়। হাত মাস বাবা হাজতে আছিল। জামিন লই বাইর হইছে।’
বিবি মরিয়মের এ বর্ণনা যখন শেষ হয়, তখন আমরা তাদের বাড়িতে চলে এসেছি। ছোট পুকুর, একটি টিনের ঘর, খেজুরের ডাল ও নাড়া দিয়ে ছাওয়া রান্নাঘর, কবুতরের খোপ ও বড় খড়ের গাঁদা নিয়ে মরিয়মদের বাড়ি। ছোট্ট উঠানে রস জ্বাল দেবার জন্য বড় চুলা। টিনের খোলা অগভীর পাত্রে রস জ্বাল হচ্ছিল। তার বাষ্প চুলার পাশে বসা বিশ বাইশ বছরের যুবকের চেহারা প্রায় ঢেকে ফেলেছে। মরিয়ম জানায় সে তার চাচা।
চুলার পাশে একটি মোড়ায় বসেছি। পাকঘর থেকে মরিয়ম একটি গ্লাস ও বোতলভরা খেজুরের গাঁঢ় রাব নিয়ে এসেছে। ভাবলাম হাতের তালুতে নিয়ে অল্প একটু খাই। আমার ডায়বেটিস আছে। তার উপর কিছুক্ষণ আগে গাছ থেকে বোতল নামিয়ে রস একটু খেয়েছি। মরিয়ম বলল গ্লাসে ঢেলে খেতে। তাই গ্লাসে ঘন সিরাপের মত রাব ঢালি। ডাকবাংলো থেকে বেরুবার সময় লেক্সাস বিস্কিটের দু’টো ছোট প্যাকেট নিয়েছিলাম। মরিয়ম ও তার ভাইবোনদের এক প্যাকেট দেই। গ্লাসের গাঁঢ় লাল রঙের রাবে ডুবিয়ে বিস্কিট খেতে লাগলো অপূর্ব। টিউবওয়েলের পানি এনে দিল মরিয়ম। চারদিকে সাগরের নোনা পানি। তারপরও দ্বীপের এই টিউবওয়েলের পানি সুপেয়, সুস্বাদু।
মরিয়মের যুবক চাচার সাথে কথা হয়। তার ভাবীর বিষ খেয়ে মৃত্যু, ভাইয়ের কারাবাস – এসব নিয়ে নানা কথা।
‘হনেরো লাক ট্যাঁয়া লাইগসে হেতেনেরে জেলেত তুন বাইর কইত্তে।’
‘এতো অনেক টাকা। কোথায় পেলে এত টাকা? কাদের দিতে হলো?’
‘এরশাদের সম জমিনের বন্দোবস্ত হাইছিল মিয়াঁবাই। হেই জমিন বেচি ট্যাঁয়া খরচ কইচ্ছি। কিছু নিছে বাদীপক্ষ, বাঁই ট্যাঁয়া খাইছে পুলিশ আর উকিল-মোক্তাররা।’
যুবকের কথায়, অবয়বে শুধুই বিষাদ ও হতাশা। জানালো দিনকয় পর মরা কাঁটাল শেষ হোলে সে যাবে গভীর সাগরে। একটি জেলে দলের সাথে। সাগরে মরা কাঁটাল ও ভরা কাঁটালের কথা এই দ্বীপে এসে প্রথম শুনেছি। চান্দ্রমাসের সাথে তার সম্পর্ক। কৃষ্ণ পক্ষে মরা কাঁটাল। তখন সাগর শান্ত, স্রোত কম। শুক্লপক্ষে তার উল্টো। সাগর হয় উত্তাল, স্রোত তীব্র। তখন ভরা কাঁটাল। মরা ও ভরা কাঁটালের হিসেব জানে জেলেরা। ভরা কাঁটালে স্রোত বাড়বে। জালে আসবে চেউয়্যা, পোয়া, লইট্টার ঝাঁক। হয়ত সেই স্বপ্ন তাকে এখনও দোলা দেয়।
‘জমি বিক্রির কথা বলছিলে। কে কিনল সে জমি?’
‘চৌধুরী বাড়ির হেরা কিনি নিল হানির দরে।’
চকিতে মনে পড়ল মরিয়মের কথা। ও বাড়ির ছাগল এসে বাড়ির বাগানের গাছ খেয়ে ফেলার সূত্র ধরেই তো তার মায়ের কথিত বিষ খাওয়া, বাবার কারাবাস, জমি বিক্রি, নতুন মায়ের ঘরে আসা। এক জটিল জালে আবর্তিত নিঝুম দ্বীপের সাগর পাড়ের নির্জন এই গ্রামের বিপন্ন মানুষেরা।
এবার আমি উঠব। বিবি মরিয়ম ও তার ভাইবোনেরা আমাকে এগিয়ে দিতে এল। লাকড়ি কুড়াবার কাজটিও তাদের সারতে হবে। এই ফাঁকে বিবি মরিয়মের সাথে আরও কিছু কথা বলি।
‘নতুন মা কি তোমাদের আদর করে? খেতে দেয়?’
আমার এ প্রশ্নে একটু কি থমকে গিয়েছিল মরিয়ম? তবে দ্রুত আনমনা ভাবটি ঝেড়ে ফেলে সে। জানায়, নতুন মা মারধর করেনা, খাবারও দেয়। নতুন একটি কথাও জানায় মরিয়ম।
‘অ্যাঁর মারে বিয়া করনের আগে বাবা আরও তিনডা বিয়া কইচ্ছিল। হেতেনরা ব্যাকে মরি গেছে। হের হরে বাপে অ্যাঁর মারে বিয়া করে।’
কি বোঝাতে চায় ছোট্ট এই বালিকা? ওরা কিভাবে মারা গেল, সে কথা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থমকে যাই। নতুন আর কোন প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে করতে ইচ্ছে হয় না।