তার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এক সমুদ্র সৈকতে । পারকি চর সি বীচ,চট্টগ্রামে। আমি তখন ক্লাস সেভেন শেষ করলাম, এইটে উঠবো। একটা বনভোজন অনুষ্ঠানে অতিথি আমি। কারন, বেড়াতে এসেছিলাম আমার খালাতো বোন নাজু আপু আর দুলাভাইয়ের বাসায়। এখানে আসার সুযোগ পেলাম তাদের মাধ্যমে।
আমার জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শন। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের ডাক হৃদয়ে প্রবল অনুভূতির সৃষ্টি করছিল। একটা অচেনা ভালো লাগার সিক্ত অনুরাগও সেদিন আমার হৃদয় ভিজিয়ে দিয়েছিল।
আসার পথে বাসে আমি তাকে প্রথম দেখি। একটু পর পর শুধু হাসছিল, নির্মল সে হাসি। আমি দেখছিলাম তাকে, মনে কোন অনুভূতি ছিলনা তখন, স্রেফ দেখা। কিন্তু কৈশোর মন, উৎসাহী হতে কতক্ষন। দু একটা হলেও কথা বলব তার সাথে, মনে মনে আশা করলাম।
একটা মিষ্টি ভাগ্নি আছে আমার, ওয়ালিসা। সমুদ্রের অপার সুন্দরে বিমুগ্ধ হয়ে সে ও ছয় বছর বয়সের গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছিল ঢেউয়ের দিকে, হঠাৎ চোখের আড়াল। আমি সন্তর্পণে পা বাড়ালাম তীরে। দেখলাম ওয়ালিসা নিরাপদেই আছে। হঠাৎ তাকে দেখলাম, সমুদ্র জলে পা ভেজাচ্ছে সে। আমি হঠাৎ একটু উদ্বিগ্ন ভাব করে তাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
-ওয়ালিসাকে দেখছ ?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই এদিক ওদিক তাকাল, দেখিয়ে দিল। আমি মনে মনে হাসছি
সে সামনে যেতে লাগলো,হঠাৎ ঘুরে এসে,
-আপনি ওয়ালিসার মামা ? কিসে পড়েন আপনি ?
-আমি ক্লাস এইটে পড়ি।
-ঢাকায় থাকেন ?
-জি
সে থাকে চট্টগ্রামেই।
এরকম খন্ড খন্ড কথোপকথন শুরু,আর একটা মিষ্টি হাসি। আমি জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেছিলাম,
-তুমি কিসে পড় ?
-আমি? আমি তো আপনার চেয়েও বড়। ক্লাস টেনে পড়ি, এইতো এবার ই SSC দিব।
আমি ছোটবেলা থেকেই বেয়াড়া । ছোটবড় সব্বাইকে তুমি করেই বলতাম। বড় জানার পরও ওকে তুমি করেই বলছিলাম । জায়গাটা একটু ঘুরে দেখা, ওর সাথে একটু কথা, আর ওর মিষ্টি হাসি, একটা মায়া। ঘড়ির কাঁটা সেদিন যেন একটু দ্রুতই ঘুরছিল।
আজকাল বনভোজনে বিনোদনের অংশ হিসেবে শেষবেলায় লটারি রেফল ড্র থাকেই। লটারির টীকেট আমিও কিনেছিলাম। পুরস্কার ঘোষণাকারীর ভাষ্যমতে, ১ম প্রাইজ ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা এয়ার টিকেট, আর দুজনের পাঁচতারা হোটেলে থাকাখাওয়া (আসলে পুরাটাই চাপা ছিল, FUN করার জন্য বলছিল)। যাই হোক বিধাতা সেদিনটা হয়ত আমার জন্য রেখেছিল। ১ম পুরস্কারটা আমিই জিতলাম । ঊপহারটা খুলে দেখার আগেই সে প্রশ্ন করে, “তুমি কি সত্যিই ব্যাংকক যাচ্ছ ?”
বাসায় ফেরার পালা । বাসে আমার সীট ছিল ওর এক সীট পিছে, কোনাকুনি বারবার সামনের সিটের পেছনের অংশে মাথাটা ঢেলান দিয়ে সে দেখছিল আমায়। আমিও দেখছিলাম তাকে, তার হাসিমুখ।
আপুরা তিন তলায় থাকত, ওরা দোতলায়। বাসায় আসার পর থেকেই খুব বোর ফিল করছিলাম । তখন আপুই সুযোগ করে দিল,ওদের সাথে নিচে ব্যাডমিন্টন খেলার। ওরা তিন বোন ছিল,ও বড় আর পরেরটা পীঠেপিঠী বয়সী । দুজনের সাথে খেলা হতো, খেলার চেয়েও কথা হতো অনেক বেশি। এমনকি আপুর বাসার ড্রয়িং রুম থেকে ওদের কমন রুমে জানালা টূ জানালা ও আমি কথা বলতাম।
বিদায়ের দিন এসে গেল। আমাদের কারোই Personal Mobile ছিলনা,তাই যোগাযোগ করার কোন সুযোগ ছিলনা। ভেবেছিলাম এখানেই শেষ। যাওয়ার দিন যখন নিচে নামছি, তাকে শেষবারের মত দেখলাম,কাধে একটা ব্যাগ ঝোলা। একটা কথা এখনও মনে আছে, “কোচিং ফাঁকি দিয়ে চলে আসলাম”। কেন এসেছিল তা জানা হয়নি।
চট্টগ্রাম থেকে আসলাম আমার খালার বাসায়, মনের অবস্থা খারাপ। খুব একা লাগছিল নিজেকে । সেদিন হঠাৎ নাজু আপু খালার কাছে ফোন করেছিল। আমার সাথেও কথা বলল। আমি আপুকে বললাম ওদের বাসার CONTACT NO. টা দিতে। আপুর ঝাড়ি খেয়ে আমার হৃদয়টা শুকিয়ে গেল, মনটা আরও উদাস হয়ে গেল।
সেদিন রাত নয়টার মতো বাজে। আমার খালাতো বোন আমাকে তার মোবাইলটা ধরিয়ে দিলো, কণ্ঠটা শুনেই আমার হৃদয় আনন্দে সিক্ত হয়ে গেল। ওর মার মোবাইল দিয়ে ফোন করেছিল, নাজু আপুই বলেছিল।
ঢাকায় যাওয়ার আগে আর কথা হয়নি। ঢাকায় এসে প্রথম ওকে ফোন করি দোকান থেকে , একটু CONFUSED ছিলাম, ও কথা বলবে নাকি। নির্ঝর সেই হাসিমাখা মুখের একটা কথা আজো কানে বাজে,”কে রাজিব? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ভুলেই গেছেন”
একটা গ্রামীণফোন সিম ছিল আমার। কখনও আব্বুর মোবাইল,কখনও কাজিন বা কখনও কোন বন্ধুর মোবাইল ধার নিয়ে কথা বলতাম ওর সাথে। প্রতিদিন বিকেলে একবার, ১০-১৫ মিনিট। আমি তখন গভঃ ল্যাবে পড়ি, বাসা অনেক দূর, মুগদাপাড়া। স্কুলের JOURNEY শেষে ওর কণ্ঠটা শুনতেই সব ক্লান্তি ভূলে যেতাম
একদিন কথা না হলেও অনেক কষ্ট পেত সে। প্রতিদিন কথা শেষ হবার আগে, “কাল কিন্তু অবশ্যই ফোন করবা”
একটি দিনের কথা এখনও মনে পড়ে, ও কাঁদছিল। আমার কল রিসিভ করার পর একটু থামল। আমকে বলে,“এতক্ষণ কাঁদছিলাম আর এখন তোমার ফোন পেয়ে হাসছি” ছোট ছোট কথাগুলো অনুভূতিতে পূর্ণ ছিল। কথার সাথে ছিল ওর কিছু এসএমএস, আমার কাছে এসব তখন খুব নতুন, ভাবতেই পারছিলাম না এটা কি ? বন্ধুত্ব বলব ? নাকি তাতে আরও কিছু মিশে আছে ? আমরা দুজনই আমাদের ব্যবধান জানতাম, কিন্তু মানতে পারতাম না… একটা ভালো বন্ধুত্ব, এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার সুযোগ নেই, তবুও মাঝে মাঝে তাকে প্রভাবিত করতাম স্রেফ মজা করার জন্য, একদিন সে অসহায়ের মতো বলে ফেলে, “আমাদের FAMILY কি এটা মানবে ?”
ওর SSC পরীক্ষা চলে আসছিলো, তাই আমি প্রায় ১ মাস ওকে ফোন করিনি। এরপর আবার ও কথা শুরু। ততদিনে একটা মোবাইল ও হল আমার।
RESULT দিলো ওর,গোল্ডেন এ+… ওর কলেজ লাঈফ শুরু হল, যোগাযোগটা কমে যাচ্ছিল হঠাৎ। কলেজে অনেক নতুন বন্ধু হল ওর।
প্রতিদিন থেকে সপ্তাহে দু একদিন, একদিন। এভাবে ব্যস্ততা আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে লাগলো……শুনলাম ও নাকি একটা মোবাইল কিনেছে নতুন, নাম্বার টা চাইলে দিতে আপত্তি জানায় সে, বুঝলাম আমাকে avoid করার চেষ্টা করছে সে। আমিও হারিয়ে যেতে শুরু করলাম…
খুব একা লাগলে ওকে ফোন করতাম, ওর আম্মুর নাম্বারেই, উনি জানত আমি ওকে ফোন করি, ও থাকলে ফোনটা দিত। আগের মত ওর Response পেতাম না…বুকে একটা অসহ্য যন্ত্রণা লাগত…
অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, আমরা যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে গেলাম,মনে রাখার কোন সুযোগ পাইনি, তবে আজ ও সে একটা দিনের কথা স্মরণ রাখে। ৭ই জানুয়ারি,আমার জন্মদিন। এ বছরও রাত ১২ টার আগে তার Birthday Wish টা মোবাইলে চলে এসেছিলো। উল্লেখ্য, ১০ই জানুয়ারি তার জন্মদিন।
আমি এখন HSC পরীক্ষার্থী। ঊনি এখন আমার ফেবু ফ্রেন্ড, পাঠক বন্ধুগন অবাক হবেন না। আমরা সবাই বদলে যাই, আমিও বদলেছি, তুমি এখন তিনি হয়ে গেছেন। ওনার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবেন, এখন সোহরাওয়ারদি মেডিক্যালে পড়ছেন, ফেবুর কল্যাণে এসব জানা । আরও জানলাম তিনি in a relationship with…নামটা ও দেয়া..
আর আমি হয়ে গেছি নীল আকাশের মত একা, কখন ও রবি, কখনও চন্দ্র, মেঘের ভিড় বা তারার মেলা, বুকে এসে স্থান নেয়, আবার সময়ের স্রোতে প্রকৃতির নিয়মে চলে যায়, চলে যেতে হয়, বুক শূন্য করে…।
ওনার নামটা বলতে পারছিনা ভয়ে, হয়ত উনি এই পেজের ফ্যান হতেও পারে
আমার কৈশোর মনের অনুভূতির জগতে উনি যতটা স্থান করে নিয়েছিল,হয়ত আমি তার হৃদয়ের এতটা গভীরে যেতে পারিনি, ওনার প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই, শুধু কিছু প্রশ্ন জাগে মনে, যার উত্তর খুঁজে পাইনা আমি, আমাদের ভিতর কি কোন ভালবাসা ছিল ? নাকি বন্ধুত্ব ? নাকি স্রেফ সময়টা উপভোগ ?
এটা বানানো গল্প নয়,পুরোটাই সত্য। যারা এতক্ষণ কষ্ট করে পড়লেন ,আপনারা কি এতে আদৌ কোন ভালোবাসার গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন ? যদি পেয়ে থাকেন তাহলে আমার এই লেখা ও শিরোনাম সার্থক।। ভালো না লাগলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি …