গল্পটা আষাঢ়ে হলেও ঘটনাটা আষাঢ় মাসের নয়। ঘটেছিল জোষ্ঠি মাসে। যশোরের নাভারন, ঝিকরগাছা ইত্যাদি পেরিয়ে গদখালীর মাঠ—একটা ছোট স্টেশন। ট্রেন দাঁড়ায় কি দাঁড়ায় না। সকালে-বিকেলে দু-চারজন মানুষকে উঠতে-নামতে দেখা গেলেও দুপুরে প্রায়ই অকারণে ট্রেন ক্যাঁচ শব্দে দাঁড়ায়; তারপর ক্যাঁচকোচ শব্দে লোহায় লোহায় ঘষাঘষির আওয়াজ করতে করতে ছাড়ে। ট্রেন চলে গেলে স্টেশনের ভাঙা-ফাটা ইটের ঘরটা নির্জনে ভূতের মতো রোদে ঝলসাতে থাকে, বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। ঘরের দরজাও নেই, জানালাও নেই। শিয়াল-কুকুরও বোধ হয় ওদিকটাতে যায় না। যশুরে খরিশ গোখরোগুলো দরজা দিয়ে ঢোকে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। নির্জনতার প্রহার বোধ হয় কামানের গোলার চেয়ে ভয়ংকর। মানুষ সাবধান হয়ে যায়—কখনো ওদিকে যেতে চায় না। এই স্টেশনটাকে যেন যমও পরিত্যাগ করেছে।
এখানে যারা নামে বা ওঠে, তারা থাকে কোথায়? ঘরবাড়ি কোন দিকে? তারা কিছুতেই কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে চায় না। নেমেই যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। ট্রেনে যারা ওঠে তাদের কে আর জিজ্ঞেস করবে? পেছন দিকে, পুবে ঝোপজঙ্গল রয়েছে—বড় শিরীষগাছ, দু-তিন শ বছরের পুরোনো কড়ইগাছ, মেহগনিগাছ ইত্যাদি আছে। ঘন ছায়ার মধ্যে পায়ে চলার পথ রয়েছে দু-একটা। বিশ্বাস হয় এদিকে অনেকটা গেলে লোকবসতি থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু পশ্চিম দিকে রেললাইনটা পার হলে যে মাঠটা দেখা যায় সেটা কত বড় কিছুতেই আন্দাজ করা চলে না—একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে; এই মাঠ-রোদের মধ্যে সেদিকে চেয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত কিছুই দেখা যাবে না। সেদিকটা না দেখাই ভালো। শুধু দিগন্তের বাঁ-দিকের কোনটাতে একটা উঁচু-নিচু কালো রেখা; দিগন্তের একটুখানি দূরে এই রেখাটি আসলে একটা গ্রাম। এত দূর থেকে বুঝবার উপায় নেই গাঁটি ছোট না বড়।
এই যে একটু আগে ট্রেনের কথা বলছিলাম, সেটা থেকে ফিটফাট বাবুটি সেজে কিঙ্করবাবু নামলেন। পরনে ফিনফিনে একটা চওড়াপাড় শান্তিপুরের ধুতি, পায়ে চকচকে পামসু, তাতে এমন পালিশ যে মুখ দেখা যায়। রোদে যখন ঝলকাচ্ছে সেখানে চোখ রাখাও যায় না। পঁচাত্তর বছর আগের কথা বলছি। তো, কোলকেত্তাই বাবুদের পোশাক-আশাক একটু অন্য রকমই ছিল তখন। ধুতির সঙ্গে পাঞ্জাবি নয়, ধবধবে সাদা ফুলশার্ট। হাতায় বেশ দামি ডবলঘাট বোতাম। বুক পকেটের পেছনে লুকোনো ছোট পকেটে সোনার ঘড়ি, তার সোনার চেইন বুকে দুলছে। বুকের তিন-চারটে বোতামও সোনার। চশমাটা দরকার কি না কে জানে কিন্তু সোনার ফ্রেমের হালকা একটা চশমা তো থাকবেই। চুল দশ আনা ছ আনা স্টাইলে ছাঁটা। ধুতির কোঁচাটা শার্টের একদিকের পকেটে গোঁজা। হাতে একখানি ছাতা।
এই বাবুর নাম কিঙ্কর সিংহ। কিন্তু কেশর নেই। ট্রেন থেকে একাই নেমেছেন। গদখালীর মাঠ স্টেশনে আর কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। কিঙ্করবাবু কলকাতায় সওদাগরি অফিসে সামান্য একটা চাকরি করেন। মেসে আর দশজন কলকাতার চাকুরের সঙ্গে থাকেন। হেঁটো ধুতি পরে খালি গায়ে যখন থাকেন, তখন তাঁর খাঁচাখানি দেখে অবাক লাগে। এর ভেতর দিয়ে অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। খাঁচা খালি রেখে চিরকালের জন্য তাঁর তো চলে যাওয়ারই কথা। কিঙ্করবাবু পুঁটি মাছ নন, জল শুকিয়ে যাওয়া ডোবার কই মাছ।
অত কথায় কাজ নেই! নিজেকে ঢেকেঢুকে সকালে ভালো করে জীবনঘড়িতে দম দিয়ে তিনি এখন এই গদখালীতে। কারণ একটাই, বছর খানেক আগে তিনি বিয়ে করেছেন, চড়চড়ে শূন্য রোদজ্বলা ঘাসপোড়া মাঠটা পেরিয়ে দিগন্তের বাঁদিকে শূন্য-দীর্ঘশ্বাসের মতো যে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, ওই গাঁয়ে। কী করে ওই গাঁয়ে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল, কীভাবে সেখানে গিয়েছিলেন, বিয়ে করেছিলেন অগ্নিসাক্ষী রেখে সাত পাক ঘুরেছিলেন একটি মেয়ের সঙ্গে, সেসব এখন আর তাঁর মনে পড়ছে না। মাথার ঠিক তালুর ওপর সুয্যি ঘিলু ফাটাচ্ছে না পোড়াচ্ছে বলা সম্ভব নয়। রেললাইনটা পেরিয়ে ছাতা মাথায় মাঠের কিনারায় দাঁড়িয়ে ঘড়ি বের করে দেখতে লাগলেন কটা বেজেছে। বারোটা বেজেছে অনেক আগে। এখন দুপুর দুটো—সুয্যি ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। ঘড়ি দেখতে এত সময় লাগে, কিঙ্করবাবু ঘড়ি দেখছেন না সময় দেখছেন, তিনিই জানেন। মাঠ পেরোতে গিয়ে ছাতি ফেটে মারা পড়বেন না তো! এ সৌভাগ্যও তো তাঁর হবে না। এই গদখালীর মাঠ ছাতি ফাটার মাঠ হয়ে যাবে। আমাদের পায়ের নিচে সব জায়গায়, মাটির তলায় মরা মানুষেরা যে গিজগিজ করছে, তা কি আমাদের মনে থাকে?
আমাদের এই সব কথা লিখতে লিখতেই কিঙ্করবাবু মনস্থির করে ফেলেছেন মাঠ পেরিয়ে শ্বশুরবাড়ি তিনি যাবেনই। বউকে তাঁর একটুও মনে নেই। তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে পারুন আর না পারুন, একবার পরিচয়টা তো হওয়া দরকার। ধুতিটা আর একটু কষে পরলেন, কোঁচাটা পকেট থেকে বের করে কোমরে জড়ালেন। এই গদখালীর মাঠ জামাইবাবু হয়ে পার হওয়া যাবে না। মানুষের পায়ে চলা কোনো পথ দেখা গেল না। মাঠ ঘাসে ঢাকা, কিন্তু এত খুদে ঘাস কিঙ্করবাবু কখনো দেখেননি। তাদের রং ঠিক সবুজ নয়, লালচে কটা। ঘাসও এখানে মাটি থেকে খাবার পায় না, মানুষ তো দূরের কথা। জনশূন্য বলাই যথেষ্ট নয়, জ্যান্ত একটা পোকামাকড়ও নেই এখানে। গদখালীর মাঠ মৃতদের জগতের অংশ—এই মাঠের সামনে দাঁড়ালেই এ কথা মনে হতে বাধ্য। কিন্তু এই প্রথমবার কিঙ্করবাবু যাবেন শ্বশুরবাড়ি। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা তালগাছ। সেটাও জ্যান্ত নয়। বাজ পড়ে তার মাথা পুড়ে গেছে। কিঙ্করবাবু একবার ভাবলেন, ওখানে কি প্রায় শুকনো লম্বা লম্বা ঘাসে ভরা একটা পুকুরও আছে নাকি ফুটিফাটা পাথুরে কাদা? ওই তালগাছটিকে নিশানা করে কিঙ্করবাবু এগোলেন। খানিকটা এগিয়েই বুঝলেন দুনিয়ায় বোধ হয় এই তাঁর শেষ হাঁটা। ঘণ্টা খানেক পরে তিনি তালগাছটার গোড়ায় পৌঁছুলেন। দিগন্তের বাঁ কোণের গাঁটিকে এখন আর একটু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুকুরে সামান্য পানি রয়েছে। একেবারে তলায়, ওপরের দিকে শুকনো কাদায় মরা মাছ—পুঁটি, ট্যাংরা, ছোট ছোট টাকি মাছ। শামুকের খোল, পচা ঝিনুক বোধ হয় চেষ্টা করছিল অন্য পুকুরে যেতে—এর চেয়ে পানিতে থাকলে অন্তত বেঁচে থাকত। তালগাছ আর পুকুরটা ছেড়ে খানিকটা এগি্য়ে এসে কিঙ্করবাবু একবার চারদিকে চেয়ে দেখলেন। না, এটা মরা পৃথিবী, জ্যান্তদের কেউ এখানে নেই। কেন তাঁর শখ হলো শ্বশুরবাড়ি আসার। গদখালীর মাঠ হঠাৎ ছোট হয়ে এসে তাঁকে চারপাশ থেকে চেপে ধরল—কোথায় যাবি? ফিরতে তো পারবি না।
কুহকি মায়ায় একটার পর একটা দেয়াল উঠছে তাঁকে ঘিরে। কোথায় পালাবি? কিঙ্করবাবু কিন্তু একবারও দাঁড়িয়ে পড়েননি। ক্রমাগত হাঁটছেনও, দেয়ালও উঠছে একটার পর একটা। যাচ্ছেনও, এক জাগায় দাঁড়িয়েও আছেন। ওই যে সূর্যটা একটু হেলে ছিল, ঠিক তেমনিই আছে। খবরের কাগজে এ রকম পড়েছেন কিঙ্করবাবু—বসন্ত কিংবা কলেরায় গোটা গ্রাম শূন্য হয়ে গেছে। একটা মানুষও বেঁচে নেই। অথচ গ্রাম যেন ছবির মতো সাজানো। বড় বড় দিঘি, তিরিশ সের ওজনের রুই-কাতলা ঘাই দিয়ে দিয়ে উঠছে। বেলগাছের সব পাতা ঝরে গিয়েছে কিন্তু বেলে-ভরা ডালপালা। পথ দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র এই পথ দিয়ে কেউ হেঁটে গিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে রান্নাবান্না চলছে। কচি শিশু কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদছে। গাঁয়ের সব রকম শব্দই আছে অথচ সব নিঝুম। মরা কিন্তু জ্যান্ত একটা গ্রাম, মাঠের মধ্যে প্রচণ্ড রোদে যেমন বারবার ধাঁধা লাগছিল—পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অথচ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিঙ্করবাবু একবার নিজের দিকে চেয়ে দেখলেন, এই যে তিনি রয়েছেন, কিন্তু কই, তিনি তো নেই।
একটার পর একটা দেয়াল উঠছে তাঁর সামনে, তিনি হেঁটেই যাচ্ছেন। ঠিকই বুঝতে পারছেন আর ফেরা হবে না। মেসে বসে আপন মনে আর দাদ চুলকোতে পারবেন না; টুলে বসে নাকে-কানে-নাভিতে সরষের তেল সারা গায়ে মেখে তোলা জলে স্নান করতেও পারবেন না; ঠাকুর, আজ যে আলুপোস্ত করবেন আগে বলেননি কেন, আজ তো ভাতে টান পড়বে; খাওয়ার পর আয়েশ করে একটা বিড়ি ধরাবেন, তাও আর সম্ভব নয়। এখন শুধু আছে—নেই দেয়াল পার হতে হতে হাঠাৎ তাঁর মাথা পরিষ্কার হয়ে এল। দিগন্তের বাঁ-দিকের কোণের গ্রামটিতে ঢুকে পড়লেন। ঢোকার মুখেই একটা বিরাট বটগাছ। তারপর আর গাছপালা তেমন নেই। খোলা চওড়া ধুলোভরা রাস্তার দুপাশে বাড়ির পর বাড়ি। রাস্তার লোকজন নেই। এই দারুণ রোদে সব পরিবারেরই দেউড়ির দরজা বন্ধ। বাইরে বেরোয়নি কেউ। কিন্তু যে কোনো গাঁয়ে ঢুকলেই গ্রামের একটা নিশ্বাস পাওয়া যায়। এখানে কোনো নিশ্বাসই পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া এতক্ষণ পর্যন্ত একটা মানুষও পাওয়া গেল না, যাকে জিজ্ঞাসা করা যায় ভবানী মুখজ্জের বাড়িটা কোথায়। সূর্য আকাশের ঢাল বেয়ে কেবল নামতে শুরু করেছিল, এখন তো সড়সড় করে নেমে যাচ্ছে। রাস্তাও তো দেখি শেষ হচ্ছে না। এই সময় কিঙ্করবাবু দেখলেন, একটা বৈঠকখানার বাইরের দিকের বারান্দায় কচি-কলাপাতার ওপর একজন মানুষ শুয়ে আছে। গুটিবসন্তে তার সর্ব অঙ্গ ভরা। মাংস খুলে খুলে পড়ছে। চারপাশে মাছি ভনভন করছে। মরেনি কিন্তু লোকটা। কেন মরেনি কিঙ্করবাবু বুঝতে পারলেন না। এরপরই তিনি দেখলেন বিরাট একটা ধানের বস্তা মাথায় নিয়ে একজন আসছে। সে সামনে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন, মুখজ্জেবাড়িটা কোন দিকে। লোকটা কোনো কথা না বলে আঙুল তুলে কোন দিকে যে বোঝাল কিঙ্করবাবু তা ধরতে পারলেন না। লোকটা পার হয়ে গেলে তিনি ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, ধানের বস্তাটা ঠিক রাস্তা ধরে যাচ্ছে কিন্তু লোকটা নেই। কিঙ্করবাবু বুঝলেন, তাহলে তাঁর এই শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ের মানুষজন কলেরা কিংবা বসন্তে মারা পড়েছে। যে লোকটা বাড়ির বৈঠকখানার রাস্তার দিকের বারান্দায় গলে-পচে গিয়েছে, সে-ও নিশ্চয় মারাই গেছে। মড়ারা বোধ হয় এভাবেই জ্যান্তদের সঙ্গে মশকরা করে।
বোধ হয় তিনি মুখজ্জেবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন। দেখলেন, শণের মতো সাদা দাড়িওয়ালা এক খুনখুনে বুড়ো ঢ্যাঁড়ায় শণের দড়ি পাকাচ্ছে। মুখজ্জেবাড়ি কোনটা জিজ্ঞেস করতেই সে লোকটা রাস্তার ডান পাশের তিনটে বাড়ির পরের বাড়িটা দেখিয়ে দিল।
ভবানী মুখজ্জের বাড়ির সামনে এসে কিঙ্করবাবু দেখলেন, দেউড়ির দরজা হাট করে খোলা। মনে হলো কেউ নেই বাড়িতে। আর থাকবেই বা কে? শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক আগেই ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। তাঁদের দুই ছেলে দুই মেয়ে ছিল। এক মেয়ে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে। অন্য মেয়েটিই কিঙ্করবাবুর স্ত্রী। সে তো শ্বশুরবাড়ির মুখই দেখেনি। ছেলে দুটোর বিয়ে হয়েছে কি তাদের বউ মরেছে—কিঙ্করবাবু কোনো খবর রাখেন না। তবে ভাই দুটি এখন বাড়িতে থাকবে, এটা আশা করা যায় না। বাড়িতে যদি কেউ থাকে তাহলে একমাত্র তাঁর স্ত্রীই আছে। কাজেই দু-একবার গলা খাঁকারে দিয়ে তিনি বাড়িতে ঢুকলেন। বিরাট শূন্য উঠান। জোষ্ঠি মাসের রান্না বোধ হয় উঠোনেই হয়। আর একটিমাত্র ঘর রয়েছে দক্ষিণ দিকে। পুরো বাড়িটা আবার মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কাউকেই না দেখে কিঙ্করবাবু ইতস্তত করতে লাগলেন—কী করবেন। স্ত্রীর নাম যদ্দুর মনে পড়ছে নলিনী। কিন্তু নলিনী নামে তাকে ডাকতে কিঙ্করবাবুর ঠিক ভরসা হলো না। তবে তখনই তিনি দেখতে পেলেন, ঘোমটা-টানা এক মেয়েমানুষ উঠোনের কোণে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি ওইখানেই ছিল, না কি আকাশ থেকে তখনই পড়ল! কিঙ্করবাবু হকচকিয়ে গেলেন। মেয়েমানুষটি তাঁর দিকে এগিয়ে এসে তাঁকে পার হয়ে ডান দিকের ঘরটিতে ঢুকল। কিঙ্করবাবু বুঝলেন, এইটাই তাঁর থাকার জায়গা হবে। তিনিও মেয়েটির পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকলেন। গিয়ে দেখলেন, এর মধ্যেই মেঝেতে শীতলপাটি পাতা হয়েছে। তিনি পামসু জোড়া খুলে ছাতাটি এক পাশে রেখে সেই শীতলপাটিতে বসলেন। মৃদু কণ্ঠে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো নলিনী, তাই তো? আমি তোমার স্বামী কিঙ্কর। আমাকে কি চিনতে পারছ? দরজার ঠিক গা ঘেঁষে একগলা ঘোমটা টেনে মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। অত বড় করে ঘোমটা দেওয়ার কী আছে? আমি তোমার স্বামী, বললাম তো কলকাতা থেকে এসেছি। জল আনো এক গ্লাস। ঘাড়টা একটু ঝুঁকিয়ে মেয়েটি বেরিয়ে গেল। তারপরেই উনি দেখলেন, ঝকঝকে করে মাজা একটা কাঁসার গ্লাসভর্তি জল তাঁর সামনেই রয়েছে। গেল কখন আর আনল কখন—কিঙ্করবাবু ভেবে পেলেন না। এই গাঁয়ে ঢোকার পর থেকে যে কয়জনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের কেউই তাঁর সঙ্গে কথা বলেনি। তিনি আবার বললেন, নলিনী, আমি তোমার স্বামী। ঘোমটাটা খোলো। অত লজ্জা কিসের? জবাবে ঘোমটাটা আরও একটু টেনে দিল মেয়েটা। ওইভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিঙ্করবাবু দেখতে পেলেন, জলভরা কাঁসার গ্লাসের পাশে একটা রেকাবিতে দুটি নারকেলনাড়ু রয়েছে। এটাই বা কোত্থেকে এল? তিনি আর দেরি না করে নারকেলনাড়ু দুটো খেয়ে ঢকঢক করে কাঁসার গ্লাস খালি করে ফেললেন। তাঁর স্ত্রী ততক্ষণে অদৃশ্য হয়েছে। তাকে আর কিছুতেই দেখতে পেলেন না। অগত্যা কিঙ্করবাবু ওই শীতলপাটিতেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু শুতে গিয়েই দেখলেন, লাল সুতোয় গোলাপ আঁকা একটা ওয়াড়ওয়ালা বালিশ তাঁর মাথার কাছেই রয়েছে। তিনি শ্রান্ত-ক্লান্ত, তাই মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না—এটা ভেবেই কিঙ্করবাবু শুয়ে পড়লেন।
তাঁর যখন ঘুম ভাঙল, তখন হয়তো রাত দশটার বেশি হয়নি; কিন্তু মনে হচ্ছে, রাত এখন দুপুর। খোলা দরজা দিয়ে চেয়ে দেখলেন, ঘোমটা টেনে নলিনী উঠোনের উনুনে রান্না চাপিয়েছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কিঙ্করবাবুর। সিংহ হলে কী হয়, তাঁর লেজ তখন ঝুলে পড়েছে। ভাবছেন কখন খেতে দেবে। সে সময় একবার জোর করেই ঘোমটা খোলাবেন। কত দিন পরে নতুন বউয়ের সঙ্গে দেখা—রাতটা নিরামিষ যেতে দেওয়া যায় না! কিঙ্করবাবু একদৃষ্টে বউয়ের রান্না দেখতে লাগলেন। ভাতটা টগবগ করে ফুটছে। ঢাকনাটা উঠছে-নামছে। ঢাকনা সরিয়ে লাকড়িতে কটা ভাত তুলে টিপে দেখছে বউ। মনে হলো সে সন্তুষ্ট হয়েছে। ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ফ্যানটা গলিয়ে নিল। তারপর ছ্যাঁছঁত শব্দ শুনে বোঝা গেল কিছু একটা ভাজা চলছে। ভাজার গন্ধ পেয়ে খিদেয় কিঙ্করবাবু চোখে অন্ধকার দেখছেন। ভাত নামিয়ে তরকারি বসাল বউ। এরপর ঘোমটার ভেতর দিয়েই সে দেখল, চুলোর মুখের সামনে একটু কাঠ-কুটোও নেই যে উনুনটা জ্বালিয়ে রাখবে। তখন বউটি যা করল, কিঙ্করবাবুর দুই চোখ তাতে কপালে উঠে গেল। নিজের ডান পাটা উনুনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল বউ। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল উনুন। গায়ে কাঁটা দিল কিঙ্করবাবুর। শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে উঠল। তারপর তিনি দেখলেন, তরকারি হয়ে গেল। ভাত থালায় বাড়া হলো। ছোট ছোট দুটো বাটিতে রাখা হলো তরকারি। ভাতের পাশে একটু লবণও রাখা হলো। তারপর বউ দেয়ালের দিকে হাত বাড়াল। কিঙ্করবাবু দেখলেন, বউয়ের ডান হাতটা ক্রমশ লম্বা থেকে লম্বা হচ্ছে—প্রাচীরের ওপারে গিয়ে পৌঁছুল হাত। বোঝা গেল সেখানে একটা লেবুগাছ আছে। হাত আরেকটু লম্বা করে বউ একটা লেবু ছিঁড়ে আনল। পরে ছোট হতে হতে যখন স্বাভাবিক হয়ে এল ওই হাত, তখন কিঙ্করবাবু ছাতা রেখে পামসু ফেলে কাছা লুটতে লুটতে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন, তিনি গদখালীর মাঠ পেরোতে পেরেছিলেন কি না জানা যায় না।