মাথার ভেজা চুল আঁচড়ে দিতে দিতে ঠাম্মা জানতে চান,
-আমি পূজার থালা-বাটি ধুয়ে আনতে আনতে ফুল তুলে এনে দিতে পারবি তো?
-হ্যাঁ ঠাম্মা, এখুনি যাচ্ছি। তোমার শেষ হবার আগেই আমি চলে আসব।
ঠাম্মা মাথার বা পাশে সুন্দর করে সিঁথি কেটে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে মিতি’র হাতে ফুলের সাজিটা ধরিয়ে দেন। মিতি আস্তে আস্তে মায়ের শোবার ঘরের পিছনের দিকে দরজার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসে। বেশ কয়ে ধাপের এই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেই হাতের ডানদিকে তুলসী’র বেদী, সেখানেই সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালান ঠাম্মা প্রতি সন্ধ্যায়। বেদীর আশে পাশে আরও অনেকগুলো তুলসী গাছ, প্রায় ছোটোখাটো একটি বন। সেখান থেকেই কিছু তুলসী পাতা তুলে নেয় মিতি। ঠাম্মার পূজোর জল শুদ্ধ করতে চন্দন আর কর্পূরের সাথে ফুল এবং তুলসী লাগবে জানা আছে মিতির। তুলসী বনের পাশ ঘেঁষেই বেড়ে উঠেছে নানা রঙের দোপাটি, এবার অঢেল ফুটেছে দোপাটি। মিতি ফুল তোলায় মন দেয়, ফুল তুলতে তুলতে বিড়বিড় করে রঙ গুলো বলে যায় আপন মনে,
-লাল দোপাটি, সাদা দোপাটি, বেগুনী দোপাটি, কমলা দোপাটি, …।
তারপর একটি ফুলের কাছে এসে হঠাৎ আটকে যায়, এই রঙের নাম জানা নেই। এটি বেগুনীর চেয়েও একটু ফিকে আবার ঘন গোলাপী চেয়েও আরেকটু গাঢ়। কি নাম এই রঙের…!
ও ঘাড় ঘুরিয়ে উঠোনের অন্য দিকে তাকায়, কলতলায় বসে শাক ধুচ্ছিলেন মিতির মা। মিতি ফুল তোলা বন্ধ করে মায়ের দিকে একবার তাকায়, মাকে জিজ্ঞেস করলে মা এখুনি বলে দেবেন। মিতি একটি ফুল হাতে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে বলে পা বাড়াতেই, চোখ আটকে গেল হালকা সবুজ পাখার গোলাপীর চেয়েও একটু গাঢ় রঙের একটি ঘাস ফড়িং এ। ঠিক নাম জানা সেই দোপাটির রঙের মতো। লাল দোপাটি গাছের সবুজ পাতায় এসে বসেছে সে। মিতি হাতের ফুল সাজিতে নামিয়ে রেখে ফড়িঙের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, কি অপূর্ব সুন্দর ফড়িঙটি। ফুল না তুলে বরং এটিকে ধরে নিয়ে মাকে নিয়ে দেখাতে পারলে…। মা কি বকে দেবেন? মিতি ঠিক বুঝতে পারে না। আচ্ছা, আগে ধরা তো যাক ফড়িঙটিকে আগে। তারপর নাহয়…।
উঁচু টিনের ঘেরাও দেয়া মিতিদের এই উঠোন একান্তই নিজস্ব; ভিতরে কি হচ্ছে কিছু বাইরে থেকে দেখবার উপায় নেই। দুই দিকে দুটি গেট। একটি পিছনের দিকে সরু পথে মিশে গেছে। সেখান দিয়ে হেঁটে গেলে আস্তে আস্তে ভাঙ্গা মন্দির, কচিকাঁচার আসরের পাশ দিয়ে অবশেষে পুকুর পাড়ে গিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। একটু আগেই মিতি সেই পুকুর থেকে স্নান শেষ করে ঠাম্মার সাথে বাড়ি ফিরেছে। সামনের গেট দিয়ে বেরুলে প্রথমেই চিলতে পথের দু’ধারে ছোট্ট সব্জীর ক্ষেত। মটরশুঁটি হয় সেখানে, অথবা লাল শাক। বাম দিকের ক্ষেতের শেষে কলা বাগান। ডান দিকে ক্ষেত শেষ হলেই ফুলের বাগান। সেখানে একটা বড় ম্যাগ্নোলিয়া গাছ। তার আশে-পাশে গাঁদা, ডালিয়া, কসমো, চন্দমল্লিকা আর দোপাটি। সেখানেই সাধারণত ঘাস ফড়িং ঘুরে বেড়ায়, নানা রঙের। নীলচে শরীর কালো পাখা, লাল শরীর সবুজ পাখা, কালো শরীর ছাই রঙ আর কালোয় মেশানো পাখা। মিতি আর ওর ভাই মিলে ফড়িঙের পিছু ধাওয়া করে বেড়ায়। ভাই মাঝে মাঝে ধরে ফেলে দু’য়েকটা ফড়িঙ, কিন্তু মিতি কিছুতেই দৌড়ে পারে না ওদের সাথে।
আজ দেখা যাক। পা টিপে টিপে ফড়িঙের দিকে এগুতে শুরু করে মিতি। হাতের নাগালে এলেই, ফড়িঙটা দোপাটির বন ছেড়ে উড়ে গিয়ে বসে টিনের বেড়া বেয়ে লতিয়ে ওঠা অপরাজিতার নীল ফুলে। উঠোনের সামনের গেটের ডান পাশ ঘেঁষে অজস্র ফুটেছে নীল অপরাজিতা। মিতি ফুলের সাজি হাতে অপরাজিতার দিকে এগুতে শুরু করে। আবারও উড়ে যায় সবুজ পাখার ঘাস ফড়িঙ, টিনের বেড়া পেরিয়ে উঠোনের অন্য পাশে। মায়ের দিকে আরেকবার তাকিয়ে দ্রুত হাতে গেট খুলে মিতিও উঠোন পেরোয়। আজ ফুলের সাজি প্রায় ভরে গিয়েছিল নানা রঙা দোপাটিতেই। আরও কিছু ফুল বেশি হলে ঠাম্মা রাগ করবেন না, হয়তো খুশী-ই হবেন।
ঘাস ফড়িঙ সামনের বাগানে বেগুনী ডালিয়ার উপর গিয়ে বসে। মিতি পিছন পিছন। ডালিয়া থেকে হলুদ গাঁদা, গাদা থেকে সাদা চন্দ্র মল্লিকা, চন্দ্র মল্লিকা থেকে গোলাপী কসমো…, ঘাস ফড়িঙ ক্রমাগত উড়ে উড়ে বেড়ায়। আর তার পিছে ঘুরে ঘুরে ফুল তুলে সাজিতে ভরে মিতি। ফড়িঙ টা ছুঁয়েও ঠিক ছুঁতে পারেনা ও, কাছাকাছি গেলেই উড়ে গিয়ে অন্য আরেকটি ফুলের গায়ে বসে। এই বাগানে আরও অনেক ঘাস ফড়িঙ, কিন্তু মিতি’র চোখ সেই বিশেষ রঙা ঘাসফড়িঙে-ই আটকে থাকে। ওর ফুল তোলা শেষ হয়েছে, সাজি উপচে পড়ছে ফুলে, তবুও মিতি থামতে ভুলে যায়। সবুজ পাখার নাম না জানা রঙের ঘাসফড়িঙ এবার উড়ে আবার দোপাটির গায়ে গিয়ে বসে। মিতি অবাক হয়ে দেখে, এই দোপাটি সেই নাম না জানা রঙের দোপাটি। ফুলে আর ফড়িঙে মিলে মিশে একাকার…। মিতি খুব সাবধানে আস্তে আস্তে হাত বাড়ায় ফড়িং এর সবুজ পাখার দিকে। সেই মাত্র ও ঘাস ফড়িঙ এর সবুজ পাখনা ছুঁয়ে দিয়েছে, অমনি ঠাম্মার গলা ভেসে আসে,
-এখনও তোর ফুল তোলা হলোনা বোন, আমি সেই কখন থেকে বসে আছি পূজো দেবো বলে…।
মিতি সামনের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়িয়ে দেয়া ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীতে কোমল একটা কিছুর স্পর্শ টের পায়। পেরেছে শেষ পর্যন্ত ভেবে এক ঝটকায় মাথা ঘুরিয়ে হাতের দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকায়, বেগুনীর চেয়ে ফিকে ঘন গোলাপীর চেয়ে আরকটু গাঢ় রঙা একটি দোপাটি ওর বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর মাঝে। সবুজ পাখার ঘাস ফড়িঙটা ততোক্ষণে উড়াল দিয়েছে বাগান ছেড়ে। মাঠ ছাড়িয়ে, রাস্তা পেরিয়ে কচুরী পানার ফুলে ভরা পুকুরটাই ওর গন্তব্য বুঝি।
-আসছি ঠাম্মা…।
মিতি বাম হাতে ফুলের সাজি আর ডান হাতের আঙ্গুলের মাঝে দোপাটি নিয়ে বাসার সামনের দরজার দিকে দৌড় লাগায়, ঠাম্মা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন ওর জন্য। ফুল গুলো দিয়েই আবার ফিরে আসবে ও, ঘাস ফড়িঙ টাকে খুঁজে বের করতে।
২.
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে মিতি। সামনের বাগানের ডান পাশে অজস্র ফুটেছে দোপাটি এবার। এখানে অনেক রঙের হয়না, কেবল একটাই রঙ। দেউড়ি পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোপাটির বনে নেমে আসতে আসতে এদিক-ওদিক তাকায় ও। টবে বেলীর গাছে বেলীও ফুটেছে এবার বেশ। বেলীর মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। পাশে কিছু অপরাজিতা, এখনও তাতে ফুল ফোটানো শুরু হয়নি। বামদিকে বেগুনি লিলি আর গোলাপি কসমো। মিতির উৎসুক দৃষ্টি সবুজ ডানার একটা ঘাস ফড়িং খুঁজে বেড়ায় ইতিউতি। তারপর হাত বাড়িয়ে দেয় দোপাটির ফুলের দিকে মিতি। ঠিক তক্ষুনি, সামনের দরজায় ছোট্ট একটি মুখ উঁকিঝুঁকি দেয়,
-তাড়াতাড়ি এসো, কই তুমি? আমরা অপেক্ষা করছি কখন থেকে।
-আসছি। এই তো এখানে। মিতি ডান হাতের বাড়ানো বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে একটি দোপাটি তুলে নেয়।
-এটা কি রঙ? বেগুনীর চেয়েও একটু ফিকে, ঘন গোলাপীর চেয়েও একটু গাঢ়। তোমার শাড়ীর সাথে একদম মিলে গেছে। মিতি আলতো হাসে,
-হ্যাঁ, মিলে গেছে পুরোপুরি। এর নাম ম্যাজেন্টা।
মিতিকে ওর মা বলেছিলেন। মিতি আরও যোগ করে,
-একে ফিউসা ও বলে অনেকে।
-ফিউসা, ম্যাজেন্টা, ফিউসা…। মা চলো। বাবা অপেক্ষা করছে।
-চলো যাই।
মিতি ফুল হাতে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াবার আগে মৃদু নেমে আসা সন্ধ্যের আবছায়া আলোয় আরেকবার দোপাটি বনের দিক তাকায়। সবুজ পাতা আর পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফোটা ফুলে ফুলে ছাওয়া দোপাটির বন। সেখানে আর কিছু নেই, কেউ নেই। ফিউসা বা ম্যাজেন্টা রঙের শরীরের হালকা সবুজ পাখার একটি ঘাস ফড়িঙ এইতো একটু আগেই মাঠ পেরিয়ে কচু্রী পানার ফুলে ভরা পুকুরটার দিকে উড়ে গিয়েছিল। বেগুনীর চেয়েও একটু ফিকে আর ঘন গোলাপীর চেয়েও আরেকটু গাঢ় রঙের সেই ঘাস ফড়িঙটি আর ফেরেনি…।