হ্যাঁ আমিই সেই ছলনাময়ী,যে কিনা দীর্ঘ ৪ বছরের সম্পর্কটাকে মাটি চাপা দিয়ে বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলেটাকে আজ বিয়ে করে নিলাম। কি না করেছিলো ছেলেটা আমার জন্য,সিগারেট ছেড়ে চুইংগাম খাওয়া শুরু করেছিলো।আড্ডাবাজি ঘুরাঘুরি বাদ দিয়ে ভালো ছাত্র হয়ে গিয়েছিলো। আমার কথা মত চাকুরীও নিয়ে নিয়েছিলো ছোট খাটো একটা। যেদিন প্রথম ও চাকুরী হয়ে যাবার সংবাদ টা পেলো, সেদিন কোত্থেকে হুট করে এসে যে একটা বেলি ফুলের মালা আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলো আমি টেরই পাইনি।
আমি ওকে সেদিন গাধা বলেছিলাম।আর বলেছিলাম,গাধা। বেলি ফুলের মালা খোঁপায় পরাতে হয়। গলায় নয়।
তখন দ্বীব্য বলেছিলো, আরে গাধী, আমি জানি খোঁপায় পরাতে হয়। কিন্তু তুমি যে গাধী খোঁপাই করোনি। সেই খেয়াল কি আছে? বেতন পেয়েই একটা শুভ্র সাদা শাড়ী আর বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবো। সেদিন কিন্তু খোঁপা করে এসো। আমার আর খোঁপা করে দ্বীব্যর সামনে যাওয়া হয়নি।তার আগেই আমি বিয়ে করে চলে এলাম অর্কের বাসায়। বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্র সে।বাবা এমন ভাবে হাত জোড় করে আমাকে বললেন,তার শেষ ইচ্ছে আমি যেন অর্ক কে বিয়ে করি। আমি আর বাবাকে না করতে পারলাম না। দ্বীব্যর সাথে সেদিনই দেখা করে আমাকে ভুলে যেতে বলে আসলাম।
আর বসে গেলাম বিয়ের পিড়িতে। দ্বীব্য সেদিন চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলো, আমাকে ছেড়ে যেওনা ঈশানী। আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকবোনা। আমি আমার চোখের জল মুছতে মুছতে, কলিজা ছেড়া কষ্ট বুকে নিয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম। আমার আর অর্কের বিয়ের ৩ বছর পূর্ণ হবে আজ। অর্ক ছেলেটাও খুব ভালো। আমার সাথে এই তিন বছরে একটু ধমকের সাথেও কথা বলেনি। আমিও তাই ছেলেটাকে ঠকাইনি। বিয়ের পর কোন রকম আর যোগাযোগ করিনি দ্বীব্যের সাথে। আর চেয়েছি এই ফাঁকে দ্বীব্য ও আমাকে ভুলে নতুন করে কাউকে নিয়ে সুখী হোক। জীবন টাকে নতুন করে সাজাক।যদিও বন্ধুদের কাছ থেকে ঠিকই ওর খবরাখবর নিয়েছি। দ্বীব্যকে কিন্তু আমি ভুলে যাইনি।
আজো কোন দুঃখের মুহূর্তে সুখের মুহূর্তে আমার ওর কথা মনে পড়ে। কখনো চোখের জলে বালিশ ভিজে। কিন্তু যোগাযোগ টা আর করিনি। আমার আর অর্কের একটা মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছি, দীবা। দ্বীব্য বলতো আমাদের মেয়ে হলে নাম দীবা রাখবো। আর আমি বলতাম,ছেলে হলে নাম রাখবো ঈশান। যেহেতু অর্কের কোন নাম চুজ করা ছিলোনা তাই মেয়ের নাম দীবা ই রেখে দেই। তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে অর্ক আমাকে নতুন একটা নাক ফুল উপহার দিলো। অবাক হয়ে বললাম,নাক ফুল কেন? আমার তো নাক ফুল আছে। ও বল্লো,একটা আছে তাতে কি? নাকের টা যদি কখনো হারিয়ে যায় তখন নতুন টা পরে নিও। রাতে অর্ক মেয়েকে কিছু ক্ষণ আদর করে ঘুমিয়ে পড়লো।
-অর্ক,এই অর্ক।বেলা কত হয়েছে সেদিকে খেয়াল আছে? আজব এত ডাকাডাকি করছি অর্ক তো উঠছেনা। মেয়ে গিয়ে বাবার উপর উঠে বসে আছে। তবুও উঠছেনা অর্ক। কাছে গিয়ে ডাকতেই দেখি আমার মেয়ের বাবা আর নেই। ঘুমের মাঝেই স্ট্রোক করে ও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে।
দেখতে দেখতে অর্ক চলে যাবার একটা বছর কেটে গেছে।দীবার এখন তিন বছর। অর্কর বাবা মা,আমার বাবা মা আমার পিছু লাগলো। আমি যেন ২য় বিয়ে করে নেই। অন্তত দীবার জন্য হলেও। অর্ক চলে গেছে আমাদের ছেড়ে দুই বছর হয়। এই দু বছর আমি বলতে গেলে বাসা থেকেই বের হইনি। আর না রেখেছি পরিবার ছাড়া আর কারো সাথে যোগাযোগ। পুরো নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছি। সবাই আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করতে চায়। সবাই বুঝাতে লাগলো অর্ক নতুন নাক ফুলটা দিয়েছিলো নতুন ভাবে জীবন সাজানোর জন্যই। ও হয়তো বুঝতে পেরেছিলো ওর হাতে সময় কম। তাই ইংগিত দিয়ে গেছে। বিয়েটা করে নে না মা। আরো নানান কথা। অবশেষে তাদের পিড়াপিড়িতে আমি রাজি হই বিয়ের জন্য। অর্কের বাবা মা আর আমার বাবা মা একটা ছেলে ঠিক করেছেন আমার জন্য।
ছেলেটার বউ এক বছরের একটা ছেলে বাবু রেখে আর তার স্বামীকে রেখে তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে। আমি বাচ্চা ছেলেটার কথা শুনে না করতে পারিনি। সবাই বুঝালো ছেলেটাও মা পাবে,আর আমাদের দীবাও বাবা পাবে। তাই হয়ে গেলাম রাজি বিয়ের জন্য। ছেলের কোন ইচ্ছে নেই আমাকে দেখার। আর আমারো কোন ইচ্ছে নেই। আমাদের বাবা মা রাই দেখে শুনে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। বিয়েও হয়ে গেলো আমাদের। বাসর ঘরে আমি বসে আছি ছেলেটাকে আর দীবাকে নিয়ে। কিছু ক্ষণ পর দীবা আর দীবার ভাইটা ঘুমিয়ে গেলো। এরপরই দরজায় ঠকঠকিয়ে আসলো সে, যাকে আজ আমি নতুন নাক ফুল টা পরার কারণ বানালাম। আমি তার আওয়াজ পেয়ে অন্য দিকে ঘুরে দীবা আর পিচ্চিটার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।
-জানেন,আমি আসলে বিয়ে করতে চাইনি। বের করার কোন ইচ্ছেই ছিলোনা আমার। শুধু মাত্র আমার ছেলেটার জন্য আমার বিয়ে করা লাগলো। আপনি ওর মা হয়ে থাকবেন প্লিজ? কখনো ওকে ছেড়ে যাবেন না তো? আমিও মেয়েটাকে বাবার স্নেহে বড় করে তুলবো। আজ থেকে আমাদের এক ছেলে এক মেয়ে। আমার দুচোখ ভিজে যাচ্ছে তার কথা গুলো শুনে।
-জানেন,প্রথম বিয়েটাও আমি করতে চাইনি। সেটা বাবা মায়ের জন্য করতে হয়েছে। আর আজ ২য় বিয়েটা করতে হলো ছেলের জন্য।
-আমি খুব আস্তে করে বললাম, কেন প্রথম বিয়েটা করতে চান নি?
-কারণ আমি একজনকে খুব ভালবাসতাম। বাসতাম বললে ভুল হবে। এখনো বাসি। জানেন ও কি বলেছিলো আমায়? আমি নাকি খুব সুখী হবো। আমার বউ নাকি আমাকে অনেক ভালবাসবে। হা হা হা। কত বড় মিথ্যেই না বলেছিলো সেদিন ও আমায়। আমি খাট থেকে অনেকটা দৌড়েই নেমে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আর কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, সেদিন মেয়েটা কোন মিথ্য বলেনি, আপনি সুখী হবেন। আর আপনার বউও আপনাকে খুব ভালবাসবে। খুব খুব ভালবাসবে।
ছেলেটা আমাকে আমার দু কাঁধ ধরে তার বুক থেকে উঠিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো।
-ঈশানী। তুমি?
-হ্যাঁ আমি। (কাঁদতে কাঁদতে)
-তুমি আমার ওয়াইফ?
-কেন কোন সমস্যা?
-কিন্তু আমি তো বিয়ে পড়ানোর সময় শুনলাম মেয়ের নাম ঈশিতা।
-আমিও তো শুনেছি ছেলের নাম আফরান।
-আরে পাগলী, আফরান তো আমার আসল নাম। আর দ্বীব্য আমার ডাক নাম।
-ও সেইম আমারো, হুহ। ঈশিতা আমার আসল নাম ঈশানী আমার ডাক নাম।
-জানো ছেলের নাম আমি ঈশান রেখেছি। তোমার পছন্দের নাম।
-আমিও মেয়ের নাম দীবা রেখেছি, তোমার পছন্দের নাম।
-শেষ পর্যন্ত ঈশান দীবা ই ভাইবোন হলো।
দ্বীব্য আমাকে জড়িয়ে ধরে বল্লো, এত দিন পর আমাদের ভালবাসাও সার্থক হলো। আমাদের জীবন টা শেষ থেকে আবার শুরু হলো। আসলে আল্লাহ্ চাইলে সব সম্ভব। তিনি চাইলে মরা গাছেও ফুল ফোটাতে পারেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প