আজ কল্পর বিয়ে। সদ্য আঠারো বছরে পা দেওয়া কিশোরীকে বিয়ের মতো একটা শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়ার কারণ শুধুমাত্র তার মা নেহার খানম জানেন। মেয়েকে বিয়ের আসরে রেখে এসে তিনি ঘরের দরজা আটকে পুরাতন ডায়েরিটার পাতা উল্টে চোখের পানি ফেলেন। ডায়েরি খোলার সাথে সাথে তিনি প্রবেশ করেন অতীতের অন্দরমহলে। ঠিক উনিশ বছর আগের কথা। হ্যাঁ! গল্পটা উনিশ বছর আগের।
বিয়ের এক বছর পর নেহার জানতে পারে তার স্বামীর অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক। মেয়েটার ফ্যামিলি সচ্ছল ছিলো না বিধায় নেহারের শ্বশুরবাড়ির লোক ঐ মেয়েকে নেহারের স্বামী হিমেলের বউ করে আনেন নি। তারা পছন্দ করেন বড়লোক বাবার মেয়ে নেহারকে। হিমেল পরিবারের কথানুযায়ী নেহারকে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়ের পরেও সে তার প্রাক্তনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলছিলো। মেয়েটা গরীব হলেও সে নেহারের চাইতে খুব বেশি সুন্দরী ছিলো। আর এই সুন্দরের পূজারী হয়েই হিমেল বিয়ের পরেও অনবরত সম্পর্ক রেখে গেছে এবং পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছিলো।
নেহার যখন ব্যাপারটা জানতে পারে তখন সরাসরি সে হিমেলের সাথে কথা বলে। হিমেল তখন অস্বীকার করলে নেহার প্রমাণ দেয়। মেয়েটাকে এনে হিমেলের সামনে দাঁড় করায়। নেহারের পরিবার আর হিমেলের পরিবার যখন বিষয়টা জানতে পারে, তখন নেহারের আর হিমেলের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
নেহার তখন দুই মাসের গর্ভবতী। বিষয়টা জেনেও হিমেল আর চায়নি নেহারের সাথে সম্পর্ক রাখতে। নেহার অন্যায় না করেও হিমেলের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো কিন্তু হিমেল মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। ডিভোর্সের কিছু মাস পরেই হিমেল দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ তুলেছিলো ঘরে। হিমেলের কাছ থেকে অপমানিত, লাঞ্চিত হয়ে নেহার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সে তার সন্তানকে একাই মানুষ করবে। সে হবে তার সন্তানের সিঙ্গেল মাদার। আজ উনিশ বছর পর নেহার আর সেই আবেগি মেয়েটা নেই। তিনি হয়ে উঠেছেন শক্ত সাবলীল একজন নারী। একজন সিঙ্গেল মাদার। কল্প যখনই মায়ের কাছে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করেছে নেহার তখন চোখ মুখ শক্ত করে উত্তর দেয়,
– তোর বাবা তুই আমার গর্ভে আসার দুই মাস পরেই মারা গিয়েছে। কল্পর কাছে ওর মা খুব শক্ত একজন নারী। তাই নেহার তার মেয়ের কাছে কখনো দূবর্লতা প্রকাশ করেনি। কল্পর আড়ালে নেহার ঘুণে ধরা কাঠের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া এক নারী। অথচ মেয়ের সামনে খুবই কঠিন। কল্প দেখতে খুবই সুন্দরী কিশোরী। গায়ের রঙ দুধে-আলতা। ঘন কেশবতী। নাক খাড়া সরু। চোখ টানা টানা। হাসি তার চিরল দাঁতের।
এমন মেয়ে চৌদ্দ-পনেরো বছর হলেই লোকের নজর কাড়ে। কল্পর ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম হয়নি। চৌদ্দ বছর হতেই পাড়ার বখাটে ছেলেদের নজরে পড়ে সে। নেহার সিঙ্গেল মাদার হয়েও এই চারটা বছর তাকে আগলে রেখেছে। কিন্তু কল্প আঠারো বছরে পা দিতেই বখাটেদের উপদ্রব আরো বেড়ে গেছে। সেই সাথে বেড়েছে ঘটকের উপদ্রব। আজ নেহারের পাশে হিমেল থাকলে হয়তো কল্পর এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হতো না। বাবার ছায়াতলে থেকে অনেক পড়াশোনা করে বড় কিছু হতে পারতো কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেটা হয় নি। তাই নেহার বাধ্য হয়েই কল্পর বিয়ে ঠিক করেন। ছেলে লেকচারার। দেখতে সুদর্শন, ভদ্র। এমন একটা ছেলের হাতে বাবা ছাড়া মানুষ হওয়া মেয়েকে তুলে দিতে পেরে নেহার স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন।
নেহারের ডিভোর্স হওয়ার পর ওর পরিবার আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। নেহার আপত্তি করা সত্ত্বেও অনেক সম্বন্ধ দেখেছিলো ওর বাবা-মা। কিন্তু নেহার গর্ভবতী শুনে সব সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছিলো। সমাজের নানান লোকদের নানান কটু কথা শুনে নেহার হয়ে উঠেছিলো এক মহীয়সী নারী। নানান ঝড় ঝাপটার সম্মুখীন হয়েও সে সংগ্রাম করেছিলো তার সন্তানের জন্য।
আজ আঠারো বছর সংগ্রামের পর নেহারের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। এই হাসি পরাজয়ের পর জয়ী হওয়ার এক নিদারুণ হাসি। এই হাসি সিঙ্গেল মাদার হয়ে নিজের মেয়েকে আগলে রাখার হাসি। এই হাসির মূল্য আমাদের সমাজের অনেক পুরুষ মানুষ দিতে পারে না। সমাজের কিছু পুরুষ হিমেলের মতো দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে সংসার শুরু করে। কিন্তু তখন নেহারের মত কিছু মায়েরা হোঁচট খেয়েও থেমে যায় না। তারা তাদের সবোর্চ্চটা দিয়ে হয়ে উঠে সংগ্রামী মা।
গল্পের বিষয়:
গল্প