ঢাকা শহরের বাইরে অনেক পরিকল্পিত আবাস গড়ে উঠেছে। কতটা পরিকল্পিত বা কতটা ডেভেলপারদের বিজ্ঞাপনের মায়াজালে সৃষ্ট স্বপ্নের আবাস, কে জানে! যমুনা সিটি, পূর্বাচল সিটি, নর্দান সিটি—যেখানে ঢাকা শহরবাসী মানুষের ঠাঁই খোঁজার স্বপ্নেরা এসে ভিড় করছে, উঁকি দিচ্ছে, দানা বাঁধছে। পিংক সিটি ঢাকা শহরের বাইরে এমন এক বর্ণিল স্বপ্ন-জাগানিয়া আবাসস্থল, অনেক পরিবারের জন্য। আমি ঢাকার পিংক সিটির কথাই বলছি, ভারতের রাজস্থানের পিংক সিটি জয়পুর নয়।
পিংক সিটি অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ইমরানের শ্বশুর বাড়ি। ইমরান যখন বিয়ে করে তখন শ্বশুর বাড়ি ছিল পশ্চিম ধানমন্ডির মধুবাজারে। পিংক সিটি আর মধুবাজার—এ দুয়ের মধ্যে তাই স্থানকালের অনেক তফাত। শ্বশুরের নয় ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে হাসিনাকে বিয়ে করার সুবাদে ইমরান শ্বশুর বাড়িতে পা রাখা প্রথম জামাই। পুত্রবধূ বলতে কেউ ছিল না তখন। এ বাড়িতে ইমরান জামাই হয়ে আসার পরপর বিয়ে-শাদির একটা ছোটখাট ধুম লেগে গেল। ইমরানের ডেনটিস্ট শ্যালিকা আঁখির বিয়ে হলো ওরই ক্লাসমেট শরিফের সঙ্গে। শরিফকে ইমরান ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখেছে। শিখা পরিচয় করে দিয়েছিল—দুলাভাই, শরিফ আমার বন্ধু ও ক্লাসমেট। বিয়ের ডামাডোলে শরিফকে অতটা মনে রাখেনি ইমরান। পরে জানল এরা ডেন্টাল কলেজে ফার্স্ট ইয়ার থেকে প্রেম করে আসছে। ইমরানের বিয়ের সময় এরা ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রী। ওদের ব্যাপারে দুই পরিবারেই সম্মতি ছিল। একমাত্র ও বড় জামাই হিসেবে ইমরানই বিয়ের পয়গাম নিয়ে শরিফের বাসায় যায়।
ওদিকে ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকনভ্যালিপ্রবাসী ইমরানের সম্বন্ধী রেজা প্রবাসী আরেক বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ঢাকায় খবর পাঠাল, সে বিয়ে করতে চলেছে। পাত্রীর অরিজিন পশ্চিমবাংলা, কিন্তু বড় হয়েছে আমেরিকাতে। ইমরানের শ্বশুর বাড়ি থেকে সামান্য ওজর আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু রেজা তার সিদ্ধান্তে অটল। প্র্যাকটিক্যাল কারণেই তার পক্ষে সেই মুহূর্তে দেশে এসে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। রেজার বিয়ে সহী-সালামতেই সিলিকনভ্যালিতে সম্পন্ন হলো। এরপর ইমরানের সকল সম্বন্ধী ও শ্যালক-শ্যালিকার একে একে বিয়ে হয়েছে তেমন কোনো ঘটন-অঘটন ছাড়াই। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ইমরানের অন্য সম্বন্ধী তারা, ওর অসি মহিলা বান্ধবীকে সিভিল কোড মোতাবেক বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া থেকে যাওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ সারল। তারার এ পদক্ষেপ ছোট করে দেখার সুযোগ নেই—এরপর ইমরানের বেশ কয়েকজন শ্যালক-শ্যালিকা তারার আগ্রহে ও স্পনসরশিপে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী হয়েছে। বাকিরা হয়েছে আমেরিকায়, তাতে বড় সম্বন্ধী রেজা ভূমিকা রেখেছে। একমাত্র মেজো শ্যালিকা জুঁই দেশে থেকে গেছে।
বিয়ের আগে ইমরানরা থাকত রায়েরবাজারে। রায়েরবাজার আর মধুবাজার পাশাপাশি দুই পাড়া। মধুবাজারকে পশ্চিম ধানমন্ডিও ডাকা হয়। ১৯ নম্বর রোড মধুবাজারকে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে আলাদা করেছে। ধানমন্ডি ছিল পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা, মধুবাজার নয়। এটা অবশ্য এখন অপ্রাসঙ্গিক। ধানমন্ডির পরিকল্পিত থেকে অপরিকল্পিত আবাসনে রূপান্তর নাটকীয় ও লাগামছাড়া। সেখানে মধুবাজারের পরিবর্তন অবধারিত মনে হয়।
এমন নয় যে ইমরান রায়েরবাজার থেকে মধুবাজারে গিয়ে হাসিনার সঙ্গে প্রেম করত বিয়ের আগে। বিয়ের আগে ইমরান একবার শুধু মধুবাজার গিয়েছিল। ওর নজর কেড়েছিল গাছগাছালি ভরা পাড়া। শিউলি, জবা, রঙ্গন, আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল গাছ যেন জড়াজড়ি করে আছে। ফুল বাগান আর ফল বাগান একাকার। সাত মসজিদ রোডের ওপারে মূল ধানমন্ডির পশ আবাসিক এলাকার তুলনায় মধুবাজার কিছুটা চাপাচাপি। রাস্তা সরু ও আঁকাবাঁকা। পাড়ায় কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার বাস করেন। এর মধ্যে একজন পিডব্লিউডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাজ্জাক সাহেব আর একজন ইমরানের শ্বশুর, ওয়াপদার অবসরপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মতিন উদ্দীন সাহেব। মনে হতে পারে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা স্কেল দিয়ে মেপে রাস্তার জন্য জায়গা ছেড়েছেন। যাতে দুটো গাড়ি কোনোরকমে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পার হয়। ইমরানের রায়েরবাজার তখন কুমার পাড়ার কাল—লাল কাদামাটির প্রলেপ আর মাটির ঘরের আদল তখনো বজায় রেখেছে। ফাঁকে ফাঁকে একটা দুটো করে টিনশেডের আধপাকা বিল্ডিং উঠছে শেরে বাংলা রোডের দু পাশে। ইমরান কী জানত মধুবাজারের সঙ্গে একদিন ওর পারিবারিক বন্ধন গড়ে উঠবে! বিয়ের পর সপ্তাহে কয়েক দিন আসা যাওয়া করতে হবে।
২. ইমরান হাসিনা দুজনই বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। এদের মধ্যে ইমরান হাসিনার দুই বছরের সিনিয়র বা হাসিনা ইমরানের দুই বছর জুনিয়র। যে যেভাবে দেখে। দুজনই চাকরি করত ওয়াপদায়, হাসিনা ডিজাইনে আর ইমরান প্ল্যানিংয়ে। পাস করে প্রাইভেট ফার্মে কিছুদিন চাকরি করার পর ইমরানের মনে হলো একটা স্থায়ী সরকারি চাকরি দরকার জীবনের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য। শেষ পর্যন্ত ওয়াপদাতে চাকরি নিল। ওয়াপদাতে পাঁচ বছর চাকরি করার পর মনে হলো এবার বিয়ে করা দরকার। শেষে ওয়াপদার কলিগ বন্ধুরা উদ্যোগ নিয়ে হাসিনার সঙ্গে ইমরানের বিয়ে ঘটাল, অবশ্য দুই পক্ষের মুরব্বিদেরও আশীর্বাদ ছিল।
এনগেজমেন্টে আর বিয়ে—এর মাঝের সময়টা ইমরান আর হাসিনা বেশ উপভোগ করেছিল। এনগেজমেন্টের পর দিন ছিল পয়লা বৈশাখ। ইমরান হাসিনাকে এই প্রথম টেলিফোন করল, হাসি আজ বাংলা নববর্ষ, চল আমরা বাইরে কোথায় ঘুরে আসি। ইমরান এই প্রথম হাসিনাকে হাসি ডাকা শুরু করল। হাসি হেসে বলল কেন বাইরে যেতে হবে কেন? কি হয়েছে? হাসির কণ্ঠ এত মিষ্টি লাগল ইমরানের কাছে, ইমরান একেবারে প্রেমে পড়ে গেল হাসির।
ইমরান কিছুক্ষণ নীরব রইল। জীবনে যা সে করেনি, কোনো দিন ভেবেও দেখেনি, তাই করল। ধীরে সুস্থে গুছিয়ে বলল, হাসি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আজ তোমার সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে। অপর প্রান্তে নীরবতা নেমে এল যেন। তারপর মুচকি হাসি মেশান কণ্ঠ ভেসে আসল, আমিতো তোমাকে এখনো ভালোবেসে উঠতে পারিনি। ইমরান শুধু বলল, তুমি রেডি হও, আমি আসছি।
ইমরান আর হাসি শেরে বাংলা নগরের ক্রিসেন্ট লেক আর সংসদ ভবনের খোলা জায়গায় বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিল। সংসদ ভবনের চত্বরে ওরা বসে গল্প করেছিল ওদের ভালো লাগার বিষয়গুলি—যেমন কী গান ওদের ভালো লাগে, কারা ওদের প্রিয় শিল্পী। আকাশ ছিল একেবারেই মেঘ শূন্য, নীল আকাশ আর মাতাল করা রোদ চরাচর কী এক আবেশে অবশ করে রেখেছিল যেন। রিকশা করে ক্রিসেন্ট লেকে আসার সময় ওদের দুজনের কী কাছে আসার সচেতন প্রয়াস ছিল, কথা বলেছিল কী দুজনে? কোথায় থেমে দুজনে মুখোমুখি বসে কথা বলে হৃদয় বিনিময়ের পালা শুরু করবে এটাই যেন ওরা দুজন চাইছিল।
ইমরানের ভালো করে মনে আছে হাসি কী রঙের শাড়ি পরেছিল। একটা মেঘ রঙের শাড়ি। এখন ইমরানের মনে হয় হাসি একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরলে পারত এমন বসন্ত দিনে। ইমরানের শ্যালিকা জুঁই হাসিকে খুব সম্ভবত সাজতে হেল্প করেছিল। এটা জুঁইকে জিজ্ঞেস করতে হবে। হাসি কপালে বড় কালো টিপ পরেছিল, মেঘ রঙের শাড়ির সঙ্গে চমৎকার ম্যাচ করেছিল—এটাও নিশ্চয় জুঁইয়ের আইডিয়া ছিল। হাসির লম্বা শ্যামলা চেহারা মুখে কপালের কালো টিপ এখনো ইমরানের চোখে ভাসে ভরা জল পুকুরের শাপলা ফুলের মতো।
৩. অতীতে রায়েরবাজার থেকে ধানমন্ডি বা সাতমসজিদ রোডে যাওয়ার বহুল ব্যবহৃত রাস্তা ছিল দুটি। একটি শংকর দিয়ে আর একটি ব্যস্ত ১৫ নম্বর রোড। গন্তব্যে যাওয়ার জন্য চেনা রাস্তায় চলতে মানুষ এত অভ্যস্ত হয়ে যায়। বিকল্প পথের সন্ধান কেউ করে না প্রয়োজন না পড়লে। এ দুটো বাদে আর একটি রাস্তা ছিল যেটা রায়েরবাজার মুক্তি সিনেমা হলের চৌরাস্তা থেকে বের হয়ে মধুবাজারের ভেতর দিয়ে ১৯ নম্বর রোডে পড়েছে। এ রাস্তা দিয়ে ধানমন্ডি বা সাতমসজিদ রোডে যাওয়ার কথা ইমরানের মাথায় আগে আসেনি। মধুবাজারের ভেতরে ঢুকে এ রাস্তা দুই ভাগ হয়েছে। একটা শাখা মধুবাজারে ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটা ডোবার পাস দিয়ে নদীর মতো এঁকেবেঁকে বিএনপির সময়কার পার্লামেন্টের স্পিকার ব্যারিস্টার জমির আলীর চেম্বার ঘেঁষে ১৯ নম্বর রোডে পড়ছে। এই ভদ্রলোক বিখ্যাত ছিলেন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় সদাই থ্রিপিস স্যুট আবরণের জন্য। অন্যটি একাধিক অলি গলির সঙ্গে সংযোগ করে আমানত ফার্মেসি ছুঁইয়ে নদীর মোহনার মতো প্রশস্ত হয়ে সেই ১৯ নম্বর রোডেই মিশছে। বিয়ের পর এ রাস্তা দিয়ে মধুবাজারে শ্বশুর বাড়ি আসা যাওয়া ইমরানের লাইফ স্টাইলের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল। মধুবাজার আর মধুবাজারের মানুষকে কাছে থেকে চিনল আর জানল।
১৯ নম্বর রোডের মুখে আমানত ফার্মেসি ইমরানের কাছে ছিল একটা ল্যান্ডমার্ক। বাইরে থেকে যারা আসত তারা মধুবাজার চিনত আমানত ফার্মেসি দিয়ে। কয়েক জন লোক গাদাগাদি করে বসতে পারে আর বাক্সের সাইজের ডাক্তারি চেম্বার নিয়ে আমানত ফার্মেসি। আমানত ফার্মেসির মালিক ছিল দেওয়ান ডাক্তার ও তার ছোট ভাই হায়দার। বিয়ের পর এ দুই ভাইয়ের সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছিল। মধুবাজার পাড়ায় এই দুই ভাই ছিল খুব চেনা মুখ। দুই ভাই গলির মুখে একটা বড় ভাড়া বাসায় একসঙ্গে বসবাস করত।
হায়দার ভাই ফার্মেসি চালাত আর দেওয়ান ডাক্তার দেখত রোগী। সকাল নয়টার দিকে হায়দার ভাই নাশতা খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে আর কৌটা থেকে সুগন্ধি জর্দা ঠোঁটে গুঁজে দিতে দিতে হেঁটে এসে ফার্মেসি খুলত। যারা পান চর্বনে আসক্ত তারা মনে হয় সুখী মানুষ। এদের জীবনের আনন্দ-মাধুর্যের রস যেন পানের রসের সঙ্গে ঠোঁটের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। ফার্মেসি খোলার অনেক পরে দেওয়ান ডাক্তার আসত। বসত পর্দা ঢাকা দেওয়া ফার্মেসিরই এক কোনায়। ফার্মেসিতে আড্ডাই বেশি চলত। আড্ডায় অনেকে আসত, তার মধ্যে ছিল গফরগাঁয়ের সাত্তার চেয়ারম্যান, অ্যাডভোকেট মজিদ ভাই। ফার্মেসির পাশে একটা খালি জায়গা ছিল। এখানে দেওয়ান, হায়দার ভাই, ইমরান ও আরও অনেকে শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন খেলত। পরে এখানে ১১ তলা বিল্ডিং উঠলে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। এটাই মধুবাজারের প্রথম হাইরাইজ বিল্ডিং। তারপর আরও হাইরাইজ বিল্ডিং হয়েছে মধুবাজারে। এখন রায়েরবাজার থেকে ধানমন্ডি বা মধুবাজার যাওয়ার অনেক বিকল্প রাস্তা বের হয়েছে। আমানত ফার্মেসির চারপাশে এখন এত উঁচু বিল্ডিং, ১৯ নম্বর মধুবাজারকে দূর থেকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। উঁচু বিল্ডিংয়ের ভিড়ে শংকর, ১৯ নম্বর বা ১৫ নম্বর রোড আলাদা করা কষ্ট। আমানত ফার্মেসি এখন আর নেই, কিন্তু ইমরানের কাছে আমানত ফার্মেসি সব সময় মধুবাজারের ল্যান্ডমার্ক হয়েই থাকবে।
৪. ইমরানের শ্বশুর বাড়ি মধুবাজারে থেকে পিংক সিটিতে স্থানান্তরের উদ্যোগ মেজো শ্যালিকা জুঁইয়ের নেওয়া। যখন একে একে শ্যালক-শ্যালিকারা দেশের বাইরে থেকে যেতে শুরু করল, ওদের দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হলো, তখন জুঁই সিদ্ধান্ত নিল ও দেশে থাকবে। শেষ পর্যন্ত ইমরানের নয় শ্যালক-শ্যালিকাদের মধ্যে একমাত্র জুঁই বাংলাদেশে থিতু হয়েছ।
শ্বশুর–শাশুড়ির তখন বয়স বাড়ছে, শ্বশুর বাড়ির পাঁচ তলা বাড়ি কে দেখাশোনা করবে, শ্বশুর–শাশুড়ির যখন আরও বয়স হবে তাদেরই বা কে দেখা দেখাশোনা করবে? তখন জুঁই ঠিক করল মধুবাজারের বাড়ি বিক্রি করে শহরের বাইরে যাবে। তখন এটা বেশ সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত ছিল। জুঁই ছিল গাছ-গাছালি আর ফুল বাগানের পাগল। ও মনে মনে তখন গাছ-গাছালি আর ফুল বাগানের ছক আঁকা শুরু করে দিয়েছে। উত্তেজনায় টগবগ করছিল জুঁই।
জুঁই প্রথম পিংক সিটিতে নিজের বাড়ির কাজ শুরু করল, তারপর পাশের প্লটে নিয়ে এল নিজের বাবা-মাকে। তারপর বাকিটুকু ইমরানের শ্বশুর বাড়ি পিংক সিটিতে স্থানান্তরের ইতিহাস। ঢাকা শহরের ভেতরে সবুজ নিঃস্বর্গবিহীন এলোপাতাড়ি আবাসনের বিপরীতে পিংক সিটি একটা ওয়েসিসের মতো। সিটির ভেতরে পরিকল্পিত রাস্তা ও লেন। পিংক সিটিবাসীরা ফল ফলাদির গাছ, ফুলের বাগান আর ভেষজ-সবজির লতাপাতা দিয়ে মুড়ে এক শ্যামল নিঃস্বর্গের বসতি গড়ে তুলেছে।
পিংক সিটি এক সময় শহর থেকে বেশ দূরে ছিল। অযত্নে পড়ে থাকা খানাখন্দে ভরা আঁকা বাঁকা পাকা আধ পাকা ফিতের মতো সরু রাস্তায় গ্রাম-গঞ্জ হাট-বাজার পাড়ি দিয়ে পিংক সিটি যেতে হতো। সময় লাগত আর ইমরান ধন্দে পড়ে যেত, শহর থেকে এত দূরে আসার কী দরকার ছিল! হাসির কাজিন শহীদ ভাই ধানমন্ডি মধুবাজারে ইমরানের শ্বশুর বাড়ির কাছেই থাকেন, ওখানেই বাড়ি করেছেন। পিংক সিটি ঘুরে এসে ওনার মন্তব্য—পিংক সিটি যেতে হলে হেলিকপ্টার ভাড়া করতে হবে। শুনে ইমরান মুচকি হেসেছিল।
ঢাকা শহর বাড়ছে, বাড়তে বাড়তে এখন শহরের বাইরের হাউজিং এলাকাগুলো ছোঁয় ছোঁয়। পিংক সিটি থেকে বালু নদী খুব একটা দূরে নয়। মনে হয় পিংক সিটি থেকে জোরে একটা ঢিল ছুড়লে ঢিলটা নদীর জলে গিয়ে পড়বে। আগে মনে হতো বালু নদী কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় বন বাঁদাড়ে গাছের ছায়ায় লতা-পাতায় ঢাকা পড়ে আছে। নদী খুঁজে পাওয়া মহা ঝক্কির ব্যাপার! ইমরান নিশ্চিত বালু নদীও ঢাকা শহরের প্রসারন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না! এ নদীর ওপর দিয়ে ৩০০ ফুট রাস্তা চলে গেছে। ঢাকা শহরে যাতায়াতের সুবিধার জন্য এ রাস্তাটা দরকার ছিল এ এলাকার হাউজিংবাসী জনগণের জন্য। এ রাস্তা ধরে ঢাকা শহরের দিকে এগিয়ে গেলে কুড়িল, সেখানে অক্টোপাসের টেন্টিকলের মতো জড়াজড়ি করে আছে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার বা উড়াল সেতু। উড়াল সেতুর টেন্টিকলের মতো লেজগুলো আছড়ে পড়েছে বিভিন্ন দিকে দিকে—মিরপুর, বিমানবন্দর, বারিধারা।
৫. ইমরান আর হাসি এবার ঢাকা এসেছে অসুস্থ শাশুড়িকে দেখার জন্য। শাশুড়ি ভীষণ অসুস্থ। জীবনের গূঢ় অর্থ আমলে নিলে বলতে হয়, তিনি তার শেষদিনগুলি পার করছেন। এই শেষদিনগুলি কতটা দীর্ঘায়িত হবে কেউ বলতে পারে না। স্মৃতি বিভ্রমে আক্রান্ত, খুব কম লোককেই চিনতে পারেন! নিজের ছেলেমেয়েকেও বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারেন না। জামাই ইমরানকেও চিনতে পারেননি। অনেকক্ষণ নানা এঙ্গেলে জামাইয়ের পরিচয় দেওয়া হলো, যেমন হাসির জামাই, কমলের বাবা ইত্যাদি। ক্ষণিকের জন্য আবছা চিনতে পারলেন, তারপরই যেন তার নিজের স্মৃতি বিভ্রমের জগতে হারিয়ে গেলেন। ইমরান ভাবল তার নিজের ছেলেমেয়েদের চিনতে পারাটাই এই মুহূর্তে জরুরি।
বেশ কয়েক শ্যালক–শ্যালিকা পালাক্রমে বিদেশ থেকে এসে মায়ের দেখাশোনা তদারকি করছে। আসল সেবা শত্রুতার কাজ একজন দিনভিত্তিক নার্স, দুজন স্থায়ী মহিলা কাজের লোক ও একজন ড্রাইভার, একজন ফিজিওথেরাপিস্ট করছে। দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থ একজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিকট আত্মীয়স্বজনের এমন আপ্রাণ ও আকুল প্রয়াস হয়তো ঢাকা শহরের অনেক পরিবারে জীবনযাত্রার কমবেশি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই বছর আগে ইমরানের শ্বশুর মতিন উদ্দীন সাহেব মারা যান। তিনি একজন সেলফ মেড ও স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন। সারা জীবন বার্ধক্য ছাড়া আর কোনো কিছু তাঁকে কাবু করতে পারেনি। গ্রামের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তাঁর ইচ্ছানুসারে গ্রামের বাড়িতে তাঁর মায়ের কবরের পাশেই তিনি চিরশয্যায় শায়িত। এ যেন উৎস বা শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া।
শ্বশুর বাড়িতে ইমরানকে সময় কাটানো আর খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর কিছু করতে হয় না। পিংক সিটির বাইরে তেমন কিছু করার নেই। শ্বশুর বাড়ির লোকজন জামাইকে আদর যত্নে রাখার ব্যাপারে ত্রুটি করছে না। শাশুড়ির সেবা শুশ্রূষার সঙ্গে জামাইয়ের প্রিয় খাবারদাবার ডাইনিং টেবিলে পরিবেশনের আয়োজন চলছে। এ রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না বলে ইমরান অস্বস্তি বোধ করে।
নার্স মমতা ও কাজের মেয়ে সুমি দিনের পর দিন সুশৃঙ্খলভাবে ওদের কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এদেরও আছে জীবন ইতিহাস—মমতা কিশোর–কিশোরী পুত্র কন্যা সন্তান নিয়ে একাকী জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে; সপ্তদশী সুমি তিন-চার বছরের দুই পুত্র ও কন্যা সন্তান বড় বোনের কাছে রেখে সন্তানদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বিভোর। সুমি ১২–১৩ বছর বয়সেই তাহলে মা হয়েছে! কিশোরী বয়সের ঢল ঢল মুখে জীবনসংগ্রামের ছাপ লাগতে শুরু করেছে, দেখলে মায়া লাগে। ইমরান ওর কয়েকটা ছবি তুলেছিল, ভেবেছিল ওকে নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেবে। সুমির কাছে অনুমতি চেয়েছিল, সুমি রাজি হয়নি। পিংক সিটির স্থায়ী বসবাসকারী মানুষদের জীবনের পরতে পরতে কচুরিপানার মতো ভেসে আসা নার্স, কাজের বুয়া, বাগানের মালি, ড্রাইভার, সিকিউরিটি গার্ডদের জীবন বাঁধা পড়ে গেছে। এদের কর্মচাঞ্চল্য বিনা পিংক সিটির স্থায়ী মানুষদের জীবনের ছন্দ এলোমেলো ও বেসুরো হতে পারত!
৬. ইমরান ও হাসি সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করে। হেঁটে এসে নাশতা করে। ওদের দুজনের কাছে সকাল বা বিকেলে হাঁটাহাঁটি করা মজ্জাগত হয়ে গেছে বিদেশে থেকে। আজ হেঁটে এসে ইমরান দেখল জুঁইয়ের বাড়ির সামনের বাগানের মাঝের শূন্য জায়গায় একগাদা শাড়ি—নারী দেহের আবরণ, গরম কাপড়চোপড়, বিছানার বালিশ ও চাদরসমূহ দড়িতে ঝুলিয়ে রোদে মেলে দেওয়া হয়েছে।প্রতীকী ছবি।
ইমরানের সাঁই করে মনে পড়ে গেল, বাঙালি মা বোনদের মধ্যে একটা প্রথা চালু আছে আশ্বিন মাসের প্রথম কড়া রোদে ট্রাঙ্ক সিন্দুকে জমে থাকা যাবতীয় কাপড়চোপড় বসন আবরণ রোদে তাঁতিয়ে আসছে শীতে ব্যবহারের জন্য সজীব করে তোলা। আজ সেটারই একটা চর্চা জুঁইয়ের বাগানে দেখতে পেল ইমরান। পুরোনো কাপড় সজীব করে তোলার মধ্যে কী কোনো মেটাফোর আছে? যে জীবন পার হয়ে গেছে তার রেশ ধরে রাখা বা তার অনুরণ সামনের দিনগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া! ফেলে আসা দিন কী মানুষ কী ভুলতে পারে, স্মৃতির ভান্ডার কী মানুষ খুইয়ে ফেলতে চায়, কিন্তু সেটাও তো বয়সের ভারে চাপা পড়তে থাকে। দিনান্তের আলো যখন ম্লান থেকে ম্লানতর হতে থাকে, তখন স্মৃতির ভাঁজ আর সহজে খুলতে চায় না।
ইমরানের শাশুড়ি তার স্মৃতি বিভ্রমের জগতেই নিমগ্ন আছেন। তার যান্ত্রিক বিছানাটা জানালার ধারে। বাগানের সবুজ ঘাস, বাহারী ফুলের ঝাড় আর ইলেকট্রিক তার ছোঁয় ছোঁয় একটা দুটো সুপারি আম কাঁঠাল ও নারিকেল গাছ দেখা যায় জানালা দিয়ে। ইমরানের মধুবাজার শ্বশুর বাড়িতেও তিনতলার বারান্দা ছোঁয়া দুটো লম্বা নারিকেল গাছ ছিল। জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে ইমরানের শাশুড়ি অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, বাড়ি যাব। ওনার একটা স্ট্রোক হয়েছিল, হাসপাতালে আইসিইউতে ছিলেন অনেক দিন। হাসপাতাল থেকে পিংক সিটিতে ফেরার পর স্মৃতি বিভ্রমের অবনতি শুরু। আর শুরু বাড়ি ফিরে যাওয়ার স্বগতোক্তি। ইমরানের বিশ্বাস উনি মধুবাজারের কথাই বলছেন।
ইমরানের ডাক্তার শ্যালক তামিম, সেও অস্ট্রেলিয়া থাকে। ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ভাইবারে ও স্কাইপে ওর মায়ের চিকিৎসা ও নার্সিং এর তদারকি করে। তামিম বলল, মানুষের বডি একটা এমাজিং মেশিন। আম্মা হয়তো নিজের ভেতরে নিজের অজান্তেই স্মৃতি জাগানিয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হয়তো আম্মা অনেক দিন পর নিজের ছেলেমেয়েকে আবার চিনতে পারবেন, নাতি নাতকুড়দের কথাও মনে পড়বে। উনি যে এখন পিংক সিটিতে আছেন এটা বুঝতে পারবেন। সবকিছু চিরতরে ভুলে যাওয়ার আগে এ রকম একটা সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তামিম জানাল, এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে।