ভুবনদের বাড়ির উঠোনে কলাবতীগাছ আছে, ফুল নেই। প্রাচীর টপকে পাশের বাড়ির পেয়ারাগাছ খানিকটা ঝুঁকেছে। ফল হলে ভুবনরা ভাগ পাবে কিনা জানি না। যদিও অন্যের বাড়ি, তবু মানুষ যেখানে থাকে অলিখিত সম্পর্ক তো হয়। পলেস্তারা খসে-যাওয়া লাল ইটের দেয়ালে কামিনী মাসি রাধা-কৃষ্ণের রঙিন ছবির পোস্টার লাগিয়েছেন। বারান্দার এক কোনায় রংচটা বাঁশের চালুনির ভেতর শুকানো পাকা বড়ই, একটু শরষে রোদে দেওয়া, প্রাচীরের পাশে ময়লার সত্মূপ। যতটা এদের ফেলা তার চেয়ে বেশি ওপাশের ছয়তলা প্রতিবেশীর। পলিথিনের ভেতর বুটের ডাল, লাউয়ের খোসা, বাসি রুটি থেকে শুরু করে ময়লা কাপড়, ভাঙা পস্নাস্টিকের পুতুল, দলা পাকানো কাগজ। ভুবনরা এই বাড়িতে আশ্রিত। দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাড়িওয়ালা থাকেন আমেরিকা। পতিত রাখার বদলে পাহারায় রেখেছে। ঢাকার বাইরে যাচ্ছি খবরটা জানাতে এসেছিলাম। ভুবনেশ্বর পা–র একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবিও দরকার ছিল আমার। এসেই এমন ঘটনার ভেতর ঢুকে পড়লাম যে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এসব দেখা ছাড়া আপাতত কাজ নেই। আসলে একটা সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি আমি।
বছর-দুয়েকের জন্য বাবার বদলির চাকরিতে আমরা মুন্সিগঞ্জে ছিলাম। মাঝখানে আরো কত কত জায়গা ঘুরে পড়ার পাঠ শেষ হয়েছে। সাংবাদিকতা শুরুর আগেই ঢাকায় থিতু হলাম, তাও বছর-ছয়। স্ত্রীর অফিস কাছে বলে গত বছর নিকেতনের একটা নতুন বাসায় উঠেছি। মাঝরাতে ডিউটি সেরে ফেরার পথে একেবারে ঘরের কাছে গাড়ির হার্ড ব্রেক কষল আমিনুল। পথের মাঝখানে উবু হয়ে বসে বিকারহীন এক লোক কিছু টোকাচ্ছে। বধির না হলেও গাড়ির আলোয় তার সরে যাওয়ার কথা, নড়াচড়ার নাম নেই। দুবার হর্ন বাজিয়ে ড্রাইভার মুখ করল – হালায় পাগল নাকি, মরার আর জায়গা পাইলি না। আমার উপস্থিতি আমিনুলকে আরো দুটো শব্দ ব্যবহার থেকে বঞ্চিত করেছে। অথচ গাড়ির তীব্র আলোয় দেখতে পাচ্ছি লোকটা সুস্থ এবং মোটামুটি মানের কাপড়-চোপড়ও আছে গায়ে। মিনিট দুই বাদে দাঁড়াতেই হেডলাইটের আলোয় দেখলাম, হাতে ককশিট আর শোলার কয়েকটা খ-।
এতক্ষণ তাহলে এসবই কুড়াচ্ছিল। লোকটা উলটো হাঁটতে শুরু করলে ড্রাইভার গাড়ি টানল। কোন বাড়ির বাচ্চার জন্মদিন, শোলায় হয়তো নাম লেখা ছিল বা কেউ নতুন ফার্নিচার কিনেছে। সঙ্গে দেওয়া শোলাগুলো বাইরে ফেলেছিল অবিবেচকের মতো। লোকটা তা-ই নিতে এসেছে মাঝরাতে। কয় টাকা পাবে ওই বিক্রি করে! নিকেতন জায়গাটা আমার পছন্দ। যদিও নতুন ঘরবাড়ির জন্য সারাদিনই কনস্ট্রাকশনের শব্দ থাকে। বাতাসে ঘরের ভেতর বালি-সিমেন্ট উড়িয়ে আনছে বলে প্রত্যহ দাঁত মাজার মতো দুবার করে ফার্নিচার ডাস্টিংয়ের হুজ্জতও আছে। তবু একটা লেক আর খেলার মাঠ বাড়িঘেঁষা, মাঝে মাঝে ভ্যানে করে টাটকা সবজি নিয়ে আসে গলিতে। ঢাকা শহরে এই কত। মাঠ থাকলেই সেখানে বাচ্চারা ছোটাছুটি করে, সাইকেল চালায়, বয়স্ক মানুষরা হাঁটতে হাঁটতে অতীতের গল্প করে। ঢাকা শহরে এই গৃহস্থালিচিত্র তো হারাতে বসেছে।
সেই নির্দিষ্ট রমনা বা ধানম– লেক। এই লেকটা মফস্বলের পুকুরের মতো। আপন আপন ভাব আছে একটা। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে যে-শহরেই ঘুরেছি, সবখানে স্টেশন, কলেজ রোড, পাড়ার লাইব্রেরি পেয়েছি। এখন জেলাশহরের মানুষও এসবের অস্তিত্ব ভুলছে। মানুষ শুধু রাজধানীতে বাড়বে আর মফস্বলে সবাই জন্মনিরোধ আইন মেনে চলবে বিষয়টা তো তা নয়। তবু মফস্বল বললেই একটা দমকা হাওয়া বুকের ভেতর খেলে। মাঝে মাঝে বাড্ডার দিকে বাজার করতে যাই। অনেকটা খুলনার রূপসাঘাটের কাঁচাবাজারের মতো, মন খুলে দরদাম করি, দোকানদারদের সঙ্গে দু-চারটে খুচরো আলাপও হয়। দোকানিরা কথায় কথায় জানায় শিম, বেগুনটা সাঁতারকুল গ্রাম থেকে টাটকা এনেছে। অধিকাংশ সময় মিথ্যা হলেও বিশ্বাস করতে ভালো লাগে।
এক ছুটির সকালে শখের বাজারে যাচ্ছি, আসলে একটু হাঁটাই মূল উদ্দেশ্য। ভুঁড়িটা যা হয়েছে না। বউ ইদানীং টিপ্পনী কাটে। গলিটা ছেড়ে ডানদিকের মূল রাস্তায় পা দিতেই একেবারে এক বৃদ্ধার মুখোমুখি। উলটোদিক থেকে আসছিলেন। ঠিক হেঁটে নয়, সামান্য কয়েকটা শাক-লতাপাতার ব্যাগ নিয়ে মনে হলো খোঁড়াচ্ছেন। ঝট করে মনে হলো মুখটা আগে দেখা। আমারও তাড়া নেই, মেজাজেও আজ বসন্ত এসে গেছে, বাতাস বইছে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। মহিলাও ব্যাগ নামিয়ে বড় শ্বাস নিয়ে তাকালেন আমার দিকে।
– আমি এ-এলাকায় নতুন এলাম। কিছু মনে করবেন না, আপনাকে পরিচিত মনে হলো।
– ও, কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না।
– জানি না বাবা, বাজার করা ছাড়া বিশেষ কোথাও বের হই না। হয়তো দেখেছেন আমার মতো আর কাউরে।
– এখানেই থাকেন?
– হুম, বলেই তিনি এবার আগের চেয়ে একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন।
ভদ্রমহিলার কথার ধরনে আরো পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু অমন সাত-তাড়াতাড়ি করে কেন সরে গেলেন বুঝলাম না। তবে কৌতূহল বাড়ছে আরেকটা কারণে। এ-এলাকায় মোটামুটি সচ্ছল ব্যক্তিরাই থাকে। সেদিন রাতে যে-লোকটা শোলা টোকাচ্ছিল, অতরাতে গলির মোড়ের সিকিউরিটি গেট দিয়ে তার প্রবেশের কথা নয় আবার এই পরিচিত মনে হওয়া মহিলাকে গৃহপরিচারিকা মনে হচ্ছে না; কিন্তু তিনিও থাকেন এই গলিতে। দুদিন বাদেই তিনতলার জানালায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম, ভদ্রমহিলা আমার বাসার সামনের রাস্তা দিয়েই সকাল সকাল ভ্যান থেকে টুকটাক বাজার করেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। মিনিট-কুড়ি বাদেই সেই কাঁধ বাঁকা করে টেনে টেনে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফেরেন এ-পথ দিয়ে। আমার বাড়ির পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে বেশ বাতাস পাওয়া যায় ঝিলের। ভদ্রমহিলাকে তৃতীয় দিন দেখে আমার মাতৃবিয়োগের কারণে হোক অথবা পরিচিত লাগছে ভেবেই হোক পথ আগলে ধরলাম।
– কিছু মনে করবেন না। আপনি সত্যি আমার পরিচিত। তিনি ভারী একটা সস্তা চশমার ভেতর দিয়ে তাকালেন। জানি না বাবা, কেমন কইরে পরিচিত?
– আপনারা সবসময় ঢাকাতেই ছিলেন? আমি তো বেশ কয়েকটা শহরে ঘুরে ঘুরে স্কুল-কলেজে পড়েছি। কোথাও দেখা হয়েছে আপনার সঙ্গে।
– আমাগের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। বড় ঘরবাড়ি আছে। আমার ছেলে চাকরি করে তাই ঢাকা থাকি। মুন্সিগঞ্জ বলতেই বুঝে গেলাম এই সেই কামিনী মাসি। ভুবনেশ্বরের মা।
– আপনি ভুবনের মা?
পরিচিত হওয়ার আনন্দের চেয়ে যেন কী এক শঙ্কা বেশি। আপনি ভুবনরে চেনেন? তিন-চারটে জেলা শহরে কয়েকশো সহপাঠীর ভেতর ভুবনের নাম আমার মনে থাকার বিশেষ কারণ ছিল না। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের হাইস্কুলে ক্লাস এইটে ভুবন ফার্স্টবয়। আমি বাবার জোরে ভর্তি হয়েছি সরকারি স্কুলে। ভুবন কথা বলত কম, একা বসে ছবি আঁকত সেইরকম। এই ভুবনের মা!
– ভুবন কোথায়? আপনি এখানে ওর সঙ্গে থাকেন? দিন, বাজার দিয়ে আসি।
– না বাবা, থাক। নিতি পারব। আপনি আইসেন একদিন। ওই কুনার বিয়াল্লিশ বাই এক নম্বর বাড়িডায় থাকি।
পরের সপ্তাহে সেই বাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করলাম, উঠোনভর্তি ছড়ানো শোলা, রঙিন কাগজ, মাটির ছোট গোল গোল পাত্রে সস্তা রং গোলানো। ভুবনের ছবি আঁকার সরঞ্জাম। সে তখন বাড়ি নেই। কামিনী মাসি বসতে দিয়ে ইতস্তত করছেন। কিছু খাব না জানিয়ে আশ্বস্ত করলাম। যদিও বুঝেছি, ছেলেবেলার আমাকে আসলে তাঁর বিশেষ মনে নেই। স্মৃতিতে সংরক্ষণ করার মতো এমন কিছু তখন ঘটেওনি ভুবনদের সঙ্গে। তবে কামিনী মাসিকে মনে রাখার কারণ আছে, দুবার দলবেঁধে ভুবনদের বাড়ি গিয়েছিলাম। একবার লক্ষ্মীপূজায় নাড়ু-খইয়ের সঙ্গে একটা বড় আগ্রহ ছিল ভুবনের প্রতিমা নিয়ে। কেমন করে যেন স্কুলের সবাই খবর পেয়েছিল, এবার ভুবনের হাতে বানানো লক্ষ্মীপ্রতিমা দিয়ে ওদের পাড়ায় পুজো হচ্ছে।
সেদিন ভদ্রমহিলার অবস্থা ছিল অনেকটা পথের পাঁচালীর অপুর মায়ের মতো। আরেকবার স্কুলে ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশনের সময়। ভুবন ভালো ছাত্র, সে সায়েন্স নিয়ে পড়বে এ-ই স্বাভাবিক; কিন্তু আমাদের হেডমাস্টার ভালো বুঝেই বললেন, তুমি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো প্রাইভেট পড়তে না পারলে রেজাল্ট খারাপ হবে ভুবন। বরং আর্টস পড়ো। সামান্য উপদেশেই ভুবন আর পড়বে না বলে বেঁকে বসল। ওকে বোঝাতে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষকরা। ভুবনকে আমরা কতটা বোঝাতে পেরেছিলাম জানি না, তবে অস্বস্তিতে ফেলে ওর মা সামনে বসেই সেদিন খুব কেঁদেছিলেন। এসব কারণে আমার মনে আছে মুন্সিগঞ্জের ছায়া-ছায়া বাড়িটার কথা। দল ধরে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে তিনি এবার বিশ্বাস করলেন, ভুবনের সহপাঠী ছিলাম।
এতে সামান্য একটু আলোও পেলেন মনে হলো। গত তিন বছর তারা এই বাড়িটায় উঠেছেন। মাসিমা সামনে বসে গল্প করছেন, ভুবন ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত কেমন করে পড়েছে। একটা স্কুলের বাচ্চাদের ছবি আঁকার কাজ পেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিলো। ভুবনের বাবার মুদিদোকান ছিল বাজারে। নির্বাচনের পর ওটাসহ বাজারের কয়েকটা দোকান আকস্মিক পুড়ে গেল এক সন্ধ্যায়। ভুবনের বাবা তখন ভেতরে বসে হিসাবের খাতা দেখছেন। মাত্র পঁচিশ শতাংশ পুড়েছিল, কিন্তু শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় তিনদিন কোনোমতে টিকে ছিলেন। মাসিমার চশমার ভেতর দিয়ে চোখ পড়া যায় না, তবে মুখের রেখা গোনা যায়। বহুবর্ষী গাছের গায়ে যেমন দাগ থাকে, সেরকম রেখা তাঁর কপালে। বাইরে তখন গনগনে রোদ। কয়েক হাত দূরেই নীলাঞ্জনা আবাসিক প্লটের তিনতলায় আমার ঘরে কাজের মেয়েটাও এখন এসি ছেড়ে বসে টেলিভিশন খুলেছে। বউ গিয়েছে অফিসে। একটু আগেও আমি ঘামছিলাম বসে। মাসিমা খুঁটে খুঁটে দানা তোলার মতো একটা একটা করে সে-সময়ের বাক্য বলছেন।
– ভুবন তখন ওদিকের একটা গ্রামে মাস্টারি করে। সেই সকালে বেরিয়ে ফেরে সন্ধ্যায়। বাড়ি ফিরে কাপড় বদলে বাবাকে দেখতে সদর হাসপাতালে যাবে, এমন সময় হারু ঠাকুর খবর নিয়ে এসেছে। ভুবন শুধু বলেছিল, আগুনে শুদ্ধি হয়েছে বাবা। এরপর থেকেই মাথাটা আরো খারাপ হয়ে গেল। আগে এমনিতেই কথা কইত না, এখন একেবারে চুপ। মাঝে মাঝে খাতা নিয়ে আঁকতে বসে। এ ছাড়া আর যেন কোনো দায় নেই। আমি কেমন করে বেঁচে আছি। একবেলা অন্তত চুলোয় হাঁড়ি বসাতে হয়। ভুবনের কোনো খেয়াল নেই।
– এরপর আপনারা ঢাকা এলেন কবে?
– এর মধ্যে আপনার মেসোর এক আত্মীয় গ্রামে গিয়েছিল। সে-ই ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি গিয়ে এই প্রস্তাব দিলো। আমিও ভাবলাম ওই ভিটের মায়া করে লাভ নেই। এবার দোকানে দিয়েছে, এরপর ঘরে দেবে। প্রাণটুকুও থাকবে না। তাছাড়া ভুবন ছাড়া আর তো আমার হারাবার কিছু রইল না। তাও যদি জায়গা বদলালে ভুবনের মনটা ফেরে। ঢাকায় শুনেছি মানুষ কতকিছু করে খাচ্ছে। আবার আশা করলাম সংসারের। ছেলেটা যদি কোনো কাজকর্মে ঢুকতে পারে, তারও সংসার করা উচিত। তাও তিন বছর হয়ে গেল এখানে আসছি। ভুবনের খেয়াল বাড়ছে বই কমছে না।
– ভুবন কোথায়?
– দেখেন গিয়ে সেই হয়তো মাঠের ভেতর বাচ্চাদের নিয়ে ছবি আঁকাতে বসিয়েছে।
– এই বাড়ির জন্য তো ভাড়া দিতে হয় না?
– তা হয় না। ওরা মাসে মাসে টাকা পাঠায়। ঠিক মাসেও নয়। একবারে দিয়ে রেখেছে মনে হয়। পাঁচ হাজার করে তুলতে পারি। ওই দিয়ে জল আর কারেন্টের লাইনের বিলটা দিয়ে যা থাকে তাই দিয়ে চলি।
– ওই দিয়ে চলে নাকি? ভুবন কাজের চেষ্টা করেনি?
– প্রথম প্রথম করেছে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা মানুষকে কে কাজ দেবে? যে কাজ দেবে তা আবার বাবুর সম্মানে লাগবে।
– আপনার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন। মন ভার করে উঠে চলে এলাম। মাসিমা আমার মায়ের চেয়ে দু-চার বছর বড় হয়তো হবেন। মা থাকলে তাঁর জীবনে এসব আমি কখনো ঘটতে দিতাম না। সারাদিন ভুবনের সেই ছোটবেলার মুখটা মাথার ভেতর ঘুরেছে। কিশোর ভুবন, কোঁকড়ানো চুল আর লিকলিকে গড়ন। সদ্য গোঁফ উঠছে আমাদের। আজ বিকেলে অফিসের একটা অনুষ্ঠান আছে। কাল বসের মেয়ের বিয়ে সেনাকুঞ্জে। দুটো প্রোগ্রামেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে যাওয়া চাই। সব মিলে আমি কখন যেন ভুলে গেলাম ভুবনদের কথা। প্রায় দুসপ্তাহ বাদে একদিন বাসায় ফিরে ওপরে উঠছি, রিসিপশন থেকে জানাল এক বৃদ্ধা খুঁজতে এসেছিল। চট করে মনে হলো নিশ্চয়ই মাসিমা। দুসপ্তাহ খবর নিইনি, ভদ্রমহিলাকে একটা কমদামি মোবাইল সেট কিনে দেবো কিনা ভাবছিলাম। অবশ্য তিনি ফোনই বা করবেন কাকে। গ্লানি নিয়ে পরদিনই সকাল সকাল গেলাম ভুবনদের বাড়ি। উঠোনের দড়িতে শার্ট-প্যান্ট ধুয়ে শুকোতে দেওয়া। আমাকে দেখেই কে যেন একজন বাইরের কল থেকে দৌড়ে ঘুরে ঢুকল। ভুবন হতে পারে। এত কাছ থেকে ওভাবে চলে যাওয়ায় আমারও অভিমান হলো। নিশ্চয়ই এ-কদিনে আমার খবর শুনছে, তবে মনে আছে কিনা তাই বা কে জানে। ভুলে যাওয়াও অত সহজ নয় মানুষ। আমি যে ওকে বোঝাতে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম তাও কি মনে নেই ভুবনের? নাম ধরে ডাকার ইচ্ছাটা অভিমানের নিচে পড়ে রইল। মাসিমা বেরিয়ে এলেন। মুখটা আরো ম্লান হয়ে গেছে এ-কদিনে।
– আপনি এসেছেন কষ্ট করে।
– আমাকে এখনো আপনি বলছেন?
– বাবা একটু বিপদে পড়েই গিয়েছিলাম। এ-মাসে টাকা তুলতে পারিনি।
– পাঁচশো টাকার চারটে নোট বের করে দিয়ে বললাম, আমি বাড়িতে সবসময় থাকি না। আমার স্ত্রী বিকেলের দিকে ফেরেন। আমি বলে রাখব। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে সাথিকে বলতে পারেন নিঃসংকোচে।
মনের ভেতর যদিও অস্বস্তি শুরু হয়েছে, সাথি খুব ভালো মেয়ে; কিন্তু ও নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। মাসিমা নিশ্চয়ই ঠেকে গিয়েই টাকাটা চেয়েছেন; কিন্তু দুসপ্তাহের মধ্যেই এই অর্থ প্রদান শুরু হওয়াটা ভালো লক্ষণ নয়। তবু আমি সাথিকে জানিয়েছি অতীতটা। কখনো এলে যা থাকে সাধ্যমতো তাই যেন খেতে দেয়, বলার সঙ্গে সঙ্গে সাথির চোখ ছলছল করে উঠেছে। এর পরের কয়েক মাসে বেশ কদিনই বাড়ি ফিরে শুনেছি, আজ মাসিমা এসেছিলেন সন্ধ্যায়। তাকে ফল খেতে দেওয়া হয়েছিল। তিনি কাটা আপেল নিতে পলিথিনের ব্যাগ চেয়েছেন। সাথিকে বলেছিলাম, ওই শরীরে বৃদ্ধার এমনিতেও বেশিদিন থাকার সম্ভাবনা কম। দুধ বা ডিমজাতীয় নিউট্রিশনটা খুব দরকার। কণ্ঠের হাড় তো গোনা যায়। দিও কখনো-সখনো।
আমার স্ত্রী আরেক কাঠি সরেস। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে সে মাঝে মাঝে আধা লিটার দুধের প্যাকেট, এক হালি ডিম পাঠায়। তবে ওসব সাথির বোঝাপড়ার ভেতর চলে যাওয়ায় আমি একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অফিসে সহকারীর পোস্ট খালি হলে একবার ভুবনের কথা ভেবেছিও মনে মনে। বললে এ-কাজটা ওর ঠিক হয়ে যেত; কিন্তু সেটা দুজনের জন্যই অস্বস্তির হবে, এগোইনি। একদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আকস্মিক চোখ পড়ল ঝিলের পাড়ে। একটা লোক কিছু একটা করছে সেখানে। দূর থেকে অত ভালো দেখা যায় না। চাটাই আর শোলা দিয়ে সে কিছুর আকৃতি দিতে চেষ্টা করছে। একটা বিড়াল ঘুরঘুর করছে লোকটার পাশে। ধক করে উঠল বুকের ভেতর। ভুবন নয় তো? সাথি দুমাস হলো রংপুর জয়েন করেছে। দুসপ্তাহ পরপর আসে। ঘর সামলাতেই ব্যস্ত থাকে। ছয় মাস না হলে ঢাকার অফিসে বদলির কথাও বলা যাচ্ছে না। ও নেই বলে মাসিমারও খবর জানি না অনেকদিন।
ঝিলের পাড়ের লোকটাকে দেখে তখুনি ছুটলাম ওই বাড়ি। সারসংক্ষেপে যা জানলাম, বাড়ির মালিকরা ফিরে আসবে এমন একটা খবর বলেছে এ-পাড়ার কেউ। এরপর থেকে ভুবনের মাথা পুরোই খারাপ হয়েছে। সে দিন-রাত ঝিলের পাশে মাঠে শোলা দিয়ে ঘর বানাতে চেষ্টা করছে। এই বাড়ি থেকে উঠিয়ে দিলে ওই ঘরে নাকি থাকবে। সারাদিন পথে পথে হাঁটে। কোথায় যায় কিছু বলে না। বিকেলে ফিরে সেই শোলার ঘর বানায়। অনেক রাতে ফেরে। ভুবনের মা তাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, কেন এত রাত করে ফিরিস? ভুবন জানিয়েছে, যদি কেউ দেখে ফ্যালে তাকে। যদি তার শোলার ঘরটা পুড়িয়ে দেয়। মা কোথায় যাব জিজ্ঞেস করে। এ-বয়সে বৃদ্ধা কোথায় ছেলের ওপর ভরসা করবেন, উলটো চোখে আঁচল চেপে কাঁদতে বসেন। তিনিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন জীবনের কাছে।
– গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়া যায় না।
– থাকলে তাও পতিত হতো। বেহাত হয়েছে কবে। মানুষের বাড়ি পাহাড়া দিতে এসে নিজের ঘর হারিয়েছি।
– তাহলে এখন উপায়?
– জানি না বাবা, তবে যারা বাড়িমালিকের ফিরে আসার কথা বলছে তারা আসলে সত্যি জানে না বলেনি মনে হয়। আমারই আগে জানার কথা। একটা চিঠি অন্তত দিত বা ডিসপেনসারির ওই অমলদার ফোনে ফোন করে জানাত। সেবার তো ওই ফোনেই খবর দিয়েছিল জলের কলটা সারিয়ে নেওয়ার জন্য। ওরা ভুবনকে পাগল কিছিমের মানুষ ভেবে পিছু লেগেছে।
– ভুবনের পিছু কেন নেবে?
– বস্তির বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায়। মাঠের ধারে বসে থাকে। স্নান করে না ঠিকমতো, আয় করে না। অফিস নেই। এমন মানুষ পাগল ছাড়া আর কী তবে!
বুকের ভেতরটা ব্যথায় চিনচিন করে উঠল। প্রায় সাত-আট মাস হলো মাসিমার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় ঘটেছে, এত কাছে থেকে একবারও ভুবনের সঙ্গে দেখা হলো না ইচ্ছের খামতিতে। ভুবনের জন্য এবার মোটামুটি মানসম্মান বজায় রাখা কোনো একটা কাজ খুঁজে বের করতেই হবে। আমি মাসিমাকে আস্বস্ত করে বেরিয়ে এলাম। সাথি রংপুর থেকে এসেছে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। যা হয় সংসারে, মাসিমার সঙ্গে দেখা হলো এর প্রায় এক মাস বাদে। তিনি আমার অফিস যাওয়ার সময় বুঝে নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভুবনকে তিনদিন হলো পাওয়া যাচ্ছে না।
– বলেন কী? থানায় ডায়েরি করেছেন?
– ওসব আমি কী জানি বাবা?
– কোথায় যেতে পারে? বাড়ি ফিরে যায়নি তো?
– না, সেদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে খুব কাঁদল ছেলেটা। চা-দোকানের ছেলেরা ওর পিছু লেগেছিল। জামা ধরে টেনেছে।
– কী আশ্চর্য, একটা নিরীহ মানুষের সঙ্গে কেন এমন করবে! ভুবন না হয় একটু খেয়ালি; কিন্তু ও তো কারো আগেপিছে নেই।
– মনুষ্য স্বভাবই এই। তোমার-আমার কিছু করার নাই বাবা। ছেলেরা খারাপ কথা বলেছে আমারে নিয়ে। ভয় দেখাইছে বাড়িওয়ালা আসতেছে, তুলে দিলে তুমার আর চিন্তা কী! ওই নীলাঞ্জনার ফ্ল্যাটে উঠবা মা আর তুমি? তোমরা তো বড়লোক হয়ে যাচ্ছ।
– আপনি কী বলেন এসব?
বৃদ্ধাকে দেখাচ্ছে ধ্বংসসত্মূপের মতো। কত হবে বয়স, বড়জোর পঁয়ষট্টি। দেখতে মনে হয় আশি ছুঁয়েছেন। মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া যে জীবনে কোনো প্রাপ্তি নেই, তেমন একটা জীবন কী কষ্টেই না বহন করছেন।
– আপনাকে নিয়ে কথা বলার মতো এতটা খারাপ রুচির মানুষ আছে পৃথিবীতে।
– বাবা, তুমি আর ওই বাড়ি যাইয়ো না। কইছে তুমার বউ থাকে না বাড়ি; কিন্তু ভুবন যে আর বাড়ি ফিরল না। পাগল হোক আমার তো ওই একটা জিনিসই আছে। তারে পাইতেছি না কোথাও।
ভুবনকে যেভাবে হোক খুঁজে বের করব আশ্বস্ত করে আমি রওনা হলাম। কিন্তু ভুবন নিখোঁজ, খবরটা গুরুত্ব হারাল আমাকে ইঙ্গিত করে মাসিমাকে নিয়ে কথা বলায়। সারাটা দিন মুখের ভেতর একটা বিবমিষা স্বাদ লেগে রইল। সারা শরীর রাগে কাঁপছে। পাড়ায় সদ্য একটা চায়ের দোকান হয়েছে দেখেছি। কিন্তু সেই দোকানে বসা ছেলেগুলোই কিনা তা জানি না, এমনকি আমাকে কেউ এ-এলাকায় সামনাসামনি ইঙ্গিত করার সাহস পাবে, আমি ভাবতেও পারি না। ভুবনদের দুর্বল পেয়েছে। তবু মনে হচ্ছে সমস্ত মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাথি শুনলে জীবনের এই নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ নিতে পারবে না সহজে। সারাটা দিন আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। মায়ের চেয়ে বেশি বয়সের এক নারীকে নিয়েও মানুষ ঠাট্টার ছলে এমন আঘাত অনায়াসে দিতে পারে? মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিছুতে মন বসছে না আমার। মা কোনোদিন আমার ঘর দেখেননি। কেমন করে ঘুমাই, কী দিয়ে ভাত খাই, গাড়ি করে অফিস যাই। মাঝে মাঝে খুব মনে হয়, যদি দেখতাম মাঝরাতে মা দরজা ধরে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। রাত জেগে পড়তাম বলে মা আমার সঙ্গে বসে থাকত আবার সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেখতাম আমার নাশতা বানিয়ে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই চলে গেছেন।
মাসিমার মধ্যে আমি মাকে পেয়েছিলাম কিনা জানি না, তবে তিনি যে সন্তানের মতো খানিকটা ভরসা করতে শুরু করেছিলেন ওতে আমারও প্রাপ্তি ছিল। কিছু না ভেবেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেললাম এক সপ্তাহের। বাড়ি যাব, মায়ের কবরটা পরিষ্কার করা হয়নি অনেকদিন। নিশ্চয়ই ওপারে বসে বসেও গাল দিচ্ছেন আমাকে। এ-শহরে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তবে মাসিমাকে কথা দিয়েছি, ভুবনকে খুঁজে বের করার। কিন্তু এই শহরে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হওয়া একটা মানুষকে আমি কীভাবে খুঁজি। বিকেলের ট্রেনে ওঠার আগে মনে হয়েছে অন্তত একটা ডায়েরি নিজেই থানায় করে দিয়ে যাই। বললে চার-পাঁচটা পত্রিকায় নিখোঁজের খবরটা ছাপিয়ে দেবে। সেজন্য ভুবনের একটা ছবিও দরকার। দারোয়ান পাঠানো ঠিক হবে না। দোটানা মন নিয়ে এসেছি নিকেতনের ৪২ বাই ১ নম্বর বাড়িতে। যাওয়ার আগে মাসিমার হাতে কিছু টাকাও দেওয়া প্রয়োজন। ভুবনের কোনো ছবি তোলা আছে কি-না তা-ই বা কে জানে। ছবি না থাকলে নিখোঁজ সংবাদের গুরুত্ব থাকে না। এ-বাড়িতে পা দিতে খুব আড়ষ্ট লাগছিল আজ। গেটের কাছে আসতেই দেখি সাত-আটজন লোক জটলা করে দাঁড়ানো। এ-বাড়ির সামনে কখনো কাউকে আগে আসতে দেখিনি।
কিছুক্ষণ আগে ভুবনের লাশ তোলা হয়েছে। শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। লেকের পানিতে আজ সকালে ভেসে উঠেছে। মাসিমা ঘরের ভেতর। তাকে ডাকতে সাহস হচ্ছে না। ভুবনের লাশটা রাখা হয়েছে উঠোনের একপাশে। দুর্গন্ধ আসছে। উৎসাহী কেউ কেউ মরদেহ দেখে ফিরে যেতে যেতে বর্ণনা দিচ্ছে। দেহ ফুইলা কেমন নীল হইয়া গেছে। নাড়া লাগলি নাড়িভুঁড়ি বাইরায় যাবে। হিন্দুগো পানিতে ডুবা লাশ কি পুড়ায় না মাটিচাপা দেয়রে? কেউ একজন বলছে, আহা রে মানুষটা একটু ক্ষ্যাপা ছিল; কিন্তু কোনোদিন রাগ দেখি নাই। পানিতে ডুবল কেমনে?
আমি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আগে খেয়াল করিনি একটা জবাফুলের গাছ আছে উঠোনে। তাতে লাল জবা ধরেছে। হিন্দুদের পুজোয় লাগে মনে হয়। মাসিমাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। ডাকলে তিনি আসবেন কিনা তাও জানি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। বাড়িওয়ালা পয়সাওয়ালা বলেই এমন জায়গায় উঠোন নিয়ে বাড়ি করে ফেলে রেখেছেন। একটা বিড়াল বসে আছে পেয়ারাগাছটার তলায়। এমন একটা বিড়াল কি দেখেছিলাম সেদিন? মাঠের ভেতর বসে যখন লোকটা কীসব বানাচ্ছিল। তার পাশেও একটা বিড়াল ছিল হয়তো। ঠিক মনে পড়ছে না। ভুবনকে বহু বছর কাছ থেকে দেখিনি। এই তো কয়েক হাত দূরেই ওর শরীরটা। কাছে গেলেই মুখটা দেখা যায়। বিড়ালটা তাকিয়ে আছে মরদেহ দেখতে আসা মানুষের দিকে। আমি ভাবছি, যাব কিনা পুরনো চাদর দিয়ে ঢাকা শরীরটার কাছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।