হুমায়ূন আহমেদ তখন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ভিনদেশে সে সময় ‘বাংলাদেশ নাইট’ আয়োজনের অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন হোটেলগ্রেভারইন বইয়ে। তাঁর সেই আবেগ, উচ্ছ্বাস নিশ্চয়ই এ সময়ের অনেক তরুণের সঙ্গেও মিলে যাবে। ১৯ জুলাই এই বরেণ্য লেখকের মৃত্যুদিবস। হুমায়ূন আহমেদের স্মরণে আজ পাঠকের জন্য তাঁর ছাত্রজীবনের গল্পটি তুলে ধরা হলো।
মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে অন্যান্য দেশের সঙ্গে উদ্যাপিত হবে বাংলাদেশ নাইট। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্র হচ্ছে মিজান, আর আমি আছি নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। মিজানের একমাত্র পরামর্শদাতা, আশপাশে সাত শ মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় বাঙালি নেই।
কফির পেয়ালা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিজানের টেলিফোন।
হ্যালো, হুমায়ূন ভাই?
হ্যাঁ।
প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে আপনার সঙ্গে আরেকবার বসা দরকার।
এখনো তো দেরি আছে।
দেরি আপনি কোথায় দেখলেন? এক সপ্তাহ মাত্র। শালাদের একটা ভেলকি দেখিয়ে দেব। বাংলাদেশ বললে চিনতে পারে না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছা করে চড় মেড়ে মুখ বন্ধ করে দিই। এইবার বুঝবে বাংলাদেশ কী জিনিস। ঠিক না, হুমায়ূন ভাই?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
শালাদের চোখ ট্যারা হয়ে যাবে দেখবেন। আমি আপনার এখানে চলে আসছি। মিজান টেলিফোন নামিয়ে রাখল। আমি আরেকটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। এই ছেলেটিকে আমি খুবই পছন্দ করি। তার সমস্যা একটাই, সারাক্ষণ মুখে—বাংলাদেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন একটা খোলার চেষ্টা করেছিল। একজন ছাত্র থাকলে অ্যাসোসিয়েশন হয় না বলে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। অন্য স্টেট থেকে বাংলাদেশি ছাত্র আনার চেষ্টাও করেছে, লাভ হয়নি। এই প্রচণ্ড শীতের দেশে কেউ আসতে চায় না। শীতের সময় এখানকার তাপমাত্রা শূন্যের ৩০ ডিগ্রি নিচে নেমে যায়, কে আসবে এ রকম ভয়াবহ ঠান্ডা একটা জায়গায়?
মিজান এ ব্যাপারে বেশ মনমরা হয়েছিল। বাংলাদেশ নাইটের ব্যাপারটা এসে পড়ায় সেই দুঃখ খানিকটা কমেছে। এই বাংলাদেশ নাইট নিয়েও বিরাট কাণ্ড। মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার মিজানকে বলল, তুমি এক কাজ করো, তুমি বাংলাদেশ নাইট পাকিস্তানিদের সঙ্গে করো।
মিজান হুংকার দিয়ে বলল, কেন?
এতে তোমার সুবিধা হবে। ডবল ডেকোরেশন হবে না। এক খরচায় হয়ে যাবে। তুমি একা মানুষ।
তোমার এত বড় সাহস, তুমি পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাকে বাংলাদেশ নাইট করতে বলছ? তুমি কি জানো, ওরা কী করেছে? তুমি কি জানো, ওরা আমাদের কতজনকে মেরেছে? তুমি কি জানো…?
কী মুশকিল, তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন?
তুমি আজেবাজে কথা বলবে, তুমি আমার দেশকে অপমান করবে, আর আমি তোমার সঙ্গে মিষ্টি কথা বলব?
মিজান ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারের সামনের টেবিলে প্রকাণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল। টেবিলে রাখা কফির পেয়ালা উল্টে পড়ল। লোকজন ছুটে এল। প্রচণ্ড হইচই।
এ রকম মাথা গরম একটা ছেলেকে সব সময় সামলে-সুমলে রাখা মুশকিল। তবে ভরসা একটাই—সে আমাকে প্রায় দেবতার পর্যায়ে ফেলে রেখেছে। তার ধারণা, আমার মতো জ্ঞানী-গুণী মানুষ শতাব্দীতে এক-আধটা জন্মায়। আমি যা বলি, শোনে।
মিজান তার ভাঙা মরিস মাইনর নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে এল। সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাপ নিয়ে এসেছে। সেই ম্যাপ দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। যে কটা রং পাওয়া গেছে সব কটাই সে লাগিয়েছে।
জিনিসটা দাঁড়িয়েছে কেমন বলুন তো?
রং একটু বেশি হয়ে গেল না?
ওরা রংচং একটু বেশি পছন্দ করে, হুমায়ূন ভাই।
তাহলে ঠিকই আছে।
এখন আসুন, প্রোগ্রামটা ঠিক করে ফেলা যাক। বাংলাদেশি খাবারের নমুনা হিসেবে খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। খিচুড়ির শেষে দেওয়া হবে পান-সুপারি।
পান-সুপারি পাবে কোথায়?
শিকাগো থেকে আসবে। ইন্ডিয়ান শপ আছে, ওরা পাঠাবে। ডলার পাঠিয়ে চিঠি দিয়ে দিয়েছি।
খুব ভালো।
দেশ সম্পর্কে একটা বক্তিতা দেওয়া হবে। বক্তার শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব। সবার শেষে জাতীয় সংগীত।
জাতীয় সংগীত গাইবে কে?
কেন, আমি আর আপনি।
তুমি পাগল হয়েছ? জীবনে আমি কোনো দিন গান গাইনি।
আর আমি বুঝি হেমন্ত? এই সব চলবে না, হুমায়ূন ভাই। আসুন, গানটা একবার প্র্যাকটিস করি।
মিজান, মরে গেলেও তুমি আমাকে দিয়ে গান গাওয়াতে পারবে না…
…উৎসবের দিন ভোরবেলায় আমরা প্রকাণ্ড সসপ্যানে খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম। চাল, ডাল, আনাজপাতি সেদ্ধ হচ্ছে। দুটো মুরগি কুচি কুচি করে ছেড়ে দেওয়া হলো। এক পাউন্ডের মতো কিমা ছিল, তাও ঢেলে দিলাম। যত ধরনের গরম মসলা ছিল সবই দিয়ে দিলাম। জ্বাল হতে থাকল।
মিজান বলল, খিচুড়ির আসল রহস্য হলো মিক্সিংয়ে। আপনি ভয় করবেন না। জিনিস ভালোই দাঁড়াবে।
সে একটা খুন্তি দিয়ে প্রবল বেগে নাড়তে শুরু করল। ঘণ্টা দুয়েক পর যা দাঁড়াল তা দেখে বুকে কাঁপন লাগে। ঘন সিরাপের মতো একটা তরল পদার্থ। ওপরে আবার দুধের সরের মতো পড়েছে। জিনিসটার রং দাঁড়িয়েছে ঘন কৃষ্ণ। মিজান শুকনো গলায় বলল, কালো হলো কেন বলুন তো, হুমায়ূন ভাই। কালো রঙের কিছুই তো দিইনি।
আমি সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। মিজান বলল, টমেটো পেস্ট দিয়ে দেব নাকি?
দাও।
টমেটো পেস্ট দেওয়ায় রং আরও কালচে মেরে গেল। মিজান বলল, লাল রঙের কিছু ফুড কালার কিনে এনে ছেড়ে দেব?
দাও।
তাও দেওয়া হলো। এতে কালো রঙের কোনো হেরফের হলো না। তবে মাঝে মাঝে লাল রং ঝিলিক দিতে লাগল। দুজনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। জাতীয় সংগীতেরও কোনো ব্যবস্থা হলো না। মিজানের গানের গলা আমার চেয়েও খারাপ। যখন গান ধরে মনে হয় গলায় সর্দি নিয়ে পাতিহাঁস ডাকছে। শিকাগো থেকে পানও এসে পৌঁছাল না।
অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। বিকেলে এক অদ্ভুত ব্যাপার হলো। অবাক হয়ে দেখি দূর দূর থেকে গাড়ি নিয়ে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। শুনলাম মিজান নাকি আশপাশের যত ইউনিভার্সিটি আছে সব ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ নাইটের খবর দিয়ে চিঠি দিয়েছিল। দেড় হাজার মাইল দূরে মন্টানো স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে একটি মেয়ে গ্রে হাউন্ড বাসে করে একা একা চলে এসেছে। মিনোসোটা থেকে এসেছে ১০ জনের একটা বিরাট দল। তারা সঙ্গে নানান রকম পিঠা নিয়ে এসেছে। গ্রান্ড ফোকস থেকে এসেছেন করিম সাহেব, তাঁর ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী। এই অসম্ভব কর্মঠ মহিলাটি এসেই আমাদের খিচুড়ি ফেলে দিয়ে নতুন খিচুড়ি বসালেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সাউথ ডাকোটার ফলস স্প্রিং থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে উপস্থিত হলো।
মিজান আনন্দে লাফাবে না চেঁচাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। চুপচাপ বসে আছে, মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় বলছে, দেখ শালা বাংলাদেশ কী জিনিস। দেখে যা।
অনুষ্ঠান শুরু হলো দেশাত্মবোধক গান দিয়ে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…।
অন্যান্য স্টেট থেকে মেয়েরা যারা এসেছে, তারাই শুধু গাইছে। এত সুন্দর গাইছে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে গান শুনে দেশের জন্যে আমার বুক হু হু করতে লাগল। চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্য মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
পরদিন ফার্গোফোরম পত্রিকায় বাংলাদেশ নাইট সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হলো। খবরের অংশবিশেষ এ রকম—
একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা সব কাঁদতে শুরু করল। আমি আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা জীবনে এমন মধুর দৃশ্য দেখিনি…। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: হোটেল গ্রেভারইন, কাকলী প্রকাশনী