সেদিন ভোরে, ঢাকা মেইল ট্রেনটি তার নির্ধারিত স্টপেজ ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশনে থামল না। সে এক দেখার মতো দৃশ্য, বিশেষত যারা স্টেশন ঘনিয়ে আসছে জন্য মালপত্র নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারা প্রত্যেকেই লক্ষ করল, স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদেরও হতভম্ব করে দিয়ে, বিরতিহীনভাবে তীব্র গতিতে ঢাকা মেইল ট্রেনটি ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশন অতিক্রম করে যাচ্ছে।
এমন দৃশ্যে প্রথমত, আমাদের যাদের ঘোড়াশালে নামার কথা নয়, হাসি পায়। আমরা প্রায় চোখ টিপে, নামতে না-পারা যাত্রীদের আবার সিটে ফিরে আসতে আমন্ত্রণ জানাই। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই প্রকৃত সত্য বুঝতে পারার ভাবগাম্ভীর্যে আমরা ফ্যাকাশে হয়ে যাই। ‘ট্রেনটি থামল না কেন?’
অজানা আতঙ্কে আমাদের প্রত্যেকের মুখেই কালো ছায়া পড়ে। স্টেশন ছাড়িয়ে, স্টেশনসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা ব্রিজে উঠে পড়ে ট্রেন। নিশ্চিত হয়ে পড়ি, অস্বাভাবিক এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেছি আমরা। একে-অপরকে জিজ্ঞেস করি, ‘ঘোড়াশালে এই ট্রেনের স্টপেজ আছে?’ বেশির ভাগই মনে করে, আছে। কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন দল এই বলে সারা বগিতে আশার সঞ্চার করে যে সম্প্রতি নাকি এই স্টপেজ তুলে নেওয়া হয়েছে। যারা খবরটা এখনো জানে না, দলটির মতে, তারাই এখন ট্রেনের মধ্যে অহেতুক এই আতঙ্ক তৈরি করছে।
শিগগিরই আশার আলো দেখে আমাদের যাদের ঘোড়াশালে নামার কথা নয়, তা সত্ত্বেও উদ্ভূত এই পরিস্থিতির শিকার, ক্ষমাশীল কণ্ঠে বলে উঠি, ‘আহা, তারা নিশ্চয়ই জানে না, এটা তাদের দোষ নয়।’ কিন্তু নিয়মিত যাত্রীদের কেউ কেউ, যারা এই গতকালও ভৈরব থেকে মাছ এনে ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশনে নামিয়েছে, তারা এই বলে সতর্ক করে যে চিল্লাহল্লা না করে আমরা সবাই যেন আল্লাহ-খোদার নাম নিই। কেননা, ঘটনা বিশেষ সুবিধার না।
স্টপেজ যদি তুলেও নেয়, অভ্যস্ত যাত্রীদের মতে, যেহেতু ব্রিজের একটি পিলারের সংস্কারকাজ চলছে, ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেনটির ধীরগতিতে যাওয়ার কথা ছিল। তা যেহেতু হয়নি, সোজা বাংলায় বলে দেওয়া যায়, লোকো মাস্টারদ্বয় (ট্রেনচালক) হয় বেঁচে নেই, নতুবা তাদের অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছে।
এই ঘোষণায় নারী-পুরুষ-শিশু-প্রত্যেকেরই অসংলগ্ন ও একটু পরেই ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াজনিত আর্তনাদে পুরো বগি ভারী হয়ে ওঠে। অতর্কিতে সম্ভ্রান্ত এক মুরব্বি দরাজ কণ্ঠে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন অংশ থেকে পাঠ শুরু করলে নিতান্তই পরকালের দিকে যাত্রা করা ছাড়া চালকহীন ট্রেনটির আর কোনো গন্তব্য থাকে না।
মনে হয় যেন আগরবাতির বনে-তা-ও কিনা আগুন লাগা আগরবাতির-বনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলছে এই ট্রেন। ক্রমধাবমান আগুনের তাড়া খেয়ে কোথায় যাচ্ছে এই ট্রেন?
উত্তরে কারও কারও মনে হয়, হয়তোবা পুলসিরাতের দিকে! যাত্রীরা জানালা ও দরজার কাছে গিয়ে জনপদের মানুষদের কাছে জীবনের আকুতি জানাল। কিন্তু ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার স্পিডে ছুটে চলা ট্রেনটির ভেতরে যাত্রীদের ত্রস্ত ছোটাছুটি ও মরণ-বিলাপ বাইরে থেকে কেউ কেউ টের পেলেও বেশির ভাগই কিছুই বুঝতে পারল না।
যাত্রীদের কেউই সঠিক জানে না দুর্ঘটনা কখন ঘটবে। এক মা তার কোলের শিশুটিকেসহ দরজার কাছাকাছি চলে যায় চলতি ট্রেন থেকেই লাফ দিয়ে নেমে পড়বে-এই আশায়। কিন্তু এ ধরনের সাহস সঞ্চয় করতে না-পারা অন্য যাত্রীরা তাকে কাজটি করতে দেয় না। ‘পাগল হলেন নাকি? এই গতিতে ট্রেন থেকে পড়লে বাঁচার চান্স জিরো পার্সেন্ট।’ কেউ একজন মহিলাকে সাবধান করে।
তারস্বরে কেঁদে চলা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে প্রথমবারের মতো মনে হয়, আমার কিছু করা উচিত। উঠে দরজার দিকে এগোই। ভিড় করে থাকা যাত্রীদের ঠেলে ঠেলে ওই পর্যন্ত যাওয়াটা সহজ কাজ ছিল না। তার ওপর যখন-তখন বাচ্চাসহ লাফ দিতে চাওয়া অর্ধ উন্মাদ মাকে নিয়ে নাটকটিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে দরজার কাছাকাছি এলাকায়।
‘আপনারা একটু সরুন, আমি দেখি,’ আমার এমন আবদারে মৃত্যুর মুখে থেকেও কেউ কেউ দরজা ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। ‘আপনি কোন বাল?’ একজন তো সরাসরি প্রশ্নই করে বসে। আরেকজন তাতে যোগ করে, ‘আপনাকে দেখতে হবে কেন?’ বানিয়ে মিথ্যা বলি যে, ‘আমি একজন ট্রেন বিশেষজ্ঞ, দেখলে হয়তো পরিস্থিতি বুঝতে পারব।’ এটুকু মিথ্যাতেই কাজ হয়ে যায়, সবাই সরে গিয়ে দরজা পর্যন্ত যাওয়ার জায়গা করে দেয় আমাকে।
দুই মাস আগে শীত শেষ হয়ে গেছে যদিও, ভোরে এসব এলাকায় এখনো কুয়াশা পড়ে। মাথা বের করে দেখি পাশের বগির দরজায় দাঁড়িয়ে একজন রেলওয়ে পুলিশ সম্ভাব্য ছাদে ঘুমন্ত কয়েকজন যাত্রীকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। ‘কী লাভ? (ওদের জাগিয়ে তুলে)’ আমি জিজ্ঞেস করি। রেলওয়ে পুলিশটি বিরক্ত চোখে তাকায় আমার দিকে। এবং প্রশ্ন করে, ‘ছাদে উঠতে পারবেন?’ আমি বলি, ‘পাগল নাকি! ছাদে উঠতে পারব কেন?’
সে ক্ষেত্রে আমার বগিতে চলতি ট্রেনের ছাদে উঠতে পারে-এমন কেউ আছে কি না, সেই খোঁজ নিতে বলে, নিজেও সে তার বগির ভেতরে সম্ভবত তেমন কাউকেই খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়ে।
আমি বগির ভেতরে আল্লাহ-খোদার নাম নিতে থাকা, মোবাইলে আপনজনদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিতে থাকা বিপন্ন সব যাত্রীর উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললাম, ‘আপনারা কেউ চলন্ত অবস্থায় ট্রেনের ছাদে উঠতে পারেন?’ কিন্তু কারও কোনো সাড়া না পেয়ে ব্যাপারটাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য নিশ্চিত না হয়েই যোগ করলাম, ‘কেউ ছাদে উঠতে পারলে ট্রেনটা থামানো যাবে।’ তবে দুর্ভাগ্যবশত চলতি ট্রেনের ছাদে উঠতে পারে এমন কেউই বগিতে ছিল না।
আবারও মাথা বের করে পাশের বগির দরজায় দাঁড়ানো রেলওয়ে পুলিশকে দেখে বললাম, ‘তেমন কাউকে পাওয়া গেল না।’ জানতে চাইলাম, কেউ ছাদে উঠলে ট্রেন থামবে কি না। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে তিনি বললেন, ‘চান্স আছে।’ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইলাম এই বলে যে, ‘আপনিই উঠে পড়ুন না, আপনাদের তো ট্রেনিং নেওয়া আছে।’ শুনে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, আমি নিশ্চিত, আন্তনগর ট্রেনের মতো এক বগি থেকে আরেক বগিতে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে দৌড়ে এসে আমাকে তিনি দুর্ঘটনার আগেই ট্রেন থেকে ফেলে দিতেন।
একটা লেখার অযোগ্য গালি দিয়ে রেলওয়ে পুলিশ আমাকে জানালেন, কোনো প্রতিষ্ঠানই নাকি খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা চলতি ট্রেনের ছাদে ওঠার ট্রেনিং দেয়। ঠিক এমন সময় ট্রেনের ভেতর থেকে এক যুবক এসে আমার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আপনি তো ট্রেন বিশেষজ্ঞ, চালক ঘুমিয়ে পড়লে ট্রেনের কি নিজে থেকেই থেমে যাওয়ার কথা না?’
যেহেতু প্রকৃতপক্ষে আমি একজন ট্রেন বিশেষজ্ঞ ছিলাম না, ফলে এমন প্রশ্নে গভীর সমুদ্রে পড়ি। তবুও বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলি, ‘হ্যাঁ, তাই তো! থামল না কেন বলুন তো?’ বুদ্ধি খাটিয়ে পুরো ব্যাপারটাই তার কাছ থেকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি। যুবকটি বলল, ‘লোকো মাস্টাররা অনেক সময় পায়ে না চেপে ডেড মান্স পেদালে ভারী কোনো বস্তু ফেলে রাখে।’
বিস্মিত হওয়ার ভান করি, ‘বলেন কী!’ যুবকটি বলে যায়, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি নিজে দেখেছি, অনেকেই ডেড মান্স পেদালে ইট বা পাথর-জাতীয় কিছু একটা দিয়ে রাখে। ফলে, ড্রাইভাররা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু এতে তাদের পা শিথিল হয়ে, প্রেশারের অভাবে ডেড মান্স পেদাল যে ধীরে ধীরে ট্রেনটাকে থামিয়ে দেবে, সেটা আর হয় না।’
প্রসঙ্গ বদলে তাকেও আমন্ত্রণ জানাই, ‘তো ভাই, আপনি চলতি ট্রেনের ছাদে উঠতে পারবেন?’ নিজের ওপর হতাশ হয়ে সে জানায়, ‘না, আপনার ঘোষণা শুনেছি। ছাদে উঠে চাবি ঘুরিয়ে ভ্যাকুয়াম রিলিজ করে দিলে ট্রেন থামবে সেটা আমিও জানি।’ সে বলে যায়, ‘মরতে কার ভালো লাগে, নতুন বউকে নিয়ে এই প্রথম ট্রেনে উঠলাম, প্রথম দিনই মৃত্যু।’
মৃত্যু বিষয়ে তার এমন সরল ভঙ্গির কথাবার্তা শুনে আমি হেসে ফেলি, উদ্বুদ্ধ করি, ‘নতুন বউয়ের জন্যও কি ছাদে ওঠার ট্রাই করা যায় না?’
ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে ট্রেনটি একদিকে প্রায় হেলে পড়তে নিলে, বহুদিন থেকেই ট্রেন দুর্ঘটনার দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে বড় হওয়া আমরা, অবশেষে সেই দৃশ্যের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই নিজেদের আবিষ্কার করি। ছিটকে গিয়ে বাইরে পড়তে নিই আমি, ট্রেন বিশেষজ্ঞ যুবকটি আমাকে ধরে ফেলে। আর মূর্তিমান এই ঝাঁকুনি শেষে সে চলে যায় তার সিটে, নতুন বউয়ের কাছে। বগির ভেতরে একটা বিশৃঙ্খল দশা।
মাত্রই আঘাত হানা তীব্র ঝাঁকুনির কারণ ঢাকা মেইল ট্রেনটি আরও একটি স্টপেজ থাকা স্টেশন-আড়িখোলা-ও-না থেমেই পার হচ্ছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি ট্রেনের স্টপেজ থাকা স্টেশন ও স্টপেজ না-থাকা স্টেশন পার হওয়ার পদ্ধতিগত পার্থক্য। যাত্রী ওঠা-নামার সুবিধার্থে, স্টপেজ থাকা একটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-সংলগ্ন লুপ লাইনে ট্রেন দাঁড়ায়। অন্যদিকে, একটি না-থামা ট্রেন সব সময় প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরের মেইন লাইন দিয়ে ছুটে যায়। আড়িখোলার এই দ্বিতীয় ব্যতিক্রম ঘোড়াশালে ট্রেনটির স্টপেজ থাকা না-থাকার বিতর্ককে বাতিল করে দেয়। সারা ট্রেনের বিভিন্ন বগি থেকে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের আহাজারি এখন আরও স্পষ্ট।
প্ল্যাটফর্মঘেঁষা লুপ লাইন ধরে পূর্ণ গতিতে ট্রেনটির ছুটে যাওয়া স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীসাধারণের মধ্যেও আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়। মেইন লাইনের তুলনায় অনেক কম গতিতে অভ্যস্ত কাঠের স্লিপারের লুপ লাইন দিয়ে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেনটির ছুটে যাওয়াই হতে পারত একটি দুর্ঘটনার যথার্থ উপলক্ষ। তা না হয়ে সহি-সালামতে স্টেশন পার হয়ে ট্রেনটি আবার মেইন লাইনে উঠে পড়লে, দ্বিতীয় ঝাঁকুনি সত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে এ যাত্রা বেঁচে যাওয়ার ঘটনাই আতঙ্কিত যাত্রীদের কিছুটা চাঙা করে তুলল।
ভেতরে গিয়ে ট্রেন বিশেষজ্ঞ যুবকটিকে আরও সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললাম, ‘চলুন, কিছু করি। নইলে বিশ্রীভাবে মরতে হবে।’ কিন্তু তার নতুন বউ তাকে প্রায় খামচে ধরে রেখে ননস্টপ ফোঁপাতে থাকে। কিছুতেই তাকে একটুও ছাড়ে না। তবু কিছুক্ষণ টানাটানি করে, ব্যর্থ হয়ে অবশেষে দরজায় ফেরত আসি। পাশের বগির দরজায় রেলওয়ে পুলিশটিকে আরও বেশি সক্রিয় দেখায়।
হাতল থেকে ছাদের কয়েক রকম মাপজোখ নেওয়াসহ পার্শ্ববর্তী একটি জানালা থেকে ছাদে ওঠার ক্ষেত্রে সাপোর্ট পাওয়া যাবে কি না, খুঁটিনাটি এসব পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন তিনি। ‘অবশেষে ছাদে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলেন?’ জিজ্ঞেস করি আমি। ‘হ্যাঁ, দেখি একটা চেষ্টা করে।’ চেঁচিয়ে উৎসাহ দিই, ‘আপনি বীর, আপনিই পারেন আমাদের বাঁচাতে।’ দয়া করে তাঁকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে নিজের কাজ চালিয়ে যান তিনি।
বাঁ হাতে ডান হাতল ধরে নিকটবর্তী জানালার ফ্রেমটা তিনি ডান হাতের সঙ্গে বাঁধান। তারপর একটু ওপরের দিকে ঠেলে দেন নিজেকে, কিন্তু কুয়াশায় ভেজা হাতল ফসকে আবারও নেমে আসে আগের জায়গায়। ‘আবার চেষ্টা করুন, প্লিজ।’ চেঁচাতে থাকি। আমার দেখাদেখি আরও অনেকে এসে জড়ো হয়ে দরজা ও জানালা দিয়ে রেলওয়ে পুলিশটির কাছে নিজেদের প্রাণভিক্ষা চায়।
এর মধ্যে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘ট্রেন থামা মাত্রই আমরা সবাই চালককে মারতে যাব।’ কেউ কেউ এমন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলে, ‘এমন কথা শুনলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবে। তারা নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃতভাবে সবাইকে বিপদে ফেলে নাই।’ সোচ্চার হয় ট্রেন বিশেষজ্ঞ যুবকটিও। তার বক্তব্য, ‘অবশ্যই চালকদেরই দোষ এটা, তারা পা ব্যবহার না করে ডেড মান্স পেদালে ইট ফেলে রেখেছে।’
সে বলে যায়, ‘সিস্টেম খুবই নিখুঁত, তারা জানত ড্রাইভার বা চালক ঘুমিয়ে পড়তে পারে। সে জন্যই ডেড মান্স পেদালের ব্যবস্থা, চালক ঘুমিয়ে পড়লে যেন আপনাআপনি ট্রেন থেমে যায়…’ অভ্যন্তরীণ চিল্লাহল্লায় জড়িয়ে পড়ে বাইরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। বাকিদের হর্ষধ্বনি শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখি পুলিশ সদস্য প্রায় উঠেই পড়েছেন।
উঠে ভ্যাকুয়াম রিলিজ করার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর বাকি কাজটুকুও সম্পন্ন করলে, আড়িখোলা-পূবাইলের মাঝামাঝি এলাকায়, দুপাশের বিস্তীর্ণ ধানখেতের মাঝখানে, অবশেষে ঢাকা মেইল ট্রেনটি পুরোপুরি থেমে গেল। মুহূর্তেই নতুন জীবন পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা এক ট্রেন মানুষ বেরিয়ে এসে চেনা-অচেনা প্রত্যেকের সঙ্গেই গলা মিলিয়ে কোলাকুলি করতে থাকল।
এক দল, ঘটনার নায়ক রেলওয়ে পুলিশকে কাঁধে নিয়ে আনন্দ মিছিল করতে করতে চরাচরে ঘুরপাক খেল। আরেক দল, ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে গেল ট্রেনটির ইঞ্জিন অভিমুখে।
গিয়ে দেখা গেল লোকো মাস্টারদ্বয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমাস্টার সিটে বসা, পেছন দিকে হাত দুটি ঝুলিয়ে দিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছেন, অন্য জন, প্রধান লোকোমাস্টার ঘুমের চোটে নিচেই পড়ে গেছেন। দুয়েকজন গিয়ে ঠেলে-ধাক্কা দিয়েও তাঁদের জাগাতে পারে না। ইঞ্জিনের অন্য পাশ থেকে ট্রেন বিশেষজ্ঞ যুবককে ইঞ্জিনের অভ্যন্তরে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখি। আমাকে দেখে সে হাত তুলে ইশারা দেয়।
‘কী হয়েছে বুঝলেন?’ বউসহ এপাশে চলে এসে সে জিজ্ঞেস করে। ‘কী আর হবে, নাশকতার চেষ্টা, ড্রাইভারদের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।’ বিশেষজ্ঞের মতো বলার চেষ্টা করি, ‘সম্ভবত চায়ের সাথে মিশিয়ে, জানেনই তো ট্রেন ড্রাইভারদের প্রচুর চা খেতে হয়।’ কিন্তু যুবকটি বলে, ‘সেটা না, ট্রেন কেন থামল না বুঝলেন?’ চুপ করে থাকি।
সে বলে, ‘লোকোমাস্টারকে দেখেন, নিচে পড়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনভাবে সে ডেড মান্স পেদালের ওপরে গিয়ে পড়েছে।’ উল্লসিত হয়ে আমি বললাম, ‘তার মানে ড্রাইভারদের দোষ নেই, মানে আপনি যেমনটা বলছিলেন, ভারী বস্তু ফেলে রাখা…’ শেষ করার আগেই, ‘না নেই, তারা নির্দোষ’ বলে সে তার নতুন বউসহ ট্রেনের মাঝামাঝি এলাকায় তৈরি হওয়া আরেকটি জটলার দিকে এগোতে থাকে।
সেখানে ট্রেনযাত্রীদের মধ্য থেকে হঠাৎই নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত লোকোমাস্টার দাবি করা এক বৃদ্ধকে কেন্দ্র করে অন্য একটি ঘটনার সূত্রপাত। উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে তিনি এখন ঢাকা পর্যন্ত ট্রেনটি চালিয়ে নিতে চাচ্ছেন। দায়িত্বরত গার্ড কিছুতেই এমন প্রস্তাবে রাজি হচ্ছেন না। তিনি বলে যাচ্ছেন, ‘আমরা তাদের সুস্থ করে তুলব। তারাই এ ট্রেন চালিয়ে নেবে।’
তখন অবসরপ্রাপ্ত লোকোমাস্টার অন্তত পরবর্তী স্টেশন পূবাইল পর্যন্ত ট্রেনটি চালিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানালে এবং ভিড় করা যাত্রীদের সমর্থনের চাপে একপর্যায়ে সম্মত হয়ে বাঁশি বাজাতে বাধ্য হন গার্ড। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যাত্রীদের ট্রেনে ওঠার নির্দেশ দিতে দিতে অবসরপ্রাপ্ত লোকোমাস্টারকে নিয়ে ইঞ্জিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর একাধিক গর্বিত হুইসেলসহ ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করলে, ‘বৃদ্ধ এই বয়সেও ভালোই চালাচ্ছে’ বলে কেউ কেউ ব্যাপারটিকে আদিরসাত্মক ইঙ্গিতের দিকে নিয়ে যায়।